Bahumatrik | বহুমাত্রিক

সরকার নিবন্ধিত বিশেষায়িত অনলাইন গণমাধ্যম

বৈশাখ ৫ ১৪৩১, শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪

দেশের সর্ববৃহৎ চালের মোকাম খাজানগর চাতালকল

বহুমাত্রিক ডেস্ক

প্রকাশিত: ২১:৪৮, ১১ আগস্ট ২০২২

আপডেট: ২১:৫০, ১১ আগস্ট ২০২২

প্রিন্ট:

দেশের সর্ববৃহৎ চালের মোকাম খাজানগর চাতালকল

দক্ষিণ এশিয়া তথা বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ চালের মোকাম হচ্ছে কুষ্টিয়া জেলার খাজানগর। এখানে ৫০০ চাল মিলের তিন হাজার চাতালে ৮০ হাজার পুরুষ শ্রমিকের পাশাপাশি প্রায় ১২ হাজার নারী শ্রমিক কাজ করেন।

এখানকার চালের মোকামগুলোতে যদি ন্যায্য মজুরি বা নানা রকম সুযোগ-সুবিধা থাকত, তাহলে এ এলাকা হয়ে উঠত উত্তর ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের অসহায় নারীদের এক বিরাট কর্মক্ষেত্র।

কুষ্টিয়া শহর থেকে মাত্র পাঁচ কিলোমিটার পরেই এর অবস্থান। চাল উৎপাদনের জন্য এখন খাজানগর সারা দেশে পরিচিত। বিশেষ করে সরু (মিনিকেট) চালের জন্য খাজানগরের রয়েছে আলাদা নামডাক। দেশে চালের চাহিদার প্রায় ৩০ শতাংশ এই মোকাম থেকে পূরণ হয় বলে জানিয়েছেন ব্যবসায়ীরা।

প্রতিদিন এ মোকাম থেকে শতাধিক ট্রাক চাল যাচ্ছে চট্টগ্রাম, ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জেলায়। বিপুল সম্ভাবনার পাশাপাশি আছে নানা সংকটও। এসব সংকট উত্তরণ করা সম্ভব হলে চাল শিল্পে বিপ্লব ঘটবে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।

মিলমালিকেরা জানান, ১৯৭৮ সালে প্রথম খাজানগরে চালকল ও চাতাল প্রতিষ্ঠা করা হয়। সে সময় কুমিল্লা থেকে কুষ্টিয়া সদর উপজেলার কবুরহাট মৌজায় এসে চালকল ও চাতাল ব্যবসার গোড়াপত্তন করেন দাদা রমিজ প্রধান নামের এক ব্যক্তি। তিনি জমি কিনে ছোট পরিসরে হাসকিং মিল স্থাপন করে ব্যবসা শুরু করেন। একে একে গড়ে উঠতে থাকে চালকল ও চাতাল। খাজানগর এলাকায় সেই সময় বিদ্যুৎ ছিল না। দাদা রমিজ প্রধান নিজের অর্থে পার্শ্ববর্তী আলমডাঙ্গা ফিডার থেকে ১৮টি খুঁটির সাহায্যে খাজানগরে বিদ্যুৎ নিয়ে আসেন। কর্মমুখর হয়ে উঠতে শুরু করে এলাকাটি। বর্তমানে তাঁর ছেলে আবদুস সালাম প্রধান ব্যবসা পরিচালনা করছেন। তাঁদের দুটি অটো মিল রয়েছে। বিভিন্ন ব্যান্ডের চাল উৎপাদন করেন তাঁরা।

কুষ্টিয়া জেলার পদ্মার তীরবর্তী দৌলতপুর উপজেলার কিছু মানুষ নদীভাঙনের সঙ্গে যুদ্ধ করতে করতে এক সময় উঠে আসে এ খাজানগরের দোস্তপাড়া গ্রামে।

খাজানগরের চারপাশের জমি ছিল একেবারেই অনুর্বর। অনাবাদি এ জমি ভরাট করে সেখানে গড়ে ওঠে কিছু বসতভিটা। কৃষিকাজ না থাকায় ওখানকার মানুষ কুষ্টিয়া শহর ও পোড়াদহ বাজার থেকে ধান কিনে নিয়ে তারা নিজেরাই কাঁচা খোলায় ধান সিদ্ধ করে ঢেঁকিতে মাড়াই করে বিভিন্ন বাজারে চাল বিক্রি করতে শুরু করে।

১৯৭২ সালে প্রথম খাজানগরের কবুরহাটে ‘কবুরহাট রাইস মিল’ গড়ে ওঠে। এভাবে এখানে ক্রমেই চাল মিলের সংখ্যা বাড়তে থাকে এবং আধুনিক পদ্ধতিতে চাল মাড়াই শুরু হয়।

বতর্মানে খাজানগরে পাঁচটি অটোমিলসহ ৫০০টিরও বেশি মিল রয়েছে। ধীরে ধীরে গড়ে ওঠা এই ধানের চাতাল ও মিলে বর্তমানে কর্মস্থান হয়েছে প্রায় এক লাখ শ্রমিকের।

এসব মিলের কারণে এখানে যেমন সৃষ্টি হয়েছে কর্মস্থানের, তেমনি বাংলাদেশের সব থেকে উৎকৃষ্ট মানের মিনিকেট চাল এখান থেকে সারা দেশে সরবরাহ করা হয়। আর বর্তমানে এখানকার চাল রফতানি হচ্ছে বিদেশেও।

খাজানগর এলাকার চাল উৎপাদনে সবচেয়ে বড় প্রতিষ্ঠান রশিদ অ্যাগ্রো ফুড প্রোডাক্টের মালিক ও বাংলাদেশ অটো মেজর অ্যান্ড হাসকিং মিল মালিক সমিতির সভাপতি আবদুর রশিদ বলেন, খাজানগর দেশের অন্যতম একটি সম্ভাবনাময় চাল শিল্প এলাকা। দেশের চাহিদার ৩০ শতাংশ জোগান যাচ্ছে খাজানগর থেকে। মালিকেরা দীর্ঘদিন ধরে এ ব্যবসাকে শিল্প হিসেবে ঘোষণার দাবি করে আসছেন। চাল ও ধানের সঠিক বাজার ব্যবস্থাপনা তৈরি হলে ক্রেতা-বিক্রেতা কেউই ঠকবেন না। নতুন যাঁরা স্বয়ংক্রিয় চালকল স্থাপন করতে চান, তাঁদের বিনা সুদে লোন দেওয়া হলে খুবই ভালো হয়।

এত বড় মোকামের মিলের চাতালে যাদের শ্রমের বিনিময়ে এ উৎপাদন, কেমন আছেন তারা?

দেখা গেছে, পুরো চাতাল এলাকায় পুরুষের পাশাপাশি নারীরাও সমানভাবে কাজ করে যাচ্ছে। এখানে পুরুষদের থেকে বেশি পরিশ্রমী নারীরাই।

গভীর রাতে ঘুম থেকে ওঠার পর সারা দিন রোদে ধান শুকিয়ে ধান উঠানো, ধান ভাঙানো, চাল ও গুঁড়া পৃথক করা এবং এরপর চাল বস্তাবন্দি করে বস্তার মুখ সেলাই করাসহ প্রায় সব কাজ এরাই করে থাকে।

এভাবে ১০০ মণ ধান শুকাতে চার জন নারী শ্রমিকের সময় লাগে প্রায় পাঁচ থেকে ছয় দিন। আর এরপর একজন নারী শ্রমিক মজুরি হিসেবে পায় ৩০০ থেকে ৪৫০ টাকা এবং তিন থেকে পাঁচ কেজি চাল। কোন কোন মিলে আবার মণপ্রতি দেওয়া হয় পাঁচ-২০ টাকা, তাও আবার ১০০ মণে চারজনের ভাগ করে নেওয়া লাগে।

অন্যদিকে এসব শ্রমিকের চারপাশের পরিবেশ একেবারেই অস্বাস্থ্যকর। এখানে প্রতি ২৫ জনে একটি করে শৌচাগার ও রান্নাঘর। এদের থাকার জন্য বরাদ্দ কক্ষে নেই কোনো জানালা বা ভেনটিলেটর। রুমের ভেতর ভালোভাবে দাঁড়ানো যায় না মাথা উঁচু করে। যেখানে কোনোরকমে দুজন মানুষ থাকা যায়, সেখানে চার-পাঁচ করে থাকতে হয় এদের।

জেলা খাদ্য অফিস সূত্র জানায়, খাজানগরসহ আশপাশের এলাকায় বর্তমানে ৪২টি অটো (স্বয়ংক্রিয়) রাইস মিল আছে। আর হাসকিং (ম্যানুয়াল) মিল আছে চার শতাধিক। তবে অনেক হাসকিং মিলে উৎপাদন বন্ধ রয়েছে। এ ছাড়া অটো মিলগুলোর সঙ্গে প্রতিযোগিতায় টিকতে না পেরেও অনেক মিল বন্ধ হয়ে যাচ্ছে।

চালকলমালিকেরা জানান, প্রতিদিন খাজানগর চাল মোকামে যে চাল প্রস্তুত করা হচ্ছে, সেই ধানের বড় একটি অংশ আসে যশোর ও নওগাঁ থেকে। প্রতিদিন এ মোকামে ৪ হাজার মেট্রিক টন চাল উৎপাদিত হয়। ভোর থেকে মিলগেটে চালের কেনাবেচা শুরু। সকাল ১০টার মধ্যে কেনাবেচা শেষ হয়ে যায়। খাজানগরে যেসব চাল উৎপাদন হয়, তার মধ্যে আছে মিনিকেট, আটাশ, কাজললতা ও গুটি স্বর্ণা। এসব চালের মধ্যে সব থেকে উৎকৃষ্ট মিনিকেট। বিশেষ করে রশিদ মিনিকেট, দাদা রাইস মিনিকেট, বিশ্বাস মিনিকেট ও স্বর্ণা মিনিকেট নামকরা।

দাদা রাইস মিলের অন্যতম কর্ণধার ও জেলা চালকল মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক জয়নাল আবেদিন প্রধান বলেন, দেশের পাইকারি ও খুচরা বাজারে প্রতিদিন গড়ে ২০০ ট্রাক চাল সারা দেশে যায়। যার বাজারমূল্য প্রায় ১২ কোটি টাকা। এ ছাড়া খুদ, গুঁড়া, পালিসসহ অন্যান্য অংশ মিলিয়ে প্রতিদিন খাজানগর মোকামে ২০ কোটি টাকার বেশি লেনদেন হয়। তাই এলাকায় বেশ কয়েকটি ব্যাংকের শাখাও রয়েছে।

Walton Refrigerator Freezer
Walton Refrigerator Freezer