Bahumatrik | বহুমাত্রিক

সরকার নিবন্ধিত বিশেষায়িত অনলাইন গণমাধ্যম

বৈশাখ ৯ ১৪৩১, মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪

দুঃস্বপ্ন

কামরুল হাসান জিয়া

প্রকাশিত: ২৩:০২, ২ জুলাই ২০২১

প্রিন্ট:

দুঃস্বপ্ন

সরফরাজ ক্যামেল সিগারেটের প্যাকেটটা টেবিলের উপর রাখল তারপর মাটিনির গ্লাসে একটা চুমুক দিয়ে বাঁ হাতে ধরা সিগারেটের ধোঁয়ায় একটা উচ্চাঙ্গের কুণ্ডুলী পাকিয়ে সিলিং-এর দিকে ছুঁড়ে দিয়ে বলল,
‘শোন! তোকে একটা অদ্ভুত একটা গল্প বলি ।’

‘আমার বস রহমান সাহেব ১৯৬১ সালে মাত্র ৫০ পয়সা নিয়ে বাসা থেকে বের হয়ে গিয়ে ৫ বছরের মাথায় ১৯৬৬ তে ফিরলেন চিলমারী বন্দরে ইজিপসিয়ান বাটন ভরা সওদাগরী জাহাজ নিয়ে । ‘অহমান ফিরি আইছে চিলমারিত’ তার ফিরে আসাতে এরকম চাঞ্চল্য চাউর হয়ে ছড়িয়ে পড়ে আদিতমারীর ছোট পাড়াগাঁ রহমান সাহেবের নাড়িপোতা সফেদা হাটিতে।

রহমান সাহেব ১৯৬৯ এ আয়ুব খানের পতনের কিছু দিন আগে সিআইপি হলেন। সফেদা হাটিতে আমি তখন ক্লাস এইট ফেইল করে ইপিআরে যোগ দেওয়ার চিন্তা ভাবনা করছি । ১০ টাকা বেতন । ১০০ টাকা মাসে রহমান সাহেব তখন আমাকে চিটাগাংয়ের আনোয়ারায় তার সদ্য স্থাপিত একটি টেক্সটাইল মিলের কেরানীর চাকুরী দিয়ে ছোঁ মেরে নিয়ে এলেন ।

আমার কাজ হলো শুধু চেক রেডী করে দেওয়া! উনি শুধু স্বাক্ষর করেন । চেক লেখা আর লেজার বুকের সাথে টাকার অংক মিলিয়ে রাখাই আমার কাজ । এই চাকুরীটা আমি প্রায় ৩০ বছর পর ছেড়ে দিলাম ২০১০ সালে । তখন আমার ব্যাংক ব্যালেন্স জমা পড়লো প্রভিডেন্ট ফান্ডের সাকুল্যে ২ লক্ষ টাকা ।

মার্টিনির গ্রাস-টা এবার এক চুমুকে শেষ করল সরফরাজ তারপর ক্যামেল সিগারেটের প্যাকেট থেকে এক সঙ্গে দুটো সিগারেট বের করে লাইটার দিয়ে এক সঙ্গে ধরিয়ে দুই হাতে দুটো সিগারেট নিয়ে যাদুকরের মতো দু’মিনিট রিং বানানোর খেলায় মেতে উঠল।

তারপর ফরাসী ওয়েটারকে একটা কনিয়াক সার্ভ করার ইঙ্গিত করে বলল, ‘অদ্ভুত ব্যাপারটি কি জানিস’?
‘২০১০ সালে আমি যখন চাকুরীটি ছাড়ি তখন রহমান সাহেবের বার্ষিক ব্যবসার আয় ২০০০ কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে কিন্তু আমি তার চেক স্বাক্ষর করে সাকুল্যে মাসিক ৩০০০ টাকা পাই ‘ভাবতে পারিস’? ২০১০ সালে রহমান সাহেব মারা গেলেন । স্বাভাবিক মৃতু । স্ত্রী পুত্র পরিজন নিয়ে বেদনা বিধুর পরিবেশে নাকে নল, গলায় ভেন্টিলেটর নিয়ে ৩ মাস সিঙ্গাপুরে মৃত্যুর সাথে লুকোচুরি খেলতে খেলতে মাউন্ট এলিজাবেথের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে মারা গেলেন তিনি।

সরফরাজ দ্রুত সিগারেটে টান মারল। পড়পড় করে সিগারেট পোড়া শেষ করে ছাইদানিতে গুঁজতে গুঁজতে বিস্ফোরিত চোখে বলল,‘কি বলব বুঝতে পারছি না । স্ট্রেঞ্জ বললেও কম বলা হবে । রহমান সাহেব মারা যাবার ৫ মাস আগের ঘটনা। উনি চেকের শেষ পাতায় স্বাক্ষর করলেন । চেকের এই পাতাটা যেটা আমি ফাঁকা রেখেছিলাম উনি নিজ হাতে আমার নামটা চেকে লিখলেন । ফাঁকা চেকটা আমার হাতে ছিঁড়ে দিয়ে বললেন, ‘সরফরাজ! ফাঁকা রাখিলাম টাকার ঘরখান । তোর সাহস থাকিলে অংকটা বসাইস্’! ‘তারপর থেকে আমি বেভারলী হিলসে এই সমুদ্র মুখো ফ্ল্যাটে । টামপা বেতেও কিছু কটেজ নিয়ে চলে যাচ্ছে দিনকাল!’

‘কিন্তু আপনি কত টাকা নিয়েছিলেন তাতো বললেন না’? আর কিভাবেই বা এখানে ভোজবাজির মত এভাবে উদয় হলেন’? আচ্ছা তা’ না হয় না বললেন । আপনি বলছিলেন আপনার দুঃস্বপ্নটার কথা বলবেন? সেটাই বলেন না’? এবার ‘মাদমোয়াজেল’ রেস্টুরেন্টের সবাই একটু সচকিত হয়ে উঠল সরফরাজের হঠাৎ বের হওয়া প্রোজেক্টাইল বমির ছিটকে ছিটকে অন্য টেবিলের কাষ্টমারদের ভিজিয়ে দেওয়া দেখে ।

আমি এই ছোট রেস্টুরেন্টের মালিক এবং ম্যানেজার। সেলফ্ এ্যামপ্লয়েড । ২ বছর হলো এখানে এসেছি । ওয়েটাররা তাড়াতাড়ি সরফরাজকে সামলে নিলে আমি ওকে সমুদ্রের ধারে প্রশান্ত মহাসাগরের বেলাভূমিতে নিয়ে এলাম । চাঁদটায় সেদিন পূর্ণিমার রেশ ছিল। পূর্ব দিক থেকে অনেকটা উপরে উঠে গেছে । সমুদ্রের কালো পানিতে চাঁদের সোনালি আভা ছড়াতে থাকলে সরফরাজ বলল, ‘এখন হয়েছে কি..... হতাশ, করুন এবং হতবিহবল স্বরে সরফরাজ বলতে থাকে, “রহমান সাহেব স্বপ্নেও আমার কাছে চেক সই করাচ্ছেন । এটা ২০১৩ না? তিন বছর হলো তিনি মারা গেছেন । কিন্তু মারা যাওয়ার পর থেকে প্রতিদিন সারারাত স্বপ্নে আমি তাঁর কাছে লক্ষ লক্ষ চেক সারারাত ধরে সই করাই । আর উনি, রুষ্ট চিত্তে অক্লান্তবদনে চেকগুলো সই করেন সারারাত ধরে । প্রতিটি চেক সুই করেন আর বলেন, ‘লেজার মিলাইস কিন্তুক সরফরাজ!”

সরফরাজ ধাতব গলায় বলে ওঠে, দুঃস্বপ্নের ক্লান্তি ভর করে চোখের পাতায় আর ঘুম ভাঙলেই কানের মধ্যে বাজতে থাকে সাইরেনের মতো রহমান সাহেবের কৌতুক মিশ্রিত অবজ্ঞা.....

‘লেজার মিলাইস্ । লেজার মিলাইস্ । লেজার মিলাইস কিন্তুক! সরফরাজ’!

বহুমাত্রিক.কম

Walton Refrigerator Freezer
Walton Refrigerator Freezer