Bahumatrik | বহুমাত্রিক

সরকার নিবন্ধিত বিশেষায়িত অনলাইন গণমাধ্যম

চৈত্র ১৩ ১৪৩০, বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪

থলের কাল বিড়াল

ডাঃ মোঃ কফিল উদ্দিন চৌধুরী

প্রকাশিত: ০২:২৩, ৩ জুলাই ২০১৮

আপডেট: ০০:০০, ৩১ ডিসেম্বর ১৯৯৯

প্রিন্ট:

থলের কাল বিড়াল

আসিফ নেওয়াজ খান। দেশ বরেণ্য এক রাজনীতিবিদ। এলাকার সাত সাত বারের নির্বাচিত সংসদ সদস্য। বর্তমানের নির্বাচিত সরকারের রেল মন্ত্রীর দায়িত্বে নিয়োজিত। দেশের তৃণমূল থেকে শুরু করে জাতীয় রাজনীতিতে তার দক্ষতা ও দূরদর্শিতা সর্বজন স্বীকৃত। রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির দিক থেকে যেন এক উদারতার মূর্ত প্রতিক। কারো সাথে নয় বিবাদ, উন্নয়নের জন্য চাই সরকার-বিরোধী নির্বিশেষে সকল দলের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান, উন্নয়নের জন্য চাই পক্ষ-বিপক্ষ সকলের সমঅংশিদারীত্ব- এই তার রাজনৈতিক দর্শন। মানবাধিকার রক্ষায় যেন “ফাদার অব হিউমেনিটি”।

আর দান-খয়রাতের ক্ষেত্রে যেন এক সাক্ষাৎ হাজী মুহাম্মদ মহসীন। প্রতিদিন সকাল-সন্ধ্যা কর্মব্যস্ত টাইট সিডিউল। দু’চোখের পলক ফেলানো যেন দায়। রাত-বিরাত নেতা-পাতিনেতা-উপনেতা কিংবা দর্শন প্রার্থীর পদচারণায় তার ঘর মুখরিত। শুধু ব্যতিক্রম বলতে প্রতি সপ্তাহের শুক্রবারটি একান্তই তার নিজের পরিবারের। আর উক্ত দিনের বিকাল হতে রাতের প্রথম প্রহর পর্যন্ত সময়টুকু যেন তার একান্তই নিজস্ব। এই সময় তিনি যেন অন্য মানুষ। নয় গাড়ি, নয় কোন সহযোগী। নিজের পরিবার যেন কিছু সময়ের জন্য পর। সম্পূর্ণ পদব্রজে কি যেন এক অজানার টানে ছুটে যান নির্জন কোন স্থানে। কাউকে জানানোর প্রয়োজন মনে করেন না, কোথায় তার গন্তব্য। নির্জন স্থানে যান আর যেন কি ভাবেন? লোক মুখে শুনা যায় এই সময় কখনও তাকে দেখা যায় এলাকার শেষ প্রান্তের নির্জন কোন বটতলে কিংবা কখনও নদীর তীরে কংক্রীটের বস্তা ফেলানো বাঁধের উপর। আজ একটু ব্যতিক্রম বলতেই হবে নির্জন স্থান হিসেবে বেছে নিলেন রেল স্টেশনের শেষ প্রান্তে রেল যাত্রীদের বসার জন্য এক বেঞ্চ। লোক-সমাগম কম। কিন্তু থেকে থেকে দুই একটি ট্রেনের হর্ণের তীব্র আওয়াজ যেন নীরবতার ঘুম ভাঙ্গায়। ট্রেন আসে-ট্রেন যায়। কিন্তু তাতে কি আসে-যায়। তার ভাবনার আত্মজিজ্ঞাসায় এর কোন ছাপ পরিলক্ষিত হয় না। শেষ বিকেলের কান্না, অতপর সন্ধ্যা হয়ে ঘড়ির কাঁটা রাত বারটা ছুই-ছুই। এর মধ্যে এক ভিক্ষুক আসে। কিন্তু আজ ব্যর্থ তার ভিক্ষার আবেদন।

ভিক্ষুক: কিছু সাহায্য দিবেন?

নেওয়াজ: নিশ্চুপ, নিথর যেন এক দেহমূর্তি। কিন্তু কয়েকবার ব্যর্থ চেষ্টার পর ভিক্ষুকের প্রস্থান। অতপর সন্ধ্যা নামার পর পাশের বস্তিগামী এক ভ্রাম্যমান চা বিক্রেতার আগমন।

চা বিক্রেতা: স্যার চা লাগবে। সাথে মচমচে টোস্ট বিস্কুট।

নেওয়াজ: কোন জবাব নেই।

চা বিক্রেতা: আছে লেবু দেয়া আদার গরম রং চা।

নেওয়াজ: নিশ্চুপ।

চা বিক্রেতা: পাগল নাকি?

নেওয়াজ: কোন ভাবান্তর নেই।

চা বিক্রেতা: সন্ধ্যার সময় কোন ভূত-জীন নয় তো!

নেওয়াজ: নীরব-নিথর এক দেহমূর্তী। কিন্তু মুখে যেন কিছু বিড়-বিড় করে বলার চেষ্টা।
চা বিক্রেতর দ্রুত প্রস্থান। এক সময় লালের আভা মেশানো শেষ বিকেলের কান্না। অতপর সন্ধ্যা হয়ে ঘড়ির কাঁটা রাত বারটা ছুই-ছুই। আচমকা যেন সম্বিত ফিরে পায় নেওয়াজ। নিরব-নিথর দেহে যেন প্রাণবায়ুর প্রবেশ। প্রথমে বসা থেকে দাঁড়ানো, অতঃপর দাঁড়ানো থেকে আস্তে-আস্তে হাঁটতে শুরু করেন বাসার দিকে। কিন্তু এ কি! বাসায় যেন আজ নেওয়াজের দু’পা যেতে চাইছে না। দুই পায়ের পাতা যেন এক মোচড়ে দেহের বিপরীত দিকে ঘুরে গেল। এক তীব্র ব্যথায় যেন নেওয়াজ ফোঁপাতে থাকল। অতঃপর হাঁটা শুরু করল বিপরীত দিকে। এক সময় রেল স্টেশন শেষ হল। শেষ হল রেল স্টেশনের লাগোয়া বস্তি এলাকা অতঃপর কিছুটা বট-পাকুড়ের বন শেষে ময়লার ভাগাড়। দিন শেষে শহরের সমস্ত ময়লা আবর্জনার শেষ আশ্রয় স্থল। চারদিকে ভোঁটকা গন্ধ আর মাছির ভন-ভনানি। আকাশে পূর্ণিমার চাঁদ। থেকে থেকে দুই একটি নেড়ি কুকুরের ঘেউ-ঘেউ। দেহ যেন অবসন্ন হাজার টনি এক পাথর। শরীর যেন আজ এক দন্ড যেতে চাইছে না। অতঃপর পাশের রাস্তায় ল্যাম্প পোস্টের নিচে বসে পড়া। আবার ঘন্ট দুয়েকের নিস্তব্ধতা। চোখে কিছুটা তন্দ্রাভাব। হঠাৎ ঘস-ঘসানির একটা আওয়াজে তন্দ্রা ভাঙল নেওয়াজের। চারদিকে একবার চোখ বুলালেন। এক পর্যায়ে অস্পষ্ট আলোতে দেখতে পেল রাস্তা থেকে কিছু দূরে ভাগাড়ের মধ্যে একটা থলে। থলের ভিতরে জীবন্ত কিছু নাড়া-চাড়া। প্রথমে ভাবলেন হতভাগ্য কোন মানব। যাকে অত্যাচারের পর মরে গেছে ভেবে এখানে বস্তা বন্দি করে ফেলে রাখা হয়েছে। অতঃপর অনেকটা কৌতূহলের বশে থলের কাছে গেলেন। দেখলেন থলের মুখ দড়ি দিয়ে শক্ত করে বাঁধা। আর থলের ভিতরে কি একটা জীবন্ত জিনিস যেন বের হবার জন্য ব্যর্থ চেষ্টায় রত। এ পর্যায়ে কিছুটা আতঙ্কিত হলেন নেওয়াজ। প্রথমে ভাবলেন কোন ভূত-জীনের কারসাজি নয়ত। আধুনিক মনস্ক মানুষ নেওয়াজ। ভূত-জীনে তার খুব একটা বিশ্বাস নেই। তাই এক পর্যায় থলের মুখ খুললেন। যেই থলের মুখ খুললেন সাথে সাথে বিকট আওয়াজ নিয়ে বের হয়ে আসল একটা বিড়াল। কুচকুচে কাল বর্ণের দেহ। দু’চোখে সবুজের ঝিলিকে যেন ঠিকরে পড়া হিংসা। চাল-চলনে কিছুটা হামবাড়া ভাব। লোভাতুর মুখ থেকে ঝরে পড়ছে যেন লোভের লালা। রাতের নিস্তব্ধতা বিদীর্ণ করা তার ডাকে যেন এক ভয়ংকর পৈশাচিক নাটকের মঞ্চায়ন। কিছু দূরে গিয়ে বিড়ালটা থামল। নেই আতংকের লেশ মাত্র। নেওয়াজ ভাবলেন দুষ্ট কোন বিড়াল। যার অত্যাচারে অতিষ্ট হয়ে বাড়ির কোন গৃহকর্তা একে মেরে থলে বন্দি করে এখানে ফেলে রেখেছে। আবার মিনিট দশেকের নিস্তব্ধতা। হঠাৎ বিড়াল যেন কথা বলে উঠল।

বিড়াল যেন আওড়াতে থাকল,
“কাল বিড়াল আমি, মনের মধ্যে বাস।
মানুষ হয় আমার গোলাম, হয় সর্বনাশ।
ভেবে ভয়ঙ্কর পরিণতি, করে আমায় থলে বন্দি।
বিশ্ব চরাচরে ঘুরে বেড়ায়, ভালর মুখোশ পরি।”

এবার নেওয়াজ বুঝতে পারলেন না বিস্মিত হবেন না আতঙ্কিত হবেন। অবশেষে কিছুটা সাহস নিয়ে নেওয়াজ বিড়ালের সাথে কথা বলতে শুরু করলেন।

নেওয়াজ: তুই কে?

কাল বিড়াল: আমি তোর ভিতরে লুকিয়ে থাকা পশু। আমি তোর অপরাধ প্রবৃত্তি। আমি তো লোভ হিংসা অহঙ্কারের মূর্ত প্রতীক। মিথ্যা আমার ধর্ম। আমি ভালোর মুখোশধারী বহুরূপী শয়তান।

অতঃপর কাল বিড়ালের এক পৈচাশিক অট্ট হাসি হাঃ-হাঃ-হাঃ। সেই হাসিতে চারপাশে যেন নেমে এল আতঙ্কের এক ধূসর পর্দা। নেওয়াজের সারা গা জুড়ে বয়ে গেল যেন এক হিম করা শীতল দমকা হাওয়া।

এবার নেওয়াজ কিছুটা আতঙ্কিত হয়ে: তুইত এক কাল বিড়াল।

কাল বিড়াল: হ্যাঁ আমি তোর কৃত অপরাধের মতই কাল। আমার দু’চোখের সবুজ ঝলকে হিংসা ঠিকরে বের হয়। আমার চলন যেন অহংকারের মূর্ত প্রতীক। আমার লোভাতুর জিহবা দিয়ে সব সময় ঝরে যেন লোভের লালা। কামনা, বিশ্বাসঘাতকতা যেন আমার পোশাক।

নেওয়াজ: আমি তো একজন দেশ বরেণ্য জনদরদী দানবীর নেতা। তাছাড়া আমার কৃত অপরাধ সম্পর্কে আমিই জ্ঞাত। তা আর কারো জানার কথা নয়। বিশ্বস্ততরা বুক ফাটবেত মুখ ফাটবে না- এমনই তো গোপন রাখার প্রতিজ্ঞা আমার সকল কাল কৃতকর্মের ঘটনা।

কাল বিড়াল: আমি তোর অন্তরে বাস করি। তোর অন্তরের সকল অতিত-বর্তমান-ভবিষ্যত আমার জ্ঞাত। আমি তো তুই। তোর সকল কুৎসিত কৃতকর্মের ফসল। আর কর্মেই কর্তার পরিচয়। যতই পরে থাকনা ভালর মুখোশ, আমাকে অস্বীকার করা মানে তোর নিজেকেই অস্বীকার করা। যেন প্রাণহীন এক দেহমূর্তী।

নেওয়াজ কিছুটা রেগে: ছি! কুৎসিত অপরাধ ছি! তোর গায়ে থু-থু।

কাল বিড়াল: তা তোর নিজের গায়েই লাগবে।

নেওয়াজ: কি বেয়াদব। তোর মুখে দিব নাকি এক থাপ্পড়।

কাল বিড়াল: লাগবে তোর নিজের গালে।

নেওয়াজ: বেশি বাড়া বাড়িস না। দুনিয়া থোক সরিয়ে দিব। জানিস তো আমার ক্ষমতা। আমার এক আঙ্গুলির ঈশারায় বাঘে-মোষে এক ঘাটে খায় জল।

কাল বিড়াল: এ হবে কেবল আত্মহত্যারই শামিল। আত্মহত্যা মহাপাপ। আর আত্মহত্যাতেই কি প্রায়শ্চিত্ত হবে সকল পাপের?

এবার কিছুটা বিতর্কের সুরে নেওয়াজ: কিন্তু আমি তো মোটের উপর নির্লোভ এক মানব হিতৈষী মানুষ।

কাল বিড়াল: হে মহামান্য নির্লোভ জনহিতৈষী। আপনি একজন লোভী, কদাচার, শঠ ব্যক্তি। মনে পড়ে কি রেল বিভাগে লোক নিয়োগে কোটি-কোটি টাকার দুর্নীতি। একে একে নামে-বেনামে রেলওয়ের খাস জায়গা দখল। রেল বিভাগে দুর্নীতি আজ ওপেন সিক্রেট ব্যাপার। রেলওয়ের সকল বিভাগের আকাশে-বাতাসে আজ দুর্নীতির গন্ধ। রেল বিভাগ আজ প্রতিবছর শত কোটি টাকার এক লোকসানী প্রতিষ্ঠান। পৃথিবীর সকল দেশের জন্য যা এক লাভজনক প্রতিষ্ঠান। প্রতিষ্ঠানে দুর্নীতির দাপট, আর আপনার দেখেও না দেখার ভান। যেন অন্যের পাপকে পশ্রয় দিয়ে নিজের পাপ ঢাকা।

নেওয়াজ: আমি কি একজন উদার মনের সাদা রাজনীতিবিদ নই?

কাল বিড়াল: হে মহামান্য উদারতার মূর্ত প্রতীক! আপনি একজন হিংসুক। হিংস্র নেকড়ের মতো আপনার চোখ দিয়ে কখনও থেকে থেকে হিংসার স্ফূলিঙ্গ বের হয়। সেই হিংসার আগুনে মারা পড়ে আপনার কোন প্রতিদ্বন্দ্বী। জ্বলেপুড়ে ছারখার হয়ে যায় কোন পরিবারের সাজানো সংসার। আকাশ-বাতাস ভারী হয়ে আসে সন্তান হারানো কোন মায়ের কিংবা বিধাব হওয়া স্ত্রী বা এতিম কোন সন্তানের তীব্র আর্তনাদে। যেন বিচারের বাণী নিরবে কাঁদে। অপরাধ ঘটবে, বেঘোরে হবে প্রাণ সংহার, অথচ ক্ষমতার দাপটে সমাজ-রাষ্ট্র নিশ্চুপ।

নেওয়াজ: কোন প্রমাণ আছি কি?

কাল বিড়াল: কর্মই কর্তার সবচেয়ে বড় পরিচয়। আর আমিই তো আপনার অপরাধ কর্ম। মনে পড়ে কি মন্ত্রী মহোদয় এক সময় আপনার চরম রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী রাজনের হত্যাকা-। আপনার নির্দেশে ঘাতক দলের শত কোপে এক নীরব নিশীথে বুড়িগঙ্গার ঘাটে প্রাণ হারান রাজন। অত:পর শিয়াল-কুকুরের মতো ঘাতক পশুদল কেটে-কেটে টুকরা করে তার দেহ। সবশেষে কাটা টুকরা সমূহ কনক্রীটের বস্তায় ভরে নদীতে নিক্ষেপ। রাজনের শেষ ঠিকানা বুড়িগঙ্গার তলদেশে। শেষ রক্ষা হয়নি আপনার অপরাধ কর্মের বিরুদ্ধে সোচ্চার তরুণ সাংবাদিক হুমায়ুন কবির। আপনার রুদ্ররোষে কোথায় যেন একদিন গুম হয়ে যায় সে। আইন শৃঙ্খলা বাহিনী মাইক্রোস্কোপ দিয়ে খুজেও আজও তাকে উদ্ধার করতে পারল না। কারণ আপনার হ্যাঁতেই সকলের হ্যাঁ, আপনার নাতেই সকলের না।

নেওয়াজ:আমি ভাই নির্বিরোধ অহঙ্কারমুক্ত মানুষ। তুমি কি বলতে চাও? কি তোমার উদ্দেশ্য?

কাল বিড়াল: আমি তোমার মনের মধ্যে বন্ধ করে রাখা অপরাধের কুৎসিত আওয়াজের প্রতিধ্বনি মাত্র। আমি তোমার বিবেকের শ্বেত-শুভ্র শান্তির পায়রার হত্যাকারী।

নেওয়াজ: তাহলে তুমি বলতে চাও আমি অহংকরী।

কাল বিড়াল: হে মাহমান্য মন্ত্রী! আপনি অহংকারের এক বরপুত্র। তাই ¯্রষ্টার পোষাক অহঙ্কার যেন আপনার গায়ে শোভা পায়। আর আপনার এই অহংকারের বলি আপনার একমাত্র আদরের দুলালী অনন্যাকে ভাল লাগার অপরাধে এক সাধারণ কেরানীর ছেলে মেধাবী পুলিশ অফিসার রফিকের অকাল মৃত্যু। যদিও আপনি ক্ষমতার বলে উক্ত হত্যাকে আত্মহত্যা বলে চালিয়ে দিয়েছেন। কিন্তু পাপ ছাড়ে না বাপকেও। পরিণতিতে আপনার অনন্যারও গলায় ফাঁসি দিয়ে আত্মহত্যা। অদৃষ্টের পরিণাম আর ¯্রষ্টার বিচার আর কি!

নেওয়াজ: আমার মতো প্রেমকাতুরে নিষ্পাপ মানুষের নামে এই কি বদনাম?

কাল বিড়াল: হে নিষ্পাপ! আপনি একজন দুশ্চরিত্র ব্যভিচারিও বটে। মনে পড়ে কি আপনার কলেজ বান্ধবী কাম প্রেমিকা রুবিনার কথা? আভিজাত্যের দাপটে ধনকুবের ব্যাবসায়ী পিতা তখন অনেকটা জোর করে আপনার বর্তমান স্ত্রী তমালিকার সাথে বিয়ে দিলেন। কিন্তু আপনি কাপুরুষের মতো সত্যকে বলার সাহস পেলেন না। কিন্তু জোরের বিয়ে, পরিণামে আপনার স্ত্রী দেহ পেল কিন্তু মন পেল না। অন্যদিকে পৃথিবীর অমোঘ নিয়মে প্রকৃতি শুন্যতা পরিহার করে রুবিনারও অন্য জায়গায় বিয়ে হল।

নেওয়াজ: কিন্ত প্রেমত স্বর্গীয়।

কাল বিড়াল: বিবাহপূর্ব প্রেম স্বর্গীয়। বিবাহ পরবর্তী অন্য ললনার সাথে প্রেম নিন্দনীয়। আর সে যদি হয় অন্যের স্ত্রী তবে তা হয় পরকীয়া। পরকীয়া মহাপাপ। তা কেবল অন্যের সাজানো বাগানে আনে ঝঞ্জা- বিক্ষুব্দ কালবৈশাখী। পর মানুষের প্রতি নিষিদ্ধ সম্পর্কের জন্য তীব্র বজ্ররাগে যেন বিচ্ছিন্ন ঘটে স্বামী-স্ত্রীর। অথচ আপনি চুটিয়ে চালিয়ে যাচ্ছেন তার সাথে পরকীয়া। আপনার স্ত্রী জানে, রুবিনার স্বামী জানে, জানে সমাজ-সংসার। কিন্তু আপনার ভয়ে সকলের মুখে কুলুপ এটে বসে আছে। যেন শত মানুষের কষ্টের ভিত্তির উপর যেন আপনার নিষিদ্ধ খেয়ালের এক কুৎসিত ভাস্কর্য।

নেওয়াজ: কি মিথ্যাবাদী রে!

কাল বিড়াল: হে মহান সত্যবাদী! আপনি তো মিথ্যাবাদীর এক আদর্শ উদাহরণও বটে। আপনার নির্বাচনী এলাকার প্রতি ঘরে একজনকে চাকুরী, কৃষকদের অধিকার আদায়, শ্রমিকের ন্যায্যমূল্য প্রাপ্তি, রাস্তা-ঘাটসহ এলাকার উন্নয়নসহ নির্বাচন পূর্বে আরও শতসহস্র প্রতিশ্রুতি। কিন্তু নির্বাচিত হয়ে মন্ত্রী হবার পর আপনি যেন এলাকায় এখন এক ডুমুরের ফুল মাত্র।

নেওয়াজ: কিন্তু আমার মাথায় তো সমগ্র দেশের ভার। তাই এলাকায় যথাযথ সময় দেয়া যায় না।

কাল বিড়াল: দেশ প্রেমত শুরু হয় প্রথমে পরিবার, তারপর সমাজ-সংসার হয়ে। সর্বশেষে তা রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে। তৃণমূলকে অস্বীকার করে দেশের সেবা যেন এক শীকড়বিহীন বৃক্ষের বেঁচে থাকার ব্যর্থ চেষ্টাও বটে।

নেওয়াজ: দূর হও বেটা দূর হও!

কাল বিড়াল: তাহলে তো আপনাকেই দূর হতে হয়।

নেওয়াজ: যতই চেষ্টা কর আমার টিকেটাও ছুতে পারবি না।

কাল বিড়াল: বিড়ালের থলের গিট যার যত শক্ত এই সমাজ যেন সেই তত ভাল। কিন্তু ভয় অদৃষ্টের নির্মম পরিহাসে এই গিট কখনও-কখনও আপনিই খুলে। জনসমাজে প্রকাশ পেয়ে যায় ব্যক্তির আসল রূপ। দাঁড়াতে হয় বিচারের কাঠগড়ায়। যেরূপ বাঁচতে পারেনি স্বৈরাচারী সাদ্দাম হোসেন, হোসনি মোবারক থেকে বিল ক্লিন্টন কিংবা আমাদের দেশের এরশাদ শিকদার থেকে বাংলা ভাই।

নেওয়াজ: তবে রে! আমাকে দেখাও বিচারের ভয়।

এই বলে বিড়ালের দিকে দৌড়। কিন্তু কিছু দূর গিয়েই বিড়ালটা দাঁড়িয়ে থাকে।

কাল বিড়াল বলে: তুমি আমাকে বন্দী করতে চাইলেও আমি তোমাকে ছাড়ব না। আমি তোমার ছায়ার মতই তোমার সাথে চিরন্তুন। যেহেতু হয়েছ আমার গোলাম, তোমার কর্মই হবে তোমার হতাশার কারণ।

নেওয়াজ: এক পর্যায়ে মাথায় হাত দিয়ে অসহায়ের মত ময়লার স্তুপের উপর বসে পড়ে।
আর ক্রমেই কালো বিড়াল হাঁটতে-হাঁটতে দূরে যেতে-যেতে এক পর্যায়ে অদৃশ্য হয়ে যায়। আর গুন-গুন করে বলে,
“কালো বিড়াল আমি, মনের মধ্যে বাস।
মানুষ হয় আমার গোলাম, হয় সর্বনাশ।
ভেবে ভয়ংকর পরিণতি, করে আমায় থলে বন্দি।
বিশ্ব চরাচরে ঘুরে বেড়ায় ভালর মুখোশ পরি।”

এক পর্যায়ে কাছের মসজিদ থেকে আসা ফজরের আজানে মোহভাঙ্গে নেওয়াজের। ঘড়ির দিকে তাকায় নেওয়াজ। ঘড়ির কাঁটা তখন ভোর পাঁচটা বাজে টিক-টিক।

লেখক : মেডিসিন ও মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞ, জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট, ঢাকা। 
E-mail: [email protected] 
মোবাইল- ০১৫৫৭৪৪০২৮৭

বহুমাত্রিক.কম

Walton Refrigerator Freezer
Walton Refrigerator Freezer