Bahumatrik | বহুমাত্রিক

সরকার নিবন্ধিত বিশেষায়িত অনলাইন গণমাধ্যম

বৈশাখ ৬ ১৪৩১, শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪

বঙ্গবন্ধুপ্রেমী একজন সেলিম রেজার কথা

নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রকাশিত: ০১:১৮, ২১ আগস্ট ২০২১

আপডেট: ০১:১৯, ২১ আগস্ট ২০২১

প্রিন্ট:

বঙ্গবন্ধুপ্রেমী একজন সেলিম রেজার কথা

গোপালগঞ্জ সদর উপজেলার একটি প্রত্যন্ত গ্রাম বাবুরগাতী। নব্বই দশকে বাবুরগাতী তথা মাঝিগাতি ইউনিয়ন ছিল বিলঝিল জলাশয় নিমগ্ন একটি নিভৃত পল্লী। রাস্তাঘাট বিচ্ছিন্ন অন্ধকারাচ্ছন্ন  শিক্ষার আলো বঞ্চিত, কুসংস্কার কবলিত একটি অজপাড়াগাঁ। কেউ কেউ কাইজা মারামারি এলাকা বলে জানত। এরকম একটি কৃষি পরিবার থেকে বেড়ে ওঠা স্বপ্নচারী সেলিম রেজা।

তার বয়স যখন পাঁচ বছর তখন তার বাবা মারা যান মো: সিরু সরদার এবং ষষ্ঠ শ্রেণীতে মাঝিগাতী হাই স্কুলে ভর্তি হওয়ার পর মা মিসেস রিজিয়া বেগম ও মারা যান। এরকম পরিস্থিতিতে তার পরিবারের সদস্য না থাকায় নানি ফুলজান বেগমের স্নেহ-মমতা-ভালবাসায় আবার টুঙ্গিপাড়া উপজেলার কুশলী ইসলামীয়া  হাইস্কুলে ভর্তি হয়ে লেখাপড়া চালিয়ে যান। বাবার উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া জমি বিক্রি করে লেখাপড়া চালিয়ে যান।

উচ্চ মাধ্যমিকে গোপালগঞ্জ সরকারি বঙ্গবন্ধু কলেজে ভর্তি হয়ে গেলেন। কিন্তু জানতে পারলেন নিয়মিত ক্লাস হয় না। তাইতো টুঙ্গিপাড়ার পাটগাতির সরকারি শেখ মুজিবুর রহমান বিশ্ববিদ্যালয় কলেজে ভর্তি হলেন। তারপর বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তির জন্য ঢাকা গিয়ে পড়ালেখা শুরু করলেন। ভর্তি পরীক্ষায় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের লোক প্রশাসনে চান্স পেলেন। কিন্তু ভর্তি না হয়ে ঢাকা কলেজে ভর্তি হলেন এবং সেইসাথে ঢাকায় প্রতিদিন কোথায় মঞ্চনাটক, স্লাইডশো, আলোচনা সভা, সেমিনার মেলা প্রদর্শন করতেন। এছাড়াও নিয়মিত পাবলিক লাইব্রেরিতে অনেক রাত পর্যন্ত পড়তেন।

আওয়ামীলীগ তখন বিরোধী দলের ক্ষমতার বাহিরে। যখন কোন প্রোগ্রামের খবর পেতেন ছুটে গেছেন প্রতিটি অনুষ্ঠানে। কিন্তু কোন পদ-পদবীর জন্য চেষ্টা করেননি। কারো সাথে বিশেষ সম্পর্ক রাখেন নি। নিজের মতো করে চলেছেন একাই। কিছুদিন পর পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি দেখে বাংলাদেশ পর্যটন করর্পোরেশনের ট্রাভেল এন্ড ট্যুরিজম বিষয়ে ন্যাশনাল সার্টিফিকেট কোর্সে ভর্তি আবেদন করলেন এবং চান্স পেলেন। হাজার হাজার শিক্ষার্থীর মধ্যে থেকে চান্স পেলেন ২৩ জন। তার মধ্যে তিনিও পেলেন।

তারপর বেসরকারি পর্যটন সংস্থার পর্যটন ব্যবস্থাপক হিসেবে বেশ কিছুদিন চাকরি করলেন।২০০৮ সালে নিজের পর্যটন অফিস পরিচালনা করলেন। সাথে বেশ কয়েকটি সরকারি অফিসে আবেদন করলেন চাকরির জন্য।  ২/৩ টা  সরকারি চাকরি পেলেন কিন্তু সেখানে মাত্র সাত মাস চাকুরী করে আবার পর্যটন অফিস কার্যক্রম চালাতে থাকেন। পর্যটন অফিসের মাধ্যমে যা তিনি আয় করতেন তা তিনি বস্তি, পথশিশু, ভিক্ষুক, রিকশাচালক, খোলা আকাশের নিচে যারা বসবাস করেন প্রায় রাতে ৮/১০ টি  তেহেরির প্যাকেট কিনে নিয়ে পথ ধরে হাঁটতেন।

কখনো সদরঘাট টার্মিনাল, কমলাপুর রেলস্টেশন বা বস্তিতে, কখনো হাইকোর্টের মাজারের সামনে, কখনো গাবতলী বাস টার্মিনালে এভাবে সপ্তাহের ২/৩ দিন এ কাজ করতেন। পরবর্তী সময়ে ২০১০ সালে নিজেকে স্বেচ্ছাসেবী সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন বাংলাদেশ ইতিহাস-ঐতিহ্য কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করলেন। ২০১১ সালে স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন দেশপ্রেম সোসাইটি প্রতিষ্ঠা করলেন। নিজের গাঁটের টাকা খরচ করে সামাজিক সাংস্কৃতিক সেবামূলক অনুষ্ঠানের করতেন। তাছাড়া তিনি হিজড়া, বীরঙ্গনা, অসহায়-দুস্থ মুক্তিযোদ্ধা, শহীদ বুদ্ধিজীবী, ভাষা সৈনিক, স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র, স্বাধীন বাংলা ফুটবল দল, তাদেরকে নিয়ে অনুষ্ঠান করলেন।

সামাজিক বনায়ন কার্যক্রম চালিয়ে গেলেন। শীতের সময় শীতবস্ত্র বিতরণ করতেন। বীরঙ্গনা পরিবার কেমন আছেন তাদের দেখতে গিয়ে তাদের দুঃখ-কষ্টের গল্প শুনতেন। সিরাজগঞ্জ থেকে ১৩ জন বীরমাতা বীরাঙ্গনাদের ঢাকা এনে কাপড়চোপড়, খাবার, নগদ টাকা-পয়সা দিয়েছেন। স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মুক্তিযুদ্ধের গল্প বলা অনুষ্ঠান শুরু করেন। মুক্তিযোদ্ধা, ইতিহাসবিদ, শিক্ষাবিদ সবাইকে নিয়ে একসাথে তিনি এ সকল কার্যক্রম চালিয়ে যান।

গোপালগঞ্জ জেলায় ২০১৫ সালের ২৫ মার্চ মুক্তিযুদ্ধের গল্প বলা অনুষ্ঠানে ৩৫টি  শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের  শিক্ষার্থীদের আমন্ত্রণ জানালেন। প্রধান অতিথি করলেন তৎকালীন বীরমুক্তিযোদ্ধা নৌপরিবহন মন্ত্রী শাহজাহান খান। দুঃখ-কষ্ট-বেদনাকে সাথী করে বড় হওয়ার পরও কারো দুঃখ-কষ্ট দেখলে কষ্ট পান। তাদের পাশে গিয়ে দাঁড়ান এবং তাদের কষ্ট দূর করার চেষ্টা করেন। কোমল হৃদয়ের একজন মানুষ সেলিম রেজা। নিভৃতচারী নির্মোহ মানুষদের খুঁজে বের করে সম্মান জানানো উচিত। তিনি জীবনে অনেক কষ্ট পেয়েছেন কিন্তু জীবনে পরাজিত হওয়ার ব্যক্তি নন। বরং মানুষের জন্য কাজ করার ইচ্ছা, তাইতো তিনি অন্যের মাঝে নিজেকে বিলিয়ে দিতে ভালোবাসেন।

তিনি মুক্তিযুদ্ধকে মনেপ্রাণে শ্রদ্ধার জায়গায় স্থান দেওয়ার জন্য মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিকথন ও গল্প বলা অনুষ্ঠান করে যাচ্ছেন ২০১২  সাল থেকে। সমাজ ও মানবিক কাজ করতে পছন্দ করেন। তার যতটুকু বয়স তার থেকে তিনগুণ বেশি কাজ করেছেন। তিনি ব্যক্তিগতভাবে বঙ্গবন্ধুর আদর্শের ধারক ও বাহক হিসাবে তরুণ প্রজন্মের মধ্যেও বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য কাজ করে যাচ্ছেন। বঙ্গবন্ধুর আদর্শের প্রতি একান্ত অনুগত, সৎ সাহসী ও বেশ কিছুটা প্রচার বিমুখ নিভৃতচারী সেলিম রেজা।

বহুমাত্রিক.কম

Walton Refrigerator Freezer
Walton Refrigerator Freezer