Bahumatrik | বহুমাত্রিক

সরকার নিবন্ধিত বিশেষায়িত অনলাইন গণমাধ্যম

চৈত্র ১৪ ১৪৩০, শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪

একাত্তরের রণাঙ্গণে

শিশু-কিশোর মুক্তিযোদ্ধা

তুষার পলাশ

প্রকাশিত: ০৫:১৯, ২৬ মার্চ ২০১৪

আপডেট: ০০:০০, ৩১ ডিসেম্বর ১৯৯৯

প্রিন্ট:

শিশু-কিশোর মুক্তিযোদ্ধা

ঢাকা: ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধ। নয় মাসব্যাপী এ যুদ্ধে অনেক রক্ত, ত্যাগ, তিতিক্ষার পর আমরা স্বাধীনতা অর্জন করেছি। এই যুদ্ধে ছেলেদের পাশাপাশি মেয়েরা যেমন অংশগ্রহণ করেছিল তেমনি অংশগ্রহণ করেছিল শিশু-কিশোররাও।

তারা মুক্তিযুদ্ধের সাথে নানাভাবে জড়িত ছিল। এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, মুক্তিযুদ্ধে শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে প্রায় ৪ লাখই ছিল শিশু-কিশোর। আর যে সব নারী সম্ভ্রম হারিয়েছিল তাদের মধ্যে প্রায় অর্ধেকই ছিল কিশোরী। তাই, মুক্তিযুদ্ধের সংগ্রামে শিশু-কিশোরদের অবদান কিছুতেই খাটো করে দেখা যায় না।

স্বাধীনতা যুদ্ধ ছিল রক্তক্ষয়ী ও দীর্ঘদিনের। শিশু-কিশোরা এ সময় কখনও কখনও বড়দের মতো যুদ্ধ করেছে। উড়িয়ে দিয়েছে পানিস্তানি সেনা ক্যাম্প। অবসরপ্রাপ্ত মেজর, মুক্তিযোদ্ধা, গবেষক ও লেখক কামরুল হাসান ভূঁইয়ার লেখাতে সে চিত্র ফুটে উঠেছে।

‘আমাদের শিশু মুক্তিযোদ্ধারা” শিরোনামের একটি লেখাতে তিনি উল্লেখ করেছেন, “সীমান্ত এলাকা বক্সনগরে পাকিস্তানীদের প্রতিরক্ষা অবস্থান বাংলাদেশের ভেতরে। ওদের বাংকার, ওদের চলাফেরা দেখা যায়। কয়েক সপ্তাহ পর একদিন দিনের বেলায় মেজর খালেদ ছেলেদের নিয়ে গেলেন সেখানে। এই কিশোরদের তিনি পাকিস্তানী প্রতিরক্ষা অবস্থানের বাংকারগুলো দেখিয়ে বললেন, ‘যারা আমার সামনে শত্রুর ওই বাংকারগুলোতে গ্রেনেড ছুড়ে আসতে পারবে তাদের জন্য পুরস্কার এই ঘড়ি।’ আমার অন্তরাত্মা নড়ে উঠল। একটি ঘড়ির বিনিময়ে নির্বোধ, নিষ্পাপ কিশোরদের নির্ঘাত মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেওয়া। শত্রু বোকা নয়। তারা প্রশিক্ষিত, সংগঠিত ও অভিজ্ঞ। আমাদের অবুঝ বালকদের তার কিছুই নেই। এই অপারেশন আবার দিনের আলোতে।

প্রতিরক্ষা এলাকায় কোনো বেসামরিক ব্যক্তিকেই প্রবেশ করতে দেওয়া হয় না, এটাই সামরিক শিক্ষা। আমাদের ছেলেরা শুধু প্রতিরক্ষা এলাকায়ই প্রবেশ করবে তা নয়, তাদের শত্রুর বাংকার পর্যন্ত পৌঁছাতে হবে এবং সবাইকে একসঙ্গে। এ ধরনের (দিনের রেইড) অপারেশন কেবল অভিজ্ঞ কমান্ডোদের দ্বারাই সফল হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। ছেলেদের কেউ শত্রু প্রতিরক্ষা অবস্থানে মারা গেলে বা ধরা পড়লে এদের মৃতদেহও পাওয়ার সম্ভাবনা নেই।

প্রায় নিশ্চিত মৃত্যুর আগাম আশঙ্কায় সুরা পড়ে দোয়া করতে লাগলাম এই দূরন্ত ছেলেদের জন্য। এদের মা-বাবাদের নিশ্চয়ই না জানিয়ে এরা যুদ্ধে এসেছে। এরা মারা গেলে কেউ জানবে না এই দুর্বিনীত, বুকভরা সাহসের ছেলেদের কথা? গ্রামের ডান-বাম দিয়ে অর্থাৎ শত্রুর প্রতিরক্ষার দু’পাশ দিয়ে আলাদাভাবে ওরা গ্রামের ভেতর ঢুকে গেল। মেজর খালেদ মোশাররফের চেহারা দেখে বোঝা যাচ্ছিল যে ছেলেদের তিনি শুধু প্রশিক্ষণই দেননি, কঠোর ও নিপুণ অনুশীলন করিয়েছেন। উৎকণ্ঠায় প্রতিটি মুহূর্ত। মেজর খালেদ ও আমার কারো মুখেই কোনো কথা নেই। ঘড়ি পুরস্কারের জন্য নয়, অদম্য সাহস আর কী প্রবল দেশাত্মবোধ ছিল এই কিশোরদের! এ আদেশ শুনে খালেদকে অত্যন্ত নিষ্ঠুর মনে হয়েছিল। কিন্তু না, দিনের আলোয় আমাদের সবার সামনে পাকিস্তানী বাংকারগুলো প্রকম্পিত করে ধূলোর আঁধার বানিয়ে ফেলল ওরা। ফিরে আসার পর অশ্রুসিক্ত চোখে খালেদ ছেলেদের বুকে জড়িয়ে ধরলেন। এ যেন এক পিতা সন্তানদের কাঁধে ওজন রেখে হাঁটতে শেখাচ্ছেন।”

শিশু-কিশোরদের যেমন বিজয়ের ঘটনা আছে তেমনি আছে শহীদ হওয়ার ঘটনাও। অনেকে গোপনে মুক্তিযোদ্ধাদের খবর আনা-নেয়া করতে করতে কোনোদিন আর ফিরে আসেনি। তার লাশও খুঁজে পাওয়া যায়নি।

বিচ্ছিন্নভাবে শিশু-কিশোরদের সারা দেশে এমন অনেক অনেক ঘটনা আছে যা দেশ স্বাধীন করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল। কামরুল হাসান ভূঁইয়ার লেখা থেকে আরো জানা যায়Ñ “ক্লাস ফোর-ফাইভের ছাত্ররা যুদ্ধে এসেছিল। দু’চোখ ভরা তাদের দুষ্টুমি। এদের আবাস ওয়াই প্লাটুনে হলেও লালমাটিয়ার আবদুল আজীজের (বীর প্রতীক, ১০ অক্টোবর ১৯৯৯ সালে প্রয়াত) সামগ্রিক তত্ত্বাবধানে ওদের ন্যস্ত করা হয়, ট্রেনিংয়ের দায়িত্বসহ।

আবদুল আজীজ এই শিশুদের আপন ভাইয়ের চেয়ে বেশি স্নেহ করতেন। ভারতের এই ক্যাম্পে এই শিশুদের কোনো আপনজন নেই। এরাও ছিল আবদুল আজীজের প্রচ- ভক্ত। দুই পা এক করে স্থির হয়ে দাঁড়ানো ছিল এদের জন্য দুঃসাধ্য। দু’টি চোখের মণি, দু’টি হাত এবং দু’টি পা সব সময়ই নড়ছে। এদের মধ্যে ঢাকার গ্রিন রোডের হাসান, প্রদীপ, শাহজাহান ছিল উল্লেখযোগ্য। ক্যাপ্টেন হায়দার আদর করে এদের নাম দিয়েছিলেন ‘ওয়াকিটকি’।

মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশ স্বাধীন করতে বড়দের সঙ্গে মাঠে নেমেছিল শিশুরাও। রাতের আঁধারে অথবা প্রয়োজনীয় যেকোনো মুহূর্তে এক ক্যাম্পের খবর অন্য ক্যাম্পে পৌঁছে দিয়েছে শিশু-কিশোররা। তারা গ্রামের বিভিন্ন বাড়ি থেকে খাবার সংগ্রহ করে মুক্তিযোদ্ধাদের খাইয়েছে। বিভিন্ন সময়ে মুক্তিযোদ্ধাদের গুপ্তচর হয়ে পাকিস্তানি শিবিরে ঢুকে সংবাদ বা যে কোনো প্রয়োজনীয় তথ্য মুক্তিযোদ্ধাদের জানিয়েছে, পাকিস্তানি হানাদারদের ভুল রাস্তা দেখিয়েছে। এছাড়া মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্প থেকে অস্ত্র ও গোলাবারুদের তত্ত্বাবধান করা, মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে থেকে গোলাবারুদ ও অস্ত্র সরবরাহ করাসহ যুদ্ধক্ষেত্রে নিজের সঙ্গে অস্ত্র নিয়ে বেড়ানোসহ মুক্তিযোদ্ধাদের অন্যান্য ছোট-খাটো কাজ করেছে।

ফটোগ্রাফার রশীদ তালুকদার প্রথম আলোর ছুটির দিনের একটি প্রতিবেদনে বলেছেন, ‘‘পেছনে আবছা দেখা যাচ্ছে আইয়ুব খানের গলায় জুতার মালা। কোথেকে সামনে ছেলেটা এসে স্লোগান দিতে শুরু করল। ছবিটা তুলে উঠে দাঁড়াতে যাব, তখনই গুলি এসে লাগল ছেলেটার গায়ে। ঘটনাটা এমন আকস্মিক ছিল, গুলিবিদ্ধ ছেলেটার ছবি তুলতেও ভুলে গিয়েছিলাম।’’ ছবিটিতে মিছিলে বড়দের থেকে শিশুদের সংখ্যা ছিল বেশি।

একবিংশ শতাব্দীতে এসে আমাদের সামনে আসা ইমপ্রেস টেলিফিল্ম -এর খালিদ মাহমুদ মিঠু পরিচলিত মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক জনপ্রিয় চলচ্চিত্র ‘গহীনে শব্দ’ তে আমারা দারুণভাবে দেখতে পাইÑ শুরুতেই একঝাঁক শিশু ও শিশুর র্কাযক্রম দিয়েই ছবিটির শুরু। ছবিটির মাঝে একটি জায়গায় একটি মুক্তিযুদ্ধের যোদ্ধাদের কমান্ডার শিশু।

পরবর্তীতে ওই শিশুটিই পঙ্গু মুক্তিযোদ্ধা চরিত্রে অভিনয় করেছেন আমাদের চিরচেনা মুখ মাসুম আজিজ। এছাড়া চাষী নজরুল ইসলাম পরিচালিত বাংলাদেশের প্রথম মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক চলচ্চিত্র ‘‘ওরা ১১ জন’’, তারেক মাসুদ পরিচালিত ‘‘মুক্তির গান’’ এবং মোরশেদুল ইসলাম পরিচালিত ‘‘আমার বন্ধু রাশেদ’’ চলচ্চিত্রটিতেও আমরা দেখতে পাই ৭১’র মুক্তিযুদ্ধে শিশু-কিশোরদের অংশগ্রহণের চিত্র।

লেখক: সাংবাদিক
বাংলাদেশ সময়: ২১৫৯ ঘণ্টা, মার্চ ২৫, ২০১৪

 

 

বহুমাত্রিক.কম

Walton Refrigerator Freezer
Walton Refrigerator Freezer