Bahumatrik | বহুমাত্রিক

সরকার নিবন্ধিত বিশেষায়িত অনলাইন গণমাধ্যম

বৈশাখ ১১ ১৪৩১, শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪

ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের কঠিন অপপ্রয়োগ হচ্ছে: সম্পাদক পরিষদ

বহুমাত্রিক ডেস্ক

প্রকাশিত: ০০:৪৭, ৭ মার্চ ২০২১

প্রিন্ট:

ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের কঠিন অপপ্রয়োগ হচ্ছে: সম্পাদক পরিষদ

ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনকে সাংবাদিকদের ওপর নিপীড়ন ও নির্যাতনের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহারের কথা উল্লেখ করে সম্পাদক পরিষদ আইনটি সংশোধনের দাবি জানিয়েছে। আইনমন্ত্রী এটি পর্যালোচনা করার যে কথা বলেছেন তা অধ্যাদেশ জারির মাধ্যমে অবিলম্বে কার্যকর করারও আহ্বান জানিয়েছে দেশের শীর্ষস্থানীয় দৈনিকের সম্পাদকদের এ সংগঠন।

এ আইনে গ্রেপ্তার সব সাংবাদিক ও লেখকের মুক্তি এবং মামলা প্রত্যাহারের দাবি জানিয়ে সংগঠনটি বলেছে, আইনটি তৈরির সময়ই এর অপপ্রয়োগের যে আশঙ্কা করা হয়েছিল, কোনো কোনো ক্ষেত্রে সেই আশঙ্কার চেয়েও তা কঠিনভাবে প্রয়োগ করা হচ্ছে। মুক্তমনা লেখক মুশতাক আহমেদকে জীবন দিয়ে তা প্রমাণ করে যেতে হলো।

শনিবার সংগঠনটির বিবৃতিতে এসব কথা বলা হয়। ১০ মাস কারাবন্দি থাকার পর কার্টুনিস্ট আহমেদ কবির কিশোরকে জামিন দেওয়ায় আদালতকে ধন্যবাদ জানিয়েছে সম্পাদক পরিষদ। তবে তার সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নির্দয় আচরণকে `অনভিপ্রেত` বলেছে সংগঠনটি।

সাংবাদিক শফিকুল ইসলাম কাজলের ব্যাপারে উদ্বেগ জানিয়ে সম্পাদক পরিষদ বলেছে, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে একটি লেখা শেয়ার দেওয়ার কারণে তাকে দীর্ঘদিন নিখোঁজ ও কারাগারে থাকতে হয়েছে। পরে জামিন পেলেও তার বিরুদ্ধে মামলাগুলো চলমান রয়েছে। আর্থিক, শারীরিক ও মানসিকভাবে বিপর্যস্ত কাজলকে মামলা মোকাবিলা করতে হচ্ছে।

যুক্তরাজ্যভিত্তিক মিডিয়া ওয়াচডগ বডি আর্টিকেল ১৯-এর তথ্য তুলে ধরে বিবৃতিতে বলা হয়, ২০২০ সালে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ১৯৮টি মামলায় ৪৫৭ জনকে বিচারের আওতায় আনা হয়েছে ও গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তাদের মধ্যে ৭৫ জন সাংবাদিক। এর মধ্যে ৩২ জনকে বিচারের আওতায় আনা হয়েছে। আইনমন্ত্রী আনিসুল হক সম্প্রতি বিবিসিকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বলেছেন, আইনটি পর্যালোচনা করা হবে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা হলে তদন্তের আগেই যেন গ্রেপ্তার করা না হয়, এমন ব্যবস্থা করা হবে বলে তিনি জানিয়েছেন। আইনমন্ত্রীর এই বক্তব্যকে স্বাগত জানিয়ে অবিলম্বে অধ্যাদেশ জারি করে একে আইনগতভাবে কার্যকর করার উদ্যোগ নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছে সম্পাদক পরিষদ।

বিবৃতিতে আরও বলা হয়েছে, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের খসড়া তৈরি, মন্ত্রিসভায় অনুমোদন, সংসদে বিল উত্থাপন ও রাষ্ট্রপতির সইয়ের আগে ও পরে সাংবাদিকদের বিভিন্ন সংগঠন, বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, সম্পাদক পরিষদ এবং দেশীয় ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংগঠন ও সংস্থা আপত্তি তুলেছিল। সরকারের পক্ষ থেকে কয়েকজন মন্ত্রী ও সংসদীয় কমিটির সদস্যরা সম্পাদক পরিষদের সঙ্গে বৈঠক করে আপত্তিগুলো শুনেছিলেন। শেষে দেখা যায়, সম্পাদক পরিষদের দাবিগুলো পুরোপুরি উপেক্ষা করা হয়েছে। এমনকি এই আইন প্রণয়নের সময় সংসদে সংশ্নিষ্ট মন্ত্রীর বক্তব্য এবং সংসদীয় কমিটির পেশ করা প্রতিবেদন সম্পর্কে সংসদীয় স্থায়ী কমিটিতে আলোচনায় অংশগ্রহণকারী গণমাধ্যমের প্রতিনিধিদের মতামতও বিবেচনায় নেওয়া হয়নি।

বিবৃতিতে বলা হয়, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের আপত্তিকর ধারাগুলো সুনির্দিষ্টভাবে উল্লেখ করে গণমাধ্যম প্রতিনিধিরা সেগুলো সংশোধনের সুপারিশ করেছিলেন। সম্পাদক পরিষদ মনে করে, সেগুলো বিবেচনায় নেওয়া হলে আজকের এ পরিস্থিতি হয়তো উদ্ভব হতো না। বিবৃতিতে বলা হয়, এ আইন নিয়ে উদ্বেগের কারণ সম্পর্কে সম্পাদক পরিষদ ২০১৮ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর বিশদভাবে ব্যাখ্যা করেছিল। ব্যাখ্যায় আইনটির ৯টি ধারা (৮, ২১, ২৫, ২৮, ২৯, ৩১, ৩২, ৪৩ ও ৫৩) নিয়ে সম্পাদক পরিষদ তাদের উদ্বেগ তুলে ধরে।

ধারাগুলো বিশ্নেষণ করে সম্পাদক পরিষদ যেসব মৌলিক ত্রুটি চিহ্নিত করেছিল, তাও তুলে ধরা হয় বিবৃতিতে। সেগুলো হচ্ছে- ১. ডিজিটাল যন্ত্রের মাধ্যমে অপরাধ সংঘটন প্রতিহত করা এবং ডিজিটাল অঙ্গনে নিরাপত্তা বিধানের লক্ষ্যে একটি আইন প্রণয়নের চেষ্টা করতে গিয়ে এমন একটি আইন করা হয়েছে, যা সংবাদমাধ্যমের কর্মকাণ্ডের ওপর নজরদারি ও বিষয়বস্তুর ওপর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করবে। এই আইনের ৮, ২১, ২৫, ২৮, ২৯, ৩১ ও ৩২ ধারা সংবিধানপ্রদত্ত সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতার সঙ্গে সাংঘর্ষিক। এই ধারাগুলো নাগরিকদের বাক্‌ ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নিয়ন্ত্রণেরও সুযোগ সৃষ্টি করবে। যেমন ৮ ধারায় উল্লেখ আছে, যদি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছে প্রতীয়মান হয় যে ডিজিটাল মাধ্যমে প্রকাশিত বা প্রচারিত কোনো তথ্য-উপাত্ত দেশের বা তার কোনো অংশের সংহতি, অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড, নিরাপত্তা, প্রতিরক্ষা, ধর্মীয় মূল্যবোধ বা জনশৃঙ্খলা ক্ষুণ্ণ করে, বা জাতিগত বিদ্বেষ ও ঘৃণার সঞ্চার করে, তাহলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ওইসব তথ্য-উপাত্ত অপসারণ বা ব্লক করার জন্য বিটিআরসিকে অনুরোধ করতে পারবে।

২১ ধারায় বলা হয়েছে, কোনো ব্যক্তি যদি ডিজিটাল মাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, জাতির পিতা, জাতীয় সংগীত বা জাতীয় পতাকার বিরুদ্ধে কোনো প্রকার প্রপাগান্ডা ও প্রচারণা চালায় বা তাতে মদদ দেয় সেটা অপরাধ হবে।

২৫ ধারায় আছে, কোনো ব্যক্তি যদি ওয়েবসাইট বা অন্য কোনো ডিজিটাল মাধ্যমে ইচ্ছাকৃতভাবে বা জ্ঞাতসারে, এমন কোনো তথ্য-উপাত্ত প্রেরণ করেন, যা আক্রমণাত্মক বা ভীতি প্রদর্শক অথবা মিথ্যা বলে জ্ঞাত থাকা সত্ত্বেও কোনো ব্যক্তিকে বিরক্ত, অপমান, অপদস্থ বা হেয়প্রতিপন্ন করার অভিপ্রায়ে কোনো তথ্য-উপাত্ত প্রেরণ, প্রকাশ বা প্রচার করেন, বা রাষ্ট্রের ভাবমূর্তি বা সুনাম ক্ষুণ্ণ করার বা বিভ্রান্তি ছড়ানোর উদ্দেশ্যে, বা কোনো তথ্য সম্পূর্ণ বা আংশিক বিকৃত আকারে প্রকাশ বা প্রচার করেন বা করতে সহায়তা করেন, তাহলে ওই ব্যক্তির এ কাজটি হবে অপরাধ।

২৮ ধারায় বলা হয়েছে, কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠী যদি ইচ্ছাকৃতভাবে বা জ্ঞাতসারে ধর্মীয় মূল্যবোধ বা অনুভূতিতে আঘাত করার বা উস্কানি দেওয়ার অভিপ্রায়ে ওয়েবসাইট বা অন্য কোনো ইলেকট্রনিক বিন্যাসে এমন কিছু প্রকাশ বা প্রচার করেন বা করান, যা ধর্মীয় অনুভূতি বা ধর্মীয় মূল্যবোধের ওপর আঘাত করে, তাহলে উক্ত ব্যক্তির এ কাজ হবে একটি অপরাধ।

৩১ ধারায় উল্লেখ আছে, কোনো ব্যক্তি যদি ইচ্ছাকৃতভাবে ওয়েবসাইট বা ডিজিটাল বিন্যাসে এমন কিছু প্রকাশ বা সম্প্রচার করেন বা করান, যা সংশ্নিষ্ট বিভিন্ন শ্রেণি বা সম্প্রদায়ের মধ্যে শত্রুতা, ঘৃণা বা বিদ্বেষ সৃষ্টি করে বা সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্ট করে বা অস্থিরতা বা বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে অথবা আইনশৃঙ্খলার অবনতি ঘটায় বা ঘটানোর উপক্রম হয়, তাহলে সেটা হবে অপরাধ।

৩২ ধারায় আছে, কোনো ব্যক্তি যদি অফিশিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্টের আওতাভুক্ত কোনো অপরাধ কম্পিউটার, ডিজিটাল ডিভাইস, কম্পিউটার নেটওয়ার্ক, ডিজিটাল নেটওয়ার্ক বা অন্য কোনো ডিজিটাল মাধ্যমে সংঘটন করেন বা করতে সহায়তা করেন, তাহলে তিনি অনধিক ১৪ বছর কারাদণ্ডে বা অনধিক ২৫ লাখ টাকা অর্থদণ্ডে বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন।

বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন এমন এক আতঙ্ক ও ভীতির পরিবেশ তৈরি করবে, যেখানে সাংবাদিকতা, বিশেষত অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা কার্যত অসম্ভব হয়ে পড়েছে। এই আইন সংবাদমাধ্যমের কর্মী ছাড়াও কম্পিউটার ও কম্পিউটার নেটওয়ার্ক ইত্যাদি ব্যবহারকারী সব ব্যক্তির মধ্যে ভীতি সৃষ্টি করেছে। এই আইনের ৪৩ ধারা পুলিশকে বাসাবাড়িতে প্রবেশ, অফিসে তল্লাশি, লোকজনের দেহ তল্লাশি এবং কম্পিউটার, কম্পিউটার নেটওয়ার্ক, সার্ভার ও ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম-সংক্রান্ত সবকিছু জব্দ করার ক্ষেত্রে সীমাহীন ক্ষমতা দিয়েছে। 

সম্পাদক পরিষদ বিবৃতি বলেছে, ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে যারা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড করবে তাদের অবশ্যই বিচারের আওতায় আনতে হবে। কিন্তু, কৌশলে তা যেন গণমাধ্যম ও মুক্তমনের লেখকদের ওপর প্রয়োগ করা না হয়, তা নিশ্চিত করতে অবিলম্বে আইনটির সংশোধন করতে হবে।

সরকারের সুবিবেচনা প্রত্যাশা করে বিবৃতিতে দাবি করা হয়েছে, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে সংবাদকর্মীদের নামে যত মামলা হয়েছে, যতজন সংবাদকর্মী ও মুক্তমনা লেখক গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারে আছেন, তাদের সবাইকে অবিলম্বে মুক্তি এবং মামলাগুলো প্রত্যাহার করে নেওয়া হোক।

সম্পাদক পরিষদ বলছে, পুলিশ এ আইনে দেওয়া ক্ষমতাবলে পরোয়ানা ছাড়াই সন্দেহবশত যে কোনো ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করতে পারে। এ ক্ষেত্রে পুলিশের কোনো কর্তৃপক্ষের কোনো ধরনের অনুমোদন নেওয়ার প্রয়োজন নেই। এই আইনে অস্পষ্টতা আছে এবং এতে এমন অনেক শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে, যার ভুল ব্যাখ্যা হতে পারে এবং সহজেই সংবাদমাধ্যমের বিরুদ্ধে ব্যবহার করা যেতে পারে।

সম্পাদক পরিষদের দৃষ্টিতে উদ্বেগের আরেকটি বিষয় হলো, এ আইনের অপরাধ ও শাস্তিসংক্রান্ত প্রায় ২০টি ধারার মধ্যে ১৪টি জামিন অযোগ্য, পাঁচটি জামিনযোগ্য এবং একটি সমঝোতাসাপেক্ষ। এর ফলে অনিবার্যভাবে একটা ভীতির পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে, যেখানে সাংবাদিকতার স্বাভাবিক অনুশীলন আরও ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে।

Walton Refrigerator Freezer
Walton Refrigerator Freezer