প্রায় পাঁচ বছর পর সৃজিতের ছবিতে স্বস্তিকা। স্ক্রিন শেয়ার করলেন পরমব্রতর সঙ্গেও। কোথাও কি কাঁপন ধরাল প্রাক্তন সম্পর্কের অনুরণন? ‘শাহজাহান রিজেন্সি’-র স্বস্তিকা কুণ্ঠাহীন। খুলে দিলেন মনের দরজা।
‘শাহজাহান রিজেন্সি’র ‘কিচ্ছু চাইনি আমি’ গানটা তো দারুণ হিট। আপনি তো তাদেরই দলে যারা বার বার মরে যায়? নাকি?
স্বস্তিকা: না, না একদম না। আমি একদম জ্যান্ত থাকি (হাসি)।
কিন্তু এই ছবিতে আপনাকে দেখলে তো কেউ না কেউ মরে যাবে মনে হচ্ছে (হাসি)।
স্বস্তিকা: কেন! এ আবার কী! (হাসি) আমি যেমন তেমনই তো কাজ করেছি।
সত্যি করে বলুন তো, পরমব্রত, সৃজিত বা সুমন কাউকে মিস করেন না?
স্বস্তিকা: না। আমার মনে হয় বয়সের সঙ্গে সঙ্গে প্রত্যেকেরই একটা ম্যাচিওরিটি আসে। পরম কোনও একটা ইন্টারভিউতে বলেছে দেখলাম, যখন বয়সটা অল্প থাকে, তখন প্রাক্তনের সঙ্গে কাজ করতে একটা কোথাও অস্বস্তি বোধ হয় বা একসঙ্গে কাজ করতে গেলে অসুবিধা হয়। আমার মনে হয় বয়সের সঙ্গে সঙ্গে আমরা আপস করতে শিখে যাই। আমরা সবাই, যারা ‘শাহজাহান রিজেন্সি’-তে কাজ করেছি, কেউ কারও প্রাক্তন বা কেউ কারও বন্ধু। যেমন অনির্বাণের সঙ্গে এটা আমার প্রথম কাজ। ওর প্রচুর কাজ আমি দেখেছি।
আর অনির্বাণ আপনার বন্ধু স্থানীয়ও…
স্বস্তিকা: হ্যাঁ। ওর খুবই ফ্যান আমি। অভিনেতা অনির্বাণকে খুব পছন্দ করি। কিন্তু ওর সঙ্গে কোনওদিন কাজ করিনি আগে তবে কাজের বাইরে অনেকবারই ওর সঙ্গে দেখা হয়েছে। আমরা সবাই কিন্তু খুবই প্রফেশনালি কাজটা করেছি। এটা খুবই শক্ত একটা ছবি। কোনও একটা রোলও নেই, যেটা খুবই হাসতে-হাসতে, খেলতে-খেলতে করে ফেলা যাবে। সেইজন্য শুটিং ফ্লোরে সবাই আসত ব্যক্তিগত জীবনের টানাপোড়েন আলমারিতে তুলে দিয়ে। মনে হয় যার সঙ্গে সম্পর্ক হয়েছে বা হয়েছিল তার জন্য সব মানুষের জীবনেই একটা জায়গা থাকে। তাদের মিস করি বা না করি। কিন্তু অস্বস্তিকর ব্যাপার হচ্ছে যে সম্পর্ক টিকে না থাকলে, একের পর এক নাম সবাই একটা লিস্টে অ্যাড করতে থাকে। সেটা খুবই আনফরচুনেট। খুব অস্বস্তিকর। মানে লালের (সুমন মুখোপাধ্যায়) সঙ্গে যখন সম্পর্ক ছিল, সবাই পরম আর সৃজিতের নাম টেনে আনত। এখন যেমন, লালের নামটাও সেই প্রাক্তনের তালিকায় যোগ হয়ে গিয়েছে। আমি যখন মারা যাব, একটা পুরো পাতা নাম নিয়েই বোধহয় মারা যাব। প্রশ্নটা হবে যে, এই-এই, অমুক-অমক এদের কী হল? (জোরে হাসি)। লিস্টটা ক্রমশ তো বাড়তে থাকে, তাই না?
আসলে একই টলিউড ইন্ডাস্ট্রি তো…
স্বস্তিকা: হ্যাঁ, একই ইন্ডাস্ট্রিতে কাজ করি তো আমরা, ফলে একই ছবিতে কাজ না করলেও, যে কোনও সময়েই দেখা হয়ে যেতে পারে, যায়ও। যাদের সঙ্গে কোনও না কোনওদিন সম্পর্ক ছিল, তারা কেউ অন্য শহরে চলে গিয়েছে, কেউ বা প্রফেশন চেঞ্জ করে ব্যাংকে চাকরি করছে বা ডাক্তারি করছে সেরকম তো নয়। আমরা একই ফিল্ডে আছি, যে যা কাজ করত সেই কাজই করছে। মনে হয়, ম্যাচিওরিটি তো এটাতেই আছে যে, দেখা হলে যাতে ‘কী গো ভাল আছ?’ বা ‘কী রে ভাল আছিস?’ সেটুকু জিজ্ঞেস করার মতো জায়গা যেন প্রত্যেকটা মানুষের থাকে। মনে করি সেটা যথেষ্ট ডিসেন্সি বা ম্যাচিওরিটির লক্ষণ। এটা আমি করেছি। বাকিরা তাদের জীবনে তাদের মতো করে আছে। আমি আমার মতন করে আছি। যেটা বললাম, যাদের সঙ্গে সম্পর্ক আছে বা যাদের সঙ্গে সম্পর্ক ছিল, বা যাদের সঙ্গে সম্পর্ক কোনওদিনই নেই, মনে হয় প্রত্যেকের জন্যই একটা আলাদা জায়গা সবার জীবনে থাকে। সৃজিতের জায়গায় পরম কোনওদিনই আসবে না। আবার সৃজিতের জায়গায় লালকে ইনক্লুড করার কোনও মানে নেই। উচিতও নয়। কারণ প্রত্যেকের সঙ্গে আমার সম্পর্কের স্টেজ তো এক ছিল না। কারও সঙ্গে হয়তো এক বছরের সম্পর্ক ছিল। কারও সঙ্গে পাঁচ বছরের। কাজেই একই স্পেসে তিনজনকে তো ফেলা যাবে না।
তবু জিজ্ঞেস করি, প্রাক্তনদের সঙ্গে এক ছবিতে কাজ করা, একজন আপনাকে ডিরেক্ট করছেন, অন্যজন সহ অভিনেতা। মানে সৃজিত এবং পরমব্রত। তো এইটা কখনও শুটিংয়ে অস্বস্তি তৈরি করেনি? বা ডিফিকাল্ট মনে হয়নি?
স্বস্তিকা: না, একদমই না। ‘শাহজাহান রিজেন্সি’-র আগেও সৃজিত অন্য ছবির জন্য আমাকে যোগাযোগ করেছিল। সেই রোলগুলো আমার করার মতো মনে হয়নি বলে আমি করিনি। কিন্তু এই ছবির ‘কমলিনী’ চরিত্রটা এমন যে, একজন অভিনেত্রী হয়তো তার পুরো কেরিয়ারেই এমন রোল পায় না। শুধু সেই জায়গা থেকেই আমি এই ছবিতে কাজ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। যে পরিচালক, তার সঙ্গে আমার কোনওকালে একটা সম্পর্ক ছিল বলে, সেটাকে প্রায়োরিটি দিয়ে এত লোভনীয় একটা চরিত্র হাতছাড়া করে দেব? আমার মনে হয় না তার কোনও প্রয়োজন আছে। ইনফ্যাক্ট, যখন ‘ভূতের ভবিষ্যৎ’-এ কাজ করেছিলাম, পরমের সঙ্গে সবে ব্রেক আপ হয়েছে তখন। যদি কেউ বলত, ওর সঙ্গে ব্রেকআপ হয়েছে বলে, ছবিটা করা উচিত নয়, তাহলে যেটা হত- অভিনেত্রী হিসেবে ‘ভূতের ভবিষ্যৎ’ ছবিটা আমার কেরিয়ারে থাকত না। সেটা কি ঠিক হত? এতে সবারই লস হত। আমারও, দর্শকেরও।
অনেকদিন পরে সৃজিত মুখোপাধ্যায়ের ছবিতে কাজ করলেন। ব্যবহারে কেমন বদল চোখে পড়ল?
স্বস্তিকা: অ্যাকচুয়ালি পাঁচ বছর পর সৃজিতের সঙ্গে কাজ করলাম। পরমের সঙ্গেও বহুদিন পর। আসলে অনেকের সঙ্গেই অনেকদিন পর কাজ করলাম। কিন্তু শুধু ওই প্রাক্তনদের টেনে এনেই কথা বলা হচ্ছে। ইনফ্যাক্ট, ২০১১-র পরে এই আবার আবিরের সঙ্গে কাজ করলাম। পরমের সঙ্গেও ‘মাছ মিষ্টি মোর’-এর পর এবার কাজ করলাম।
বলছি এই জন্য যে, ‘জাতিস্মর’-এর পরে তো আর সৃজিত মুখোপাধ্যায়ের পরিচালনায় কাজ করেননি।
স্বস্তিকা: হ্যাঁ, ঠিক। বদল কী কী ঠিক বলতে পারব না। কারণ, আমার হিন্দি ছবিটার শুটিং আর এই ‘শাহজাহান’-এর শুটিং একই সঙ্গে করছিলাম। আগস্ট মাসে। আমি জামশেদপুর, রাঁচি, কলকাতা প্রায় ডেলি প্যাসেঞ্জারি করছিলাম, হিন্দি ছবিটায় আমার যেরকম চরিত্র আর ‘শাহজাহান’-এ যেমন চরিত্র, দুটো পোল্স অ্যাপার্টও বলা যায় না। ইউনিভার্স অ্যাপার্ট! সেই জন্য আমি আর অন্য কোনও দিকে মাথা দিতে পারিনি। কার মধে্য কতটা বদল হয়েছে কিচ্ছু আমার মাথায় রেজিস্টার করেনি। আমি জাস্ট চেয়েছিলাম, আমার অভিনয়ের ক্ষেত্রে সব বল যেন মাঠের বাইরে পাঠাতে পারি। দ্যাট ওয়াজ মাই অনলি কনসার্ন। কিন্তু নিশ্চয়ই, ২০১৩-র একজন পরিচালক, ২০১৮-তেও একইরকম থাকবে, সেটা না থাকাই বোধহয় কাম্য। আমরা সবাই আসলে আগের চেয়ে ম্যাচিওর করেছি। সৃজিতও করেছে আই অ্যাম সিওর।
অনির্বাণ ভট্টাচার্যর সঙ্গেই বোধহয় এই ছবিতে আপনার সবচেয়ে বেশি দৃশ্য। দূরন্ত কেমিস্ট্রি স্ক্রিনে দেখা যাচ্ছে গানের দৃশ্যগুলোতে। কীভাবে?
স্বস্তিকা: (হাসি) আমি অনির্বাণের সঙ্গে কাজ করতে খুব আগ্রহী ছিলাম। যদিও ও আমাকে ‘পিসি’ বলে ডাকে। প্রথম দিকে আমাকে ‘দিদি’ বলত। তারপর শুটিংয়ে যেদিন ওর সঙ্গে দেখা হল, বললাম- “অনির্বাণ তুই যদি এই ‘দিদি’ বলাটা না বন্ধ করিস, তাহলে অনস্ক্রিন যেটা মনে হবে, দু’জনেই উদুম গালাগাল খাব। তুই এত ভাল দেখতে হট টাইপের একটা ছেলে, কেন যে আমাকে দিদি বলে ডাকছিস, আমার প্রচণ্ড মাথা গরম হয়ে যাচ্ছে।” (হাসি) তখন পিসিতে শিফ্ট করল। ও ছবিতে আসার আগেই আমি ওর প্রচুর নাটক দেখেছি। লালের সঙ্গে গিয়েও ওর নাটক দেখেছি। লালের নাটকেও কাজ করেছে। ওর আর আমার একসঙ্গে লালের একটা ছবিতে কাজ করারও কথা হয়েছিল, কিন্তু তখন হয়নি। ওর থিয়েটার দেখে ভাল লেগেছিল। ইনফ্যাক্ট ওর প্রথম নাটক দেখেই আমার মনে হয়েছিল- এর সিনেমা করা উচিত। আর আমারও ওর সঙ্গে সিনেমা করা উচিত (হাসি)। সেটা ফাইনালি হল। তাও এমন ছবিতে হল, যেখানে ওর সঙ্গে সবচেয়ে বেশি সিন আমার।
বেশ কিছু ঘনিষ্ঠ দৃশ্য আপনাদের।
স্বস্তিকা: হ্যাঁ। খুবই অন্যরকম একটা পেয়ারিং আমাদের। চট করে তো ওকে আর আমাকে একসঙ্গে কেউ ভাববে না। সেটার মধ্যেও সারপ্রাইজ এলিমেন্ট আছে। ওর অ্যাজ অ্যান অ্যাক্টর স্ট্রং পয়েন্ট হচ্ছে- একদমই কোনও ইনহিবিশন নেই। ইনহিবিশন নেই- এর দিকে থেকে আমারও সুনাম আছে (হাসি)। সেই কারণে কোথাও গিয়ে অসুবিধা হয়নি। টিউনিংটা ভাল হয়েছে। ও যদি কোথাও গিয়ে কুণ্ঠা বোধ করত, বা আমিও বোধ করতাম, তাহলে অবভিয়াসলি রসায়নটা হয়তো একইরকম হত না, মানে যেরকম দেখাচ্ছে।
আপনার ‘কমলিনী’-র চরিত্রটা দেখতে দেখতে কোথাও ‘চৌরঙ্গী’-র ‘করবী গুহ’-র কথা মনে পড়তে পারে? মানে সুপ্রিয়া দেবীর কথা?
স্বস্তিকা: দেখুন, এই ছবিটা হল, অ্যাডাপ্টেশন ফ্রম দ্য নভেল। যেটা বারবারই বলছি আমরা। কিন্তু সত্যি অনেকেরই আগের ‘চৌরঙ্গী’ ছবিটার কথা মনে আছে। আমারই মনে আছে ভাল ভাবে। এই ছবিটা যারা দেখেছে, মনে রাখার মতো একটা বয়সে পৌঁছনোর পর তাদের তো ভোলার কথা নয়। আর প্রত্যেকটা কথাতেই ‘চৌরঙ্গী’ নামটা চলে আসছে। সেইজন্য মানুষের মাথা থেকে একদমই বেরিয়ে যাবে, সেটা হবে না। কিন্তু সৃজিতের নিজের স্ক্রিন অ্যাডাপ্টেশনের স্টাইলটা এখানে অ্যাড হয়েছে। এরকম নয়, যা ‘চৌরঙ্গী’ হয়েছিল সেটাই হুবহু তুলে ধরা হয়েছে এখানে। আর নভেলটা খুব ফেমাস। এত ভাষায় ট্রান্সলেটেড হয়েছে যে, সকলের প্রায় পড়া। শুধু বাঙালির নয় সবার। কিন্তু আমি যে বেণু আন্টির চরিত্রটা মনে রেখে করেছি রেফারেন্স হিসেবে, সেটা কিন্তু একদমই নয়। আমার অনেক বেশি ভাল করে মনে আছে শুভেন্দু জেঠু, উত্তমকুমার আর অঞ্জনা ভৌমিকের রোলটা। বাকিগুলোয় একটু ধুলো পড়ে গিয়েছে। আর আমি সেই ধুলো পরিষ্কার করার চেষ্টা করিনি এই ছবিটা করতে যাওয়ার আগে। কাজেই মনে হয় না করবীর সঙ্গে কমলিনীর মিল খুঁজবে দর্শক। হ্যাঁ, ডেফিনিটলি চরিত্র দুটোর ফ্রেম এক। কারণ উপন্যাসটা তো এক। কিন্তু চরিত্রটার গঠন, তার জার্নি বা আমার অভিনয়ের সঙ্গে আগের ‘করবী’-র কোনও মিল দর্শক পাবে বলে মনে হয় না।
এই চরিত্রেই জয়া আহসানের করার কথা ছিল না?
স্বস্তিকা: এই বিষয়ে আমি একদম ক্লুলেস।
আপনার জীবনে হোটেলের অভিজ্ঞতা কেমন? আছে নাকি কোনও গভীর-গোপন গল্প?
স্বস্তিকা: (হাসি) আমার জীবনে তো গোপন কিছুই নেই। সবাই সব জানে।
তবু হোটেল এবং হোটেল-ঘর। সুইট… কিচ্ছু গল্প নেই? প্লিজ বলুন না…
স্বস্তিকা: কাজের সূত্রে বিদেশের হোটেলে গিয়ে এমন হয়েছে, ওয়াশরুমে গিয়ে বিপদ! সেটা কেরিয়ারের শুরুর দিকে। সবথেকে অসুবিধা হত শাওয়ারটা বুঝতে পারতাম না। বা হাইফান্ডা কমোডে এত সুইচ, কোনটা পুশ করব বুঝতে পারিনি। কাউকে জিজ্ঞেস করতেও অসম্মানিত লাগত। মনে হত হাউসকিপিং থেকে কাউকে ডেকে এনে সুইচগুলো মুখস্থ করে নিই। বা বাড়ি ফিরেই বাথরুমে যাই। একটা হোটেলে থাকার এত চাপ হলে- থাক! (হাসি)
আর হোটেলে প্রেম বা ডেট?
স্বস্তিকা: হুম্… না ডেট করতে হোটেলে যাইনি। প্রেম করতেও হয়তো না। কলকাতায় হয়তো কারও সঙ্গে দেখা করতে সমস্যা হচ্ছে, কারণ কফি খেতে দেখলেও তো মানুষের ধারণা হয়, তার সঙ্গে সম্পর্ক হয়েছে, সেটা খুব চাপের। তখন হোটেলের সাহায্য নিয়েছি।
শেষ প্রশ্ন, কখনও মনে হয়েছে শুটিং ফ্লোরে সৃজিত, আপনি আর পরমব্রত- অ্যাকশন-রিঅ্যাকশন নিয়েই আরেকটা ছবির চিত্রনাট্য লেখা হয়ে যেতে পারে?
স্বস্তিকা: ওহ্ (হাসি)… আপনারা পারেনও!
সূত্র: সংবাদ প্রতিদিন