Bahumatrik | বহুমাত্রিক

সরকার নিবন্ধিত বিশেষায়িত অনলাইন গণমাধ্যম

বৈশাখ ৪ ১৪৩১, বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪

ফিরে দেখা: কফিল মাস্টারের রক্তে রঞ্জিত ভাওয়াল মির্জাপুর

মাসুদুল হক

প্রকাশিত: ০০:২০, ২৬ জুন ২০১৯

আপডেট: ০০:৪২, ২৬ জুন ২০১৯

প্রিন্ট:

ফিরে দেখা: কফিল মাস্টারের রক্তে রঞ্জিত ভাওয়াল মির্জাপুর

ছবি : লেখক

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কাছে খবর আসলো জয়দেবপুরের আওয়ামী লীগ নেতা কফিল উদ্দিনকে গণবাহিনীর ক্যাডাররা গুলি করে হত্যা করেছে। বঙ্গবন্ধুর কপালে ভাঁজ পড়ল। ধরা গলায় জিজ্ঞেস করলেন,‘কোন কফিল ? ওই মাস্টার, যে সব সময় পান চিবোয়?’

১৯৭৫ সালের ২৪ জুন মঙ্গলবার জাসদ গণবাহিনীর হাতে ভাওয়াল মির্জাপুর হাজী জমির উদ্দিন উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে নৃশংসভাবে খুন হন কফিলউদ্দিন মাস্টার। তিনি ওই বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ও মুক্তিযুদ্ধের ওই অঞ্চলের সংগঠক। আর খুনিরা তারই ছাত্র। রক্ষিবাহিনী , সরকারি পুলিশ বাহিনী বনাম জাসদের গণবাহিনীর লড়াইয়ে দেশব্যপি হাজারো রক্তক্ষয়ের কলঙ্কজনক ঘটনা ঘটেছে। কিন্তু এই হত্যাকান্ডের প্রতিক্রিয়া ও প্রভাব আজও ওই জনপদে বিরাজমান।

বঙ্গবন্ধু ব্যক্তিগতভাবে কফিল উদ্দিন মাস্টারকে চিনতেন। তিনি স্থানীয় সংসদ সদস্য শামসুল হককে নির্দেশনা দিলেন কফিল উদ্দিন মাস্টারের মৃতদেহ সংসদ ভবনে আনতে। পরদিন সকালে মহকুমা শহরের একটি নিভৃত পল্লীর বিদ্যালয় মাঠে এম আই ৪ মডেলের ঢাউস আকারের হেলিকপ্টার নামল।

কফিল উদ্দিন মাস্টার এবং তাঁর সঙ্গে নিহত জনপ্রিয় অভিনয় শিল্পী শেহের আলীর মৃতদেহ নিয়ে হেলিকপ্টার ফিরল সংসদ ভবন প্লাজায়। সেখানে বঙ্গবন্ধুর উপস্থিতিতে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। এ ঘটনার মাত্র ৫২ দিন পর বঙ্গবন্ধু সপরিবারে শহীদ হন। পরিনতিতে সারাদেশে হত্যা,গুম, ডাকাতিসহ যে বিশৃংখল পরিবেশ তৈরি হয়, মির্জাপুরও এর বাইরে ছিল না ।

যেভাবে খুন হলেন কফিলউদ্দিন মাস্টার

২৪ জুন বিকেলে স্কুল মাঠে স্থানীয় দুই দলের ফুটবল খেলা ছিল। হাজারো দর্শক মাঠের চারিদিকে জড়ো হয়ে খেলা উপভোগ করছিলেন। এ উপলক্ষে নির্মিত মঞ্চে প্রধান অতিথি হিসাবে কফিল উদ্দিন মাস্টার উপবিষ্ট ছিলেন। খেলা শেষ পর্যায়ে। ততক্ষণে দিনের আলোও কমে এসেছে। আচমকা স্টেনগানের মুহুর্মুহু ফাঁকা গুলির প্রচন্ড শব্দ। মুহূর্তেই ফাঁকা হয়ে যায় মাঠসহ আশপাশের এলাকা। মঞ্চে বসে আছেন কফিলউদ্দিন মাস্টার এবং শেহের আলী। ঘটনা বুঝার চেষ্টা করছেন। এরমধ্যেই সামনে এসে দাড়াঁলেন মাস্টারের দুই ছাত্র জাহাঙ্গীর ও দুলাল আর হায়দার ওরফে মুক্তার আলী, মুসলেম, নিয়ামত। স্যারকে ছালামও দিলেন।

কী হতে যাচ্ছে মুহূর্তেই বুঝতে পেরে শেহের আলী স্যারকে জাপটে ধরে সরিয়ে নেয়ার চেষ্টাকরা মাত্রই শুরু হলো স্বয়ংক্রিয় স্টেনগানের গুলি। মঞ্চেই লুটিয়ে পড়লেন শেহের আলী। কফিল মাস্টার মঞ্চ থেকে পূব দিকে দৌঁড়ে ৫০ ফুট পর্যন্ত যেতে পেরেছিলেন। মসজিদের সামনে ফেলে উপর্যুপরি গুলি করে ঘাতকরা মৃত্যু নিশ্চিত করে চলে যায়। নির্ভরশীল সূত্র জানান ঘাতকরা তাদের মিশনে অত্যাধুনিক এম-২ স্টেনগান ব্যবহার করে। ৩২ রাউন্ড গুলিভর্তি এই স্টেনগানটি সেকেন্ড ৩৬৫ মিটার দূরত্বের লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানতে পারে। শেহের আলীর বুকে বিদ্ধ হয় ৪টি আর কফিল উদ্দিন মাস্টারের বুক ছিন্নভিন্ন করে ৩৬ টি গুলি।

হত্যাকান্ডের নেপথ্য কাহিনী

কফিল উদ্দিন মাস্টারের হত্যাকন্ডের ৪৪ বছর পরও এর প্রভাব ও নানা গুঞ্জন এখনও তরতাজা। কিন্তু সবই ফল্গুধারার মত প্রবাহমান, প্রকাশ্যে কেউ মুখ খুলতে চায় না। মায়াবি চেহারার এক স্কুল বালক (জাহাঙ্গীর আলম) কেন তাঁর শিক্ষককে দলবল নিয়ে প্রকাশ্যে হত্যা করল । এটি কী শুধুই তৎকালীন সরকার ও গণবাহিনীর দ্বন্ধের ফসল। জাহাঙ্গীর বাহিনীর এতো বেপরোয়াভাব, প্রভাব বা অত্যাধুনিক অস্ত্রেরই বা উৎস কী - এসব জল্পনা-কল্পনা হত্যাকান্ডের পরে যেমন ছিল , এত বছর পরেও তেমনি আছে।

জাহাঙ্গীর আলমের বাড়ি মির্জাপুরের কাছেই ডগরী গ্রামে। তার পরিবারসহ ডগরী, পাইনশাইল, আঙ্গুটিয়া চালা , তালতৈল, কাঞ্জিয়ানুল, পিরুজালি,বিকেবাড়ি এলাকার অধিকাংশ অধিবাসীদের আদি নিবাস টাঙ্গাইল। বিশেষ করে টাঙ্গাইলের মির্জাপুরে। স্থানীয়ভাবে এ অঞ্চল ‘ভাওয়াল মির্জাপুর’ আর টাঙ্গাইল মির্জাপুর ‘ কাঠাইল্যা মির্জাপুর’ হিসাবে পরিচিত। দুই অঞ্চলের লোকজনের এই আত্ত্বিক যোগাযোগ অতি নিবিড়। মুক্তিযুদ্ধোত্তর উত্তাল ছাত্র আন্দোলনের ‘চার খলিফা’র একজন শাজাহান সিরাজের ঘনিষ্ট আত্মীয়তা ছিল জাহাঙ্গীর আলমের পরিবাররের সঙ্গে।

জাহাঙ্গীর আলমের বড় ভাই খোকা ও শাজাহান সিরাজ আপন ভাইরা ভাই। দেশ স্বাধীনের মাত্র ১০ মাস ১৫ দিন পর সরকারকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে জন্ম নেওয়া জাসদের অন্যতম রূপকার ও শীর্ষস্থানীয় নেতাও এই শাজাহান সিরাজ। তিনি তার দলের গোপন ‘মিলিশিয়া বাহিনী’ হিসাবে গঠিত গণবাহিনী পরিচালনা ও নিরাপদ অস্ত্রভান্ডার হিসাবে ঘণ অরণ্যবেষ্টিত নদীঘেরা ভাওয়ালের এই জনপদকে বেছে নেয়। জাহাঙ্গীরের তেজ, সাহস, সাংগঠনিক দক্ষতা দেখতে পান তিনি। ফলশ্রুতিতে সৃষ্টি হয় ভয়ঙ্কর ত্রাস ঠান্ডা মাথার খুনি জাহাঙ্গীর।

কফিল উদ্দিন মাস্টার হত্যার নেপথ্যের ইন্ধনদাতা হিসাবে আঙ্গুল ওঠে তাঁরই এক সহকর্মীর দিকে। ওই সহকর্মীও আওয়ামী লীগ নেতা হিসাবে মুক্তিযুদ্ধে উল্লেখযোগ্য সাংগঠনিক দক্ষতা দেখান। তিনি প্রকাশ্যে জাসদ রাজনীতির সঙ্গে জড়াননি কিন্তু পরবর্তীতে বিএনপির ডাটসাইটে নেতা হিসাবে পরিচিতি পান। কফিল উদ্দিন মাস্টার নিহত হওয়ার আনুমানিক এক মাস আগে রাতের অন্ধকারে সংঘবদ্ধ কিছু লোক ডগরী গ্রামে জাহাঙ্গীরের বাড়িতে ব্যাপক ভাংচুর করে। এ ঘটনার কাউকে সনাক্ত করা যায়নি বা কেউ দায় স্বীকারও করেনি। কিন্তু স্থানীয় একটি মহল ওই ঘটনায় কফিলউদ্দিন মাস্টার জড়িত থাকতে পারে বলে জাহাঙ্গীরের কান ভারী করে। এ ক্ষেত্রেও প্রধান কুশীলব সেই সহকর্মী।

‘জাহাঙ্গীরের বাড়িতে হামলার প্রতিশোধ হিসাবে কফিল উদ্দিন মাস্টারকে হত্যা করা হয়েছে’- গণবাহিনীর সমর্থকরা এটি প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করলেও সাধারন মানুষ এটা একেবারেই আমলে নেয়নি। আম জনতা কফিল উদ্দিন মাস্টারকে ‘মুক্তিযোদ্ধা, সরকারি দলের নেতা, স্থানীয় একমাত্র উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক, দৃঢচেতা, স্পষ্টভাষী - এমন কী তাঁর দ্রুত বেপরোয়া হয়ে উঠতে থাকা ছাত্রটিকে (জাহাঙ্গীর) প্রকাশ্যে শাসন করতে পারে’ এভাবে চিনে। তিনি ওই স্বভাবের ছিলেন বলে ঘাতক ছাত্র যখন সামনে এসে সালাম দিয়ে দাড়াঁয় সঙ্গে থাকা শেহের আলী তাৎক্ষণিক পরিণতি আন্দাজ করতে পারলেও কফিল উদ্দিনের বিশ্বাস করতে খানিকটা সময় লেগেছিল। জাহাঙ্গীর বাহিনীর ‘থিঙ্ক ট্যাংক’ ছিলেন তার চেয়ে পাঁচ বছরের সিনিয়র -দুলাল।

জাহাঙ্গীর-দুলাল নাম দুইটি হয়ে ওঠে ভীতি-ভয়জাগানিয়ার সমার্থক। চিঠি দিয়ে ডাকাতি, দিনদুপুরে লোকজন ধরে নিয়ে গাছে উল্টো করে ঝুলিয়ে পিটানো এসব ছিল মামুলি ও নিত্যদিনের ঘটনা। এক রাতে জাহাঙ্গীরের বাড়ির অদূরে পদ্মিপাড়া মহল্লায় অবস্থাপন্ন আদিবাসীদের ২০ পরিবারের প্রতিটি ঘরে একযোগে দাউ দাউ করে আগুন জ্বলে ওঠে। বিভিষিকাময় সেই রাতেই পরিবারগুলো বন পোড়া হরিণির মতো বাস্তুভিটা ফেলে পালালো। পরদিন থেকে আদিবাসী পরিবারগুলোর ফেলে যাওয়া অন্ততঃ ১৫০ বিঘা জমির মালিক জাহাঙ্গীর।

মির্জাপুরের কোল ঘেঁষে বয়ে যাওয়া স্রোতস্বিনী তুরাগ নদে কত মানব সন্তানের গলা কাটা দেহ ভেসে গেছে তার হিসাব কেউ রাখেনি। পার্শ্ববর্তী বহুরিয়া চালার খালসংলগ্ন ঈদ গাঁ মাঠটি হয়ে উঠল মানুষ জবাইয়ের কসাই খানা। এক সময় ওই মাঠে ঈদের নামাজ পড়া বন্ধ হয়ে যায়। এ সব নারকীয় ঘটনা বন্ধ হয়ে যাওয়ার পরও অনেকদিন পর্যন্ত আশপাশের জমি পতিত পড়ে রইল। দিনের বেলায়ও ঈদ গাঁ মাঠের দুই-তিন কিলোমিটার এলাকায় যেতে সাহস করত না কেউ। 

জাহাঙ্গীরের খুনের বদলা: খুন হলেন পিতা-পুত্র

জাহাঙ্গীর আলমের করুণ অসহায় ও নৃশৃংস্য খুন তার অনুসারীদের স্তম্ভিত , দিশেহারা করে দেয়। এই পরিণতি মেনে নেয়া কঠিন। মির্জাপুর ও আশপাশের এলাকার প্রত্যেকটি লোকের অভিব্যক্তি ভাবলেশহীন। জাহাঙ্গীর নিহতের ঘটনায় কে খুশি কে বেজার বুঝার উপায় নেই।

কিন্তু ভেতরে ভেতরে জাহাঙ্গীরের অনুসারীরা শোক কাটিয়ে প্রতিশোধ নিতে মরিয়া। তাদের সন্দেহ গিয়ে পড়ে পশ্চিম ডগরী এলাকার সায়ের উল্লাহ মুসুল্লি পরিবারের উপর। সম্ভ্রান্ত এ পরিবার জাহাঙ্গীরের অনুসারীদের হাতে একাধিকবার লাঞ্ছিত হয়েছে। গোষ্ঠি বড় হওয়ায় তারা অত্যাচার কখনোই মুখ বুজে সহ্য করত না।

জাহাঙ্গীর হত্যাকান্ডের এক মাসের মাথায় সায়ের উল্লাহ’র বড় ছেলে আব্দুল্লাহকে দুর্বৃত্তরা পিরুজালি থেকে ধরে নিয়ে যায়। সেখান থেকে কালিয়াকৈরের গলাচিপায় নিয়ে তাকে গলা কেটে হত্যা করে। খুনিরা গর্ব করে নিহতের পরিবারের কাছে লাশের সন্ধান দেয়। এর এক মাস পর মির্জাপুর রাজারের কাছাকাছি থেকে অপহৃত হন স্বয়ং সায়ের উল্লাহ। পরদিন রাজেন্দ্রপুরের গহিন জঙ্গলে লাশ মেলে সায়ের উল্লাহর।

ট্র্যাজিক ভিলেন: জাহাঙ্গীরনামা’র হঠাৎ অবসান

উচ্চতা প্রায় ছয় ফুট। বড়সর শরীর দেখে বুঝার উপায় নেই সদ্য উচ্চ বিদ্যালয়ের পাঠ শেষ করেছে। গায়ের রঙ কালো হলে কী হবে - চেহারা খুবই মিষ্টি। আর হাসলে সৌন্দর্য বেড়ে যায় কয়েক গুণ।

প্রকৃতির নিষ্ঠুর রসিকতা বোধ হয় এটি। এই মায়াবি চেহারার বালক তাঁর অল্প আয়ুর জীবনে দেশের জন্য যুদ্ধ করেন। স্বাধীন দেশের বয়স এক বছর পেরোতেই যে হটকারী রাজনীতি শুধু হয় - দেশের সম্ভাবনাময় লাখো তরুনের মতো সেও তাতে যোগ দেয়। রাজনীতির নামে খুন, রাহাজানি, ডাকাতি, লুটতরাজ। তিন বছরের রীতিমত দানবীয় শাসনের অবসান হয় আততায়ীর হাতে খুনের মাধ্যমে। এই ট্র্যাজিক ভিলেনের নাম জাহাঙ্গীর।

ইতিহাসের শিক্ষা হচ্ছে - কোন দুঃশাসনই দীর্ঘস্থায়ী হয় না। সেই রাতে বন্ধু দুলালের মির্জাপুর পূর্ব পাড়ার বাড়ি থেকে মোটর সাইকেলে চেপে নিজ বাড়ি ফিরছিলেন। পেছনে বসা ছিলেন তার এক সহচর মোসলেম। মোটর সাইকেলটি স্থানীয় জাইল্লা হোতা পুকুর পাড়ে পৌঁছামাত্র অন্ধকার থেকে আচমকা আক্রমন। খুব কাছ থেকে চকচকে বর্শা দিয়ে জাহাঙ্গীরের বুকে আঘাত করে ধাতব অংশের পুরোটা ঢুকিয়ে দেয়া হয়। মৃত্যু নিশ্চিত করার জন্য করা হয় আরও কয়েকটি আঘাত।

খানিকটা দূরে মোসলেমের ক্ষত-বিক্ষত নিথর দেহ পড়ে আছে। আততায়ীদের আক্রোশ এর প্রতি বেশি ছিল তা পরিষ্কার বুঝা যায়। এলাকায় ব্যাপকভাবে প্রচলিত আছে - অন্ধকারে আততায়ীরা মোসলেমকে দুলাল ভেবেছিল। কারণ জাহাঙ্গীরের মোটর সাইকেলের পেছনে সাধারণত দুলালই বসা থাকত।

বহুমাত্রিক.কম

Walton Refrigerator Freezer
Walton Refrigerator Freezer