Bahumatrik | বহুমাত্রিক

সরকার নিবন্ধিত বিশেষায়িত অনলাইন গণমাধ্যম

চৈত্র ১৪ ১৪৩০, শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪

ভয়, গুজব এবং রহস্যের প্রাণী টিকটিকি

শওকত আলী বেনু

প্রকাশিত: ১৩:০৫, ১২ আগস্ট ২০১৪

আপডেট: ১০:০৩, ১৩ আগস্ট ২০১৪

প্রিন্ট:

ভয়, গুজব এবং রহস্যের প্রাণী টিকটিকি

লন্ডন থেকে: টিকটিকি আমি খুব একটা ভয় পাইনা। তবে ঘুমের মধ্যে ধপাস করে শরীরের কোথাও ছিটকে পড়লে আর রক্ষা নেই । ঘুম ভেঙ্গে ঘেন্নায় চিতপটাং হয়ে যাই। শিরশির করে উঠে গায়ের লোমগুলো । কেমন যেন খসখসে এবং কিছুটা হিমশীতল স্পর্শ । এক রাত্রের কথা বলি। ঘুমের ঘোরে আঙ্গুলের ঘষা খেয়ে টিকটিকি একটা ফটাস করে ফেটে গিয়েছিল একবার । সেই কী বিচ্ছির অবস্থা । এমনটি আর দুইবার না হলেও ধপাস করে গায়ে পরার কাহিনী ঘটেছে একাধিকবার ।

টিকটিকি নিরীহ হলেও অনেকেই টিকটিকি দেখলে ভয় পায় । বিশেষকরে ছোট বেলায় এমন ভয় অনেকেরই থাকে । আমারও ছিল। তাতে দোষের কিছু নেই । টিকটিকি দেখতে অনেকটা কুমীরের মত হলেও টিকটিকি বেশ নিরীহ । আর কুমীর অতি ভয়ংকর।

একটা ছোট্ট কাহিনী বলি । একবার যশোরে গিয়ে একটি সরকারী ট্রেনিং ইনস্টিটিউট-এ সপ্তা চার থেকেছিলাম । একান্তই অফিসের কাজে। তিনতলা বিল্ডিং এর নিচতলায় আমাকে থাকতে দেয়া হয়েছিল । বোধহয় ওই সময় ট্রেনিং এর আকাল চলছিল তাই জনশূন্য নিচতলায় আমিই অধিপতি । কেন্টিনের দুইচারজন বয়-বেয়ারা ছাড়া আর কাউকে দেখা যায়নি ওখানটায়। এক রাত্রের কাহিনী এটা । গরমের ঠেলায় রাত্রের ঘুম হারাম । যদিও হালাল খেয়ে ঘুমোতে গিয়েছিলাম। মশারির ভিতরে রক্ত চোষা পোকাগুলোর কী বাহাদুরি আর উপদ্রপ ছিল ওইদিন না দেখলে বোঝানো যাবেনা।

আমাকে একা পেয়ে ছেড়াবেড়া করে দিল। মানে, ছেড়া মশারির ভিতর ওদের গুঞ্জন এবং পুটুস-পাটুস কামড়ানি আমাকে নাস্তানাভূত করে ছাড়লো।অস্থির হতে হতে এক পর্যায়ে নিস্তেজ হওয়া ছাড়া আমার আর উপায় ছিলনা। সরকারী মালের এই দশা তা আমার আগে জানা থাকলেও সেইবার প্রত্যক্ষ করেছিলেম নিজে ভুক্তভোগী হয়ে। ওই মশারিটা বেশ কয়েক জায়গা দিয়ে ফুটো ছিল।

বাইরের পূর্ণিমার আলোতে হঠাৎ ঘরের দেয়ালে চোখ পরতেই ভয়ে শরীরের লোম খাড়া হয়ে গেল । দেয়ালে ধুসর বর্ণের নাদুসনুদুস ছয় সাত ইঞ্চি পরিমান লম্বা কী যেন একটা নড়াচড়া করছে । আবছা আলোতে মূহুর্তের মধ্যেই ধপাস করে মশারির উপর পরে গেল । আমার নিস্তেজ দেহ আরো নিস্তেজ হয়ে পড়লো মশারির উপর ভারী কিছু একটা দেখতে পেয়ে। আচমকা কিছুই ভাবতে না পেরে গভীর রাত্রে নিমিষেই মেষ হয়ে গেলাম।

মেষ মানে ভেড়া । কেউ বলে মেড়া । এই ভেড়া নাকি রাশিচক্রের প্রথম রাশি । আমি মকর রাশির জাতক হলেও জীবনে এই প্রথম কিছুক্ষণের জন্যে হলেও রাশিচক্রে প্রথমস্থান দখল করেছিলাম । একা একা প্রথম হওয়ার মজাটাই আলাদা । যদিও গভীর রাতে মেড়া-ভেড়া সেজে । মেড়া নিস্তেজ ও নিরীহ প্রাণী । ছিঃ আমি এখন মেষ ! মানে ভেড়া । এটা কী করে হয় ? নিমিষে অনিমেষ নয়নে স্থির করে ফেলি ওটা একটা টিকটিকি ।

ওই রাত্রে একটি নিরীহ প্রাণীর সঠিক আবিষ্কার ছিল আমার একটি দুর্দান্ত কর্ম । যদিও আমি ভেড়ার মতই কিচ্ছুক্ষণ নিরীহ ও নিস্তেজ থেকেছিলাম।

টিকটিকি নিয়ে গল্পের শেষ নেই । এই যেমন ধরুন কোনো কথা বলার সময় পাশে বসে থাকা টিকটিকি টুক... টুক.. করে শব্দ করলে আমরা বলে থাকি `কথাটি সত্য`- তাই টিকটিকি সায় দিচ্ছে । অনেকে আবার অমঙ্গলসূচক শব্দ ভেবে ভয়ও পেয়ে থাকে । এমন ভয় পেতে আমি অনেককেই প্রত্যক্ষ করেছি । বিশেষ করে নারীদের ক্ষেত্রে এই ভয়টা প্রবল ।এই নিরীহ প্রাণীটা সত্য-মিথ্যার পার্থক্য না বুঝলেও আমরা ধরে নেই টিকটিকি সত্য অনুধাবন করতে পারে। আসলে কী তাই?

এটাই যদি সত্যি হতো তাহলে টিকটিকি দিয়ে সত্য মিথ্যে নির্ণয় করার জন্যে এই নিরেট ভদ্র প্রাণীটির চাষাবাদে দুনিয়া জোড়া ধুম পরে যেত । আর টিকটিকির অকাল নির্মম মৃত্যু ও বিলুপ্তিও এইভাবে ঘটত না। কিংবা মোসাদের মত তুখোর গোয়ন্দা নজরদারী ছাড়াই সত্য-মিথ্যা বের করে ফেলা যেত শুধু টিকটিকি ভাড়া করে ।

রাজ-রাজাদের মধ্যে টিকটিকির কদর বেড়ে যেত রাজ্যে রাজ্যে। অনেকে বলেন টিকটিকি মারলে নাকি নেকী বাড়ে ! আল্লাহই মালুম ।

টিকটিকি সত্যের অনুসন্ধান দিতে না পারলেও টিকটিকি নিয়ে সত্য-মিথ্যার গুজবের শেষ নেই । টিকটিকি নিয়ে একটা মজার গুজব ছড়িয়েছিল একবার ফিলিপাইনে । গুজবটি বেশ প্রকট আকার ধারণ করেছিল সেইসময় । একটি অনলাইনে হঠাৎ সংবাদ ছড়িয়ে পড়ে চিকিৎসা হিসেবে এইডস এবং অ্যাজমা প্রতিরোধে নাকি টিকটিকির ব্যবহার করা হচ্ছে । এবং খুব চড়া দামে বিক্রি হচ্ছে এই টিকটিকি । সেই থেকে ফিলিপাইনে শুরু হয়ে যায় উন্মাদের মত টিকটিকি ধরপাকড় ।

টিকটিকি ধরতে না পারলেও অনেকেই তার লেজ টুকু সংগ্রহ করতে পেরেছিল বিনা পরিশ্রমে । টিকটিকির লেজ পেতে কষ্ট হয় না এইটা সবাই জানে । ফিলিপাইনে টিকটিকি ধরার এই উন্মাদনা নিয়ে ওইদেশের স্বাস্থ্য ডিপার্টমেন্টকে জরুরী বিবৃতি জারী করতে হয়েছিল যে, এটা একটা ভুয়া প্রচারণা।

গুজবের শেষ নেই । নারীর গর্ভে জন্ম নিয়েছিল টিকটিকি! এটাও কী বিশ্বাস করা যায়? এমন একটি খবর বের হয়েছিল এইতো কিছুদিন আগে বিশ্বের বৃহত্তম মুসলিম দেশ ইন্দোনেশিয়ায় । দীর্ঘ আট মাস গর্ভে বেড়ে ওঠার পর নাকি এক নারী এটি প্রসব করেছিল। টিকটিকির জন্মদাত্রী মাতাও এ ঘটনায় বিস্মিত ও স্তম্ভিত । এ নিয়ে নানা কথা-বার্তাও শুরু হয়েছিল চারদিকে ।
তবে বিজ্ঞানীরা বলেছেন, এটি মোটেও বিশ্বাসযোগ্য নয় । কারণ পৃথিবীতে এখনো এমন কোন ঘটনা ঘটেনি যে, এক প্রজাতির প্রাণী অন্য প্রজাতির সন্তান প্রসব করবে।

টিকটিকি নিয়ে যতই সত্য-মিথ্যার গুজব ছাড়ানো হোক না কেন এর রক্ত যে সাদা এটা কিন্তু মিথ্যে নয় । খাঁটি প্রমানিত সত্য কথা । এটা কম বেশি সবাই জানে । রক্তের রঙ কেমন হবে তা নির্ভরকরে রক্তের উপাদান- শ্বেতকণিকা, লোহিতকণিকা আর অণুচক্রিকা`র উপর।

লোহিতকণিকায় থাকে হিমোগ্লোবিন, যার রং লাল । মানুষের রক্তে লোহিতকণিকার পরিমাণ বেশি, তাই আমাদের রক্ত লাল দেখায় । বিজ্ঞানীরা দেখিয়ে দিয়েছে টিকটিকির রক্তে শ্বেতকণিকা বেশি আর তাই টিকটিকির রক্ত সাদা হয় । তবে এই সাদা রং ঠিক ধবধবে সাদা নয় । অনেকটা তাদের স্বীয় ত্বকের রঙের কাছাকাছি হয়ে থাকে।

তবে গোপন তথ্য বের করার জন্যে যাদেরকে পিছনে লাগিয়ে দেয়া হয় তাদেরকে টিকটিকি বললেও নিরীহ প্রাণী হিসাবে টিকটিকির চরিত্রে এমনটি আছে কিনা তা আমার জানা নেই । খুঁজে কোথাও পাইনি। এই ধরণীতে টিকটিকির বিলুপ্তি ঘটলেও মানব সমাজে রঙবে রঙের মানবরূপী চ্যালা-চামলা টিকটিকিদের সংখ্যা কী কমে যাচ্ছে? বোধ হয় না।

টিকটিকি নিরীহ হলেও টিকটিকি রূপী চ্যালারা তো নিরীহ নয়। টিকটিকি সত্য অনুধাবন করতে না পারলেও সমাজে কত চেনা অচেনা টিকটিকি ঘুরে বেড়ায় যারা সত্যকে মিথ্যা আর মিথ্যাকে সত্য বলে চালিয়ে দিয়ে আমাকে আপনাকে ধোঁকা দিচ্ছে প্রতিনিয়ত। এদের রক্ত সাদা না হলেও আমরা ক`জনই বা খবর রাখি এদের।

benuশওকত আলী বেনু: বহুমাত্রিক.কম-এর ইউকে এডিটর

বহুমাত্রিক.কম

Walton Refrigerator Freezer
Walton Refrigerator Freezer