-ড. হুমায়ুন কবীর
বাংলা ব্যাকরণে পড়েছি নদী মাতা যার- নদীমাতৃক। অসংখ্য নদ-নদী থাকার কারণে বাংলাদেশকে বলা হয় নদীমাতৃক দেশ। নদীর পরিসংখ্যান নিয়ে মতভেদ থাকলেও দেশে ছোট-বড় মিলে প্রায় সাত শতাধিক নদীর অস্তিত্ব রয়েছে। তবে সর্বশেষ সরকারি তথ্যমতে এ সংখ্যা কমবেশি ২৩০ টি। সংখ্যা যাই হোক না কেন এ নদীগুলো ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে সারা দেশজুড়ে। আমাদের পাশ্ববর্তী দেশ ভারতের সাথে রয়েছে প্রায় অর্ধ শতাধিক নদ-নদীর সংযোগ। বাংলাদেশে জালের ন্যায় এসব নদ-নদী ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। সেভাবে দেখতে গেলে প্রতি জেলা-উপজেলায় একাধিক ছোট-বড় নদীর রয়েছে। এসব নদ-নদীর বেশিরভাগই এখন লুপ্তপ্রায় এমনকি বিলীন হয়ে গেছে বা যাচ্ছে।
মহান সৃষ্টির সবকিছুই ভারসাম্যপূর্ণ। কিন্তু আমরা সৃষ্টির সেরা জীব মানুষ আমাদের নিজেদের প্রয়োজনে সেসব প্রাকৃতিক ভারসাম্যপূর্ণ পরিবেশ বিনষ্ট করে চলেছি। তার মধ্যে নদী দখল দুষণ অন্যতম। আমরা জানি পৃথিবীর তিন-চতুরাংশই জল আর বাদবাকী মাত্র এক চতুরাংশ স্থলভাগ রয়েছে। সেখানেই বসবাস কারি আমরা সৃষ্টির সেরা জীব মানুষ। সাধারণভাবে বলতে গেলে প্রাকৃতিকভাবে পৃথিবীর জন্য যা প্রযোজ্য সঙ্গত কারণেই একটি দেশের জন্যও তাই প্রযোজ্য হওয়ার কথা। আর তাই একটি দেশের অভ্যন্তরেও নিশ্চয়ই তিন-চতুরাংশ জলভাগ এবং এক-চতুরাংশ স্থলভাগ থাকাটাই আদর্শ হওয়া উচিত। তবে ভৌগোলিক স্থানভেদে সেটার কিঞ্চিৎ রদবদল হতেই পারে। আর থাম্বরুলটি কিন্তু প্রাকৃতিক।
একটি দেশে বা অঞ্চলে যখন সেসব প্রাকৃতিক ভারসাম্যগুলো ঠিক থাকেনা, তখনই পরিবেশের জন্য তা হুমকি হয়ে দাঁড়ায়। আর এটাকেই বর্তমানে নাম দেওয়া হয়েছে জলবায়ু পরিবর্তন। জলবায়ু পরিবর্তনই এখন সারাবিশের এক অভিন্ন ও অন্যতম মহামারি। করোনা হয়তো মহামারি হিসেবে আজ আছে কাল মানুষেই সেটাকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে। কারণ অতীতে এমন অনেক মহামারি মানুষই তার জ্ঞান, মেধা, বুদ্ধি, প্রজ্ঞা ও বিজ্ঞান দিয়ে নিয়ন্ত্রণ করেছে। কিন্তু পরিবেশ কিংবা জলবায়ুজনিত অভিঘাত অত সহজে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়। সেটি করতে গেলে প্রয়োজন সম্মিলিত প্রয়াস।
কিন্তু প্রকৃতিকে নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমেই কেবল সেসব অভিঘাত মোকাবেলা করা সম্ভব। আর সেসব প্রাকৃতিক নিয়ন্ত্রণের অগ্রভাগে রয়েছে জলাধার। প্রাকৃতিক ভূগোলকে ফিরিয়ে দেওয়া। কথায় আছে, ‘ফিরিয়ে দাও অরণ্য লও এ নগর’। অর্থাৎ প্রকৃতিকে যথাসম্ভব প্রকৃতির মতো থাকতে দিতে হবে। সেখানে নদ-নদী, জলাধার, হাওর-বাওর, বিল-ঝিল, খাল-নালা ইত্যাদি সংরক্ষণ করতে হবে। কারণ আমরা যদি পানিচক্র পাঠ করি তাহলে দেখতে পাব কেমনে পানির রূপান্তর ঘটে থাকে। সেখানে প্রাকৃতিক জলাধার না থাকলে সেই পানিচক্র বাধাপ্রাপ্ত হয়। আর পানিচক্র বাধাপ্রাপ্ত হলেই জীবন থেমে যায়। কারণ পানির আরেক নাম জীবন তা আমরা সবাই জানি।
এখন থেকে প্রায় চার দশক আগেও আমরা বাংলাদেশের অভ্যন্তরে নদ-নদীর যে পানিপ্রবাহ লক্ষ্য করেছি তা দিনে দিনে কমতে কমতে এখন প্রায় শূন্যের কোটায়। আমার গ্রামের বাড়ি কিশোরগঞ্জ জেলার পাকুন্দিয়া উপজেলার চরটেকী গ্রামে। সেইগ্রামের পাশের নরসুন্দান নদীর পাড়ে একটি জায়গার নাম কাওনা। আমরা আমাদের বাপ-দাদাদের কাছে শুনেছি সেই কাওনাতে একটি বড় খেয়াঘাট ছিল। সেখান থেকে গাজীপুর জেলার শ্রীপুরে অবস্থিত মাওনা ঘাটে নৌকা চলাচল করতো।
অর্থাৎ কাওনা থেকে মাওনা পর্যন্ত নৌকায় মানুষ, সে এলাকায় জন্মানো পাটসহ অন্যান্য উৎপাদিত কৃষিপণ্য বাজারজাত করার জন্য পরিবহণ করা হতো। একসময় হোসেনপুর-পাকুন্দিয়া ও গফরগাঁওকে আলাদাকারী পুরাতন ব্রহ্মপুত্র নদের পাকুন্দিয়া অংশের মুনিয়ারিকান্দা এবং গফরগাঁও অংশের দত্তেরবাজার হতে শীতলক্ষা, সুতী ও ত্রিমোহনী হয়ে শ্রীপুরের বরমীবাজারে নৌকা চলতো। আবার গফরগাঁও হতেও মুনিয়ারিকান্দা এবং দত্তেরবাজারে নৌকা চলতো। আমি নিজেও অনেকবার এসব নৌপথে ভ্রমণ করেছি।
নৌকায় মালামাল পরিবহন অনেক নিরাপদ, সহজলভ্য, সাশ্রয়ী, পরিবেশবান্ধব ও দুষণমুক্ত। অপরদিকে সড়কপথের যান্ত্রিকতায় অনেক দুষণ। নদীর নাব্যতা ফেরালে আশেপাশের কৃষিকাজ করা অনেক সহজ ও নিরাপদ। কারণ সেচের জন্য এখন যেভাবে ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলন করা হচ্ছে তাতে প্রতিনিয়ত পানির স্তর নিচে নেমে যাচ্ছে, সেটাও আরেকপ্রকার পরিবেশ বিনষ্ট করছে। এখন প্রাকৃতিক অনেক মাছের জাত বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। নদীকেন্দ্রিক অনেক জীবিকা ছিল যা এখন অনেক অনুৎপাদনশীল কাজে নিয়োজিত হয়ে পড়েছে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অত্যন্ত পরিবেশবান্ধব। পরিবেশবান্ধব পরিকল্পনা দিতে পারলে তিনি সেটা যেকোন মূল্যেই বাস্তবায়ন করে থাকেন। সেজন্য বড়বড় নদ-নদীর পাশাপাশি দেশজুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ছোটছোট নদ-নদীগুলোও সংস্কার ও ড্রেজিং এর আওতায় এনে কার্যক্ষম রাখার ব্যবস্থা নিতে হবে। কারণ এসব বিষয় এখন গ্রাম-গ্রামান্তরের মানুষের মধ্যেও সচেতনতা সৃষ্টি করছে। সম্প্রতি শ্রীপুরের কাওরাইদে গঠিত সুতী সুরক্ষা পরিষদ তাদের অন্যতম। যারা দেশের নদীমাতৃক চরিত্র পুনরুদ্ধারের প্রতীকী চেষ্টা করছে।
লেখক: কৃষিবিদ ও ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়
email: [email protected]
বহুমাত্রিক.কম