Bahumatrik | বহুমাত্রিক

সরকার নিবন্ধিত বিশেষায়িত অনলাইন গণমাধ্যম

চৈত্র ১৪ ১৪৩০, শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪

শিশুশ্রমের ভয়াবহতা, করোনায় অচলাবস্থা

মাকামে মাহমুদ চৌধুরী

প্রকাশিত: ২২:২৩, ৩ আগস্ট ২০২০

আপডেট: ২২:৩৩, ৩ আগস্ট ২০২০

প্রিন্ট:

শিশুশ্রমের ভয়াবহতা, করোনায় অচলাবস্থা

ছবি- সংগৃহীত

করোনা ভাইরাস জীবনকে করেছে অবরুদ্ধ,
অদৃশ্য শত্রুর সাথে মানবজাতির চলছে মহাযুদ্ধ,
এ যুদ্ধ বেঁচে থাকার,
এ যুদ্ধ মানবতার।
করোনায় অচলাবস্থা,
কোটি মানুষকে করেছে অসহায়,
দুবেলা দুমুঠো খাবারের চিন্তা, ফেলেছে হতাশায়।
মানুষের জীবন আজ হাজারো দুর্ভোগে,
প্রতিটি মানুষ ব্যস্ত টিকে থাকার লড়াইয়ে। ( করোনায় অসহায়ত্ব-জান্নাতুল ফেরদৌস জ্যোতি)

করোনা ভাইরাসের তান্ডবলীলায় পৃথিবী আজ বিপর্যস্ত। তবে এ বিপর্যস্ততার মাঝেও থেমে আছে কি দেশের অন্যতম ভয়াবহ সমস্যা শিশুশ্রম। আজ করোনার এ তান্ডবলীলায় কেমন আছে শিশুশ্রমের শিকার সেই শিশুরা। করোনা সব কিছুকে থামাতে পারলেও শিশুশ্রমকে কি পেরেছে থামাতে? বলা হয়ে থাকে, ঘুমিয়ে আছে শিশুর পিতা সব শিশুরই অন্তরে। প্রতিটি শিশুকে ভাবা হয় ভবিষ্যতের জন্য সম্ভাব্য নেতা। শিশুর মধ্যেই নিহিত রয়েছে আগামী দিনের ভবিষ্যৎ ও সম্ভাবনা। তবে দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য আমাদের দেশের অধিকাংশ শিশুরা আজও অধিকারবঞ্চিত এবং উপেক্ষিত যা শিশুশ্রম বৃদ্ধিতে জ্বালানি যোগায়। প্রতি বছর শিশুশ্রমের বিরুদ্ধে মানুষকে সচেতন করার লক্ষ্যে বিশ্বব্যাপী শিশুশ্রম দিবস পালন করা হলেও লক্ষ লক্ষ শিশু এখনো তাদের শ্রম বিনিময়ের আয়ের উপর নির্ভরশীল। শিশুশ্রম ভবিষ্যৎ সম্ভাবনার পথে একটি বড় বাঁধা যা শিশু দাসত্ব নামেও পরিচিত। ভারতের বিখ্যাত এক নোবেল বিজয়ী বলেছেন- "Child slavery is a crime against humanity. Humanity itself is at stake here." অর্থাৎ `শিশুদের দাসত্ব করা মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ। মানবতা নিজেই এখানে ঝুঁকিতে পড়ে।`

শিশুশ্রম বলতে সাধারণত শিশুদের এমন সব কাজে অন্তর্ভুক্ত করা বোঝায় যেখানে তাদের সব অথবা বেশিরভাগ অধিকারগুলো থেকে বঞ্চিত করা হয়। উদাহরণ স্বরূপ বলা যায়, যে সময় শিশুদের স্কুলে যাওয়ার জন্য সেসময়ে তাদের ইট ভাটায় ইট ভাঙতে দেখা যায়। শিশুশ্রম দরিদ্র্যতা, বেকারত্ব, নিরক্ষরতা এবং জনসংখ্যা বৃদ্ধি সহ অন্যান্য সামাজিক সমস্যাকে দীর্ঘস্থায়ী করে তোলে। বাংলাদেশে জনসংখ্যা বৃদ্ধির উচ্চহার, দরিদ্রতা এবং নিরক্ষরতার কারনে শিশুশ্রমের হার পুষ্পিত হয়। প্রতিনিয়ত শিশুশ্রমের হার বৃদ্ধির ফলে তাদের মানুষের ঘরে কাজ করে উপার্জিত অর্থ দিয়ে দিন অতিবাহিত করতে হয়। জন্ম থেকে অধিকার বঞ্চিত এ শিশুদের আলাদা করে বসবাস করতে হয়। এদের মধ্যে কেউ আবার তাদের নিয়োগকর্তাদের বাড়িতে নিয়োগ প্রাপ্ত হয়ে সার্বক্ষণিক সেবা দিয়ে তাদের কাজের বিনিময়ে অর্থ লাভ করে থাকে। এছাড়া এমনও রয়েছে যারা তাদের কাজের বিনিময়ে অর্থ গ্রহণ না করে সহজাত সুবিধাগুলো যেমন খাদ্য, বস্ত্র ও আশ্রয় ইত্যাদি পেয়ে থাকে।

বিশ্ব শ্রম সংস্থার তথ্যমতে বর্তমানে সারা বিশ্বে ২০০ মিলিয়নেরও বেশি শিশু শ্রমকার্যে নিয়োজিত এবং এ সংখ্যা ভবিষ্যতে আরও বাড়বে বলে আশংকা প্রকাশ করা হয়েছে। বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক অবস্থার কারনে শিশুরা সবচেয়ে বেশি শোষিত এবং বঞ্চিত হয়। তারা তাদের কাজের অদৃশ্য প্রকৃতির কারণে শ্রম আইন, বিচ্ছিন্নতা, অসন্তুষ্টি, স্থায়ী বৈষম্য এবং বর্জনের সম্মুখীন হয়। তারা তরুণ, তাই তারা তাদের অধিকার সম্পর্কে অবগত নয়। ছোট থেকেই তারা পরিবারের সহচার্য থেকে বঞ্চিত। সর্বোপরি তারা তাদের নিয়োগকর্তাদের করুণার উপর নির্ভরশীল। তাদের কাছে আন্দোলনের স্বাধীনতা নেই। পারিবার বঞ্চিত এসব শিশুরা সম্পূর্ণরূপে অন্যের বিবেচনার উপর নির্ভরশীল। আমাদের ভবিষ্যৎ নেতাদের এমন শিশুশ্রমে নিযুক্ত হওয়া অভিশাপ ছাড়া কিছু হতে পারে না। আর করোনা পরিস্থিতিতেও থেমে নেই শিশুশ্রমের ভয়াবহতা।

বাংলাদেশ শিশুশ্রম সমীক্ষা-২০১৩ শীর্ষক একটি সমীক্ষা প্রতিবেদনে দেখা যায়, প্রায় সাড়ে নয় লক্ষ ছেলে শিশু এবং সাড়ে সাত লক্ষ মেয়ে শিশু বিভিন্ন গার্মেন্টস এবং ফ্যাক্টরিতে নিযুক্ত রয়েছে। এছাড়া প্রায় ১৩ লক্ষ শিশু বিভিন্ন কারখানায় বিপজ্জনক কাজে নিয়োজিত রয়েছে। (সূত্রঃ ইন্টারনেট ) শিশুশ্রমে নিযুক্ত শিশুদের পরিবার থেকে বিচ্ছিন্নতাবোধ তাদের সাহায্যের ক্ষেত্রে এবং যেখানে তাদের অপব্যবহার করা হচ্ছে যেসব ক্ষেত্র সনাক্ত করা কঠিন করে তোলে। শিশুদের একটি বড় অংশ কৃষি খাতেও স্বনিযুক্ত হয়ে কাজ করে যেসব অঞ্চল সম্পূর্ণরূপে অনিয়ন্ত্রিত অবস্থায় থাকে। বৃহত্তরভাবে শিশুশ্রম নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য আইন প্রয়োগের পাশাপাশি তা বাস্তবায়নের কোনো বিকল্প নেই।

শিশুশ্রম শিশুদের শৈশব, সম্ভাবনা এবং মর্যাদা থেকে তাদের বঞ্চিত করে। তাদের স্কুলে যেতে বাঁধা দেয়। তাদের স্বাস্থ্য, মানসিকতা এবং প্রাকৃতিক বিকাশকে বিকারগ্রস্থ করে দেয়। এটি নতুন নিরক্ষর প্রজন্মের পথকে প্রশস্ত করে। এটি জনশক্তিকে মূল্যহীন করার মাধ্যমে নতুন প্রজন্মের সম্ভাবনাকে হত্যা করে দেয়। দরিদ্র্যতা শিশুশ্রমের প্রধান কারণ হতে পারে কিন্তু এ দরিদ্র্যতাই আবার শিশু শ্রমের কারণেও ঘটে। যেসব শিশুরা স্কুলে যেতে ব্যর্থ হয় তারা কোনো দক্ষতা ছাড়াই এমন অনেক ভারী কাজে নিযুক্ত হয়ে বিপদের শিকার হয়। কিন্তু এ শ্রমের বিনিময়ে অনেক সময় তারা তাদের যথাযথ প্রাপ্যও পায় না। ফলস্বরূপ তারা দরিদ্র থাকে। এভাবে দারিদ্র্যের ক্ষতিকারক চক্র অব্যাহত থাকে। শিশু অধিকার রক্ষার ক্ষেত্রে আমরা বরাবরই কেবল ব্যর্থ হয়েছি। দরিদ্রতার শিকার এসব শিশুরা গুরুতর পরিস্থিতিতেও কঠোর পরিশ্রম করতে বাধ্য হয়। যেমন বাস চালক, গার্হস্থ্য সাহায্যকারক, ট্যানারার এবং ক্যাস্টার হিসেবে তাদের কাজ করতে দেখা যায়। শিশুরাই আগামী দিনের ভবিষ্যৎ। তাদের সুস্থ সবল বিকাশ নিশ্চিত করা সকলের দায়িত্ব ও কর্তব্য। তাদের শারীরিক, মানসিক এবং অর্থনৈতিক শোষণ থেকে বের করে আনতে হবে। দারিদ্র্যের ক্ষতিকারক শিকল থেকে বের হয়ে আসতে তাদের প্রয়োজনীয় শিক্ষা এবং দক্ষতা অর্জনের সুযোগ করে দিতে হবে।

শিশুশ্রম এই ভয়াবহ সমস্যাটির জন্য শিশুরা তাদের শৈশব এবং ভবিষ্যৎকে হারাচ্ছে। বাংলাদেশে বিদ্যমান শোষণের সবচেয়ে বিপজ্জনক এই সমস্যাটি নির্মূল করার জন্য প্রত্যেকের নিজের প্রতিশ্রুতির পাশাপাশি বিদ্যমান আইনগুলো বাস্তবায়নের জন্য কর্তৃপক্ষকে আরও গুরুতর হতে হবে। আপন দেবনাথের সঙ্গে তাই সবার সুর মিলিয়ে বলা উচিত –

নজর যদি পড়ে শিশুর দিকে
অবহেলা বোধ করে ফিকে
দূর করবো চক্ষু ভ্রম
বুকে হাত রেখে মোরা আজ শপথ করি,
বন্ধ করবো শিশু শ্রম।

(সহযোগিতায়ঃ জান্নাতুল ফেরদৌস জ্যোতি, শিক্ষার্থী, চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়)

লেখক: শিক্ষার্থী, চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়।

বহুমাত্রিক.কম

Walton Refrigerator Freezer
Walton Refrigerator Freezer