Bahumatrik | বহুমাত্রিক

সরকার নিবন্ধিত বিশেষায়িত অনলাইন গণমাধ্যম

চৈত্র ১৩ ১৪৩০, বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪

শ্রদ্ধার্ঘ

মাথাউঁচু সেই বাঙালি বিচারক ও তাঁর ‘ষোলআনা’

ড. জয়ন্ত চৌধুরী

প্রকাশিত: ২১:২৭, ১৮ এপ্রিল ২০২১

আপডেট: ০০:৫০, ১৯ এপ্রিল ২০২১

প্রিন্ট:

মাথাউঁচু সেই বাঙালি বিচারক ও তাঁর ‘ষোলআনা’

ছবি: লেখক

শনিবার রাতে (১৭ এপ্রিল ২০২১) প্রয়াত হন মুখার্জী কমিশনের চেয়ারম্যান বিচারপতি মনোজ কুমার মুখার্জী। তাঁকে নিয়ে স্মৃতিচারণ করেছেন ড. জয়ন্ত চৌধুরী...

ছয় বছর অক্লান্ত পরিশ্রম করেছেন তিনি, প্রথম বছর কমিশনের স্থায়ী ঠিকানা খুঁজে পেতেই চলে যায়। নিউমার্কেটের কাছে খাদ্য ভবনে তৎকালীন ডেপুটি স্পিকার অনিল মুখোপাধ্যায়ের চেষ্টায় সাত তলায় একদিকে কমিশনের স্থায়ী ঠিকানা হয়। প্রথম থেকেই অত্যন্ত স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে এক সদস্যের এই কমিশন কাজ করলেও সঙ্গে পান বিচারক এন. কে. পাঁজা, কমিশন সেক্রেটারি জাস্টিস মিঃ পি কে সেনগুপ্ত এবং কোট মাস্টার চিত্তমোহন চট্টোপাধ্যায় এর মত নিষ্ঠাবান পরিশ্রমী মানুষদের।

আমি কমিশনে তৃতীয় ডিপোনেন্ট ছিলাম। পরবতী কালে ডিপোনেন্টদের সংখ্যার পাশাপাশি কাজের বিস্তার লাভ করে। অনেক স্মৃতি আজ ভিড় করে আমাকে। মহাজাতিসদনের অ্যানেক্স বিল্ডিং এর তিনতলার হল ঘরে মাসে এক বার দু’বার করে অধিবেশন বসতো। ঘড়ি ধরে ঠিক সময় মতো উনি প্রবেশ করতেন। হল ঘরে সমবেত সবাই শ্রদ্ধায় দাঁড়িয়ে উঠতো। সাধারণত সামনের সারিতেই আমরা বসতাম। মঞ্চে থাকতেন টিম মুখার্জী। ঘটনাচক্রে নানা সূত্রে টিম মুখার্জীর সঙ্গে ঘনিষ্টতা গড়ে উঠে। নেতাজিতথ্য আদানপ্রদানের অন্য প্রসঙ্গ। 

জাস্টিস মুখার্জী সাক্ষীদের সরাসরি প্রশ্ন করতেন এবং ডিপোন্যান্টদের সুযোগ দিতেন। পয়েন্ট করে সুনির্দিষ্ট করতাম বলে আমাকে যেন একটু বেশি সুযোগ করে দিতেন কখনও কখনও। আজ স্মৃতি হয়ে গেছে বহু ঘটনা। তৎকালীন কেন্দ্রীয় সরকারের ক্রমাগত নানা বিষয়ে তাঁর সঙ্গে অসহযোগিতায় তাঁকে ক্ষুব্ধ হতে দেখেছি। কেন্দ্র সরকারের প্রতিনিধি যখন উপস্থিত থাকতেন অধিবেশন কক্ষে তিনি বহু ফাইল বার বার চেয়ে না পাওয়ার কথা জানাতেন। স্ট্যাটাস রিপোর্টগুলো আজও তার সাক্ষ্য বহন করে। অধিবেশন শেষে সবাই দাঁড়িয়ে উঠতো, উনি বেরিয়ে যেতেন।

লাইব্রেরি রুম সংলগ্ন কক্ষে প্রেসমিট করতেন। সেখানেও উপস্থিত থাকতাম। সেক্রেটারিকে কখনও তথ্য সরবরাহ কিংবা সাংবাদিক হিসেবে প্রশ্ন-দুটোই করার সুযোগ পেয়েছি। মনে পড়ে এক প্রেসমিটের দিন এক দৈনিকে প্রকাশিত হয় জনৈক বিদেশিনী অ্যানিটা পাফ জানিয়ে দিলেন যে, ভারতের মতো গরীব দেশে মুখার্জী কমিশন করা অর্থহীন। তাঁর বাবা বেঁচে থাকলে অখুশি হতেন ইত্যাদি। এ ব্যাপারে প্রশ্ন করায় জাস্টিস মুখার্জী স্পষ্ট ভাষায় উত্তর দিয়ে দিলেন, ‘কে কী মন্তব্য করলো তা নিয়ে উত্তর দেওয়া কমিশনের কাজ নয়।’

কমিশনের উপর অসম্ভব চাপ ছিল ঘরে ও বাইরের। বিশেষ করে ডিএনএ টেস্টেও জন্য সেদিন বসু পরিবারের কেউ একফোঁটা রক্ত দিতে রাজি হলেন না। খুব অসহায় দেখেছি সেদিন জাস্টিস মুখার্জীকে। পরবর্তীকালে নানা লেখালেখির চাপে পরিস্থিতি বদলে যায়। দাবিদার পরিবারের অনেকেই কমিশনে এসে সাক্ষ্য দিতে চাইতেন না, বিদেশ যাবার অনুমতি পেতে কেন্দ্র বার বার অসহযোগিতা করতো, ফাইলপত্রে তারা প্রিভিলেজ দাবি করতো সেই মুহুর্তগুলিতে মনোজ মুখোপাধ্যায়কে কড়া হতে দেখেছি।

কোন কোন হ্যান্ডরাইটিং এক্সপার্টদের দায়সারা বিপোর্ট দেওয়াকেও তিনি ভালোভাবে নেননি। তাঁর প্রতিটা কাজেই স্বচ্ছতা চোখে পড়ার মতো, কেউ কেউ তাঁকে রাশিয়ায় নেতাজী হত্যাভাবনায় পরিচালিত করতে চেয়েছিলেন। জাস্টিস মুখোপাধ্যায় রাশিয়া থেকে ফিরে ক্ষোভ প্রকাশ করেছিলেন যে তাকে যা বোঝান হয়েছিল তার সামান্যতম প্রমাণ পাননি তিনি রাশিয়াতে। ২০০৬-এ লোকসভায় তাঁর ঐতিহাসিক রিপোর্ট বাতিল করে তথ্যপ্রমাণ ছাড়াই।

তাইহুকু বিমান দুর্ঘটনা মিথ্য ও চিতাভস্মের কাহিনী সাজানো তা তিনি তিন খণ্ডের রিপোর্টে প্রকাশ করেন। অফ্ ক্যামেরায় জানিয়ে দিলেন, তাঁর ব্যক্তিগত বিশ্বাস ফৈজাবাদের ভগবানজী নেতাজী। সেময় এটির ভিডিও রেকর্ড প্রকাশ্যে আসায় তিনি অপ্রস্তুত হন। নিভৃতবাসে চলে যান। দেশবাসীকে তিনি উপহার দিয়েছে এক বলিষ্ঠ রিপোর্ট। ছয় বছর এই কাজের জন্য তিনি মাসিক বেতন নিতেন মাত্র এক টাকা। তিনিও ষোলআনা দিয়েই চলে গেলেন নানা বিতর্কের উপরে। তিনি সেখানে টিম মুখার্জীর সঙ্গে মিলিত হবেন নিশ্চয়ই। এই মাথাউঁচু বাঙালি বিচারকের জন্য রইল শ্রদ্ধা ও প্রণাম।

লেখক: নেতাজী বিশেষজ্ঞ, নেতাজীর অন্তর্ধান রহস্য উন্মোচনে ভারত সরকার গঠিত ‘মুখার্জী কমিশন’র এর অন্যতম ডিপোন্যান্ট এবং কলকাতার আলিপুর বার্তার সম্পাদক। 

নেতাজীরহস্যে আলো দেখানো সেই মনোজ কুমার মুখার্জীর প্রয়াণ

বহুমাত্রিক.কম

Walton Refrigerator Freezer
Walton Refrigerator Freezer