Bahumatrik | বহুমাত্রিক

সরকার নিবন্ধিত বিশেষায়িত অনলাইন গণমাধ্যম

চৈত্র ১৪ ১৪৩০, শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪

রংপুর রাইডার্সের বিজয় ও লেখাপড়ার ‘মিনিং’ খোঁজার গল্প

মো: অভি আলম

প্রকাশিত: ০১:২৭, ১৩ ডিসেম্বর ২০১৭

আপডেট: ০০:০০, ৩১ ডিসেম্বর ১৯৯৯

প্রিন্ট:

রংপুর রাইডার্সের বিজয় ও লেখাপড়ার ‘মিনিং’ খোঁজার গল্প

ঢাকা : আমার গতকালের লেখায় বলেছিলাম পরের অংশ আজকে লিখবো। তাহলে চলুন শুরু করি, মূল কথা ছিলো ভালো ফল করেও শেষ পর্যন্ত ঢাকাও প্রমাণ করতে পারলো না তারা মেধাবী।

এই লেখাটা ক্লিয়ার হতে অবশ্যই লিংকে ক্লিক করে আমার আগের লেখাটি দেখে নিন                    ( http://www.bahumatrik.com/ভাল-ফল-করা-ছাত্ররা-শেষ-পর্যন্ত-মেধাবী-নাও-হতে-পারে/44360 )

রংপুর নিয়ে কেউ চিন্তাও করে নি, বাস্তব জীবনটা ঠিক এমনই। সফলতা শেষ পর্যন্ত পরিশ্রমী ও আত্মবিশ্বাসীদের জীবনেই ধরা দেয়। কে কোথায় পড়লো কে ক্লাসে টপার ছিলো সেটার উপরে নির্ভর করে না।

অনেকেই ভাবতে পারেন আমার হয়তো খারাপ রেজাল্ট তাই এমন লিখছি, না-তা নয়। আমি প্রাইমারি থেকে মাষ্টার্স পর্যন্ত কম বেশি টপার রেজাল্ট করেছি। প্রাইমারি স্কুলে ফার্স্ট বয় ছিলাম। গ্রামের প্রাইমারি স্কুলে সহপাঠী ছিলো পঁচিশ জনের মতো। হাই স্কুলে উঠে প্রথম দিকে শুধু ফেইল করতাম, এক টানা ক্লাস এইট পর্যন্ত। এই সময়টাতে আমি লেখাপড়ার মিনিং খুঁজতাম তবে সঠিক মিনিং খুঁজে পেতাম না। ক্লাস নাইনে উঠলাম মানবিক শাখা নিলাম, কারন আমি তখন মধ্যম ছাত্র ছিলাম।

বলে রাখছি তখন আমার বাবা আমাকে খুব শাসন করতো। এমন দিন নেই ধোলাই খেতাম না। যথারীতি গ্রামের স্কুলে মানবিক শাখা নিয়ে ক্লাস নাইনে রেজিষ্ট্রেশন করলাম তবে তখনও আমি লেখাপড়ার অর্থ বুঝতাম না। ক্লাসে ক্ষুধার্ত ব্রেইনে রহস্য খুঁজে বেড়াতাম, শিক্ষকরাও আমাকে নিয়ে কোনো আশা করতো না।

যথারীতি তারা টপারদের নিয়ে প্রশংসায় মেতে থাকতো (এটা স্বাভাবিক)।বলে রাখছি আমার স্কুলটা পিরোজপুর জেলার মধ্যে কম বেশি ভালো অবস্থানে রয়েছে-সাপলেজা মডেল হাই স্কুল(মাঝে মাঝে জেলায় টপার হয়)।

পিরোজপুরের মধ্যে প্রধান শিক্ষক এম এ কুদ্দুস স্যারকে চিনেন না এমন শিক্ষানুরাগী লোক খুব কমই আছেন। সব থেকে খুশির বিষয়, তিনি আমার বড় কাকা, ছোট কাকা, মেজো কাকা এবং আমার বাবারও শিক্ষক। স্যার মঠবাড়িয়া সদরে থাকতেন এবং সেখান থেকে এসে শিক্ষকতা করতেন।

স্যার স্কুলের শুরু ১৯৪০ সাল থেকে। আমি লাকি ছিলাম, কারণ আমার বাবা কাকাদের শিক্ষক ছিলেন এমন পাঁচ জনের ওপরে শিক্ষক পেয়েছি(এমন ভাগ্য খুব কম লোকের জীবনেই হয়)। যাই হোক মূল কথায় আসি, যথারীতি ক্লাস নাইনেও আমি কোনরকম পাশ মার্কস নিয়ে ক্লাস টেনে উত্তীর্ণ হলাম।

তখন শুরু হলো আমার জীবনের নূতন পরিবর্তন, আমি শিক্ষার অর্থ খুঁজে পেতে থাকলাম। বাবার সাথে অনেক বাকবিতণ্ডা করে সিদ্ধান্ত নিলাম ক্লাস নাইনে আর একবছর থাকবো এবং আমি পড়াশুনা শুরু করবো-যেই কথা সেই কাজ। আমি মনোযোগ দিয়ে শুরু করলাম এবং আমার সাথের সেই টপাররা গোল্ডেন পেলো একসাথে আটজন।

আমি তো এখন তাদের ছোট ভাই হয়ে গেছি, আমি ভালো ফল করতে আত্মবিশ্বাস নিয়ে পরিশ্রম করতে থাকলাম। মানবিক শাখায় প্রায় পঁয়ত্রিশ জন ছাত্রছাত্রী ছিলো।ওইদিকে আমার সেই ক্লাসমেটরা গোল্ডেন প্লাস নিয়ে দেশের বিভিন্ন কলেজে ভর্তি হলো।

আমি যথারীতি মানবিক শাখায় ৪.৪৪ নিয়ে মানবিক শাখায় প্রথম হলাম (তখন মানবিক শাখায় রেজাল্ট তোলা সহজ ছিলো না)। ইন্টারে ভর্তি হলাম গ্রামের কলেজে প্রথম বর্ষ আর আমার সেই আগের ক্লাসমেটরা দ্বিতীয় বর্ষে দেশের বিভিন্ন কলেজে পড়ছে।

তাদের ইন্টার পরীক্ষা আসলো, দিলো,রেজাল্ট হলো। সেই আটজন গোল্ডেনের তিন জন ফেল এবং এক জন এ প্লাস, বাকি দুইজন ৪.৮০/৪.৯০/ এবং বাকিরা ৩.৩০+। আমারও পরীক্ষা আসলো দিলাম ৪.৮০ নিয়ে পরীক্ষায় আমার বিভাগে দুজন একত্রে প্রথম হয়ে উত্তীর্ণ হলাম, ছাত্রছাত্রী ছিলো শতাধিক।

তবে দুর্ভাগ্য, তখন আমার সাথে বাস্তব জীবন খেলা শুরু করলো।আশা নিয়ে ঢাকায় আসলাম আট হাজার টাকা নিয়ে, ঢাকায় থাকার মতো ছিলো চাচাদের বাসা। গ্রামের শিক্ষিত মিডেল ক্লাস পরিবার বলতে জমিজমা এর ওপরেই পরিবার চলানো পরিবার।

বাবা একসময় আর্মিতে জব করতো, দুর্ভাগ্য সে জবটা কন্টিনিউ করেন নি। উঠলাম ঢাকায় চাচাদের বাসায় তবে পরিণতি ছিলো ভাগ্যের বিপরীতে, ঢাকার চাচারা ভাতিজাকে পজিটিভলি নেয় নি। চাচাদের গ্রামের জমিজমাও আমার বাবা মেইনটেনেন্স করে তাই তারা আমাদের সাথে সুসম্পর্ক রেখেছে।

বাস্তবতার বহুরূপ, শুরু করলো বাস্তবতার জ্ঞান দেয়া এবং আমার বাবাকেও ইন্টারনাল ব্রেইন ওয়াশ করার অবস্থা। মিডেল ক্লাস পরিবার অর্থ আয় করা দরকার,অনার্স করে কি হবে? ইত্যাদি ইত্যাদি।তবে ২০১৭-তে এসে একটা কঠিন বাস্তবতা হলো আমাকে শিক্ষার প্রতি নারাজি করানো এক চাচার ছেলেকে বিইউপি এর মতো বিদ্যাপীঠে বিবিএ ভর্তি করিয়েছে। তাদের মূল উদ্দেশ্য ছিলো তারা কেনো গ্রামের ছেলেটাকে তাদের বাসায় রাখবে।

মিডেল ক্লাস যথারীতি আমি অর্থ ছাড়া ছেলেটা কোচিং ভর্তি হয়েও মানসিকভাবে পেরে উঠছিলাম না। চাপে পরে বড় চাচার কাছে চাকরি চাইতে বাধ্য, দিলো চাকরি। সাভারে ইপিজেড ‘এ ওয়ান ফ্যাশন লি.’ এর জ্যাকার্ড ম্যাশিং এর হেল্পার হিসেবে, মাথায় করে সুতা টানতাম। তিনি তখন পাশের হেলিকন ফ্যাশন লি. এর জিএম ছিলেন। ডিফেন্স রিটায়ার্ড তাই এই ধরণের জব পেয়েছেন।

আমি সাভারে থেকে মাস দেড়েক জবটা করলাম,থাকলাম ইপিজেড এর অপোজিট একটা গলির জনাকীর্ণ নোংরা ছারপোকা পূর্ণ ম্যাচ বাসায়।(খাবারের কথা নাই বললাম)আমি জবটা নিয়ে অনেক ভাবলাম দেখলাম যেইখানে জব দিয়েছে সেখানে সহকর্মীরা এইট পাশ এর নিচে সব। শেষ পর্যন্ত পারলাম না জবটা কন্টিনিউ করতে।

এলাকার পরিচিত ভাইদের সাথে যোগাযোগ করলাম এবং তারা আমার পাশে দাঁড়ালো। তাদের বাসায় রেখে স্কুলে জব দিলো-টিউশনি দিলো, আমি আজীবন কৃতজ্ঞ তাদের প্রতি। দুইটা বছর আরো কিছু সমস্যার কারনে গ্যাপ হয়ে গেলো।পাবলিকে পড়ার স্বপ্নটা আর পূরণ করতে পারলাম না।

আমাকে সাহায্য করা ভাইদের পরামর্শমতে বহু কষ্টে বাবাকে রাজি করিয়ে জমি বিক্রি করলাম, প্রাইভেট ভার্সিটিতে আইন বিষয়ে পড়বো বলে। শুরু হলো নূতন সংগ্রাম, একে একে অনার্স শেষ করলাম ব্যাচ এর ফার্স্ট রেজাল্ট নিয়ে,মাষ্টার্সটাও শেষ করলাম ব্যাচ এর ফার্স্ট রেজাল্ট নিয়ে।

প্রাইভেট বলে ছোট করে ভাবার কিছু নেই, উদাহরণসরূপ,এখানে দেশবরেণ্য ড.মিজানুর রহমান স্যার, কাজী এম এইস সুপন স্যার, ড.মাহাবুবুর রহমান স্যারের কোর্সগুলোতে A+, A তোলা চারটে খানি কথা নয়। আমি বিশ্বাস করি আমার জন্য মাষ্টার্স শেষ করাটাই সব থেকে বড় অর্জন এবং হয়তো আমার জন্য এর থেকে বড় অর্জনটাও অপেক্ষা করছে।

আল্লাহ্ আমাকে সংগ্রামী জীবনে বিলাসিতা করতে শেখায় নি, খুব বেশি আত্মবিশ্বাসী ও সঠিক পরিশ্রমী হতে শিখিয়েছে। মূল কথা ছিলো আমি বিশ্বাস করি ভালো ফল করা ছাত্ররা শেষ মেধাবী নাও হতে পারে, সফলতা পায় আত্মবিশ্বসী ও পরিশ্রমী মানুষগুলোই সফল হয়। 

লেখক: শিক্ষানবিশ আইনজীবী, ঢাকা জাজ কোর্ট।

বহুমাত্রিক.কম

Walton Refrigerator Freezer
Walton Refrigerator Freezer