Bahumatrik | বহুমাত্রিক

সরকার নিবন্ধিত বিশেষায়িত অনলাইন গণমাধ্যম

বৈশাখ ৫ ১৪৩১, শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪

বৈশ্বিক মহামারি করোনাভাইরাস নিয়ে কিছু কথা

মুহাম্মদ শামসুল ইসলাম সাদিক

প্রকাশিত: ০০:২৬, ৩ এপ্রিল ২০২০

প্রিন্ট:

বৈশ্বিক মহামারি করোনাভাইরাস নিয়ে কিছু কথা

করোনা ভাইরাস ‘অনেকগুলো ভাইরাস এর সমন্বয়ে গঠিত বড় গ্রুপ বা ফ্যামিলি’ যেটা সাধারণ ঠান্ডা লাগা থেকে অনেক জটিল রোগের উৎপত্তি হয়ে থাকে। এই ভাইরাসটিকে বলা হয় জোনোটিক যার অর্থ হচ্ছে এটা ‘পশু এবং মানুষের মধ্যে সংক্রামিত হয়’ যেমনটি সার্স সংক্রামিত হয়েছিল বিড়াল জাতীয় প্রাণী থেকে মানুষের মধ্যে এবং মার্স এসেছিলো উট থেকে মানুষের মধ্যে। করোনা ভাইরাস এর সাধারণ উপর্সগ জ্বর, কফ, শ্বাসকষ্ট যার ফলে নিউমোনিয়া, জটিল শ্বাসকষ্ট, কিডনি জটিলতা এমনকি মৃত্যুও হতে পার।

বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা চীন শাখা ২০১৯ সালের ৩১ ডিসেম্বর প্রথম করোনা ভাইরাস ঘোষণা দেয় চীনের হুবেই প্রদেশের উহান শহর। চীন উহানে করোনা ভাইরাস সনাক্ত হওয়া পর থেকে বিশ্বের অন্যান্য দেশসহ এ পর্যন্তÍ ৭,১০,৯৮৭ জন লোক আক্রান্ত এবং কমপক্ষে ৩৫ হাজারের বেশি লোক মারা গেছে। ২০১৯ সালে উৎপত্তি এই ভাইরাস একটি নতুন ধরনের। ১৭২০ সাল থেকে প্রতি ১০০ বছর পরপর নতুন মহামারির সৃষ্টি। ঐ বছরে বুবোনিক প্লেগ বৃহৎ আকারে মহামারি ছিল।

ধারণা করা হয় ব্যাকটেরিয়া সংক্রমিত মাছি দ্বারা আত্রুান্তÍ হয়ে প্রায় ১ লাখ মানুষের মৃত্যু হয়। তারপর ১৮২০ সালে থাইল্যান্ডে কলেরা চিহ্নিত করা হলে ইন্দোনেশিয়া, ফিলিপাইনসহ এশিয়ায় সব মিলে প্রায় ১লাখ মানুষের মৃত্যু হয়। অতঃপর ১৯২০ সালে স্প্যানিশ ফ্লুর মাধ্যমে বিশ্বের ৫০ কোটি মানুষ আক্রান্তÍ হয় এবং প্রায় ১০ কোটি মানুষের মৃত্যু হয়। এটা ছিল বিশ্বের সবচেয়ে বড় মহামারি। ঠিক  ১০০ বছর পর বর্তমানে মরণব্যাধি করোনা ভাইরাসের মৃত্যুতান্ডব দেখা দিল।

বর্তমান গ্লোকালাইজেশনের যুগে, বিশ্বব্যাপী করোনা ভাইরাস ছড়িয়ে পড়া তেমন কোনো আশ্চর্যের খবর নয়। কেননা, আজকের বিশ্ব শুধু পণ্য আমদানি-রপ্তানিতেই সীমাবদ্ধ হচ্ছে না বরং মানব সম্পদের আদানপ্রদানও হচ্ছে হরহামেশা। যেহেতু, করোনা ভাইরাসের বাহক মানুষ, তাই এই রোগ যে কোনো দেশেই বিস্তৃত হতে পারে।

আন্তর্জাতিক অঙ্গনে মরণব্যাধি করোনা ভাইরাস নিয়ে বিভিন্ন প্রচার মাধ্যমগুলো সচেতনতামূলক প্রচার করা হচ্ছে, তার বিপরীত প্রাধান্য দেওয়া হচ্ছে মানুষের মৃত্যুর সংখ্যা নিয়ে। কিন্তু বাংলাদেশ তার কিছুটা ব্যতিক্রম। প্রতিদিন প্রতিমুহূর্তে গণসচেতনতামূলক বিভিন্ন বিষয়ে আলোকপাত করা হচ্ছে। টিভি ও ইলেকট্রনিক্স মিডিয়াগুলোতে ভাইরাস থেকে বাঁচতে যা যা করতে হবে তা বারবার প্রচার করছে। আক্রান্তÍ ব্যক্তি হতে কমপক্ষে দুই হাত দূরে থাকতে হবে।

বারবার প্রয়োজনমতো সাবান পানি দিয়ে হাত ধুয়ে ফেলা, বিশেষ করে আক্রান্ত ব্যক্তির সংস্পর্শে এলে কিংবা সংক্রমণস্থলে ভ্রমণ করলে। জীবিত অথবা মৃত গৃহপালিত/বন্যপ্রাণী থেকে দূরে থাকা। ভ্রমণকারীগণ আক্রান্ত হলে কাশি শিষ্টাচার অনুশীলন করতে হবে (আক্রান্ত ব্যক্তি হতে দূরত্ব বজায় রাখা, হাঁচি-কাশির সময় মুখ ঢেকে রাখা, হাত ধোয়া, যেখানে-সেখানে কফ কাশি না ফেলা)। খাদ্য উচ্চ তাপমাত্রায় রান্না করা।

যদিও আমরা মনে করি, করোনায় মৃত্যুঝুঁকির হার কম, তবে ভয়ের বিষয় এটি একটি ছোঁয়াচে রোগ। করোনা ভাইরাস নিয়ে এত উদ্বিগ্ন হবার কারণ হলো, আমরা সচেতনতার চেয়ে কুসংস্কার বা গুজবে বেশি বিশ্বাসী। অনেকে স্বপ্নে দেখা ওষুধ খেয়ে, থানকুনি পাতা খেয়ে, কেউবা আমপাতা থেকে নিঃসৃত মধু খেয়েও রোগ সারানোর চেষ্টা করেছেন। এসব গুজব ছড়িয়ে অনেকে আবার কোটিপতি বা লাখোপতি হওয়ার স্বপ্নে ভিবোর। অনেকেই আবার প্রয়োজনীয়-অপ্রয়োজনীয় অতিরিক্ত খাবার পাশাপাশি ওষুধ বাসায় মজুত করছেন। যার কারণে অনেক জায়গাতেই নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদির দাম বাড়তে শুরু করেছে।

মানুষের আহমরির জন্য প্রশাসন বিভিন্ন ব্যবস্থা গ্রহণের পাশাপাশি সর্বাত্মক পদক্ষেপ গ্রহণের চেষ্টা করেছেন। তবে প্রশাসনকে এ ব্যাপারে আরো বেশি জোড়ালো ভূমিকা  রাখতে হবে, যাতে এই করোনা ভাইরাসের অজুহাতে ব্যবসায়ীরা কৃত্রিম সংকট তৈরি ও তাদের পণ্যমূল্য আর বৃদ্ধি করতে না পারেন একই সঙ্গে জনগণ যাতে খাদ্যাভাব গুজবের নামে ব্যবসায়ীদের ন্যায় বাসায় বেশি পণ্য মজুতের চেষ্টা না করে। তার জন্য করোনা ভাইরাস থেকে খাদ্যাভাবেই মানুষের মৃত্যু হবে হয়তো বেশি।

প্রতিবছর রমজান ঘুরে আসতে না আসতেই পণ্যমূল্য বৃদ্ধির একটি সুযোগ খুঁজেন ব্যবসায়ীরা, অথচ বিশ্বের অন্যাণ্য দেশে প্রতি রমজান মাস আসার সাথে সাথে নিত্যপ্রয়োজনিয় পণ্যমূল্য কমতে শুরু করে। কিন্তু আমাদের দেশে ব্যবসায়ীরা রমজান মাসকে সুযোগে সদ্ব্যবহার করতে থাকেন। তাই প্রশাসনকে শুধু সতর্কীকরণ কিংবা সাবধানতা ঘোষণা নয়, প্রয়োজনবোধে কঠোর থেকে কঠোরতম ভূমিকাও গ্রহণ করতে পিছপা হবে না। প্রয়োজনবোধে বাস্তবতার উদাহরণও সৃষ্টি করে যেতে হবে।

শুধু টিভি ও ইলেকট্রনিক্স মিডিয়াগুলোতে  প্রচারের ওপর নির্ভর না করে আমাদেরকে অবশ্যই সতর্ক হতে হবে। ইতিমধ্যেই চীন থেকে আমাদের দেশে করোনা ভাইরাসের চিকিৎসাসামগ্রী আমদানি করা হয়েছে। আমরা আশা করি দ্ররুত চিকিৎসাব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। কোয়ারেন্টাইনে বা আলাদা থাকাই সমাধান নয়। প্রত্যেকের উচিত ব্যক্তি থেকে পরিবারের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি করা।

আমাদের পাশ্ববর্তী দেশ ভারত ও সৌদি সরকার তাদের দেশে ২১ দিনের কারফিউ জারি করেছে। নিউজিল্যান্ডসহ অন্যান্য দেশেও জরুরি অবস্থা জারি হয়েছে। বাংলাদেশেও গত ২৬ মার্চ থেকে সাধারণ ছুটি ঘোষণা করা হয়েছে। লক ডাউন করা হয়েছে গণ ও জনপরিবহন।

সেনাবাহিনী, পুলিশ ও যৌথ বাহিনীর মাধ্যমে নেওয়া হয়েছে জেলায় জেলায় ঘরে নিরাপদ ও সর্তক থাকা নিশ্চিতকরণ অভিযান; কিন্তু আমরা সর্তক না হলে মরণব্যাধি করোনা ভাইরাস থেকে পরিত্রাণের কোনো উপায় নেই। পরিবার পরিজন এমনকি দেশের স্বার্থে ভ্রমণ, গণজমায়েত পরিহার এবং নিরাপদ দূরত্ব বজায় রাখতে হবে। কেননা জনসমাগমপূর্ণ এলাকা এই রোগের বিস্তার ঘটে, যেমনটি ঘটেছিল দক্ষিণ কোরিয়ার একটি গীর্জা থেকে ৩ হাজারেরও বেশি লোকের। মালয়েশিয়ার একটি তবলিগ জমায়েত থেকে এই রোগের বিস্তার ঘটে তথ্য পাওয়া যায়। ইতালির মধ্যে ঠিক একইভাবে এই রোগের বিস্তার ঘটে। তাই এইমুহূর্ত থেকে আমাদেরকে সচেতন হতে হবে, কোনো ভাবে হেয়ালিপনা কাম্য নয়।

একই সঙ্গে মানতে হবে স্বাস্থ্যবিধির বিভিন্ন নিয়মকানুনও। বিশ্ব স্বাস্থ সংস্থার বর্তমান পরিসংখ্যান অনুযায়ী আক্রান্ত মানুষের মধ্যে যারা ‘৬০+ বয়সের বিভিন্ন ধরনের হেলথ ইস্যু দ্বারা যেমন ডায়বেটিস, উচ্চ রক্তচাপসহ আরো অনেক কিছু’ তারা সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ। এছাড়া কোনো হেলথ ইস্যু ছাড়া আক্রান্ত ব্যক্তিরা সাধারণত ১৪-৩০ দিনের মধ্যে ভাইরাস মুক্ত হয়ে যায়। তবে এটাও আবার নির্ভর করে ‘করোনা ভাইরাস পরিবারের’ কোনটা দ্বারা আক্রান্ত। অন্যথায় এটি ছাড়িয়ে যেতে পারে অতীতের সকল রেকর্ড। প্রাণহানি ঘটতে পারে লক্ষ থেকে লক্ষান্তর। তাই আমাদের অত্যন্ত জরুরি নিজেরা সুস্থ থাকি এবং অন্যকে সুস্থ রাখি ।

লেখক: প্রাবন্ধিক

বহুমাত্রিক.কম

Walton Refrigerator Freezer
Walton Refrigerator Freezer