Bahumatrik | বহুমাত্রিক

সরকার নিবন্ধিত বিশেষায়িত অনলাইন গণমাধ্যম

বৈশাখ ৫ ১৪৩১, শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪

জীবন কথক কবি ও ঔপন্যাসিক আশামণি

রুদ্ধ অনির্বাণ

প্রকাশিত: ১৫:৩১, ২ নভেম্বর ২০২২

প্রিন্ট:

জীবন কথক কবি ও ঔপন্যাসিক আশামণি

-কবি আশামণি

১.
কবি নিজেকে প্রশ্ন করেন: ‘জীবন যেভাবে চলছে-সেভাবে কী চলা উচিত? আমরা যা করছি-যে ভাবে করছি-তা কি সেভাবে করা উচিত বা আমরা কেন আমাদের দৈনিন্দন জীবনের কাজগুলো করছি?’ এসব মৌলিক প্রশ্ন দার্শনিকেরা একটি প্রত্যয়ের মাধ্যমে প্রশ্ন আকারে প্রকাশ করেন এভাবে- Why do we do what we do? Why do we do what we do in the way we do it? এসব প্রশ্নের উত্তরের মাঝে মানবপ্রগতির অনেক আন্দোলন-সংগ্রাম আর অগ্রসরমানতার বীজ নিহিত রয়েছে?

আমরা মহামানবদের জীবনী গভীরভাবে অনুসন্ধান ও বিশ্লেষণ করলে দেখবো পাবো তাঁরা প্রত্যেকেই সমাজের তৎকালীন অবস্থার আলোকে সে সময়কার মানুষের জীবন-কর্ম ও চিন্তন প্রণালীর বিষয়ে উপরিউক্ত প্রশ্ন উত্থাপন করে সমাজ প্রগতির দিশা খুঁজেছেন। আর এভাবেই এগিয়ে গেছে মানব সমাজ-মানবপ্রগতিতে এসেছে আলোক বিচ্ছুরণ। মহান দার্শনিক হেগেলের ত্রয়ী প্রত্যয়- Thesis-Antithesis-Synthesis পথ দেখিয়েছে আলোকিত সুষম বৈষম্যহীন সমাজ নির্মাণে এগিয়ে যেতে। এ প্রত্যয়েরই ধারক ও বাহক কবি ও ঔপন্যাসিক আশামণি।

আলোকিত সমাজ নির্মাণের একজন কারিগর কবি ও ঔপন্যাসিক আশামণি। ‘জীবন ঘষে আগুন জ্বেলে জীবনের পথ চিনে নেওয়া’র মাঝেই জীবনের বহমানতা। কবি ও উপন্যাসিক আশামণি এই জীবনপ্রবাহের একজন ঋত্বিক। তাঁর লেখনিতে প্রোজ্জ্বল হয় মানুষের কথা-জীবনের কথা-প্রকৃতির কথা-চারপাশের পরিবেশ-প্রতিবেশ ও নানান অনুষঙ্গের কথা। প্রগতিবাদি-মানবতার পূজারী এবং সভ্যতার আলোকিত দিক নিয়ে চর্চাকারী একজন মননশীল ও সৃজনশীল সত্ত্বার অধিকারী তিনি।

লেখনির মাঝে তুলে আনেন আমাদের সমাজের চারিদিকের নানান অনুষঙ্গ-কহুমাত্রিক দ্যোতনা। এসব অনুষঙ্গ ও দ্যোতনায় থাকে আবেগ-বাস্তবতার কঠিন কষাঘাত এবং সমাজের চারিদিকে ছড়িয়ে থাকা দৃশ্যপট। কবিতায় নিবেদিতপ্রাণ হলেও আশামণি ছোট গল্প,উপন্যাস, ছড়া ও প্রবন্ধ লেখায়ও সিদ্ধহস্ত। মনের ভেতর লুকিয়ে থাকা না বলা কথা-আবেগ-দ্রোহ ও প্রতিবাদ অনেক সময় প্রকাশ করা যায় না-গুছিয়ে বলাটা কঠিন হয়ে যায়। আশা মণি আমাদের অনেকের মনের ভেতর লুকিয়ে থাকা এই না বলা দ্রোহ-আবেগ-প্রতিবাদ ও অবদমিত মনের ভাব প্রকাশ করে চলেছেন তাঁর লেখনির মাধ্যমে। আত্মজাগরিত আশামণির স্বচ্ছন্দ প্রকাশ তার আত্মবিশ্বাসী লেখনিতে।

২.

ভ্রষ্ট সমাজের নানান অসঙ্গতি নর-নারীর শাশ্বত প্রেম-বিরহ ও প্রকৃতি বন্দনা নিয়ে কবি আশামণির কাব্য প্রচেষ্টা। চিত্রা নদীর তীরবর্তী নয়নাভিরাম নিঃসর্গের জনপদ নড়াইলে ১৯৭২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি জন্মগ্রহণ করেন তিনি। মরহুম আব্দুস সালাম ও সৈয়দা মনোয়ারা বেগম দম্পতির কন্যা আশামণি আশৈশব ভাবনাপ্রবণ-কল্পনাবিলাসী। সাহিত্যচর্চার শুরু কৈশোরেই। ব্যক্তিজীবনের কঠিনতম বাস্তবতার সঙ্গে মানবজীবনের অবিরত সংগ্রামের চিত্র নির্মোহভাবে কবিতায়-প্রবন্ধে রূপায়িত করতে পারঙ্গম তিনি।

পেশাগত জীবনে নড়াইলের শিশুদের স্কুল অনির্বাণ ও আশামণি সঙ্গীত নিকেতনের শিক্ষক তিনি। সাহিত্য ও সংস্কৃতিচর্চার ফলশ্রুতিতে আঞ্চলিক ও জাতীয় একাধিক সংগঠনের সাথে যুক্ত রয়েছেন । বঙ্গবন্ধু তরুণ লেখক পরিষদের মহাসচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করে চলেছেন দক্ষতার সাথে। দীর্ঘদিন থেকেই সংবাদপত্রে কবিতা ও প্রবন্ধ লিখে ঋদ্ধ তিনি। ভারত-বাংলাদেশের অসংখ্য পত্র পত্রিকায় তাঁর লেখা প্রকাশিত হয়ে আসছে। নিরলসভাবে লিখে চলেছেন ছড়া-কবিতা-প্রবন্ধ-ছোটগল্প-উপন্যাস। দেশে বিদেশে কুড়িয়েছেন সারস্বত সমাজের সম্মান ও সম্মাননা।

৩.
কবি আশামণি মূলত সাম্যের কবি ও কথক। ছোটবেলা থেকেই ব্যতিক্রমী মননের অধিকারিণী। নির্জনতাপ্রিয় ও অন্তর্মুখী। বই পড়া ও ভ্রমণ তাঁর একান্ত নেশা ও শখ। বাবা ছিলেন হাইস্কুলের শিক্ষক। বাবার উৎসাহেই কবিতা লেখালেখির মধ্য দিয়ে তাঁর সাহিত্যাঙ্গনে প্রবেশ। যে কোনো বৈষম্যের বিরুদ্ধে তাঁর কলম নির্ভীকভাবে সোচ্চার। প্রাতিষ্ঠানিক সম্পৃক্তিতে তিনি অনন্য। মহাসচিব- বঙ্গবন্ধু তরুণ লেখক পরিষদ, ঢাকা, বাংলাদেশ; সহকারী শিক্ষক, অনির্বাণ প্রি-ক্যাডেট স্কুল, নড়াইল;সংগীত ও আবৃত্তি শিক্ষক, আশামণি সংগীত ও আবৃত্তি নিকেতন, নড়াইল, স্থাপিত ২০০৬; আজীবন সদস্য, উত্তর বাংলা সাহিত্য সাংস্কৃতিক পরিষদ এবং সদস্য, নড়াইল জেলা পাবলিক লাইব্রেরী তাঁর জীবন দ্যোতনার কয়েকটি স্ফুলিঙ্গমাত্র। এসবের ব্যাপ্তি ছাড়িয়ে তিনি উচ্চতর মার্গে নিজের দক্ষতার প্রকাশ ঘটিয়ে চলেছেন প্রতিনিয়ত।

৪.
আশামণির এযাবৎ প্রকাশিত গ্রন্থ সংখ্যা ১৮টি। এর মধ্যে কাব্যগ্রন্থ-৭টি; ছোটগল্প-১টি; উপন্যাস-৪টি; সম্পাদিত গ্রন্থ-৫টি; প্রবন্ধ সংকলন-১টি। ধারাবাহিক পরম্পরায় আমরা আশামণির রচনাসম্ভারকে পেতে পারি এভাবে: (ক) কাব্যগ্রন্থ: (১) অন্তবাসে অন্তহীন-২০১১; (২) ইন্দ্রবিলাস-২০১২; (৩) অনুক্ষণে অনুভবে তুমি-২০১৩; (৪) হিমাদ্রী পরবাস-২০১৬; (৫) বিশ্ববরেণ্য বিশ্বনন্দিত তুমি-২০১৭ ; (৬) বাসনার বহ্নি-২০১৯ ও (৭) ত্রিযামা-২০২১।

(খ) প্রবন্ধের বই: প্রেম ও জৈবিকতা-২০১১। (গ) উপন্যাস: (১) পৃথা-২০১৫; (২) বাবাতন্ত্র-২০১৭; (৩) লাম্পট্য-২০১৮ এবং (৪) ছান্দিক দ্বান্দ্বিক-২০২২। (ঘ) ছোটগল্প : (১) মধ্যবিত্তের মধ্যগগন (২০২০) এবং (ঙ) সম্পাদিত গ্রন্থ: (১) হৃদয়ে শেখ রাসেল- ২০১৩; (২) শতদল-২০১৩; (৩) বঙ্গবন্ধু-এই প্রজন্মের ভাবনা -২০১৫ এবং (৪) বঙ্গবন্ধু, মুক্তিযুদ্ধ ও বাংলাদেশ-২০১৮। এসব রচনার ভেতরে প্রবেশ করে পাঠক পেতে পারেন জীবনের নানান রঙের অনুষঙ্গ ও দর্শন যা একজন মানুষকে নতুনভাবে জীবনোপলব্ধি দিতে পারে বলে আমাদের বিশ্বাস।


৫.
কবি মানুষকে ভালোবাসেন-আশামণিও মানুষকে ভালোবেসে মানুষের মাঝে নিজের কলমকে ঋদ্ধ করেন। আশামণিকে আমরা চিত্রকর বলেও আখ্যায়িত করতে পারি। তিনি রঙ তুলি হাতে ক্যানভাসে ছবি আঁকেন না-নিজের ষষ্ঠ আঙ্গুল হিসেবে ব্যবহার করেন তাঁর কলমকে। [ সৈয়দ শামছুল হকের ভাষায় ‘কলম হচ্ছে লেখকের ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়’।] আর এই ষষ্ঠ আঙ্গুল তাকে সমাজের ছবি আঁকতে প্রেরণা দেয়-উৎসাহিত করে-ঋদ্ধ করে -বাধ্য করে। ‘জীবনের কঠিন মাটি’তে ‘ সংগ্রাম’ নামক লাঙ্গল চালিয়ে ‘বাস্তবতা’র নিড়ানি দিয়ে এবং ‘চেষ্টা’ নামক পানিসেচ করে ‘সফলতা’ নামক ‘ফসল’ ফলাতে সাধারণ যেসব মানুষেরা ‘জীবনের সার’ হিসেবে ‘অদম্য জেদ ও পরিশ্রম’ নামক মহাঅস্ত্র ব্যবহার করে আমাদের প্রিয় স্বদেশকে বিশ্বের দরবারে উন্নয়নের মডেল হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার নিরন্তর প্রয়াসে লিপ্ত; তাদের এই ‘অদম্য জেদ ও পরিশ্রম’ পাথেয় করে ‘হৃদয়ের ঊষ্ণতা’র তুলি দিয়ে ‘ভালবাসা’র রং মাখানো ‘সমাজ’ নামক ক্যানভাসের ‘মানুষ’ নামক মডেলদের নিয়ে ‘আলোকিত সমাজ তথা আলোকিত পৃথিবী’ শীর্ষক ‘ মহান ছবি’ আঁকার কাজে রত আছেন ‘আশামণি’ নামক ‘আশা জাগানিয়া প্রাণ’।

আশামণির মনে সঞ্জিবনী সুধা হয়ে আছে মানুষের প্রতি ‘ভালবাসা’ নামক মহার্ঘ্য বস্তুটি। প্রগতিশীল ও আলোকিত চেতনার বিশ্বাসে বিশ্বাসী হয়ে বিশ্বাসের রথে চড়ে বিশ্বাস নামক বিশ্বাসের ঘরে তিনি দৃঢ়বিশ্বাস নিয়ে বিরাজ করছেন ‘মানবতা’র সুবাস ছড়িয়ে। তাঁর বিশ্বাসময় ভালবাসা আমাদের সহজ-সরল ও সংগ্রামী মানুষদের মনে ছড়িয়ে দেয় স্বপ্নের জাল -দিন বদলের পালাগান- সুখী সমৃদ্ধ জীবন গড়ার উত্তর ফাগুনের কবিতা- মফিজ, গনি মিয়া-আইজ উদ্দিন নামক সাধারণ মানুষদের দৈনন্দিন জীবনের অত্যাবশকীয় ভাত ও রুটির গদ্যগাথা- রুজি ও রোজগারের কাহিনীকাব্য-আঠারো বছর বয়স ভয়ংকর খ্যাত তারুণ্যের ভবিষ্যৎ বিনির্মাণের সনেট।

৬.
আশামণি একজন শিক্ষক। তিনি প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষকতা করেন-ছাত্রছাত্রীদের আলোকিত করেন। একই সাথে তিনি সমাজ নাম প্রতিষ্ঠানেরও শিক্ষক যেখানে তিনি সমাজের মানুষের হৃদয়কে আলোকিত করতে সদাপ্রস্তুত-সদাসচেষ্ট। প্রাচীনকালের মুনিঋষি ও পন্ডিতেরা বলেছেন ‘ জ্ঞান বা বিদ্যাকে ধরতে শিক্ষককে হতে হবে বোবা আর শিক্ষার্থীকে হতে হবে বধির।

স্বাভাবিকভাবে প্রশ্ন ওঠে, শিক্ষক বোবা হলে হলে তিনি বলার মাধ্যমে শেখাবেন কী করে, আর শিক্ষার্থী বধির হলে সে বিদ্যা শুনবে কী করে? পন্ডিতজনের বাণী বলে কথা। শিক্ষক বোবা হবেন অর্থ একজন একজন বোবাকে তার নিজের ভাষা বোঝানোর জন্য যে পরিমাণ কষ্ট বা কসরত করতে হয়, শিক্ষককে বোঝানোর জন্য সে পরিমাণ কষ্ট করতে হবে। আর বধিরকে অন্যের কথা শোনার জন্য যতখানি একনিষ্টতা ও অধ্যবসায় প্রয়োগ করতে হয়, শিক্ষার্থীকে শিক্ষকের নিকট থেকে অতখানি কষ্ট করে জ্ঞান অর্জন করতে হবে। (সূত্র:জয়া ফারজানা,নীরবে বদলে যাচ্ছে বাংলাসংস্কৃতি; কালের কন্ঠ: ১৯ ফেব্রুয়ারি ২০১৭)

৭.
কবি আশামণি পেয়েছেন মানুষের ভালোবাসা। এই ভালোবাসার প্রকাশ হিসেবে তাঁর প্রতি নিবেদিত হয়েছে সম্মাননা ও পুরস্কার। এ যাবৎ দেশ বিদেশ থেকে পেয়েছেন অসংখ্যা সম্মাননা। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে: (১)সাতক্ষীরা লেখক সম্মেলন সম্মাননা-২০০৯; (২) মাগুরা লেখক সম্মেলন সম্মাননা-২০০৯; (৩) কুষ্টিয়া লেখক সম্মেলন সম্মাননা-২০১০; (৪) যশোর লেখক সম্মেলন সম্মাননা-২০১০; (৫) কবি সংসদ বাংলাদেশ, সম্মাননা-২০১১; (৬) উত্তর বাংলা বিজয় দিবস পদক,পাবনা-২০১১; (৭) ফেরারী প্রকাশন সাহিত্য পদক,শেরপুর, বগুড়া- ২০১১; (৮) মহিয়সী সাহিত্য ও পাঠচক্র পদক সম্মাননা, পাবনা-২০১২; (৯) স্বপ্নীল স্বদেশ,রংপুর, পদক সম্মাননা-২০১২; (১০) অগ্নিবীণা ১৪ আর এন রোড, যশোর স্মারক সম্মাননা-২০১২; (১১) প্রদীপ্ত সাহিত্যাসর রাজশাহী পদক সম্মাননা-২০১২; (১২) খুলনা লেখক সম্মেলন সম্মাননা-২০১২; (১৩) নড়াইল লেখক সম্মেলন সম্মাননা-২০১২; (১৪) আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পদক সম্মাননা রুরাল জার্নালিষ্ট ফাউন্ডেশন (আরজেএফ) ঢাকা -২০১২; (১৫) বরেন্দ্র সাহিত্য পরিষদ, নওগাঁ, খন্দকার মকবুল হোসেন সাহিত্য- পদক সম্মাননা-২০১২; (১৬) নজরুল পাঠাগার ও ক্লাব, রবীন্দ্র নজরুল জয়ন্তী উৎসব দিনাজপুর- পদক সম্মাননা -২০১২; (১৭) বহুভূজ সাহিত্য পরিষদ পদক পঞ্চগড় সম্মাননা -২০১৩; (১৮) অরুণিমা সাহিত্য পর্ষদ, ঈশ্বরদী, পাবনা শুভেচ্ছা সম্মাননা-২০১৩; (১৯) কুসুমের ফেরা সাহিত্য পদক-পশ্চিমবঙ্গ,ভারত- ২০১৩; (২০) ললিতকলা মিউজিক এন্ড কলেজ, পদক স্মারক সম্মাননা, পশ্চিমবঙ্গ, ভারত- ২০১৩; (২১) বাউল ফকির উৎসব শ্যামনগর উত্তর চব্বিশ পরগনা, পশ্চিমবঙ্গ, ভারত সম্মাননা-২০১৪; (২২) সংলাপ সাহিত্য পদক মানপত্র ও উত্তোরীয় সম্মাননা পূর্ব মেদিনীপুর, পশ্চিমবঙ্গ, ভারত-২০১৫; (২৩) সংকেত সাহিত্য পত্রিকা অভিনন্দন সম্মাননা কোলাঘাট (পূর্ব মেদিনীপুর) পশ্চিমবঙ্গ, ভারত-২০১৬।

৮.

কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর দ্বিধাগ্রস্ত কবিকে উদ্দেশ্য করে বলেছেন-‘সেই সত্য যা রচিবে তুমি, কবি তব মনোভূমি রামের জন্মস্থান অযোধ্যার চেয়ে সত্য জেনো।’ কবিগুরুর এ অমোঘ উচ্চারণে আমরা কবি ও কবিতার ক্ষমতা ও ব্যাপ্তির পরিধি জানতে পারি। কবি কে? কবিতা কী? কবি ও কবিতার বাসর ঘরের আনন্দ রসায়ন মাধুর্য্য কেমন? এটা একটা চিরন্তন চলমান বিতর্ক। এর শেষ কোন দিন হবে কি না কে জানে? তবে ‘সকলেই কবি নয়, কেউ কেউ কবি’ বলে জীবনানন্দ যখন কবিতার ডিঙ্গি ভাসিয়ে আমাদের জীবন আনন্দের রঙিন চিল আকাশে উড়িয়ে স্বর্গীয় স্বস্তি দেন তখন একটু ভরসা পাই আর কি?

আবার আধুনিক তরুণ কবি আওলাদ হোসেন যখন বলেন-‘সকলেই কবি, কেউ কেউ লেখেন’ তখন থমকে দাঁড়াতেই হয়। কবি ‘কল্পনা বিলাসী’ হলেও ‘কর্ম বিশ্বাসী’। আর কবির কাছে কবিতা ‘কল্পনাময় বিশ্বাসের তালপুকুর’। কর্ম বিশ্বাসী বলেই কবি মর্মে ধারণ করেন আদর্শ- চেতনায় লালন করেন আবেগ এবং ধর্ম হিসেবে পালন করেন মানবিক প্রেম প্রীতিময় ভালবাসার সৌন্দর্যরাশি। কবিতার বাসরে কবির আসরে খেলা করে ভাব-অভাব থাকে না সেখানে প্রেমের- অভাব থাকে না রসের। কবি ও কবিতার বাসর ঘরে উঁকি মেরে আমরা দেখতে পাই কবি ও কবিতার শাশ্বত সৌন্দর্যরাশি-কবি ও কবিতার মনোরজ্যের অপার রহস্য-আনন্দ রসায়ন।

কবি আশামণির কবিতায় ও লেখনিতে আমরা পাই কবিতার চিরকালীন আবেদন। বলা হয়ে থাকে পৃথিবীর প্রথম কবিতা পঙক্তিমালা হিসেবে উৎসারিত হয়েছে মহর্ষি বেদব্যাস (যিনি রত্নাকর দস্যুর খোলস ভেঙ্গে বাকদেবীর কৃপায় কবিত্বপ্রাপ্ত হন) রচিত ক্রোঞ্চ-ক্রোঞ্চীর শোকগাথাজাত বেদনা সিঞ্চিত কষ্টবিধূর শব্দগুচ্ছ।তস্কর জীবন পেছনে ফেলে দেবীর কৃপায় বাল্মিকী (দস্যু রত্নাকর একাগ্র সাধনার আত্মনিমগ্নতায় উই পোকার ঢিবি দ্বারা আবৃত হয়েছিলেন বলেই নাম হয়েছে বাল্মিকী) কঠোর তপস্যার পর তমসা নদীর তীরে আনন্দমগ্ন একজোড়া ক্রৌঞ্চ-ক্রৌঞ্চীর প্রতি ব্যাধের শর নিক্ষেপে হত্যার দৃশ্য দেখে বাক্দেবীর অশেষ অনুগ্রহে তাৎক্ষণিকভাবে কবিতা রচনা করেন।

ব্যাধের প্রতি অভিশাপসূচক এই কবিতাটি পৃথিবীর আদি কবিতা বলে অভিহিত। শোক থেকে প্রথম কবিতা উৎসারিত হয়েছে বলেই আমরা ধর্মীয় কবিতা গাথার পংক্তিকে শ্লোক হিসেবে জানি। কবিতার বাসরে বাল্মিকীর প্রথম সেই অভিযাত্রাজাত আনন্দই পৃথিবীর সকল কবিকেই তাড়িত-জারিত-আবেশিত করে কাব্য সাধনায় নিযুক্ত রেখেছে আবহমানকাল ধরে। অনুপম যে পংক্তিমালা বাল্মিকীর কণ্ঠ থেকে অবলীলায় স্বতঃস্বরে বের হলো তার দ্যোতনাই যুগে যুগে সকল কবিকে বাল্মিকী হবার আনন্দ রসায়নে আপ্লুত রেখেছে। আদিকবি বাল্মিকীর কাব্যগাথা আমরা স্মরণ করতে পারি এখানে-

মা নিষাদ ! প্রতিষ্ঠাং ত্বমগমঃ শাশ্বতী সমাঃ।
যৎ ক্রৌঞ্চমিথুনাদেকমবধীঃ কামমোহিতম্।।
রে নিষাদ ! জীবনে তোর প্রতিষ্ঠা নাহি হবে।
কাম মোহিত ক্রৌঞ্চ যুগলের পুরূষে বধিলি যবে।।

কবি ও উপন্যাসিক আশামণিকেও আমরা সমাজ নামক প্রতিষ্ঠানের অবক্ষয় দেখে কষ্টতাড়িত হতে দেখি আমরা। তাঁর কলম থেকে তাই মহর্ষি বাল্মিকীর ন্যায় উৎসারিত হয়েছে সমাজের অসঙ্গতিজনিত বেদনাকাব্য।

৯.
ভিন্নভাবে আমরা আশামণির লেখক জীবনের বিশ্লেষণ করতে পারি। তিনি কেন লেখেন-এ প্রশ্নের মেঠোপথ ধরে এগুলে আমরা দেখবো তিনি স্বভাবগতভাবে লেখক। লেখা তাঁকে বাধ্য করে লিখতে। মনোবৈজ্ঞানিক দিক থেকে এর এটা ব্যাখ্যা আমরা পেতে পারি। সৈয়দা আনোয়ার হক একটি চমৎকার বিশ্লেষণ করেছেন ‘লেখক কেন লেখে এ প্রশ্নের উত্তরে’। তিনি বলেন-‘লেখালেখি এক ধরনের মানসিক ব্যাধি।

ওসিডি (অবসেসিভ কমপালসিভ ডিসঅর্ডার)। এই ধরনের রোগীরা একটা জিনিস নিয়ে করে বলতে থাকে, একই জিনিস বারবার করতে থাকে। কারও হয়তো মনে হয়, বাসা থেকে বেরিয়েছি, ঘরে তালা দেওয়া হয় নাই। তিনি বার বার ফিরে আসেন। দেখেন, তালা দেওয়া হয়েছে তো। কেউবা শুধু হাত ধোয়। বার বার করে হাত ধোয়। তারপরও মনে হয়, হাতে ময়লা লেগেই আছে। তো যার এই রোগ আছে, সে হয়তো একবার হাত ধুলো, দুইবার হাত ধুলো, পাঁচবারের পর মনে হলো, এবার পরিস্কার হয়েছে।

সে শান্ত হলো, শান্তি পেল। কিন্তু কতক্ষণ আর। একটু পর সে আবার হাত ধুতে শুরু করল। লেখকেরাও এই রকম। একটা লেখা লিখে মনে হবে, হয়নি। আবার লিখতে হবে। আবারও লিখল। তারপর মনে হলো, না, হয়নি। আবার লিখল। একবার মনে হলো, হ্যাঁ, হয়েছে। খানিকক্ষণ শান্তি। কিন্তু সেও ক্ষণিকের। আবারও লিখতে শুরু করল। (সূত্র: গল্পগুলো নিউইর্য়কের বইমেলায় শোনা,আনিসুল হক, প্রথম আলো: ২৯ জুন ২০১৮) কবি আশামণিও তাঁর আন্তর্জগত তাড়িত একজন সৃজনশীল সত্ত্বার লেখক যিনি আপন তাড়নায় লিখে চলেছেন সমাজমনস্ক কাব্য।

১০.
কবি আশামণি একজন গভীর মনোযোগী পাঠক এবং এই নিবেদিত পাঠ অভ্যাস তাঁর লেখনিকে সবল ও সচল রেখেছে বলে আমাদের বিশ্বাস। বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা থেকে জানা যায়- ‘মনোযোগ দিয়ে পড়াশোনা করলে চেহারা সুন্দর হয় ও ডিপ্রেশন কমে যায়। গভীর মনোযোগ ব্রেনে আলফা ওয়েভ তৈরি করে, মেলাটোনিন নিঃসরণ করে। ফলে চেহারা সতেজ হয় ও মনোযোগ বৃদ্ধিও ফলে ডিপ্রেশন কমে যায়।

(সূত্র: ফেসবুক) নিজে সুন্দর হয়ে মানসজগতে সুন্দর অবয়বের কবি ও লেখক আশামণি তাই সততই আমাদের সুন্দর সমাজ গড়ার প্রেরণা দিয়ে লিখে চলেছেন।

জর্জ বার্নার্ড শ বলেছেন: The man who writes about himself and his own time is the only man who writes about all people and about all time.কবি ও উপন্যাসিক আশামণির জন্য কথাটা শতভাগ্য প্রযোজ্য।

জয়তু কবি ও ঔপন্যাসিক আশামণি


লেখক: কবি. প্রাবন্ধিক ও তুলনামূলক ধর্মতত্ত্ব গবেষক

বহুমাত্রিক.কম

Walton Refrigerator Freezer
Walton Refrigerator Freezer