Bahumatrik | বহুমাত্রিক

সরকার নিবন্ধিত বিশেষায়িত অনলাইন গণমাধ্যম

চৈত্র ১৩ ১৪৩০, শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪

মুক্তি সংগ্রাম এবং মুক্তিযুদ্ধে বাংলার কৃষক

মুহম্মদ র ই শামীম

প্রকাশিত: ১৩:৩৫, ১৩ সেপ্টেম্বর ২০২২

প্রিন্ট:

মুক্তি সংগ্রাম এবং মুক্তিযুদ্ধে বাংলার কৃষক

ব্রিটিশ শাসন ও শোষণের বিরুদ্ধে বাংলার কৃষক-জনসাধারণই মূলত সংগ্রাম করেছে, বারবার বিদ্রোহ করেছে। পলাশীর তথাকথিত যুদ্ধ পরবর্তী পরাধীনতা, তাদের ভাগ্যে নির্মম দুঃশাসনের সূচনা করে। কৃষক সমাজ তখন থেকেই প্রতিবাদী হয়ে ওঠে, বিদ্রোহ করতে শিখে। ১৭৬৭ খ্রিস্টাব্দে সন্ন্যাসী বিদ্রোহের মধ্য দিয়ে তা শুরু হলেও পরবর্তীতে ঊনবিংশ শতাব্দীব্যাপি কৃষক-জনসাধারণ নিজ অধিকার আদায়ে সচেতন ও সংগঠিত হয়ে বারবার প্রতিবাদ সংগ্রাম করে রক্ত আর জীবন দেয়। কৃষকের রক্তে দুশ বছর ধরেই বাংলা বার বার রক্তাক্ত হয়েছে। কিন্তু কোনো দিন তারা ব্রিটিশ শাসন মেনে নেয়নি।

ব্রিটিশ শোষণ নিপীড়ন থেকে বাঁচতে অবশেষে ১৯৪৬ সালে পাকিস্তান রাষ্ট্র সৃষ্টির পক্ষে তারা রায় দেন। বুক ভরা আশা আর যেসব প্রতিশ্রুতির প্রেক্ষিতে পাকিস্তান রাষ্ট্রের পক্ষে কৃষকেরা মতামত দেন, ১৯৪৭ সালের পাকিস্তান নামক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর সে আশা অচিরেই নিরাশায় পরিণত হয়। জমিদার প্রথা উচ্ছেদ,ভূমি সংস্ক্রা, ভূমিহীনদের মাঝে খাস জমি বিতরণসহ পূর্ব বাংলার কৃষকদের উন্নয়নে যে ওয়াদাগুলো ছিল, তা পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠী সহজেই ভুলে যায়। সকল ক্ষমতা কুক্ষিগত করে নিজেদেরকে রাস্ট্রের মালিক মনে করতে থাকে। পাকিস্তানের

শাসকগোষ্ঠী পূর্ব বাংলা তথা পূর্ব পাকিস্তানে ব্রিটিশদের মতোউপনিবেশিক শাসন শুরু করে।
‘পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর ভূমি সংস্কার এবং কৃষি উন্নয়ন ক্ষেত্রে গৃহীত বৈষম্যমূলক নীতি পূর্ব বাংলায় কৃষক সম্প্রদায়ের স্বাধীনতা আন্দোলনের উর্বর ভিত্তি তৈরি করেছিল। পাকিস্তান সৃষ্টির সময় জমিদারি প্রথা বিলোপের কথা বলা হলেও ১৯৫১ সালে পাকিস্তানের সংসদে যে ভূমি সংস্কার বিল পাস করা হয় তাতে সেই প্রতিশ্রুতির বিপরীতে জোতদার বা ধনী কৃষকদের স্বার্থ সংরক্ষণ করা হয়। সাধারণ কৃষকরা তখনও একটি অসম ভূমি অবস্থার চাপ অনুভব করতে থাকেন। এ চাপ পৃষ্ঠপোষকতা পায় এমন একটি নিপীড়নমূলক রাষ্ট্রব্যবস্থায় যার একমাত্র আগ্রহ ছিল অসাধু ভূমি রাজস্ব আদায়ে নিয়োজিত কর্মচারী, কৃষক সম্প্রদায় এর কাছ থেকে বেশি করে রাজস্ব আদায় করা। আরও নানা কারণ স্পষ্ট হয়ে দেখা দেয়।’ (আব্দুল্লাহ ১৯৭৬, সিদ্দিকী, ১৯৮১)

পূর্ব বাংলার কৃষিখাতে কোনো বিনিয়োগ না করে তারা কৃষকদের প্রতি অবহেলা-বৈষম্য সৃষ্টি করতে থাকে। এছাড়া"পূর্ব পাকিস্তানের কৃষি ও অবকাঠামো উন্নয়নে খুব একটা সরকারি বিনিয়োগ করা হয়নি, যা খাদ্য উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণতা নিশ্চিত করতে পারত। বরং এখনকার উদ্ধৃত খাদ্য থেকে অর্জিত অর্থ পশ্চিম পাকিস্তানের উন্নয়নে ব্যবহৃত হচ্ছিল। আর পূর্ব পাকিস্তানের গ্রামাঞ্চলে একটি সীমিত ক্ষমতার ভিত্তি তৈরীর সংকীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি আরো পাকিস্তান সরকার পৃষ্ঠপোষকতা দিয়ে যাচ্ছিল জোতদার ও উদ্বৃত্ত কৃষক শাসিত ক্ষমতাকে লোক দেখানো কিছু কর্মসূচি যেমন ভি-এইড , গ্রামীণ গৃহায়ন কর্মসূচি, কুমিল্লা মডেল এর মত সমবায়, থানা সেচ কর্মসূচি ইত্যাদি গ্রামের ধনী আর শক্তিশালী এলিটদের আরো শক্তিশালী করে চলছিল।’ (সোবহান,১৯৯২)

বাংলার কৃষক দরদী নেতা বঙ্গবন্ধুর তা বুঝতে দেরি হয়নি। পাকিস্তান সৃষ্টির এক বছর পূর্তিতে বঙ্গবন্ধুর বক্তব্য থেকেও এর পরিষ্কার প্রমাণ পাওয়া যায়। বঙ্গবন্ধু তখন থেকেই রাজনৈতিক মঞ্চ-ময়দানে বৈষম্য ও বঞ্চনাগুলো বাংলার কৃষকের দোরগোড়ায় পৌঁছে দিতে শুরু করেন। ফলে গ্রামে-গঞ্জেও তখন বেশি বেশি বঞ্চনার বিষয়গুলো আলোচিত হতে থাকে। সাধারণ কৃষক সমাজ তখন থেকে উপলব্ধি করতে থাকেন, স্বাধীনতা ছাড়া পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর নিপীড়ন বৈষম্য কোনো দিন বন্ধ হবে না। তখন পূর্ব পাকিস্তানে শতকরা ৯০ ভাগ লোকই ছিল প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে কৃষির উপর নির্ভরশীল। কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীরাও ছিল বেশিরভাগই কৃষিনির্ভর গ্রামীণ মধ্যবিত্ত পরিবারের।তাদের খরচও আসতো কৃষিভিত্তিক পরিবারের আয় থেকে।ফলে ছাত্র সমাজ শাসক শ্রেণির বিরুদ্ধে আন্দোলন সংগ্রাম শুরু করে।কৃষি ও কৃষকদের প্রতি শুরু থেকেই নানা বৈষম্য- উদাসীনতা নিয়ে পূর্ব পাকিস্তানের ছাত্র -শ্রমিক-কৃষকেরা মনের মধ্যে এই জমানো ক্ষোভ পোষে রাখে

পশ্চিমা শাসকগোষ্ঠীর চাপিয়ে দেয়া নানা অর্থনৈতিক বৈষম্যের কারণে কৃষিপ্রধান পূর্ববাংলার কৃষকদের অবস্থা আরও দরিদ্র হয়ে ওঠে। দরিদ্র ভূমিহীনদের সংখ্যা দিন দিন বাড়তে থাকে। বাংলায় তখন খাদ্য সংকট ও অভাব নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়। ঘরে ঘরে অভাব-অনটন খাদ্যসঙ্কট লেগেই থাকত। খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত না করা, এমনকি দুর্যোগেও পূর্ব বাংলার জনগণের প্রতি অমানবিক আচরণগুলো কৃষকদের মনে গভীর আঁচর কাটে। বাঙালি জাতির এই দুর্দিনে মুখ বুজে চুপ থাকতে পারেননি শেখ মুজিবুর রহমান। এসব অন্যায় বৈষম্যের বিরুদ্ধে বাঙালি জাতির মুক্তির পথ প্রদর্শক এর ভূমিকায় অবতীর্ণ হন তিনি। সারা বাংলায় কৃষকদের প্রতি তথা সাধারণ জনগণের প্রতি পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর বৈষম্য অন্যায় শোষণগুলো বাংলার ঘরে ঘরে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিতে থাকেন। তারা সচেতন হয়ে ওঠে। রাজনীতিতে তখন কৃষকদের নিকট তিনি হয়ে ওঠেন একজন একক জনপ্রিয় নেতার মত। কৃষকদের দাবি-দাওয়া, অভাব, দারিদ্র,কৃষকদের প্রতি পশ্চিমা শাসকগোষ্ঠীর প্রতিটি আচরণের প্রতিবাদ তিনি করতে থাকেন, বাংলার কৃষকদের একজন মুখপাত্র হয়ে উঠেন তিনি।

১৯৫৪ সালের নির্বাচনে যুক্তফ্রন্ট কৃষকদের ভোটে জয়ী হলেও যুক্তফ্রন্ট সরকার কৃষকদের দাবিগুলো বাস্তবায়ন করতে ব্যর্থ হয়। এর কারণঅবশ্য জানা ছিল বাংলার কৃষকদের। এছাড়া বঙ্গবন্ধুর ছয় দফাও তৈরি হয়েছিল বাংলার কৃষকদের অর্থনৈতিক মুক্তির লক্ষ্যকে উদ্দেশ্য করেই।১৯৬৯ গণঅভ্যুত্থানেও কৃষকদের প্রতি পশ্চিমা শাসকগোষ্ঠীর অন্যায় অবিচারগুলোর প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ প্রভাব ছিল । ১৯৬৯ সনে ছাত্রদের ১১দফা দাবির মধ্যে কৃষকদের দাবিও অন্তর্ভুক্ত ছিল। মুক্তিযুদ্ধের আগে থেকেই সংবাদপত্রগুলোও কৃষকদের প্রতি অবহেলা, অবজ্ঞা, উদাসীনতা আর বৈষম্যগুলো গুরুত্ব সহকারে তুলে ধরে বাংলার কৃষকদের মনে স্বাধীনতার আকাঙ্খাকে জাগ্রত করতে সহায়ক ভূমিকা রাখে।

এইভাবে পূর্ব বাংলার কৃষকরা নিজেদের অধিকার সম্পর্কে সচেতন হয়ে ওঠে। ক্ষমতাসীন শাসকদের প্রতি অসন্তুষ্ট মনোভাব পোষণ থেকে আত্মঅধিকারের চেতনা তাদের মধ্যে গড়ে ওঠে। ফলে বাংলার সংখ্যাগরিষ্ঠ কৃষকসমাজ বৈষম্য থেকে চিরতরে মুক্তির জন্য এক ধরনের সুযোগের অপেক্ষায় থাকে। বাংলার কৃষক শ্রমিক ছাত্র জনতা তাদের প্রাণ প্রিয় নেতার চুড়ান্ত ডাকের অপেক্ষা করতে মানসিকভাবে প্রস্তুত হয়ে যায়।সঠিক নেতৃত্বের অভাবেই কৃষকদের পুর্বপুরুষরা ২০০ বছরে বারবার রক্ত দিয়েও নিজেদেরকে শাসন-শোষণের হাত মুক্ত করতে পারেনি,এটা তাদের অজানা ছিল না। তবে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বের প্রতি তাদের ছিল অবিচল আস্থা, যা অর্জন করতে বঙ্গবন্ধু সক্ষম হয়েছিলেন দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে নানা ত্যাগ ও নির্যাতন সহ্য করে। এই জন্য তাঁর নেতৃত্ব নিয়ে বাংলার কৃষকের মনে কোনো সংশয় ছিল না।

মুক্তিযুদ্ধে কৃষক: পূর্ব পাকিস্তানের আপামর কৃষক-শ্রমিক-জনতা তথা বাঙালিজাতি শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে ঐক্যবদ্ধ এবং একটি স্বাধীন জাতিসত্তার স্বপ্নে বিভোর ছিল।অবশেষে ১৯৭০ এর নির্বাচনের পর সারাদেশে সর্বস্তরের জনতা তখন পশ্চিম পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে জেগে উঠে। শুধু বঙ্গবন্ধুর ডাকের অপেক্ষা।এভাবেই প্রেক্ষাপট তৈরি হয়ে যায় স্বাধিকার আন্দোলনের। বঙ্গবন্ধু বাঙালিজাতির মুক্তির জন্য অত্যাচার-সংগ্রাম সহ্য করেও, আপস না করার কারণে সমগ্রজাতি তাঁর নেতৃত্বে আশার আলো দেখতে পায়। পরাধীনতার গ্লানি থেকে মুক্তির প্রহর গুনতে থাকে। ১৯৭০ নির্বাচন সে সুযোগ এনে দিলেও পাকিস্তানি শাসকেরা নতুন ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়।

অবশেষে নানা ঘটনাক্রমে ১৯৭১ এর ৭ মার্চ, অগ্নিঝরা মার্চেই বাংগালি জাতি চুড়ান্ত সিদ্ধান্তে উপনীত হয়। বাঙালির মহান নেতা বজ্রকন্ঠে সেদিন কোন ভয়ডঢ় ছাড়াই ঘোষণা করেন : "এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম’’বাঙালিজাতি তার মহান নেতার ভাষণ শোনার জন্য তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানে ‘জয় বাংলা’ স্লোগানে বাঁধ ভাংগা জোয়ারের মত আকাশ বাতাস কাঁপিয়ে তুলেছিল।সেদিন তাদের মধ্যেও বেশিরভাগই ছিল বাংলার কৃষক তথা সাধারণ মানুষ। তিনি ভালোবাসার আস্থার জায়গা থেকেই জনগণের উদ্দেশ্যে বলে উঠলেন`` যার যা আছে তাই নিয়ে যাবে ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোল।`` বঙ্গবন্ধু সারা বাংলার কৃষক শ্রমিক জনতাকে দিকনির্দেশনা দেন। মুক্তির এরকম অকুতোভয় আহবানে সমগ্র জাতি লড়াইয়ের জন্য জেগে ওঠে।

মুক্তিযুদ্ধে কৃষকদের সমর্থনই ছিল বঙ্গবন্ধুরশক্তির জায়গা । কারণ বাংলার কৃষকের রক্তে মিশে আছে শতাব্দীর পর শতাব্দী শোষণ-বঞ্চনার গ্লানি আর অন্যায়ের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করার অদম্য সাহস। মুক্তিযুদ্ধে ঐক্যবদ্ধভাবে কৃষকেরা অংশগ্রহণের জন্য প্রস্তুত হয়েই ছিল। এর পেছনের কারণ ছিল একটাই,বঙ্গবন্ধুর প্রতি বাংলার কৃষকের ভালোবাসা, পশ্চিম পাকিস্তানের বিরুদ্ধে প্রতিশোধ স্পৃহা,আর নিজেদেরকে পরাধীনতার গ্লানি থেকে চির মুক্তি। একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্য বাংলার কৃষককে যে কোনো সময় লড়াইয়ের জন্য প্রস্তুতও করেছিলেন বংগবন্ধু-ই।

বয়োবৃদ্ধ ব্যতিত গ্রামের সাধারণ কৃষকরা বঙ্গবন্ধুর ডাকে তাই মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তে কোন দ্বিধাবোধ করেননি। তাঁর আহবানে সেদিন কৃষকদের স্কুল-কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া ৯০ ভাগ ছেলেরাই মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন। মোটাদাগে যদি বলা যায় মুক্তিযুদ্ধ এদেশের কৃষকদের অংশগ্রহণ ছিল সবচেয়ে বেশি। তাদের অংশগ্রহণ ছিল সতস্ফুর্ত। গ্রামের একেবারে তৃণমূলে বয়োবৃদ্ধ এবং পাকিস্তানীদের দেশীয় মুষ্টিমেয় দোসর রাজাকার-আলবদর ছাড়া গ্রামের প্রতিটি কৃষক পরিবার কোন না কোনভাবে যুদ্ধে অংশ নেয়।মুক্তিযুদ্ধে অবদান ছিল ব্যাপক এবং বহুমাত্রিক। মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয় দিয়ে, কেউ কেউ গেরিলা যুদ্ধে অংশ নিয়ে, কেউবা তথ্য সংগ্রহ করে সহায়তা যুদ্ধে ভূমিকা রাখে ।মুক্তিযোদ্ধা শিক্ষিত যুবদের মধ্যেও গ্রামের কৃষকের সন্তানই ছিল সবচেয়ে বেশি।

মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয় দেয়াও ছিল তখন নিজ পরিবারসহ নিশ্চিত মৃত্যুর ঝুঁকি। তবু বাংলার কৃষক সমাজ একাত্তরে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে সন্দেহাতীতভাবে স্বাধীনতা সংগ্রামে জীবন বাজি রেখে ভূমিকা রেখেছেন। কৃষক পরিবারের মায়েরা পর্যন্ত মাতৃস্নেহে অন্যের সন্তানকে নিজ সন্তানের মতোই গোপনে খাবার দিয়েছেন, আশ্রয় দিয়েছেন। নিজের বুকের প্রিয় সন্তানকে কিংবা স্বামীকে মুক্তিযুদ্ধে যাওয়ার জন্য সাহস যুগিয়েছেন। কেউ কেউ সরাসরি যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছেন। এজন্য নিজেদের জীবন, সম্ভ্রম, নির্যাতন সহ্য করতে হয়েছে বাংলার মা-বোনদের।

মুক্তিযুদ্ধে কৃষকের সন্তানেরাই যেমন বেশি জীবন দিয়েছে,তেমনি ক্ষয়ক্ষতির বিবেচনায়ও তাদের ক্ষতিই বেশি হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে এজন্য বেশিরভাগই ছিল বাংলার কৃষকের সন্তান ;শিক্ষিত ছাত্র-যুবক, শ্রমিক,কামার,কুুলি,মাঝিসহ সব পেশার অংশগ্রহণ ছিল সবচেয়ে বেশি। এদের মধ্যে যারা সরাসরি যুদ্ধে অংশ নেননি তারাও বসে থাকেননি। তাদের প্রায় সবাই পরোক্ষভাবে মুক্তিযুদ্ধ এবং মুক্তিযোদ্ধাদের সব রকম সহায়তা দিয়েছেন। জীবনের ঝুঁকি থাকা সত্ত্বেও কেউ কেউ কৃষি উৎপাদন অব্যাহত রেখে ধ্বংসপ্রাপ্ত দেশকে দুর্ভিক্ষ হতে রক্ষা করেছেন। মুক্তিযুদ্ধে সহায়তা করাও ছিল সমান অপরাধ। এজন্য সহায়তা করা বা নিজ সন্তান মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেওয়ার অপরাধে গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে দেয়া হয়েছে। কৃষকদের বাড়িঘর পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে। মা-বোনদেরকে সম্ব্রম হারাতে হয়েছে,জীবন দিতে হয়েছে সন্তান মুক্তিযুদ্ধে যাওয়ার অপরাধে।

অনেক কৃষক পিতা পাক হানাদারদের হাতে নিশংসভাবে নির্যাতিত হয়ে প্রাণ দিয়েছেন। সংখ্যার হিসাবেও মুক্তিযুদ্ধে গ্রামের কৃষকের দামাল ছেলেরাই বেশি শহীদ হয়েছেন। এদের অবদানের সঠিক ইতিহাস কেউ লেখেনি। এখনো এসব কৃষক পরিবারের আত্মত্যাগের পরিসংখ্যান, ইতিহাস পুরোপুরি আমাদের জানা নেই।কৃষক পরিবারের কত মা-বোনকে এজন্য সম্ভ্রম হারাতে হয়েছে, জীবন দিতে হয়েছে,তার কোনো হিসাব নেই। আমরা এজন্য বলতে পারি মুক্তিযুদ্ধে তাদের অবদান ছিল সামগ্রিক। মুক্তিযুদ্ধে এদেশের সাধারণ কৃষক-জনতার বীরত্বগাথা, কৃষকের অংশগ্রহণও ছিল সাহসী,স্বতস্ফূর্ত এবংবহুমাত্রিক।

১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে কৃষকদের অবদান প্রসঙ্গে আইন কমিশনের চেয়ারম্যান ও সাবেক প্রধান বিচারপতি এবিএম খায়রুল হক যথার্থই বলেছেন-‘যারা রাইফেল দেখেননি তারা ও মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন। কৃষকরা গৃহযুদ্ধে জড়িয়ে পড়েছিলেন। তাদের বীরত্ব কোন জেনারেল ফিল্ড মার্শাল এর চেয়ে কম ছিলনা। তারা হয়তো কোন পদক পান নি, তারা কোন সেক্টর কমান্ডার ছিলেন না, কিন্তু এটাই তাদের শ্রেষ্ঠ বীরত্ব যে, তারা যখন যুদ্ধে গিয়েছিলেন তারা জানতেন না, সেখান থেকে ফিরবেন কিনা।’

মহান মুক্তিযুদ্ধে সংগ্রামী কৃষকদের সঠিক অবদান, অংশগ্রহণ, সমর্থন এবং বীরত্বগাঁথার ইতিহাস জানতে আরও গবেষণার প্রয়োজন। আমাদের স্বাধীনতার ইতিহাসে এখনো বাংলার কৃষকের অবদানের ন্যায্য স্বীকৃতি আজো চোখে পড়ে না। ত্রিশ লক্ষ প্রাণ মা বোনের ইজ্জতের বিনিময়ে অবশেষে ১৯৭১, ১৬ই ডিসেম্বর বাঙালি জাতি বাংলাদেশ নামক যে স্বাধীন রাষ্ট্র লাভ করে, প্রকৃতপক্ষে সেখানে বাংলার কৃষক পরিবারের রক্তের দাগ-ই বেশি লেগে আছে।

মুহম্মদ র ই শামীম: গবেষক। লেখকের ‘বাংলার কৃষকমুক্তির মহানায়ক-বঙ্গবন্ধু’ বই থেকে সংকলিত

বহুমাত্রিক.কম

Walton Refrigerator Freezer
Walton Refrigerator Freezer