-‘প্রাণিবন্ধু’ কর্পোরাল মোঃ আবদুর রউফ (১৯৭৯-২০১৮)
আর মাত্র ২৬ দিন বাকী। প্রাণিবন্ধু আবদুর রউফের প্রয়াণের দ্বিতীয় বর্ষপূর্তি সমাগত। বেদনাবিদূর সেই দিনটি যতোই ঘনিয়ে আসছে হৃদয়ের হাহাকার নতুন করে জেগে উঠছে। সেই বেদনার আখ্যান মেলে ধরতে অগণিত শব্দরাজিও যেন অপরাগ। মনুষ্যজগতের ভাষার পরিধি ছাপিয়ে প্রাণিজগতের যে অজস্র ভাষার অস্তিত্ব বিজ্ঞান জানাচ্ছে, তা যদি আমরা বুঝতে পারতাম তবে হয়তো প্রাণিবন্ধুর বেদনার আখ্যান খানিক পূর্ণতা পেত।
তবুও দূরতম কল্পনায় আমার অভিন্নহৃদয় দাদাভাইয়ের কত স্বরূপই না আজ কল্পনা করি! বেদনাশ্রু আজ আরও প্রগাঢ়। আরও শূণ্যতা আর অসহায়ত্বের আর্তচিৎকারে বিদীর্ণ। তাঁর অতৃপ্ত আত্মার যে ক্রন্দনধ্বনি নীরবে শিমুলতলার স্নিগ্ধ-শ্যামল অঙ্গন ছাপিয়ে দিগ-দিগন্ত আচ্ছন্ন করছে নিয়তই, তা ভাতৃহৃদয়কে আড়াল করতে পারছে কৈ?
মায়াময় লাজুক যে মূর্তি নিয়ে মশাখালীর মাতুলায়ে জন্মেছিলেন প্রাণিবন্ধু আবদুর রউফ-জীবনভর সেই রূপেই তাকে দেখেছেন সবাই। হয়তো সেজন্যই তাকে ঘিরে স্বজন-শুভার্থীদের হৃদয়ের ফেনায়িত হাহাকার চিরজীবন্ত বেদনার দীর্ঘশ্বাসে রূপ নিয়েছে। চার দশকের সংক্ষিপ্ত পার্থিব জীবনে যেন বহু জনমের ভালোবাসা বিলিয়ে যেতে পেরেছেন তিনি! নয়তো তাকে ঘিরে এতো বেদানাশ্রু কেন গড়াবে?
ফুলগুলো দাদাভাইয়ের খুব প্রিয় ছিল। তাই নিয়মিতই তাঁর সমাধিতে নিবেদন করা হয় শ্রদ্ধার্ঘ
প্রাণাধিক প্রিয় এই ভাইটির চিরপ্রস্থানের দ্বিতীয় বার্ষিকী সামনে রেখে মনে মনে কতোই না বিস্ময় আর স্মৃতি জাগিয়ে তুলছে। ক্রমেই কালের গর্ভে বেদনার স্মৃতি হয়ে যাচ্ছেন আমার দাদাভাই! কই, সেদিনই তো আমাকে নিয়ে বাড়ির পাশের খালে ছুটলেন মাছ ধরতে। আমাকে কেবল একপাশ থেকে মাছেদের ধাওয়া করতে বললেন। অল্প সময়ে রীতিমতো এক দিনের প্রয়োজনীয় মাছ ধরে তবেই ফিরলেন আমাকে নিয়ে। একজন পুরো দস্তুর সৈনিকের এমন কৈশোরভাবাপন্ন মনোভাব আমৃত্যুই ধরে রেখেছিলেন দাদাভাই।
সম্ভবতঃ এপ্রিল ২০১৩। সবে বাংলানিউজ২৪ ছেড়েছি। রাজধানীর ফ্রি-স্কুল স্ট্রিট (ভূতের গলি) এর একটি বাড়ির তৃতীয় তলায় ভাড়া থাকি আমি। জানলাম দাদাভাই দু’মাসের ছুটি নিয়ে বাড়ি এসেছেন। ছুটি এসে তাঁর সবচেয়ে প্রিয় কাজের একটি বড়শিতে মাছ ধরা। ফোন করে জানালাম আপনার প্রিয় সখপূরণে আমি একটি আয়োজন করতে চাই। সঙ্গে সঙ্গেই রাজি হয়ে গেলেন শিশুর মতো সরলতায়। চিন্তা করলাম দূরে কোথাও এই আয়োজনটি করা গেলে ভ্রমণ ও মাছ ধরা দু-ই হবে। তাই বন্দোবস্ত হলো।
নানা জায়গায় ফোন করে অবশেষে খুলনায় আমার এক বোনের সহায়তা চাইলাম। আমার প্রিয় সাংবাদিক সহকর্মী শেখ হেদায়েতুল্লাহ’র সহোদর বোন হোমিও চিকিৎসক ডা. আরেফা-কেও আমি নিজ ভগনিজ্ঞান করি পূর্বে থেকেই। আপা, সানন্দে আমন্ত্রণ করলেন। সম্ভবত দুপুর নাগাদ পৌছে গেলেন দাদাভাই ছিপ-বরশি ও অন্যান্য সরঞ্জাম সমেত। সন্ধায় আমরা বেরিয়ে পড়লাম খুলনার বাস ধরতে। যানজটের কারণে ভূতের গলি থেকে হেটে ধানমন্ডি কলাবাগান পেরিয়ে আরও সামনে থেকে রিকশা করে শ্যামলী পৌছে বাস করে ভোরে খুলনায় পৌছাই আমরা।
পথে পাটুরিয়া-দৌলদিয়া দিয়ে ফেরিতে পারাপারের সময় নদীবক্ষে দুই সহোদরের আবেগসিক্ত স্মৃতি চিরঅক্ষয় হয়ে রইল। বাসের আসন থেকে উঠে দুই ভাই ফেরিতে নদীর শীতল জলের হিমেল আলিঙ্গনে কতোই না স্বপ্ন রচনা করেছিলাম ভবিষ্যতের জন্য। আমাকে ফাঁকি দিয়ে কিভাবে দাদাভাই আজ দূরগিন্তে বিলীন হলেন? সেই ভবিষ্যত নির্মাণে আমি কতটা একা, কতটা অসহায় হয়ে গেলাম-তা কী তিনি একবারও ভাবলেন না! ভেবে চোখ ভিজে যায়।
কত বাহারি ফলের গাছরই তিনি লাগিয়েছিলেন! সেইসব গাছে এবার ধরেছে থরে থরে ফল
প্রত্যুষে খুলনা মহানগরীতে পৌছে ভাগনিদের জন্য কিছু মিষ্টি কিনে রিকশা করে বোনের বাড়ি মুসলমানপাড়ার হদিস যখন করছিলাম তখন নগরীর পরিচ্ছন্ন রূপ দেখে দাদাভাই বড়ই মুগ্ধ হয়েছিলেন। বাসায় পৌছে আমি কিছু সময়ের জন্য ঘুমিয়ে পড়লেও দাদাভাই আপার এক সহকারীকে নিয়ে বেরিয়ে পড়েছিলেন শহরের কোথায় বরশিতে মাছ ধরার ‘টোপ’ পিপড়ার ডিম পাওয়া যায়। শহর ঘুরে ঠিকই পিপড়ার ডিম খোঁজে এনেছিলেন। বেলা না বাড়তেই আমরা দুই ভাই বেরিয়ে পড়েছিলাম হেদায়েত ভাইদের মৎস্য ঘের খুলনার ডুমুরিয়ার উদ্দেশ্যে।
ঠিকানা অনুযায়ী রূপসা নদী পেরিয়ে আমরা ঠিক পৌছে গিয়েছিলাম। সেখান মাছ যতোটা না ধরা গিয়েছিল তারচেয়ে উল্লেখযোগ্য ছিল হোদায়েত ভাইয়ের মায়ের অপার স্নেহ। তিনি রীতিমতো পানিতে নেমে আমাদের বরশি ফেলতে সহযোগিতা করেছিলেন। ফেরার পথে আন্তঃনগর ট্রেনে দুই ভাইয়ের অবিস্মরণীয় সেইসব স্মৃতি-কথোপকথন আমার এখনকার সকল ভ্রমণান্দকে গ্রাস করে। চিরদিন হয়তো সেই হাহাকার নিয়েই কাটবে।
দেশের বাইরে যখন প্রথম ভারতবর্ষে গেলাম সেটা ২০১৮ এর ১৩ এপ্রিল। সেই যাত্রায় প্রতি মুহুর্তে আমার খোঁজ নিয়েছেন দাদাভাই। এত স্নেহে কুশল আর তো কেউ জানতে চান না! ১২ এপ্রিল ২০১৮ দিনের বেলা। চারদিক ঘোর অন্ধকার নেমে এলো হঠাৎই। কালবৈশাখী ঝড়ের তান্ডব শুরু হলো। আমি মোহাম্মদপুর বাসস্ট্যান্ড মসজিদ সংলগ্ন একটি দোকানে ভিসা ফরম পূরণ করছিলাম অনলাইনে।
এসময় ফোন করলেন দাদাভাই, সব জেনে মন্তব্য করলেন, ‘তোর ভিসা তো দ্রুতই হয়ে যাবে’। ঠিকই স্বাধীন ভারতভূমিতে তেরঙ্গা জাতীয় পতাকা উত্তোলন দিবস উপলক্ষে কলকাতায় আয়োজিত অনুষ্ঠানে যোগ দানের জন্য দ্রুততার সঙ্গেই ভিসা মঞ্জুর করলেন হাই কমিশন। দাদাভাইয়ের মন্তব্য ঠিক ফলে গেল। কিন্তু যে ঘোর অন্ধকার সেদিন দিবালোকে নেমে এসেছিল তা কী আমার জীবনের ঘোর অন্ধকারকেই নির্দেশ করেছিল? আজ সেই স্মৃতি ভেবে বার বার ব্যাকুল হই।
এসব ফুল ফসলের মাঝেই যেন প্রাণিবন্ধুর অস্তিত্ব
প্রিয় দাদাভাইহীন দুইটি বছর অতিক্রম করতে চলেছি আমরা। আমার মতোই বাবা-মা হারিয়েছেন তাদের প্রাণপ্রিয় জ্যেষ্ঠপুত্রকে। সুখি-আবির হারিয়েছে তাদের বটবৃক্ষ বাবাকে। বলতে গেলে তিনি আমাদের সবারই বটবৃক্ষ ছিলেন। ভাইহীন এই দুইটি বছরে প্রিয়-অপ্রিয় কত কিছুই না প্রত্যক্ষ করেছি।
তবে হৃদয়ে সবচেয়ে দাগ কাটা কথাটি আমার মা প্রতিনিয়তই উচ্চারণ করেন। অনেকের কাছেই হয়তো বেদনা সয়ে যাওয়ার মতো ব্যাপারটি ঘটে গেছে। তবে জননীর এই অনন্ত ক্রন্দন যেন সব বিদীর্ণ করে খোদার আরশ প্রকম্পিত করে তুলছে। মা যখন করুণস্বরে আমাকে প্রশ্ন করেন, ‘তোমার দাদাভাইকে ফোন করো না? তাঁর না আমাকে ছুটি দেওয়ার কথা!’-বাষ্পরুদ্ধ আমি নির্বাক অশ্রুবিসর্জন করে জননীকে আলিঙ্গন করা ছাড়া যে আর কোন জবাব দিতে সক্ষম নই।
স্মৃতির সমুদ্র ঘেঁটে কতই না হৃদয়মথিত ঘটনা উঁকি দেয়। সময়ের স্রোতে বেদানাশ্রু ক্রমেই বিলীন হয় চিরায়ত নিয়মে। কিন্তু নির্ভরতা আর স্নেহের এমন কিছু ক্ষুধা থাকে যা কেবল কিছু স্বজনই পূরণ করতে পারেন। দাদাভাই তেমনি অমলিন চিরউজ্জ্বল এক চরিত্র আমার যাপিত জীবনে।
স্বার্থহীনতা ও সর্বস্ব বিলিয়ে দেবার যে প্রবণতা দাদাভাইয়ের ছিল, তা ছিল আমার ব্যক্তি জীবনের এক পাঠশালা। সৃষ্টিকর্তা হয়ত তাঁর চিরবিদায়ের অনেক পূর্ব থেকেই আমাকে ইঙ্গিতে জানান দিচ্ছেন আমার বৃটবৃক্ষের পতনের পূর্বাভাষ। একটি সিদ্ধান্তে খানিক মতবিরোধে অভিমানে আমি দাদাভাইয়ের অসুস্থ হবার সময়ে পবিত্র রমজানের ঈদে বাড়ি যাইনি। ঈদের দুই এক রজনী পূর্বে দাদাভাইয়ের ছবি সামনে রেখে দীর্ঘ সময় একান্তে যে অশ্রুবিসর্জন করেছিলাম-তখন সবকিছুর অলক্ষ্যেই এক অশনি বার্তা আমার হৃদয়কে দুমড়ে মুচড়ে দিয়েছিল মোহাম্মদপুরের বসিলার বাসায়। সপ্তাহ গড়ায়নি দুরারোগ্য ব্যাধি দাদাভাইকে আচ্ছন্ন করে ফেলে। ফোনে কাতরকণ্ঠে দাদাভাই যখন জানাচ্ছিলেন তাঁর যন্ত্রণাময় মুহূর্তগুলোর কথা আমি ঝড়ের বেগে ছুটে গিয়েছিলাম তাকে ঢাকায় নিয়ে আসতে।
এখন ইচ্ছা করেই সেই মুহূর্তগুলো থেকে নিজেকে সরিয়ে রাখতে চেষ্টা করি এজন্য যে সেইসব স্মৃতি ভেতরটাকে এমনভাবে দুমড়েমুচড়ে দেয় যে তা সহ্যের সীমা অতিক্রম করে। কষ্টকরে নিজেকে স্থির করে তাঁর কর্তব্যের মাঝে নিজেকে নিবিষ্ট করে উৎরে যাবার নিষ্ফল চেষ্টা করি। খুব মনে পড়ে, তাঁর চলে যাওয়ার দুই এক বছর পূর্বে অন্তত কয়েকবার তিনি আমার বাসায় এসেছিলেন।
এরমাঝে অন্ততঃ দু’বার দাদাভাই আমার পকেটে জোর করে টাকা গুজে দিয়ে যান, যেমন করে শৈশব-কৈশোরে দিতেন! কোনো সংকট না থাকলেও প্রায়শঃই ফোন করে জানতে চাইতেন টাকা আছে কিনা? ঐশ্বর্য থাকলেও যে সবাই অভিভাবক হতে পারেন না তা চারপাশ দেখলে অনায়াসে টের পাওয়া যায়। দাদাভাই যেন আজন্ম অভিভাবক হয়েই জন্মেছিলেন, বটবৃক্ষের মতো অভিভাবক-যাঁর ছায়ায় সবাই সুশীতল হতে পারেন।
এক বটবৃক্ষের পতন। প্রিয় শিশুপুত্রকে এমন স্নেহ-আশীর্বাদ করা ছবি আজ কেবলই বেদনাময় স্মৃতি
কেবল স্বজনদের প্রতি অপার স্নেহ আর কর্তব্যবোধই নয়-প্রাণিজগতের প্রতি তাঁর ভাবাবেগ ও গভীর অনুরাগ তাকে এক অনন্য মানুষে রূপান্তর করে। জীবনের শেষ সময়গুলোতে প্রাণিদের নিয়ে তাঁর নানামূখি প্রচেষ্টা হৃদয়স্পর্শ করবার মতো। ভাই হিসেবে তাই হয়তো ‘প্রাণিবন্ধু’ হিসেবে তাকে অভিষিক্ত করে খানিক শ্রদ্ধা নিবেদনের প্রয়াস পেয়েছি। বেঁচে থাকলে হয়তো পরিকল্পনামতো নানামূখি প্রচেষ্টার মধ্য দিয়েই পরিস্ফুট হবে প্রাণিবন্ধুর স্মৃতি।
ক’দিন পূর্বে উদযাপিত হয়েছে পবিত্র ঈদুল ফিতর। শ্রীপুরের শিমুলতলা গ্রামে প্রায় দুই সপ্তাহ কাটিয়ে অধিকাংশ সময়ই নীরবে তাঁর স্মৃতি রোমমন্থনের চেষ্টা করেছি। তাঁর পবিত্র সমাধিপার্শ্বে গভীর রজনীতে অবস্থান করে সমাধিস্থ করবার মুহূর্তের দাদাভাইয়ের শীতল দেহখানা আর মায়াময় মুখাবয়ব মনে করছিলাম। সবুজঘাসে শান্ত-স্নিগ্ধগ্ধ সেই অঙ্গনে যেন এক চিরশান্তির আবহ। রমজানের পবিত্র রজনীতে উন্মূক্ত তাঁর আত্মা কী তবে আমার সঙ্গে লীন হয়েছিল?
তবে সমাধিচত্বর পেরিয়ে বাড়ি পথে দাদাভাইয়ের স্নেহমাখা সুন্দর হাতে রোপণ করা বৃক্ষরাজি যেন ঠিকই তাঁর সগৌরব উপস্থিতি জানান দিচ্ছিল। তাঁর শেষ কর্মস্থল রাজশাহী সেনানিবাসে থাকার সময়কালে অনেক কষ্ট স্বীকার করে নিয়ে আসা বিভিন্ন জাতের আম গাছগুলো কয়েক বছরে বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয়ে দুই বছর ধরে ফল দিতে শুরু করেছে। এবার এর পরিমাণ ক্রমেই বৃদ্ধি পেয়েছে। গাছগুলোতে অপরূপ সৌন্দর্য নিয়ে ঝুলে থাকা আমের গুচ্ছ কিংবা বর্ণিল পুষ্পমঞ্জরি নিয়ে প্রস্ফুটিত ফুলগাছের সারি যেন প্রিয় দাদাভাইয়ের অক্ষয় স্মৃতিকেই সগৌরবে ঘোষণা করছে।
আশরাফুল ইসলাম: প্রয়াত প্রাণিবন্ধু আবদুর রউফের ছোটভাই ও বহুমাত্রিক ডটকম এর প্রধান সম্পাদক।
‘প্রাণিবন্ধু’র চিরঘুম ও আমাদের অনন্ত রোদন
বহুমাত্রিক.কম