Bahumatrik | বহুমাত্রিক

সরকার নিবন্ধিত বিশেষায়িত অনলাইন গণমাধ্যম

চৈত্র ১৪ ১৪৩০, শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪

শীতে অতিথি পাখিদের মেলা ও আমাদের পরিবেশ

ড. মো. হুমায়ুন কবীর

প্রকাশিত: ২১:১২, ১৯ জানুয়ারি ২০১৯

আপডেট: ০০:০০, ৩১ ডিসেম্বর ১৯৯৯

প্রিন্ট:

শীতে অতিথি পাখিদের মেলা ও আমাদের পরিবেশ

ছবি- সংগৃহীত

বাংলাদেশে সারাবছরই কোন কোন মেলার আয়োজন করা হয়ে থাকে। কৃষিমেলা, সবজিমেলা, ফলমেলা, মাছমেলা, গাছমেলা, বাণিজ্যমেলা, পিঠামেলা, বৈশাখীমেলা, এমনকি পর্যটনমেলা- আরো কত কি মেলা তা বলে শেষ করা যাবে না। এক কথায় বলতে গেলে মেলা বাঙালি কালচারের সাথে মিশে গিয়ে এমন একটি কালচারে পরিণত হয়েছে যা খুবই গুরুত্ব বহন করে। আর একথা ঠিক যেভাবেই এসব মেলা শুরু হয়ে থাকুক না কেন প্রত্যেকটি মেলার রয়েছে আলাদা গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা। এমনি একটি মেলা হলো পাখি মেলা। সময়ের ব্যবধানে এটি অন্যতম প্রাকৃতিক পরিবেশ সংরক্ষণে পরিবেশবাদী একটি মেলায় পরিণত হয়েছে।

বলছিলাম জাহাঙ্গীরনগর বিশ^বিদ্যালয়ে বিগত ১১ জানুয়ারি ২০১৯ তারিখে অনুষ্ঠিত হয়ে যাওয়া পাখি মেলার কথা। পত্রিকান্তরে এবং ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ার মাধ্যমে জানতে পারি সেখানে ঐদিন অনুষ্ঠিত হয়ে গেল ১৮তম পাখি মেলা। অর্থাৎ যদি প্রতিবছরে তা একবার অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে তাহলে ১৭ বছর আগে থেকে তা শুরু হয়েছে যা মোটেও কম সময় নয়। আর যাঁদের উদ্যোগে এ মহৎ কার্যটি সম্পন্ন হয়ে থাকে তাঁদেরকে আন্তরিক অভিনন্দন। জানা গেছে এবারের (২০১৯) ১৮তম পাখি মেলাটি জাহাঙ্গীরনগর বিশ^বিদ্যালয়ের উপাচার্য প্রফেসর ড. ফারজানা ইসলাম উদ্বোধন করেছেন। অনুষ্ঠানটি প্রতিবছর আয়োজন করে গৌরবের ভূমিকায় থাকে উক্ত বিশ^বিদ্যালয়ের প্রাণিবিজ্ঞান বিভাগ। সাথে আরো ছিলেন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন পাখি বিশারদ ড. ইনাম আল হক, বিশিষ্ট প্রকৃতি প্রেমি ও মিডিয়া ব্যক্তিত্ব মুকিত মজুমদার বাবু।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ^বিদ্যালয়ে প্রতিবছর শীতকালে যে অতিথি পাখিকুলের আগমন ঘটে তা দেশবাসী সকলেই কমবেশি অবগত। বিশ^বিদ্যালয় ক্যাম্পাসের যারা আছেন তারা তো এ অতিথি পাখি গমণাগমণের বিষয়টি উপভোগ করেনই,। সেইসাথে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে এমনকি বিদেশের অনেক জায়গা থেকেও ছুটে আসেন মানুষ সেখানকার জাঁকে জাঁকে পাখি উঠা-নামার নয়নাভিরাম দৃশ্য উপভোগ করার জন্য। অথচ সেখানে মাত্র কযেকটি বদ্ধ জলাশয়ে এ পাখিগুলো সুদূর ইউরোপ, আফ্রিকা থেকে হাজার হাজার মাইল অর্থাৎ সাত সাগর তের নদী পাড়ি দিয়ে চলে আসে। শীত চলে গেলে আবার তারা ফিরে যায়। কী মধুর প্রাকৃতিক যোগসূত্র!

বিশে^ প্রায় দশ হাজার প্রজাতির পাখি বিদ্যমান। তারমধ্যে প্রায় দুই হাজারেরও মতো পাখি অতিথি বা পরিযায়ী ধরনের। আর যেসব পাখি শীতে আমাদের দেশে আসে তাদের মধ্যে রয়েছে- লালবোবা, বক, পানকৌড়ি, শামুককনা, গাঙ, কবুতর, থাম, পাইজ, জলপিপি, পেরিহাঁস, পাতিবাটান, পাতিকুট, গিরিয়া, পাতারি ইত্যাদি। যেসব জাযগায় আসে সেগুলো হলো- জাহাঙ্গীরনগর বিশ^বিদ্যালয়, সোনাদিয়া ও মহেশখালী দ্বীপ, টাঙ্গুয়ার হাওর, বাইক্কার বিল, হাকালুক হাওর, হাইল হাওর, নিঝুম দ্বীপ, ঢাকার আশে-পাশের বিভিন্ন জলাশয়, বিভিন্ন চর-দ্বীপ ইত্যাদি স্থান উল্লেখযোগ্য।

দেশে এমন আরো অনেক জায়গা রয়েছে যেখানে এভাবে ভিনদেশি পাখিগুলো উড়ে আসে। এটি একটি প্রাকৃতিক সমন্বয়। মানুষ যেমন কর্মের খাতিরে এক দেশ থেকে অন্য দেশে চড়ে বেড়ায়, ঘুরে বেড়ায়, ঠিক তেমনি এ অতিথি পাখিগুলো দেশ হতে দেশ দেশান্তরে ছুটে বেড়ায়। যেসব দেশে অধিক শীত থাকে কাজেই সেই শীত থেকে বাঁচার জন্য সেসব দেশের পাখিগুলো অন্যত্র চলে আসে। এদেরকে অতিথি পাখি বা মাইগ্রেটরি বার্ডস কিংবা পরিযায়ী পাখি বলে চিহ্নিত করা হয়ে থাকে। এসব পাখি নিয়ে এখন অনেক গবেষণা চলছে। প্রাণিরা প্রভুভক্ত হয়ে থাকে। অপরদিকে বলা যায় যেখানে মনে করবে তাদের বসবাসের জন্য উপযুক্ত জায়গা রয়েছে সেখানেই তারা এসে আশ্রয় নেবে সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু এখন আর সেদিন নেই। যেখানেই এসব অতিথি পাখি এসে নিরাপদ আশ্রয়স্থল খুঁজছেন সেখানেই একদল নির্মম শিকারীর কবলে পড়ছে তারা।

সমতলভাগে বলতে গেলে ঢাকার অতি সন্নিকটে সাভারের জাহাঙ্গীরনগর বিশ^বিদ্যালয় ক্যাম্পাসে যে অতিথি পাখির আগমণ ঘটে, এটি সারাদেশের একটি জায়গা মাত্র। তার পাশাপাশি বৃহত্তর সিলেটের হাওরাঞ্চলে এর আধিক্য সবচেয়ে বেশি। কারণ সেখানে হাকালুকি হাওর, টাঙ্গুয়ার হাওর, বাইক্কার বিল ইত্যাদি এলাকায় এসব শীতের পাখির বিচরণক্ষেত্র। তবে আগেই বলেছি এসব স্থানে আর পাখিকুল নিরাপদে বসবাস করতে পারে না। সরকার থেকে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক মন্ত্রণালয় কর্তৃক এসব এলাকা পাখ-পাখালি বসবাসের জন্য অভয়ারণ্য ঘোষণা করলেও তা মানছে না কেই। কারণ সেখানে দেদার অতিথি পাখি শিকার করছে একদল মুনাফাখোর অবিবেচক শিকারীর দল।

শুধু তাই নয়, পাখি বিশ্রাম নেয় গাছ-গাছালির ডালে বসে। তাছাড়া অনেক পাখি আছে যারা ডিম পাড়ে গাছের গোহায়, নিরাপদ বাসা তৈরী করে গাছের ডালে, গাছের পাতা কিংবা খরকুটো দিয়ে। কিন্তু এখন বনজঙ্গল উজার হয়ে যাচ্ছে। সে কারণে হুমকির মুখে পড়ছে পাখির নিরাপদ আবাসস্থল। দেশের একমাত্র প্রাকৃতিক ম্যানগ্রোভ সুন্দরবনসহ যেকোন স্থানের গাছ-গাছালি উজাড় হয়ে যাওয়ার কারণে অতিথি পাখির আগমন দিনে দিনে কমে যাচ্ছে। আর তা আমাদের পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় মারাত্মক হুমকির মধ্যে পড়ছে। কারণ জীববৈচিত্র্য রক্ষার জন্য প্রাকৃতিক পরিবেশের সব জীবজন্তু মানুষ পক্ষীকুল সবকিছু একে অপরের পরিপূরক হয়ে থাকতে হবে। তাই এমন পাখি মেলা করে বাংলাদেশে অতিথি পাখির গুরুত্ব অনুধাবন করার বিষয়টি খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। এভাবে চলতে থাকলে মানুষের মধ্যে সচেতনতা গড়ে উঠবে এবং প্রকৃত অর্থেই রক্ষা পাবে অতিথি পাখিসহ অন্যান্য সকল পক্ষীকুল সেটাই আমাদের প্রত্যাশা।

লেখক: কৃষিবিদ ও ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার

জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়

email: [email protected] 

 

বহুমাত্রিক.কম

Walton Refrigerator Freezer
Walton Refrigerator Freezer