Bahumatrik | বহুমাত্রিক

সরকার নিবন্ধিত বিশেষায়িত অনলাইন গণমাধ্যম

বৈশাখ ৪ ১৪৩১, শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪

পেঁয়াজ-আলুর উচ্চমূল্য ও আমাদের করণীয়

ড. মো. হুমায়ুন কবীর

প্রকাশিত: ১৭:১৩, ৫ নভেম্বর ২০২০

প্রিন্ট:

পেঁয়াজ-আলুর উচ্চমূল্য ও আমাদের করণীয়

করোনাকালে এমনিতেই দেশের মানুষের বিভিন্ন দিকে কষ্টের শেষ নেই, তার উপর আবার নিত্যপণ্যের উচ্চমূল্য মরার উপর খাড়ার ঘা হয়ে দেখা দিয়েছে। বাজারে অনেক নিত্যপণ্যের মূল্য স্বাভাবিকের চেয়ে একটু বেশি থাকলেও তা মোটামুটি ক্রয় ক্ষমতার মধ্যেই রয়েছে।

তাছাড়া যেহেতু সদ্য একটি বড় বন্যা বাংলাদেশের উপর দিয়ে বয়ে গেছে এবং বর্ষাকাল একটু প্রলম্বিত হয়েছে। তাই উৎপাদন কম হওয়ার কারণে বাজারে সরবরাহ কম থাকায় শাক সবজির দাম কিছুটা বৃদ্ধি পেয়েছে। অবশ্য আমরা একটু স্মরণ করলে বুঝতে পারবো বছরের এ সময়টাতে এমনিতেই সবসময় এসব পণ্যের দাম একটু বাড়তি থাকে।

আলু, পেঁয়াজ- এগুলো যেহেতু শীতকালীন ফসল সেজন্য বছরের শেষদিকে এসে বাজারে একটু টান পড়ে। তবে যেহেতু আলুর বিষয়টি এবারই প্রথম হলেও পেঁয়াজের বিষয়টি গতবছর থেকে সমস্যা শুরু হয়েছিল। সেজন্য পেঁয়াজের বাজার ব্যবস্থাপনাটা সঠিকভাবে করতে পারলে হয়তো এ সমস্যা এখন হওয়ার কথা ছিল না।

আমরা জানি কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের হিসাব মতে দেশে প্রতিবছর পেঁয়াজের চাহিদা হলো প্রায় ২.৮ মিলিয়ন মে. টন। আমাদের উৎপাদন হয় সর্বোচ্চ ২.৫ মিলিয়ন মে. টন। আমদানি করতে হয় ০.৩ মিলিয়ন মে. টন। কাজেই দেখাই যাচ্ছে যে পরিমাণ (২.৫ মিলিয়ন মে. টন) পেঁয়াজ উৎপাদিত হয় তা দিয়ে আমাদের সারাবছর চলেনা।

কিছু পেঁয়াজ (০.৩ মিলিয়ন মে. টন) আমদানি করতেই হয়। যদিও গতবছর পেঁয়াজের ক্রাইসিস হওয়ার কারণে কৃষক পর্যায়ে উৎপাদন বৃদ্ধি করে তা গতবছর থেকে ২,২০,০০০ মে. টন পেঁয়াজ বেশি উৎপাদন করা হয়েছিল। কিন্তু তার পরও দেশের চাহিদা মেটানোর জন্য আরো কমপক্ষে আরো ৮,০০,০০০ মে. টন পেঁয়াজ আমদানি করা প্রয়োজন হয়।

তাছাড়া দেখা গেছে, আমাদের পেঁয়াজ আমদানির বেশিরভাগ অংশ পার্শ্ববর্তী ভারত থেকেই অমদানি করতে হয়। তাই যেহেতু সবসময় ভারতের সাথে নানা টানাপড়েনে বাণিজ্যিক সম্পর্ক সবসময়ই একরকম থাকেনা। সেজন্য পেঁয়াজ আমদানির বিকল্প বাজার খোঁজার প্রয়োজন ছিল। এটি যেহেতু প্রতিবছরই কিছু না কিছু করতে হয় সেজন্য আগে থেকেই সংশ্লিষ্টদের এ বিষয়ে আগাম ব্যবস্থা নেওয়ারও প্রয়োজন ছিল।

পেঁয়াজের বিষয়টি এমন হলেও আলুর বিষয়টি সম্পূর্ণ বিপরীত এবং অপ্রত্যাশিত। কারণ বাংলাদেশের আবহাওয়া সম্পূর্ণ কৃষি অনুকুল। এ পরিবেশে দেশে প্রচুর আলু উৎপাদিত হয় প্রতিবছর। আমাদের দেশে বর্তমানে আলু উৎপাদিত হয় প্রায় সোয়াকোটি মে. টন।

আমাদের সর্বোচ্চ চাহিদা মিটিয়ে প্রতিবছর ২৫ লক্ষ মে. টন আলু বিদেশে রপ্তানি করা সম্ভব। আমরা প্রতিবছর দেখতে পাই আলুর উৎপাদন মৌসুমে দাম না পেয়ে কৃষকরা তাদের উৎপাদিত আলু রাস্তায় পর্যন্ত বিছিয়ে ফেলে দেয়। আলুর এমন উৎপাদনের কারণে সবসময়েই একটি সেøাগান দেয়া হয়, ‘বেশি করে আলু খান, ভাতের উপর চাপ কমান’।

অর্থাৎ আলু আর ভাতের পুষ্টিমান একই এবং তা হলো শর্করা বা কর্বোহাইড্রেট। অথচ এবার (২০২০) প্রতিকেজি আলুর দাম হয়েছে ৫০ থেকে ৫৫ টাকা যা সত্যিই সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিত। বড়জোর এসময়ে আলুর দাম থাকার ২০-২৫ টাকা। বর্ধিত মূল্যটি যদি উৎপাদক হিসেবে কৃষক পেতো তাহলেও একটা কথা ছিল। অথচ কৃষক যখন উৎপাদন মৌসুমে বিক্রি করেছে তখন পানির দরেই বিক্রি করেছিল। কিন্তু এখন মধ্যস্বত্বভোগী, কোল্ড স্টোরেজ মালিকরা অনৈতিকভাবে এ মুনাফা করে নিচ্ছে। আবারো সেখানে ক্ষতিগ্রস্ত সাধারণ ভোক্তা।

এক্ষেত্রে অবশ্য বাজার ব্যবস্থা তথা সরবরাহ চেইনে সমস্যা থাকার কারণেই এমনটি হচ্ছে। আলু কোন আমদানি পণ্য নয়। সারাদেশে কৃষকের বাড়িতে, কোল্ড স্টোরেজগুলোতে লক্ষ লক্ষ মে. টন আলুর মজুদ থাকার পরও আলুর মূল্য নিয়ে এমন কারসাজি কোন অবস্থাতেই মেনে নেওয়া যায় না। আমরা জানি আলু কৃষি বিজ্ঞানীদের নিকট কোন সবজি ফসল নয়। এটিকে বলা হয় একটি উদ্যানতাত্বিক ফসল। বাংলাদেশের সর্বত্র আলুকে সবজি হিসেবেই ব্যবহার করে থাকে। সেজন্য এ করোনাকালে অন্যান্য তাজা শাকসবজির পরিবর্তে সবার বাড়িতে সহজ সবজি হিসেবে আলুই ব্যবহূত হয়ে থাকে।

কাজেই এমন একটি সহজলভ্য নিত্য ব্যবহার্য সবজি ফসলের মূল্য নিয়ে যদি এমন অবস্থা হয় তখন স্বাভাবিকভাবেই সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলোর ব্যবস্থাপনার দিকেই সমন্বয়হীনতার আঙুল উঠে। সরকার সকল কাজই সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় এবং তাদের অধীনস্ত দপ্তরসমূহকে দায়িত্ব দিয়ে রেখেছে। তারা সময়মতো প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেবে সেটাইতো স্বাভাবিক। কিন্তু দেখা যায় দিনশেষে সবকিছু মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকেই ব্যবস্থা নিতে হচ্ছে।

দেখা যায় সমস্যা শুরু হলে টিসিবির মাধ্যমে পণ্য বিক্রিসহ নানা উদ্যোগ গ্রহণ করে সমাধানের চেষ্টা করা হয়। নানা উদ্যোগের ফলে হয়তো সমস্যা একসময় থাকেও না। সেজন্য কোন কখন সমস্যা হতে পারে সেটি আগে থেকেই আচ করে সে মোতাবেক দ্রুত প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিলে সেরকম সমস্যা হয়তো সৃষ্টিই হবেনা। এতে একদিতে সরকার, অপরদিকে কৃষক এবং ভোক্তাগণ তাদের স্ব-স্ব ন্যায্য হিস্যা বুঝে পাবেন। আগামীতে সংশ্লিষ্টদের সেভাবেই প্রস্ততি রাখার অনুরোধ রইল।

লেখক: কৃষিবিদ ও ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়
email: [email protected]

বহুমাত্রিক.কম

Walton Refrigerator Freezer
Walton Refrigerator Freezer