Bahumatrik | বহুমাত্রিক

সরকার নিবন্ধিত বিশেষায়িত অনলাইন গণমাধ্যম

বৈশাখ ৫ ১৪৩১, শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪

ব্যর্থতার দায়ভার ভারতের উপর চাপাতে ব্যস্ত পাকিস্তান

মেজর জেনারেল (অব:) হর্ষ কাকর

প্রকাশিত: ২২:১৪, ১৯ জুলাই ২০২১

আপডেট: ২২:১৫, ১৯ জুলাই ২০২১

প্রিন্ট:

ব্যর্থতার দায়ভার ভারতের উপর চাপাতে ব্যস্ত পাকিস্তান

ছবি- সংগৃহীত

পাকিস্তান কেবল এবং কেবলমাত্র ভারতের সঙ্গে নিজেদের দম্ভ এবং অসম প্রতিযোগিতার কারণে ক্রমাগত নিচের দিকে ধাবিত হচ্ছে

সম্প্রতি লাহোরের জোহর টাউন এলাকায় কুখ্যাত জঙ্গি মদদ দাতা হাফিজ সাইদের বাড়ির কাছে ইমপ্রোভাইজড এক্সপ্লোসিভ ডিভাইস (আইইডি) বিস্ফোরণে অন্তত ২ জনের মৃত্যু সহ প্রায় জনা বিশেক মানুষ আহত হোন। ঘটনাটির জন্য সর্বোতভাবে ভারতকে দায়ী করে পাকিস্তানের নিরাপত্তা বাহিনী এবং গণমাধ্যম। হামলার পর এক বিবৃতিতে পাকিস্তানের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা মুইদ ইউসুফ বলেন, “নিঃসন্দেহে ভারতীয় মদদপুষ্ট সন্ত্রাসী গোষ্ঠীই এই হামলাটি করেছে।”

হাফিজ সাইদের বাড়ির সম্মুখে হামলার দিনই পাকিস্তানে একাধিক সাইবার এটাক হয়েছে বলেও দাবি করে দেশটির কর্তৃপক্ষ। এতেও ভারতের সংশ্লিষ্টতা দাবি করে বিবৃতি দেয় তাঁরা। এ প্রসঙ্গে মুইদ ইউসুফ দাবি করেন, “আমাদের এ ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই যে, জোহর টাউন বিস্ফোরণ এবং সাইবার হামলার মাঝে যোগসূত্র রয়েছে।”

পরবর্তীতে পাক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানও একটি টুইট বার্তায় লাহোর হামলার জন্য ভারতকে দায়ী করেন। তিনি লিখেন, “পাকিস্তানে এই জঘন্য সন্ত্রাসী হামলার পরিকল্পনা এবং অর্থায়নের পেছনে ভারতীয় পৃষ্ঠপোষকতা রয়েছে।” এমনকি পাকিস্তানের রাষ্ট্রপতি ড. আরিফ আলভীও ভারতকে দোষারোপের এই মিছিলে সুর মিলিয়েছেন।

সর্বোপরি, এই হামলার কারণ হিসেবে পুরো পাকিস্তানী কর্তৃপক্ষ একমত যে, হাফিজ সাইদকে লক্ষ্য করেই হামলাটি পরিচালনা করে ভারত। কিন্তু পাকিস্তানের এফএটিএফ রিপোর্ট অনুসারে হাফিজের এ মুহূর্তে লাহোরের কোট লক্ষপত কারাগারে ১৫ বছরের জন্যে জেল খাটার কথা।

প্রশ্ন হচ্ছে, যদি হাফিজ সাইদ সত্যিই কারাগারে থেকে থাকে, তাহলে কীভাবে তাঁকে লক্ষ্য করে ভারত হামলা চালাতে পারে? তাহলে সত্য কী এই যে, হাফিজকে কখনোই কারাগারে পাঠানোই হয়নি? নিজ বাড়িতেই আরাম এবং আয়েশে দিনাতিপাত করছেন? সম্পূর্ণ ঘটনাটিই প্রমাণ করে যে, এফএটিএফ শর্তমতে পাকিস্তান কখনোই সন্ত্রাসীদের শাস্তি দিতে সচেষ্ট নয়। তাই গোটা প্রসঙ্গটাই এফএটিএফ এর সম্ভাব্য বৈঠকের জন্য বিবেচনা করা উচিৎ।

এদিকে, ভারত পাকিস্তানের যাবতীয় সন্ত্রাসবাদে অর্থায়নের দাবি প্রত্যাখান করেছে। ভারতীয় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র বলেছেন, “ভারতের বিরুদ্ধে ভিত্তিহীন প্রচার চালানো পাকিস্তানের জন্য মোটেও নতুন কিছু নয়। এসবের বদলে পাকিস্তানের উচিৎ নিজের ঘর সামাল দেয়া এবং তাঁদের নিজস্ব ভূমিতে আশ্রিত সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে বিশ্বাসযোগ্য এবং যাচাইযোগ্য পদক্ষেপ গ্রহণ করা।” তবে হামলার পেছনে সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলোর আভ্যন্তরীণ প্রভাব বিস্তারের বিষয়টিও থাকতে পারে বলে ধারণা করছে কেউ কেউ।

বিগত কয়েক বছর ধরেই লাগাতারভাবে ভারতের বিরুদ্ধে পাকিস্তানের সন্ত্রাসী গোষ্ঠী তেহরিক-ই-তালিবান-পাকিস্তানকে (টিটিপি) অর্থায়নের দাবি তুলছে পাক কর্তৃপক্ষ এবং নিরাপত্তা বাহিনী গুলো। উল্লেখ্য, এই টিটিপি সন্ত্রাসীরাই সম্প্রতি বিগত এপ্রিল মাসে চীনা রাষ্ট্রদূতকে লক্ষ্য করে কোয়েটা বিস্ফোরণের দায় স্বীকার করেছিলো এবং ২০১৪ সালে পেশোয়ারের আর্মি স্কুলে আক্রমণের মাধ্যমে ১১৪ নিরীহ শিশুর হত্যা করেছিলো।

পাকিস্তানের দাবি, ভারতের ‘র’ এবং আফগান গোয়েন্দা সংস্থা ‘এনডিএস’ একত্রে টিটিপি-কে প্রশিক্ষণ দিচ্ছে এবং তহবিল সরবরাহ করছে। এ নিয়ে এফএটিএফ কর্তৃক ভারতকে জিজ্ঞাসাবাদ করার দাবিও করে পাকিস্তান।

কিন্তু, এদিকে চলতি মাসের শুরুতে পাক জেনারেল বাজওয়া বলেন, “টিটিপি এবং তালেবান একই মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ।” তাছাড়া পাক সামরিক কর্তাগণ এও স্বীকার করে নেন যে, আফগানিস্তানে তালেবানদের উপর ক্রমাগত চাপ বাড়ানোয় পাকিস্তানে টিটিপি হামলা বাড়িয়েছে। আফগান গোয়েন্দা প্রতিবেদন অনুসারে প্রায় ৬৫০০ টিটিপি যোদ্ধা আফগানিস্তানে তালেবানের পক্ষে সশস্ত্র সংগ্রাম করছে।

এ কথা তো সর্বজন বিদিত যে, আফগান তালেবানের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক এখনও মধুর নয়। তাহলে ভারত টিটিপিকে সাহায্য করছে, পাকিস্তানের এই দাবি শুরুতেই ধুলিস্মাৎ হয়ে যায়।

অপরদিকে, সম্প্রতি অনানুষ্ঠানিকভাবে জানা গিয়েছে, পাক সেনাবাহিনী তালেবানদের সঙ্গে একটি চুক্তিতে পৌছেছিলো যে, পাকিস্তান কর্তৃক মার্কিন বাহিনীকে বেজ না করতে দেয়ার বিনিময়ে টিটিপির হ্রাস টেনে ধরবে তালেবান।

আমার প্রশ্ন হচ্ছে, যদি তালেবানরাই টিটিপি নিয়ন্ত্রনে মুখ্য ভূমিকা পালন করে, এবং ইচ্ছেখুশি তাঁদের কার্যক্রম হ্রাস বা বৃদ্ধি করার মতো অবস্থায় থাকে, তাহলে এখানে ভারতের সংশ্লিষ্টতা কীভাবে সম্ভব? তাই এটি স্পষ্টতই প্রতীয়মান হয় যে, ভারতকে মিথ্যাভাবে দোষারোপের জন্যেই পাকিস্তান মুখস্থ বুলি আওড়িয়ে যাচ্ছে।

একইভাবে পাকিস্তানের বেলুচিস্তানে বিদ্রোহের জন্যেও ভারতকে দায়ী করে পাকিস্তান। এমনকি দেশটি নিজেদের এই দাবি প্রমাণের জন্যে ইরান থেকে অপহরণ করা ভারতীয় নাগরিক কুলভূষণ যাদবকে বেলুচিস্তানে কর্মরত ভারতীয় এজেন্ট দাবি করে এবং গ্রেফতার দেখায়। সম্প্রতি পাক রাষ্ট্রপতি বেলুচিস্তান সম্পর্কিত এক অনুষ্ঠানে বলেন, “জঙ্গি সংগঠন গুলোকে অর্থায়ন করা হচ্ছে। পাকিস্তানকে অস্থিতিশীল করার জন্য ভয়ানক ষড়যন্ত্র করা হচ্ছে।” এখানেও ভারতের সংশ্লিষ্টতা দাবি করেন তিনি। কিন্তু আজ অবধি পাকিস্তান এ সংক্রান্ত কোনো প্রমাণাদি বিশ্ববাসীর নিকট উপস্থাপন করতে পারেনি।

সম্প্রতি, পাকিস্তানের খাইবার-পাখতুনখোয়া প্রদেশের কোহিস্তান অঞ্চলে এক বিস্ফোরণে চীনের অর্থায়নে করা ৪৩০০ মেগাওয়াট জলবিদ্যুৎ প্রকল্পে কাজ করা ০৯ শ্রমিক এবং অন্য আরও ০৪ জন মারা যায়। বিষয়টি নিয়ে চীন এবং পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থা যৌথভাবে তদন্তে নেমেছে। কোনো সন্ত্রাসী গোষ্ঠীও এই বিস্ফোরণের দায় স্বীকার করেনি। ধারণা করি, শীঘ্রই এখানেও ভারতের সংশ্লিষ্টতা দাবি করবে পাকিস্তান। দেশটির জন্য সবকিছুতেই ভারত লিঙ্ক খোজাটা নিত্যকার ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে।

এছাড়াও, পাক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের ভারতের প্রতি আবেগটা একটু বেশিই বলে মনে হয়। যেকোনো ইস্যুতে পাকিস্তানের সঙ্গে ভারতের তুলনা না করলে যেনো তাঁর ঘুম হয়না। অথচ, তাঁর নিজ দেশের অর্থনীতি বর্তমানে আইসিইউ-তে রয়েছে। ঋণের বোঝায় তাঁর দেশ গলা অবধি ডুবে রয়েছে। অথচ ইমরান খান দম্ভ ভরে বলেন, “ভারতের জিডিপি মাইনাস সাতে, আর আমাদের জিডিপি চার শতাংশে রয়েছে।” অথচ তিনি ভুলে গেলেন ভারত নিজ গুনে এগিয়ে যাচ্ছে আর তাঁর দেশ ক্রমবর্ধমান মূল্যস্ফীতি, বেকারত্ব এবং অভাবের চাদরে ডুবে আছে। ইমরান ভাবছেন ভারতীয়দের সঙ্গে তুলনা টেনে নিজ দেশে জনরোষের হাত থেকে তিনি বাঁচতে পারবেন।

কাশ্মীর নিয়েও পাক কর্তৃপক্ষের আবেগ মাত্রাতিরিক্ত। চলতি বছর এপ্রিল মাসে পাক মন্ত্রীসভা সিদ্ধান্ত দেয় যে, ভারত থেকে চিনি এবং তুলা আমদানি বাতিল করা হবে। তাঁরা ঘোষণা দেয় যে, ভারত কাশ্মীরে ৩৭০ অনুচ্ছেদ বহাল করার আগ অবধি ভারতের সঙ্গে কোনো বাণিজ্য করবেনা পাকিস্তান। ফলস্বরূপ, পাকিস্তানের অভ্যন্তরে চিনির দাম দরদর করে বাড়ছে। এখানেও দেশটির সাধারণ জনগণ ভূক্তভোগী।

আমরা দেখেছি, কাশ্মীরে বর্তমানে শান্ত পরিস্থিতি বিরাজমান থাকায় সম্প্রতি হুরিয়াত দ্বারা আহবান করা হরতাল সার্বিকভাবে প্রত্যাখান করেছে সেখানকার জনগণ। সাধারণ মানুষ এখন বুঝতে শিখেছে। তাঁরা যেকোনো অন্যায় ষড়যন্ত্র অনুধাবন করতে পারছে। এখানেও তাই পাক ষড়যন্ত্র মুখ থুবড়ে পড়বে।

অন্যদিকে, এটিও পাকিস্তানকে বুঝতে হবে যে, আফগানিস্তানের আভ্যন্তরীণ সমস্যা এবং গৃহযুদ্ধ পরিস্থিতি পাকিস্তানের সমস্যা গুলোকেই কেবল বাড়িয়ে তুলবে, এর বেশি কিছু নয়। অন্যদিকে, পাকিস্তানে বিনিয়োগকারী দেশগুলোও বর্তমানে আতঙ্কে রয়েছে। তাই দেশটির উচিৎ অহেতুক ষড়যন্ত্র এবং মিথ্যাচার থেকে সরে প্রকৃত উন্নয়নে মনযোগী হওয়া।

পাকিস্তান কেবল এবং কেবলমাত্র ভারতের সঙ্গে নিজেদের দম্ভ এবং অসম প্রতিযোগিতার কারণে ক্রমাগত নিচের দিকে ধাবিত হচ্ছে। আর ক্ষতিগ্রস্ত জনসাধারণকে ভারতের বিরুদ্ধে দোষারোপ করে শান্তনা দেয়া হচ্ছে। অর্থনৈতিক এবং নিরাপত্তা ইস্যুতে চরম সঙ্কটাপন্ন অবস্থায় পৌছানোর পূর্বেই পাকিস্তানের উচিৎ নিজেদের নীতিগুলো সংশোধন করা।

লেখক: ভারতীয় সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল, কৌশলগত কূটনীতি এবং নিরাপত্তা বিষয়ক বিশেষজ্ঞ।

India News Network

Walton Refrigerator Freezer
Walton Refrigerator Freezer