চলতি বছরের জানুয়ারিতে কলকাতায় সংবর্ধিত হয়েছিলেন কর্নেল এবি সিং। ছবি: ড. জয়ন্ত চৌধুরী ও অমৃত দে
ঢাকা : অনেকটা নীরবে না ফেরার দেশে চলে গেলেন অখন্ড ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের কিংবদন্তি যোদ্ধা, আজাদ হিন্দ ফৌজের সেনানি কর্নেল এবি সিং(অমর বাহাদুর সিং)। রোববার সকালের ভারতের উত্তরাখন্ডে ১০৩ বছর বয়সে শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শক্তির শৃঙ্খল থেকে ভারতবর্ষকে মুক্ত করতে নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসুর নেতৃত্বে আজাদ হিন্দ ফৌজে (আইএনএ) যোগ দিয়ে সম্মূখ সমরে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন এবি সিং। মাতৃভূমিকে স্বাধীন করতে তাঁর বীরত্ব ও সাহসিকতার জন্য লাভ করেছিলেন সর্বাধিনায়ক নেতাজির আশীর্বাদ।
কিন্তু দেশের জন্য সীমাহীন আত্মত্যাগ করলেও স্বাধীন ভারতভূমিতে তাদের স্বীকৃতি মেলেনি। দেশজুড়ে আজাদ হিন্দের প্রতি মানুষের অকুণ্ঠ সমর্থন ও ভালোবাসায় স্বাধীনতা ত্বরান্নিত হলেও এই বীর সেনানিরা পরবর্তী সরকারগুলোর চরম নিগ্রহের স্বীকার হন। কর্নেল এবি সিং তাদেরই একজন।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জাপানের সহযোগিতা নিয়ে অকতোভয় আজাদ হিন্দ সেনারা ব্রিটিশ সৈন্যদের নাস্তানাবুদ করে ব্রিটিশ অধিকৃত অনেক এলাকায় স্বাধীন ভারতের পতাকা উত্তোলনের মাধ্যমে বিজয়ের পথে এগিয়ে যাচ্ছিল। সেই সময়ে জাপানের আত্মসমর্পনে পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে কৌশলগত কারণে বাধ্য হয়ে হিন্দ সৈন্যদল ভেঙে দেন নেতাজি। তবে আজাদ হিন্দ ফৌজের আত্মত্যাগের মহিমা ভারতবর্ষজুড়ে মানুষকে স্বাধীনতার জন্য উত্তাল করে তুলে। বাধ্য হয়ে ব্রিটিশ রাজশক্তি তাদের আনুগত্য স্বীকারকারী শক্তির কাছে শাসন ক্ষমতা তুলে দিয়ে ভারত ত্যাগ করে।
পরবর্তীতে আজাদ হিন্দ ফৌজের অনেকে তৎকালীন শাসকগোষ্ঠীর প্রতি আনুগত্য দেখিয়ে মর্যাদা লাভ করলেও সিংহভাগ সৈন্যরা থেকে যান অন্তরালে-অবহেলার পাত্র হয়ে;কর্নেল এবি সিং ছিলেন সম্মান না পাওয়াদের দলেই। দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের এই জীবন্ত কিংবদন্তীর নীরব প্রস্থানে রাষ্ট্রীয়ভাবে কোনো সম্মান জানানোর খবর পাওয়া যায়নি। তবে ভারতের তরুণ প্রজন্ম ও নেতাজিপ্রেমীরা ইতিহাসের সাক্ষী এই বীরের প্রতি শেষ শ্রদ্ধা জানাচ্ছেন।
রাষ্ট্রীয়ভাবে উপেক্ষিত হলেও নেতাজিপ্রেমী ও তরুণ প্রজন্ম শ্রদ্ধায় আসনে বসিয়েছিলেন কর্নেল এবি সিংহ-কে।
নেতাজি গবেষক ও পশ্চিমবঙ্গের বিশিষ্ট সাংবাদিক ড. জয়ন্ত চৌধুরি বহুমাত্রিক.কম-কে শতবর্ষী এই আজাদ হিন্দ সেনানির মৃত্যুর খবর নিশ্চিত করেছেন।
তিনি বলেন, ‘অখন্ড ভারতের স্বাধীনতার জন্য লড়াই করা অজস্র বীরদের একজন কর্নেল এবি সিং। সবেচেয়ে বেদনার কথা দীর্ঘ জীবদ্দশায় তো নয়-ই মৃত্যুর পরও তিনি প্রাপ্য সম্মানটুকু পেলেন না।গত বছর নেতাজি সারথি কর্নেল নিজামউদ্দিন চলে গেলেন এভাবেই-রাষ্ট্র তাদের কোনো সম্মান দেয়নি।’
‘এসব বীর সেনানিরা নেতাজির সঙ্গে চলেছিলেন। আজ যদি তারা গান্ধীবাদী-নেহেরুবাদী হতে তাহলে তারা উপেক্ষিত হতেন না’-বলেন ড. জয়ন্ত চৌধুরি।
নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসুর তথাকথিত বিমান দুর্ঘটনায় মৃত্যুর তথ্যকে সরাসরি প্রত্যাখ্যান করেছিলেন সদ্যপ্রয়াত কর্নেল এবি সিং। চলতি বছরের ২২ জানুয়ারি নেতাজিপ্রেমীদের কাছ থেকে কলকাতায় সংবর্ধনা গ্রহণ করে তিনি বেশ কিছু চাঞ্চল্যকর তথ্যও জানিয়েছিলেন।
সেই সংবর্ধনা আয়োজনের অন্যতম উদ্যোক্তা এবিষয়ে ড. জয়ন্ত চৌধুরি বলেন, ‘সংবর্ধনায় আপ্লুত এবি সিং আমাদের বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য জানিয়েছিলেন। তিনি আমাদের কাছে দাবি করেছেন-২০০৩ সাল পর্যন্ত নেতাজির সাহচর্য পেয়েছিলেন তিনি(এবি সিং)। তথাকথিত প্লানক্র্যাশ থিওরি তিনি সরাসরি উড়িয়ে দেন।’
‘ভারতের উত্তরপ্রদেশের নেপাল সীমান্তে মুজিয়ানায় একটি আশ্রমে ‘এবি-কে আসতে দাও’ বলে যে সন্নাসী তাকে ডেকে নিয়েছিলেন তিনিই ছিলেন স্বয়ং নেতাজি। ২০০৩ সালের পর থেকে তিনি নেতাজি থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যান।’
আজাদ হিন্দ সেনানিদের যথাযথ মূল্যায়ন না করার কঠোর সমালোচনা করে এই নেতাজি গবেষক বলেন, ‘ভারতবর্ষের প্রধান সমস্যা হচ্ছে জাতপাতের সমস্যা। নেতাজি চেয়েছিলেন জাতপাতহীন অখন্ড ভারতবর্ষ। একথা মানতেই হবে নেতাজির নেতৃত্বে আজাদ হিন্দের তীব্র প্রতিরোধের কারণেই ব্রিটিশরা ভারত ছেড়েছিল। কিন্তু পরবর্তীতে রাজনীতিকরা তাদের প্রাপ্যসম্মান দেননি। নেতাজির ঘনিষ্ট কর্নেল হবিবুর রহমান, কর্নেল এজেড কিয়ানিরা পাকিস্তানে চলে যেতে বাধ্য হয়েছিলেন।’
বহুমাত্রিক.কম