Bahumatrik | বহুমাত্রিক

সরকার নিবন্ধিত বিশেষায়িত অনলাইন গণমাধ্যম

বৈশাখ ৬ ১৪৩১, শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪

ডেঙ্গু সমাচার: দায় কার ?

ড. মো. হুমায়ুন কবীর

প্রকাশিত: ০১:০৯, ৮ আগস্ট ২০১৯

প্রিন্ট:

ডেঙ্গু সমাচার: দায় কার ?

ডেঙ্গু একটি মারণঘাতী রোগে রূপ নিয়েছে। প্রতিবছরই বর্ষা মৌসুমে ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব কমবেশি দেখা দেয়। কিন্তু ২০১৯ সালের বর্ষাকালের শুরুতেই এ যেন এক মহামারী রূপ ধারণ করতে চলেছে। প্রতিদিনই গণমাধ্যমে নতুন নতুন রোগাক্রান্ত ব্যক্তির মৃত্যু এবং আক্রান্তের খবর পাওয়া যাচ্ছে। খবরে কখনো কখনো প্রকাশ পাচ্ছে প্রতি মিনিটে একজন করে আক্রান্ত হচ্ছে। কিন্তু সকল পরিসংখ্যানকেই এখন ছাড়িয়ে গেছে। আজ (০৭ আগস্ট ২০১৯) যখন আমি এ প্রবন্ধ লিখছি, ঠিক তখন অবধি বিগত ২৪ ঘণ্টায় সারাদেশে ২ হাজার ৪২৮ জনের ডেঙ্গু জ¦র নিয়ে হাসপাতালে ভর্তির রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছে। আর এ পর্যন্ত এবছরে এ সংখ্যা ৩০ হাজার ছাড়িয়েছে। ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে স্বয়ং চিকিৎসকসহ দেশজুড়ে কমপক্ষে অর্ধশতাধিক রোগীর মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। সংখ্যা যাই হোক না কেন বিষয়টি দিনি দিন জনমনে শুধু আতঙ্কই সৃষ্টি করে চলেছে।   

প্রথম দিকে ডেঙ্গু রোগ ও রোগীর সংখ্যা নিয়ে একটু ধোয়াশা থাকলেও সময় যতই গড়িয়ে চলেছে এর গুরুত্ব ও ভয়াবহতা সম্পর্কে সবারই একটি পরিষ্কার ধারণা হচ্ছে। প্রথমে আসা যাক কীভাবে ডেঙ্গু রোগের সৃষ্টি হয়। এডিস নামের এক বিশেষ প্রজাতির মশা কামড়ালে ডেঙ্গু রোগ হয়। ডেঙ্গু রোগের সাধারণ কিছু লক্ষণ রয়েছে। যেগুলো এখন সচেতনতার জন্য প্রায়শই প্রতাশিত হচ্ছে বিভিন্ন মাধ্যমে। সেসব স্থান থেকে সংগৃহীত তথ্যমতে জানা যায় প্রথমে জ¦র হবে, তারপর বমি বমি ভাব হবে এবং বমিও হবে। সারা গা, হাত-পা ঠা-া হয়ে যাবে, নাড়ির গতি ক্ষীণ হবে। বেশি হলে চোখ লাল হবে, চোখের পিছনে ব্যাথা অনুভুত হবে, গিটে গিটে ব্যাথা হবে। আরো বেশি হলে রক্ত বমি, দাঁতের মাড়িতে রক্তক্ষরণ হবে, কালো বমি বা কালো পায়খানা হবে, দীর্ঘক্ষণ প্র¯্রাব হবে না এবং এক পর্যায়ে শরীর নিস্তেজ হয়ে যাবে।

তবে যেকোন জ¦র হলেই প্রথমেই ডাক্তারের চিকিৎসা নিয়ে সেই মোতাবেক ব্যবস্থা গ্রহণ করার কথা বলা হচ্ছে সতর্কবার্তায়। আর সেজন্য মানুষ এখন আগের তুলনায় অনেক স্বাস্থ্য সচেতন হওয়ার কারণেই হাসপাতালে ভীড় বাড়ছে। তবে আমরা যাই বলি না কেন এসব ব্যাপারে চিকিৎসা ব্যবস্থা এখন অনেক উন্নত হয়েছে। কিন্তু সমস্যা হয়েছে অন্য জায়গায়। বর্ষা মৌসুমে এডিস মশার প্রজনন বৃদ্ধি পায়। তবে জুলাই-আগস্টে এর প্রজনন সবচেয়ে বেশি। অথচ সেই বেশি প্রজননের আগেই যদি এডিস মশার আক্রমণে ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব এমন মহামারি রূপ লাভ করে তাহলে এখনই কার্যকরভাবে প্রতিরোধ করতে না পারলে সামনে সত্যিই আরো ভয়াবহতা অপেক্ষা করছে।

আগেই বলছিলাম ডেঙ্গু অন্য সাধারণ মশার মতো নয়। একে বলা হয়ে থাকে শহুরে ভদ্র মশা। অর্থাৎ নোংড়া কাদা পানি, ময়লা আবর্জনা, পঁচা ড্রেন, পঁচা পানি ইত্যাদির মধ্যে তা জন্মে না। ডেঙ্গু মশা ডিম পাড়ে এবং সেখান থেকে লার্ভা বের হয় তিন-চার দিন জমে থাকে এমন পরিষ্কার পানিতে। ঘরে বা আশেপাশে যেকোন পাত্রে/জায়গায় জমে থাকা পানি তিন দিন পরপর ফেলে দিলে এডিস মশার লার্ভা মরে যাবে। কোন পাত্রের গায়ে লেগে থাকা মশার ডিম অপসারণে পাত্রটি ঘষে ঘষে পরিষ্কার করতে হবে। বাসাবাড়িতে কিংবা ছাদের ওপর রাখা ফুলের টব, প্লাস্টিকের পাত্র, পরিত্যক্ত টায়ার, প্লাস্টিকের ড্রাম, মাটির পাত্র, বালতি, টিনের কৌটা, ডাবের খোসা, নারিকেলের মালা, কন্টেইনার, মটকা, নির্মাণাধীন বাড়ির চৌবাচ্চা, ব্যাটারি শেল ইত্যাদিতে এডিস মশা ডিম পাড়ে। কাজেই প্রাথমিকভাবে এদের ধ্বংস করতে হলে অব্যবহূত পানির পাত্র ধ্বংস অথবা উল্টে রাখতে হবে যাতে পানি জমতে না পারে। রাতে এমনকি দিনের বেলাতেও ঘুমানোর সময় মশারি ব্যবহার করতে হবে।     

এখন আসা যাক কীভাবে এর মহামারী প্রকোপ থেকে রক্ষা পাওয়া যেতে পারে। আমরা যদি আমাদের আশেপাশের প্রতিবেশি কয়েকটি দেশের কিছু পরিসংখ্যান দেখি সেখানে দেখা যাবে সেসব দেশেও বাংলাদেশ থেকে প্রাদুর্ভাবের দিক দিয়ে কোনভাবেই পিছিয়ে নেই। তবে সাম্প্রতিক সময়ে ভারতের অতি প্রাচীন কলকাতা শহরে ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব হলেও তারা তা সহজেই মোকাবেলা করে ফেলেছে। এখানে অভিজ্ঞতা ও পূর্ব প্রস্তুতি একটি বড় ফ্যাক্টর হিসেবে কাজ করেছে। আশার কথা ইতোমধ্যে দেখা গেছে ঢাকার সাথে ভিডিও কনফারেন্সিংয়ের মাধ্যমে তাদের সফলতার সহায়তা নেওয়ার প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে। এখন যদিও ডেঙ্গু সারাদেশেই ছড়িয়ে পড়েছে, কিন্তু প্রথমদিকে শুধু রাজাধানী ঢাকা শহরেই এর ব্যাপ্তি সীমাবদ্ধ ছিল।

এখন এডিস মশা, এর প্রাদুর্ভাব এবং ডেঙ্গু পরিস্থিতি ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। এর জন্য আমরা আসলে কাকে দায়ী করব। সরকার, মেয়র নাকি জনগণ। সরকার ও মেয়র তো আসলে এক সূত্রেই গাঁথা। এখানে মেয়রের গাফিলতি হলে নিশ্চয়ই সরকারও এর দায় এড়াতে পারবে না। কিন্তু এ বিষয়টি নিয়ে একটু বিশ্লেষণ প্রয়োজন। প্রথমত প্রতিবছরের প্রাদুর্ভাবের উপর ভিত্তি করেই সাধারণত দমন ও প্রতিকার কর্মসূচি গৃহীত হয়ে থাকে। এক্ষেত্রে বিগত বছরগুলোর তুলনায় এবার যে হঠাৎ করেই এত বেশি প্রদুর্ভাব হবে তা হয়তো সংশ্লিষ্ট কারোরই ধারণায় ছিলনা। এখানেই আসলে ভুলটি হয়েছে। যেহেতু এ মৌসুমে ডেঙ্গুর প্রকোপ হয়ে থাকে সেজন্য যেকোন অজুহাতই থাকুক না কেন তা আসলে গাফিলতি হিসেবেই ভুক্তভোগীরা বিবেচনা করবে।

অপরদিকে কার্যকর মশানাশক ওষুধ কেন এখনো আমাদেও সংগ্রহে নেই সেটাও গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। আবার রাস্তাঘাটে ওষুধ স্প্রে করা,  ঝোঁপঝাড় পরিষ্কার করা, জনগণকে সচেতন করা ইত্যাদিও জন্য হয়তো নাগরিকের মৌলিক সেবা হিসেবে নগর পিতাকেই ভুক্তভোগীরা দায়ী করবেন। কিন্তু আপনার আমার বাসা বাড়িতে জমে থাকা পানি, ময়লা আবর্জনা এবং এডিস মশার উর্বর স্থান সৃষ্টিতে বাধা দেওয়া কিন্তু আবার সংশ্লিষ্ট বাড়িওয়ালার ওপরেই বর্তাবে। আবার এডিস মশার কামড় থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য কি কি সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন সেটাও আপনাকে কিংবা আমাকেই নিতে হবে। অপরদিকে যদি কেউ রোগাক্রান্ত হয়েই পড়ে সেক্ষেত্রে মৌলিক অধিকার হিসেবে তার চিকিৎসা ব্যবস্থা রাষ্ট্রকেই সমন্বয় করতে হবে। আশা করি রাষ্ট্র সাফল্যজনকভাবেই সেই কাজটি করে চলেছে এবং শেষপর্যন্তও করে যাবে।

এটি নিসন্দেহে একটি জাতীয় দুর্যোগ। কাজেই আমরা এ দুর্যোগ থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য সবাইকেই দোষারোপের সংস্কৃতি থেকে বের হয়ে সম্মিলিতভাবে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে কাজে ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে। এ ব্যাপারে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যদিও রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ কাজে বিদেশে সফরে ছিলেন তারপরও তিনি সেখান থেকেই ভিডিও কনফারেন্স করেছেন, খোঁজখবর নিয়েছেন এবং সংশ্লিষ্ট সকলকে প্রয়োজনীয় পরামর্শ ও নির্দেশনা দিয়ে চলেছেন। কাজেই অতীতে যেমন যেকোন দুর্যোগ দুর্বিপাক আওয়ামীলীগের নেতৃত্বাধীন সরকার সামাল দিয়েছে এবারেও এর ব্যতিক্রম হবে না-এটি জোর দিয়েই বলা যায়।   
    
লেখক: কৃষিবিদ ও ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়
email: [email protected]

বহুমাত্রিক.কম

Walton Refrigerator Freezer
Walton Refrigerator Freezer