Bahumatrik | বহুমাত্রিক

সরকার নিবন্ধিত বিশেষায়িত অনলাইন গণমাধ্যম

চৈত্র ১৪ ১৪৩০, শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪

‘‘নদীকর্মী’ এর বাইরে কোন বিশেষণ দরকার নাই’’

প্রকাশিত: ২৩:২৪, ৫ মে ২০২০

আপডেট: ১২:৫৯, ৭ মে ২০২০

প্রিন্ট:

‘‘নদীকর্মী’ এর বাইরে কোন বিশেষণ দরকার নাই’’

নদীর সান্নিধ্যেই প্রাণ পান শেখ রোকন। পেশাগত দায়িত্বের বেড়াজাল ডিঙিয়ে প্রায়শঃই ছুটে যান নদীবক্ষে। ছবিতে অচেনা এক মাঝির সঙ্গে নদী অন্তঃপ্রাণ শেখ রোকন। ছবি: সংগৃহীত

নদী বিষয়ক নাগরিক সংগঠন রিভারাইন পিপল-এর প্রতিষ্ঠাতা ও মহাসচিব শেখ রোকন দুই দশক ধরে নদী নিয়ে গবেষণা করছেন, লিখছেন, নদী আন্দোলন সংগঠিত করছেন। একটি জাতীয় দৈনিকের সম্পাদকীয় বিভাগের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। খণ্ডকালীন শিক্ষকতা করেন একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে।

গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর এবং যুক্তরাষ্ট্রের ওকলাহোমা বিশ্ববিদ্যালয় ও ভারতের সিকিম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পরিবেশ ও পানিসম্পদ নিয়ে সংক্ষিপ্ত শিক্ষা সম্পন্ন করেছেন। জন্মদিন উপলক্ষে তার সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলেছেন বহুমাত্রিক.কম-প্রধান সম্পাদক আশরাফুল ইসলাম।

বহুমাত্রিক.কম: জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানাই। আপনার ভাষায় নদীময় শুভেচ্ছা।

শেখ রোকন: ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানাই দিনটি মনে রাখার জন্য। আমি একই সঙ্গে আপ্লুত যে, আগেও আপনি আমার মতো সামান্য মানুষের জন্মদিনে সাক্ষাৎকার প্রকাশ করেছিলেন। আপনাকে ও বহুমাত্রিক.কম-কে আন্তরিক শুভেচ্ছা জানাই। নদী সুরক্ষা আন্দোলনে আপনার মনোযোগ সত্যিই অনুপ্রেরণাদায়ক। আমার ও রিভারাইন পিপলের পক্ষে নদীময় শুভেচ্ছা জানবেন।

বহুমাত্রিক.কম: ধন্যবাদ। দিনটি কীভাবে কাটাচ্ছেন?

শেখ রোকন: নাটকীয় শোনাবে, কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে আর দশটা স্বাভাবিক দিনের মতোই। সকালে ঘুম থেকে জেগে হোম অফিসের কাজ করছি। আসলে জন্মদিন উদযাপনের মতো বাস্তবতা শৈশবে বা কৈশরে কখনোই ছিল না। কলেজে বা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের সুবাদে জন্মদিন আলাদাভাবে মনে করার উপলক্ষ তৈরী হতো। ফেসবুক চালু হওয়ার পর বিষয়টি পাবলিক হয়ে গেছে। বিয়ের পর থেকে কেক কাটা শুরু হয়েছে। যদিও পশ্চিমা এই সংস্কৃতি আমার খুব একটা পছন্দ না। তবু পারিবারিক চাপ বলে কথা।

বহুমাত্রিক.কম: এবারও কি কেক কাটা হয়েছে?

শেখ রোকন: আনুষ্ঠানিকতার অবকাশ নেই। দেশের ও বিশ্বের পরিস্থিতি আপনি জানেন। আমার পুত্র রিওর আগ্রহে তার মা ঘরেই একটি কেক তৈরি করেছিল। সেটা আমরা বাসায় সবাই মিলে খেয়েছি।

বহুমাত্রিক.কম: এবার তাহলে অন্যরকম জন্মদিন?

শেখ রোকন: খুব বেশি নয়। বলা চলে বরাবরের মতো। শুধু গত কয়েকবছর ধরে জন্মদিনে পরিবার নিয়ে নদীতে ঘুরতে যেতাম। এবার সেটা হয়নি। রিও খুব মিস করছে। সে নদীতে যেতে পছন্দ করে।

বহুমাত্রিক.কম: করোনা পরিস্থিতি তাহলে নদীর কাজেও প্রভাব ফেলছে?

শেখ রোকন: অবশ্যই। আমার নিজের ও রিভারাইন পিপলের আউটডোর সব কাজ বন্ধ। গত কয়েক মাস ধরে বলতে গেল সবাই ঘরবন্দী। কাজ করবে কীভাবে? শুধু আমাদের নয়, গোটা বিশ্বেই নদী ও পরিবেশ সংক্রান্ত তৎপরতা একপ্রকার স্থবির। আলাপ-আলোচনা, লেখালেখি, ডেস্ক ওয়ার্ক অবশ্য থেমে নেই। প্রযুক্তি ব্যবহার করে নতুন ও উদ্ভাবনী পদ্ধতিতে সবাই কাজ করছে।

বহুমাত্রিক.কম: আপনার একটি ফেসবুক পোস্টে দেখলাম দক্ষিণ এশিয়ার নদী নিয়ে আপনারা অনলাইনে মিটিং করছেন।

শেখ রোকন: ঠিকই দেখেছন। আমরা দক্ষিণ এশিয়ার ছয় দেশের ছয়জন যথাক্রম বাংলাদেশ, ভুটান, ভারত, নেপাল, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কায় বসে ছিলাম। সভাটি মডারেট করা হচ্ছিল ইংল্যান্ড ও স্পেনে বসে। চিন্তা করুন, এই কঠিন পরিস্থিত এ ধরনের সভা কতটা সহজ করে দিয়েছে। আগে হলে হয়তো কোনো এক দেশে গিয়ে বসে বসে এই আলোচনাটা হতো।

বহুমাত্রিক.কম: এই পরিস্থিত আরও কতদিন চলতে পারে? নদী আন্দোলনের কী হবে?

শেখ রোকন: করোনা পরিস্থিত কবে স্বাভাবিক হবে, সেটা বিলিয়ন ডলার প্রশ্ন। টিকা যদি আবিস্কার হয়, তারপর অনুমান করা সম্ভব। কিন্তু আমি মনে করি, টিকা আবিস্কার হোক বা না হোক, জীবন থেমে থাকবে না। শঙ্কা, সতর্কতা নিয়েই মানুষ জীবন ও জীবিকায় নিয়োজিত থাকবে। নদীর কাজও থেমে থাকবে না। কারণ নদী জীবনেরই অংশ। জীবন থাকলে নদী থাকবে। জীবনের স্বার্থেই নদী সুরক্ষার কাজ করতে হবে।

‘‘জীবন মানেই জল বাংলা’’

বহুমাত্রিক.কম: আপনার জীবনে নদীর প্রভাব কেমন?

শেখ রোকন: আগে কেমন ছিল মনে নেই। এখন আমার কাছে জীবন মানেই নদী। ভারতের একটা টিভি চ্যানেল বলে না। জীবন মানেই জী বাংলা। আমরা বলি, জীবন মানেই জল বাংলা। নদী হচ্ছে পানিচক্রের প্রদান সূত্র। আকাশ, পাতাল, মর্তে যত পানি আছে, সব একসূত্রে গেঁথে রাখে নদী। মাঝে মাঝে ভাবি, নদী নিয়ে কাজ না করলে কী করতাম? আমার কাছে সেই জীবন অবিশ্বাস্য মনে হয়। জীবনানন্দ দাশের কবিতা আছে না? সব কাজ তুচ্ছ হয়, পণ্ড মনে হয়। নদী নিয়ে আমার একই কথা। নদী না থাকলে সব কাজ তুচ্ছ মনে হয়।


বিপন্ন নদ-নদীর সুরক্ষায় শেখ রোকন প্রতিষ্ঠিত রিভারাইন পিপল এর অর্জন অনেক। জনসচেতনতা কিংবা জনবোধ সৃষ্টির সাফল্য একে দিতেই হবে 

বহুমাত্রিক.কম: দুই দশক নদী আন্দোলন করে কতটা সাফল্য এসেছে?

শেখ রোকন: এই প্রশ্নের মুখে আমি আগেও পড়েছি এবং প্রায় সবক্ষেত্রে একই উত্তর দিয়েছি। আজকেও দিতে চাই। নদ-নদীগুলো দখল, দূষণ মুক্ত হয়নি সত্য। কিন্তু এই যে আমরা নদী নিয়ে কথা বলছি, এটাই প্রাথমিক সাফল্য। আপনি খেয়লা করে দেখবেন দশ বছর আগেও নদী নিয়ে সমাজে এত কথা হতো না। সংবাদমাধ্যমে নদী নিয়ে এতো সংবাদ, বিশ্লেষণ, টক শো ছিল না। আপনার কি মনে হয় না, ফেসবুকেও নদীর সঙ্গে ছবি দেওয়া বেড়েছে? এগুলোই বাংলাদেশর নদী আন্দোলনের সাফল্য।

বহুমাত্রিক.কম: রিভারাইন পিপল কতটা সার্থক?

শেখ রোকন: রিভারাইন পিপল কিছু তরুণ নদীকর্মী তৈরি করতে পেরেছে। জনপরিসরে নদী বিষয়ক আলোচনা বাড়াতে পেরেছে। অনেক পরিবেশ আন্দোলন আপনি  দেখবেন এখন নদীর প্রতি বেশি ফোকাস দিয়েছে। এর পেছনে রিভারাইন পিপলের অবদান আপনাকে স্বীকার করতে হবে।

বহুমাত্রিক.কম: নদী নিয়ে অনেক কাজ করেছেন। আর কী করতে চান?

শেখ রোকন: সবসময়ই মনে হতো নদী নিয়ে এখনো অনেক কাজ বাকি। করোনা পরিস্থিতিতে মনে হয়, এত কাজের এতো সময় হাতে নেই। কাজের অগ্রাধিকার ঠিক করতে হবে। সাংগঠনিক কিছু কাজ বাকি আছে। সেগুলো যত দ্রুত সম্ভব সম্পন্ন করে আমি লেখালেখিতে আরও বেশি সময় দিতে চাই। আরও বেশি নদীতে যেতে চাই।

বহুমাত্রিক.কম: এখন পর্যন্ত কত নদীতে গেছেন?

শেখ রোকন: মোটাদাগে, দেশ ও বিদেশ মিলে চারশ`র মতো। কিন্তু আরও অনেক নদী দেখার বাকি। প্রথম সুযোগেই যাওয়ার চেষ্টা করবো।

বহুমাত্রিক.কম: আপনি মাঝে রিভার থ্রি সিক্সটিফাইভ একটা সিরিজ লেখা শুরু করেছিলেন? সেটা কি শেষ করতে পেরেছেন?

শেখ রোকন: না, পারিনি। প্রতিদিন একটি করে নদী নিয়ে লেখা সত্যিই কঠিন কাজ। ভেবেছিলাম একবছরে শেষ হবে। এখন মনে হচ্ছে, তিন বছর লাগবে। বলা সহজ, করা কঠিন। আমি হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছি সিরিজটা শেষ করতে গিয়ে।

বহুমাত্রিক.কম: সব নদীর ছবি আছে?

শেখ রোকন: মোটামুটি আছে। কিছু ছবি হারিয়ে গেছে। সব নদীর সঙ্গে নিজের ছবিও নেই। কারণ ডিজিটাল ক্যামারা আসার আগে বিষয়টি সহজ ছিল না। মোবাইল ফোনের ক্যামারা আসায় অনেকটা সহজ হয়েছে।

বহুমাত্রিক.কম: লেখাগুলো দিয়ে বই প্রকাশ করবেন?

শেখ রোকন: এখনো ভাবিনি। ইংরেজি প্রবাদের মতো করে বলতে হয় ব্রিজটা আসুক আগে, তারপর পার হওয়ার কথা ভাববো। সিরিজটা শেষ করতে চাই আগে।

বহুমাত্রিক.কম: নদী নিয়ে কাজ করছেন, সাংবাদিকতা করছেন, শিক্ষকতা করছেন। এর মধ্যে কোনটি বেশি পছন্দ।

শেখ রোকন: তিনটি কাজই আমার কাছে উপভোগ্য। তিনটি কাজই আমি নিজে বেছে নিয়েছি। পরিস্থিতির কারণে নয়। আমি বলি চুজেন লাইভ। এই জীবন আমি নিজেই বেছে নিয়েছি। তবে যদি কখনো এমন পরিস্থিত হয় যে, যে কোনো একটিকে বেছে নিতে হবে, তাহলে আমি নিঃসন্দেহে, নির্দ্বিধায় নদীর কাজকেই বেছে নেব।

সাধনা, চর্চা কিংবা অবসরযাপন-সব এই নদীকে ঘিরেই। তাই তো নদী-বীক্ষণে সঙ্গী প্রাণপ্রিয় স্ত্রী-পুত্র 

বহুমাত্রিক.কম : অনেকে আপনাকে নদীবন্ধু, নদীভাই, নদীপুত্র, নদী মানব আখ্যা দেয়। এর মধ্যে কোনটি পছন্দ?

শেখ রোকন: আমার নাম শেখ রোকন, পরিচয় নদীকর্মী, এর বাইরে আর কোনও বিশেষণ আমার দরকার নেই। দেখুন, আমার স্কুলের নাম ছিল লম্বা, পাঁচ শব্দের। সম্প্রতি দাদু, মানে আমার পিতামহের ডায়েরিতে লেখা আমার জন্মের ক্ষণ দেখতে গিয়ে দেখি সেটা আরও লম্বা। সাত শব্দের। সেখান থেকে কেটে আমি দুই শব্দে নামিয়ে এনেছি। এই নামের সঙ্গে আর কোনও বিশেষণ দরকার নাই। নদীর কাজ করা মূল কথা, বিশেষণ নয়। আপনি নিজের কাজে কতটা সফল হতে পারলেন সেটাই মূল কথা। বিশেষণ দিয়ে, নাম দিয়ে কী হবে?

বহুমাত্রিক.কম: আপনার ও রিভারাইন পিপলের সাফল্য কামনা করি।

শেখ রোকন: আপনিও নদী নিয়ে কতটা নিবেদিতপ্রাণ আমি জানি। বাংলাদেশের নদী আন্দোলনে আপনার অবদান অনস্বীকার্য। করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে আমরা সুতিয়া নদী নিয়ে একসঙ্গে কাজ করব।

বহুমাত্রিক.কম: নিশ্চয়ই। আমরা একসঙ্গে কাজ করার জন্য অপেক্ষা করে আছি অনেকদিন ধরে। ভালো থাকবেন নদীময় শুভেচ্ছা।

শেখ রোকন: আপনিও ভালো থাকবেন। অবশ্যই নদীময় শুভেচ্ছা থাকবে আপনাদের জন্য, আপনার জন্য।

বহুমাত্রিক.কম: নতুন নদীকর্মীদের জন্য কিছু বলবেন?

শেখ রোকন: উপদেশ দেওয়ার যোগ্যতা আমার নেই। নিজের অভিজ্ঞতা বলতে পারি। আমার কাছে মনে হয়েছে বাংলাদেশে নদীর কাজ মানে সহজ কাজ নয়। বহু লোক কোনও কারণ ছাড়া বা বহুবিচিত্র কারণে আপনার বিরোধিতা করবে। সামনে ভালো বলবে, পেছনে সমালোচনা করবে। এর মধ্য দিয়েই আপনাকে নদীর জন্য কাজ করে যেতে হবে। নদী নিয়ে কাজ করা মানে, রবীন্দ্রনাথের ভাষায় বলতে হবে কঠিনেরে ভালোবাসিলাম। নদী নিয়ে কাজ করতে হলে কঠিনেরে ভালোবাসতে হবে।

বহুমাত্রিক.কম

Walton Refrigerator Freezer
Walton Refrigerator Freezer