Bahumatrik | বহুমাত্রিক

সরকার নিবন্ধিত বিশেষায়িত অনলাইন গণমাধ্যম

বৈশাখ ৫ ১৪৩১, শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪

দেবতার পুকুর

ডা: মো: কফিল উদ্দিন চৌধুরী

প্রকাশিত: ০০:০৫, ১০ জুলাই ২০১৮

আপডেট: ০০:০০, ৩১ ডিসেম্বর ১৯৯৯

প্রিন্ট:

দেবতার পুকুর

ছবি : সংগৃহীত

ঢাকা : সারা রাতের বাস জার্নি। আধো ঘুম, আধো জেগে থাকা। ঢাকা থেকে খাগড়াছড়ির দীর্ঘ পথ। কাক ডাকা ভোরে পাহাড় ঘেরা অরণ্য কন্যা খাগড়াছড়িতে নামা। তবু মন যেন আজ উড়ো এক প্রজাপতি। সীমানার ধার না ধারা উড়ন্ত বিহঙ্গের মত মন যেন ছুটে যেতে চাইছে অরণ্য অভিসারে এক নিস্তব্ধতার মায়ায়।

কিছুক্ষণের জন্য আড়ি পেতেছে যেন কর্ম-ব্যস্ত নগর জীবনের কোলাহল থেকে। আমি এক নিঃসঙ্গ অভিযাত্রী। পরিবার-সমাজ থেকে শত-কিলো দূরে। প্রথমেই আগে থেকে বুক করে রাখা হোটেল কামরায় প্রবেশ অতঃপর গোসল করে কিছুটা ফ্রেশ হওয়া। না আর নয় ঘুম।

পূর্ব পরিকল্পনা মোতাবেক সকাল ৭টা বাজেই আমার খাগড়াছড়ির বন্ধু বর প্রকাশ বড়–য়ার মোটর সাইকেলের হর্ণ। প্রকাশ বড়ুয়া খাগড়াছড়ি জোনে একটি ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানীতে এরিয়া ম্যানেজার হিসেবে কর্মরত। জীবন চলার পথে কর্মসূত্রে পরিচয়। অতঃপর ঘনিষ্ঠতা এই আর কি। সাত বছর ধরে খাগড়াছড়িতে। এখানকার সকল আনাছে-কানাছে তার নখদর্পনে। শুরুতেই স্থানীয় এক হোটেলে সকালের নাস্তা। অতঃপর খাগড়াছড়ির জিরো মাইল থেকে যাত্রা শুরু।

দক্ষিণে ১১ কিলোমিটারের উচু-নিচু পাহাড়ী পথের চড়াই-উৎরাই। পথের পাশে হাজার বিহঙ্গের কুজন আর মৃদু বাতাসে বন-বিটপীর সবুজ পাতার মর্মর ধ্বনি। সকালের সূর্য তখনও ততটা তেঁতে উঠেনি। পথ-ঘাট জনবিরলই বলতে হয়। শরতের নীল আকাশে যেন সাদা মেঘের ভেলা। দূর-দিগন্ত থেকে থেকে পাহাড়ের কোলে নিঃসঙ্গ আদিবাসী কন্যাদের জুমের ফসল সংগ্রহ কিংবা কখনও বিস্তীর্ণ আম-আনারস আর লিচুর বাগান দেখতে-দেখতে মাইস ছড়ি বাজারে আসা। ছোট গ্রাম্য বাজার। আদিবাসী-বাঙ্গালীর এক মিলন মেলা। স্থানীয় মানুষের প্রাচুর্যতা নেই বটে। তবে প্রতিটি মানুষই যেন আতিথেয়তা আর আন্তরিকতার গুনে গুনান্বিত। প্রকাশ বড়ুয়ার মাধ্যমে এক স্থানীয় রাখাইন তাঁত ব্যবসায়ীর সাথে পরিচয়। অতঃপর তার থেকে দেবতার পুকুরে যাবার পথ-ঘাট সম্পর্কে ছবক নেয়া।

আর বলে রাখা ভাল যে মেহমান হিসেবে আমাদের ভাগ্যে জুটল ধূমায়িত চা আর স্থানীয় পাকা পেঁপে। আমিও সুযোগ বুঝে কিনে নিলাম দু’খানি পাহাড়ী তাঁতবস্ত্র যা স্থানীয় জনসাধারণের মধ্যে খামি নামে পরিচিত আর দু’খানি গামছা। তার ভাষ্যমতে পিচ ঢালা পথের এখানেই শেষ। এই পথের ডানে ইট বিছানো ক্ষয়ে যাওয়া এবড়ো-থেবড়ো আঁকা-বাঁকা সর্পিল ৪ কিলোমিটার পাহাড়ী পথ। মোটরসাইকেলে গম্য। অতঃপর উচুপাহাড়ের গা ঘেষে এক পাহাড়ি গ্রাম। সেই গ্রামে মোটরসাইকেল রেখে উচু-খাড়া ৩ কিলোমিটার পাহাড়ি পথ হয়ে দেবতার পুকুর। অতঃপর পথ প্রদর্শন মোতাবেক পথ চলা। ঝাঁকুনি খাওয়া উচু-নিচু পাহাড়ি ইটের পথ আর কতিপয় ভাঙ্গা খাদের কল্যাণে যখন পাহাড়ের পদদেশ ঘেষে গ্রামে পৌঁছা তখন আমার দেহ যেন এক সাক্ষাৎ আলুর দম।

তবুও প্রকৃতি, দুর্গমতা ও অজানার প্রতি এক আকর্ষনে আমার দেহ থেকে মুহুর্তেই দূর হয়ে গেল রাজ্যের সকল ক্লান্তি। গ্রাম্য মুদি দোকান থেকে মধ্যাহ্ন ভোজের জন্য নিলাম শুকনা রুটি আর কলা। কারণ সামনে সহ¯্র সিড়ির খাড়া পাহাড়ি ৩ কিলোমিটার পথে নেই কোন খাবার দোকান। সর্বশেষে জনৈক স্থানীয় দোকানীর জিম্মায় আমাদের মোটরসাইকেল রেখে শুরু হল আমাদের গন্তব্যের সবচেয়ে দুর্গম অংশের উদ্দেশ্যে যাত্রা। সিড়ির পর সিড়ি পার হচ্ছি। সমস্ত শরীর দিয়ে যেন ঘামের ধারা। পাহাড়ি ঝাড়ফুল আর নানা জানা-অজানা বুনোফুলের ঘ্রাণ আর শতবিহঙ্গের কুজন যেন আমাদের ক্লান্তি ভাঙায়। থেকে-থেকে দূরে যেন সারিবদ্ধ পাহাড়ের মিছিল। সকলে যেন সবুজ বন-পিটপীর পোষাকে সজ্জিত। সেই সাথে পাহাড় সাদা মেঘের মিতালী। থেকে-থেকে এই উচু জন-বিরান ভূমিতে ক্লান্ত পথিকের বিশ্রাম নেয়ার জন্য স্থানীয় ত্রিপুড়া সম্প্রদায়ের করে দেয়া দুই-একটি ধর্মঘর। সেখানে রয়েছে পিপাসার্ত পথিকের পিপাসা নিবারনের জন্য স্থানীয় চাপা কলের ঠান্ডা পানি। থেকে-থেকে দুই-একটি পাহাড়ি গ্রাম। প্রতি গ্রামে খান কয়েক ঘর মাত্র।

গ্রামের মাথায় কখনও উঁচু মাচাংয়ে বসে থাকতে দেখা যায় গ্রামের শতোর্ধ বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের। শত বছরের দুর্গম বুনো-অভিজ্ঞতার ছাপ যেন তাদের চোখে-মুখে। পথ চলতে-চলতে হঠাৎ যেন এক পাহাড়ি ঝরণায় বয়ে যাওয়া পানির কলধ্বনিতে আমাদের এক ঘেয়েমির কিছুটা অবসান ঘটে।

যেন পাহাড়ের কান্না। সেই কান্নায় বিলীন হয়ে যায় যেন বিহঙ্গের কুজন আর বন-বিটপীর শুকনো পাতার মর্মর ধ্বনি। যেন অরণ্যের ভাষা। ঝরণার পাশের পিচ্ছিল পাথর আর শতবর্ষী বট-পাকুড় কিংবা আকাশচুম্বী তেলশুর-গর্জন এর প্রত্যক্ষদর্শী। তবে ভয়ের কথা এই যে এই প্রাকৃতিক বনে থেকে থেকে লেগেছে ভিন-দেশীয় সেগুন-একাশিয়ার বিষাক্ত ক্ষত। লাভের তাড়নায় স্থানীয় আদিবাসীদের সহায়তায় যেন এই ক্ষত দিন-দিন ক্যান্সারের মত বেড়েই চলেছে সমস্ত পাহাড়ে।

উজাড় হচ্ছে স্থানীয় বৃক্ষের প্রজাতি। লুপ্ত হচ্ছে স্থানীয় প্রজাতির প্রজাপতির আনাগোনা আর পাখির কলকাকলি। অরণ্যের সন্তান ভালুক, হাতি আর পাহাড়ি চিতার দাপটের কাহিনী আজ যেন ইতিহাসের পাতায় আর জেলা প্রশাসনের প্রাচীন গেজেটের কোন তথ্য। সবশেষে তালগাছের শেষ আড়াই হাত। জায়গায়-জায়গায় পাহাড়ের ধ্বস। শেওলায় ঢাকা পিচ্ছিল পথ। দুবার পিছলে যাওয়া। প্রকাশ দার জুতর দফা-রফা। অবশেষে সিড়ির সর্বশেষ ধাপ অতিক্রম শেষে সপ্তম পাহাড় চূড়ায় আমরা।

সেই চূড়া থেকে শতধাপ নিচে স্বচ্ছ জলের অরণ্যটিপ দেবতার পুকুর। স্থানীয় ত্রিপরাদের দেয়া নাম “মাতাই পুখরি”। ত্রিপুরা ভাষায় “মতাই” অর্থ “দেবতা” আর “পুখরি” অর্থ “পুকুর”। স্থানীয় আদিবাসীদের মধ্যেও প্রচলিত যে লৌকিক এক দেবতাই এই পুকুরের স্রষ্টা। ৭০০ ফুট পাহাড়ের উপর অবস্থিত হলেও ঋতুভেদে কি গ্রীষ্ম কি বর্ষা কিংবা কি শীত কি বসন্ত কখনই এর পানি শুকায় না।

দেবতাকে সন্তুষ্ট করার নিমিত্তে এই পুকুর থেকে সকল প্রকার মাছ শিকার করা স্থানীয়ভাবে নিষিদ্ধ। প্রতি বছর চৈত্রসংক্রান্তিতে এখানে বসে পূজার আসর আর মেলা। যেন বিশ্বাসের টান আর আনন্দ সাজের রব উঠে পুকুরের চার পাশে। চারপাশে যেন উচু বৃক্ষঘেরা ঋষিমৌন অরণ্য। যেন সবুজ অরণ্য সাদা টিপ পরে সেজেছে। মৃদমন্দ বাতাস। পুকুরের স্বচ্ছজলে শত-সহস্র মাছের জলকেলি। দুর্গমতার কারণে পর্যটক সমাগম ততটা নেই। থেকে দুই একজন আদিবাসী ত্রিপুরা মানব-মানবীর পুকুরে নেমে ¯œান সারা ও পাহাড়ি দুর্গম পথ বেয়ে গৃহে প্রস্থান। সুভেনির হিসেবে প্রকাশ দা আর আমার ক্যামেরায় চলল কিছুক্ষণ ক্লিক-ক্লিক। জীবনের রোজনামোচায় কথা না বলা কিছু নিরব-নিস্তব্ধ মুহুর্তের স্মৃতি। ঘড়ির কাঁটা তখন দুপুর বারটা ছুই-ছুই। সূর্যি মামা মধ্যগগনে।

রোদের তাপ যেন চরমে। পথে কিনে নেয়া বিস্কুট আর কলাতেই মধ্যাহ্ন ভোজ। অতঃপর এক প্রাচীন বটবৃক্ষ তলে ঘন্টাখানেকের নীরব নিস্তব্ধতা আর প্রকৃতিবিক্ষণ শেষে খাগড়াছড়ির উদ্দেশ্যে পুনঃযাত্রা। পুনরায় খাড়া পাহাড়ি পথ বয়ে এবড়ো-থেবড়ো, কোমর ভাঙ্গানো ইটের বিছানো রাস্তা শেষে মাইসছড়ি বাজার। সেখান থেকে পিছ ঢালা পথ হয়ে সোজা উত্তরের খাগড়াছড়ির উদ্দেশ্যে আমাদের দ্বিচক্রযানের চলতে থাকা। শুধু আমি আর প্রকাশ। দুপুর গড়িয়ে বিকাল আসি-আসি। দূর পাহাড়ে নিঃসঙ্গ জুমিয়া কন্যাদের দিনমান পরিশ্রম শেষে যেন ঘরের উদ্দেশ্যে যাত্রা। পাহাড়ের গা ঘেষে এঁকে-বেঁকে বয়ে চলেছে চেঙ্গি নদী। যেন কোন চিত্রশিল্পীর ক্যানভাসে আঁকা নিসর্গের এক তৈলচিত্র। মনের মধ্যে বেজে উঠে যেন মাইলসের সেই বিখ্যাত গানের উক্তি,
“পাথুরে নদী চলে, পাহাড়ি মেয়ে নামে,
ভেজা তার তনুমন ধরা দেয় না,
কি স্বপ্ন এঁকে দিল বলা যায় না।”

ডাঃ মোঃ কফিল উদ্দিন চৌধুরী
মেডিসিন ও মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞ
জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট, ঢাকা
E-mail: [email protected]
মোবাইল- ০১৫৫৭৪৪০২৮৭

বহুমাত্রিক.কম

Walton Refrigerator Freezer
Walton Refrigerator Freezer