Bahumatrik | বহুমাত্রিক

সরকার নিবন্ধিত বিশেষায়িত অনলাইন গণমাধ্যম

বৈশাখ ২ ১৪৩১, মঙ্গলবার ১৬ এপ্রিল ২০২৪

জিল্লুরের যত অপকর্ম

বহুমাত্রিক ডেস্ক

প্রকাশিত: ১০:৩৬, ৩০ নভেম্বর ২০২২

আপডেট: ১৭:২৪, ২ ফেব্রুয়ারি ২০২৩

প্রিন্ট:

জিল্লুরের যত অপকর্ম

ঢাকায় নিযুক্ত বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রদূতদের অনুষ্ঠানে ডেকে দীর্ঘদিন ধরে উদ্দেশ্যমূলক প্রশ্ন করে বিভ্রান্তি ছড়িয়ে আসছিলেন সাংবাদিক জিল্লুর রহমান। তিনি বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল আইয়ে ‘তৃতীয় মাত্রা’ নামে একটি টকশো অনুষ্ঠানের উপস্থাপক।

‘মিট দ্য অ্যাম্বাসেডর’ নামে তার অনুষ্ঠানে কূটনীতিকদের দেয়া ‘বেফাঁস মন্তব্য’ নিয়ে রাজনৈতিক মাঠও বেশ সরগরম হয়েছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, নিজের রাজনৈতিক এজেন্ডা বাস্তবায়ন করতেই তিনি এসব করছেন। কূটনীতিকদের যেসব প্রশ্ন করা হচ্ছে, তার বেশির ভাগই আসন্ন দ্বাদশ নির্বাচন ঘিরে। প্রশ্ন যারা করছেন, তারাও সরকারবিরোধী রাজনৈতিক দলের সক্রিয় নেতাকর্মী।

বিএনপিঘেঁষা জিল্লুর
সেন্টার ফর গভর্নেন্স স্ট্যাডিজ (সিজিএস) নামে একটি সংগঠন মূলত ‘মিট দ্য অ্যাম্বাসেডর’ অনুষ্ঠানের আয়োজন করছে। গত বছর থেকে তারা এটি আয়োজন করে আসছে। অনুষ্ঠান উপস্থাপনা করেন সংস্থাটির নির্বাহী পরিচালক জিল্লুর রহমান।

সূত্র জানায়, তার সঙ্গে বিশেষ সম্পর্ক রয়েছে বিএনপির মিডিয়া সেলের নিয়ন্ত্রক জহিরুদ্দিন স্বপনের। তার অনুষ্ঠানে সব রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধি থাকলেও বেশিরভাগ ক্ষেত্রে প্রশ্ন করতে দেখা যায় কিছু বিএনপি নেতা ও সুশীল সমাজের প্রতিনিধিকে।

বিশ্লেষকরা বলছেন, মাঠে শক্তিশালী না হলেও নির্দিষ্ট দল বিদেশি শক্তির দিকে তাকিয়ে থাকে; এসব তারই নমুনা। আর এদের তল্পিবাহক হিসেবে কাজ করে কিছু ব্যক্তি।

গেল ২০ নভেম্বর রাজধানীর একটি হোটেলে এক সংবাদ সম্মেলন করেন জিল্লুর রহমান। সেখানেও তার বক্তব্য ছিল বেশ ঔদ্ধত্যপূর্ণ। দেশের জাতীয় নির্বাচন ও রাজনৈতিক পরিস্থিতির মতো স্পর্শকাতর, অভ্যন্তরীণ বিষয়ে প্রশ্ন করে উদ্দেশ্যমূলক জবাব বের করানোর যে অভিযোগ উঠেছে, তা তিনি ‘কেয়ার’ করেন না বলেই ওই সংবাদ সম্মেলনে জানান।

জিল্লুর রহমান জানান, অনুষ্ঠানে কেউ স্পর্শকাতর বা অভ্যন্তরীণ ইস্যুতে নিয়ম বহির্ভূতভাবে প্রশ্ন করলে তিনি বা তার প্রতিষ্ঠান দায়ী নয়। এছাড়াও সংবাদ সম্মেলনে বিএনপির মিডিয়া সেলের নিয়ন্ত্রক জহিরুদ্দিন স্বপনের সঙ্গে নিজের বিশেষ সম্পর্ক নিয়েও কোনো কেয়ার করেন না বলে মন্তব্য করেন তিনি।

জিল্লুর রহমান বলেন, তার সঙ্গে আমার ব্যক্তিগত সম্পর্ক আছে, আড্ডা মারি। রাজনৈতিক স্বার্থে তো ব্যক্তিগত সম্পর্ক অস্বীকার করতে পারব না।

বঙ্গবন্ধুর খুনির পক্ষে প্রচার
সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় বঙ্গবন্ধুর খুনি কর্নেল আবদুর রশীদের সাক্ষাৎকার নিয়ে সমালোচনার জন্ম দিয়েছিলেন এ উপস্থাপক জিল্লুর রহমান। ওই সাক্ষাৎকার নেয়া হয়েছিল পাকিস্তানের মাটিতে। অথচ স্বাধীনতা অর্জনে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর হাতে ৩০ লাখ মানুষকে আত্মদান করতে হয়েছে। শহীদ হয়েছেন কয়েকশ’ বুদ্ধিজীবী। আর কয়েক লাখ নারী তাদের সম্মান বিসর্জন দিয়েছেন।

ওই সাক্ষাৎকারে আবদুর রশীদ যে বক্তব্য দিয়েছেন, তাও রাষ্ট্রবিরোধী। কিন্তু এ নিয়ে কোনো অনুশোচনা নেই জিল্লুর রহমানের। বরং একজন সঞ্চালক হিসেবে তিনি জাতির পিতার স্বঘোষিত খুনির স্বার্থই দেখেছেন। সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় কর্নেল আবদুর রশীদের ওই সাক্ষাৎকার চ্যানেল আইয়ে সম্প্রচার করা হয়।

এমন এক সময়ে তিনি ওই সাক্ষাৎকার নেন, যখন জরুরি অবস্থা জারির পর রাজনৈতিক দলগুলোর সব ধরনের কর্মকাণ্ড অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত ঘোষণা করা হয়। শুরু হয় রাজনৈতিক নেতাদের ধরপাকড়। দুর্নীতির অভিযোগসহ বিভিন্ন অভিযোগে দায়ের করা মামলায় প্রধান দুই রাজনৈতিক দলের শীর্ষ নেতাদের অনেকেই গ্রেফতার হন।
আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনাসহ দেশের শীর্ষ রাজনীতিবিদ, ছাত্র-শিক্ষক, ব্যবসায়ীসহ অনেকেই এ সময় গ্রেফতার হন।

জিল্লুর রহমানের বিরুদ্ধে অভিযোগ, তিনি বঙ্গবন্ধুর আত্মস্বীকৃত খুনি, সন্ত্রাসী ও যুদ্ধাপরাধীদের টকশোতে ডেকে দেশবিরোধী অপরাধী কার্যক্রম প্রচারে তাদের সুযোগ করে দিয়েছেন। যথাযথ প্রশ্ন করে অপরাধীদের জবাবদিহিতার আওতায় নিয়ে আসার বদলে তাদেরকেই জাহির করেছেন। এর মধ্যদিয়ে তিনি নিজেকে বিএনপি-জামায়াতের একজন প্রচারকারী হিসেবেই তুলে ধরেছেন।

বিশ্লেষকরা বলছেন, দেশ স্বাধীন হওয়ার পঞ্চাশ বছরে আমরা সবাই জানি, ১৯৭১ সালে যুদ্ধাপরাধীদের উদ্দেশ্য কী ছিল। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার উদ্দেশ্য কী ছিল। কিন্তু এখন টেলিভিশন টকশোতে ডেকে সেই খুনিদের গৌরবান্বিত করা হচ্ছে।

তাদের প্রশ্ন, আমরা কী দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় যুদ্ধাপরাধে জড়িত থাকা নাৎসি কিংবা তাদের প্রতি সহানুভূতিশীল কাউকে বিবিসিসহ পশ্চিমা সংবাদমাধ্যমে বড় করে প্রচার করতে দেখেছি?

তৃতীয় মাত্রায় প্রতারক সাহেদ

মহামারির সময়ে করোনা রোগীদের চিকিৎসা নিয়ে প্রতারণা করা রিজেন্ট গ্রুপের চেয়ারম্যান সাহেদকে টকশোতে নিয়ে ‘রাজনৈতিক বিশ্লেষক’ হিসেবেও পরিচয় করিয়ে দিতেন জিল্লুর রহমান। ২০১৫ সাল থেকে তৃতীয় মাত্রায় দেখা গেছে সাহেদকে। এমনকি সাহেদের যেসব বক্তব্য সামাজিকমাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে, তাও তৃতীয় মাত্রায় দেয়া। তৃতীয় মাত্রার অন্তত ২১টি পর্বে অতিথি হিসেবে দেখা গেছে সাহেদকে।

টকশোতে গিয়ে রাজনীতি থেকে সমাজনীতি, অর্থনীতি থেকে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক, চিকিৎসা বিজ্ঞান থেকে মহাকাশ বিজ্ঞান - প্রায় সব বিষয়ে অল্প-বিস্তর মতামত দিতে দেখা গেছে তাকে। জিল্লুর রহমান বলেন, তাকে আওয়ামী লীগের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক উপকমিটির সদস্য হিসাবে আনা হত। যদিও ২০১৭ সালে ওই পদ পাওয়ার আগে থেকে জিল্লুরের এ অনুষ্ঠান মাতাতে দেখা গেছে সাহেদকে।

পরবর্তীতে এক টকশোতে ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক সিদ্দিকী নাজমুল আলম বলেন, ‘আমি তৃতীয় মাত্রার জিল্লুর রহমানের কাছে প্রশ্ন রাখছি, আওয়ামী লীগে এত গুরুত্বপূর্ণ নেতা থাকতে, হাজার হাজার মেধাবী, গ্যাজুয়েট ছাত্রনেতা থাকতে কোন যোগ্যতায় সাহেদকে তিনি অতিথি করতেন? এত অতিথি থাকতে সাহেদ কেন টকশোতে যায়? এগুলো কিছু লোভী, যারা উদ্দেশ্যমূলক এদের দিয়ে টকশো বানায়, সংবাদের শিরোনাম বানায়, তারা তাদের প্রমোট করে, আর অবশ্যই এখানে লেনদেন রয়েছে।’

কূটনীতিকদের দিয়ে ‘বেফাঁস মন্তব্য’

বিশ্লেষকদের মতে জিল্লুর রহমান যেভাবে মিট দ্য অ্যাম্বাসেডরে কূটনীতিকদের ডেকে এমন বক্তব্য দিতে বাধ্য করাচ্ছেন, যা বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপের শামিল। এতে এ টকশো উপস্থাপকের উদ্দেশ্য নিয়েই প্রশ্ন উঠেছে। মিডিয়াপাড়ায়ও তাকে নিয়ে আলোচনার ঝড় উঠেছে।

সংবাদ সম্মেলনে এসব বিষয় নিয়ে প্রশ্ন করা হলে জিল্লুর রহমান বলেন, ‘সত্যিকার অর্থে এসব কিছুকে আমি থোড়াই কেয়ার করি। আমার এখন এসব কিছু কেয়ার করার সময় নেই। যদি আপনি এসব কিছু মাথায় নেন, তাহলে সামনে এগোতে পারবেন না।’

সিজিএস নামে এ এনজিওর অর্থ কোথা থেকে আসে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘বিভিন্ন উৎস থেকে আমাদের অর্থ আসে। আমরা কোনো টিপিক্যাল এনজিও না।’ সাংবাদিকরা প্রশ্ন করলেও নিজে তার সংস্থার অর্থের উৎসের কথা গোপন রেখেছেন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ইমতিয়াজ আহমেদ বলেন, ‘পৃথিবীর কোনো দেশই চূড়ান্ত নির্ভুল নয়। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র কী নিজেদের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে মন্তব্য করতে অন্য দেশের কূটনীতিকদের সুযোগ দেবে?’

তার মতে, কূটনীতিবিদরা কথা বলতে পারছেন এ কারণে; যেহেতু তাদের একটা প্ল্যাটফর্ম দেয়া হচ্ছে। তারা নিজেদের ইচ্ছায় প্রেস কনফারেন্স করছেন, এমনটা না। সুযোগটা দেয়া হচ্ছে বলেই তারা কথা বলছেন। আবার এটিও হতে পারে যে, এ বিভাজনের রাজনীতি তাদের স্বার্থ অনেককে কাজে দেয়।

রাজনৈতিক বিশ্লেষক অধ্যাপক ড. এম এম আকাশ বলেন, বিরোধীদলও বিদেশিদের আশীর্বাদ নিয়ে নির্বাচনে যায়। তাই অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে তাদের হস্তক্ষেপ বেড়ে গেছে। ২০১৮ সালে দেখেছিলাম মার্শাল বার্নিকাট যখন বলেছিলেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়াই বিএনপির নির্বাচনে অংশগ্রহণ করা উচিত; তখন কিন্তু বিএনপি নির্বাচনে গেল।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক বলেন, কূটনৈতিকদের শিষ্টাচারবহির্ভূত বক্তব্যে রাজনৈতিক ইন্ধনের বিষয়টি একেবারে উড়িয়ে দেয়া যাচ্ছে না। কিন্তু রাজনৈতিক প্ররোচণা থাকলেও দেশের বাইরে ভিয়েনা কনভেনশন অনুসারে নিজেদের কার্যক্রম চালাতে হবে একজন কূটনীতিককে।

এ অধ্যাপক আরও বলেন, ‘আমরা তাদের বিভিন্ন জায়গায় আমন্ত্রণ জানিয়ে নিয়ে যাই, তারা যখন সরকারি ও বিরোধীদলের নেতানেত্রীদের সঙ্গে দেখা করেন, তখন তা ফলাও করে প্রচার করা হয়। এ প্রচারে কূটনীতিকদের চেয়ে আমাদের লোকজনই বেশি আগ্রহী। এসব কারণে আমরা নিজেরাও দায় এড়াতে পারি না।’

অথচ বিভিন্ন দেশে কূটনীতিকরা যখন কাজ করেন, তখন নীরবে কাজ করেন বলে জানান আরেফিন সিদ্দিক। তিনি জানান, বিভিন্ন দেশে তারা (কূটনীতিকরা) যখন কোনো রাজনৈতিক নেতার সঙ্গে দেখা করেন, তা ফলাও করে প্রচার করা হয় না। কারণ এটা তাদের রুটিন কাজ।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকতা বিভাগের এ অধ্যাপক বলেন, ‘কিন্তু বাংলাদেশে তাদের বিভিন্ন সভা-সমাবেশে প্রধান অতিথি করে নিয়ে এসে এমন প্রশ্ন করা হচ্ছে, যাতে তারা কূটনৈতিক শিষ্টাচারবহির্ভূত জবাব দিতে বাধ্য হন। সবকিছু মিলিয়েই আমি বলব, কূটনীতিকদের কিছু দায়িত্ব আছে, যা অস্বীকার করা যাবে না। আবার আমরাও দায়িত্ব এড়াতে পারব না। আমরা তাদের প্রচারণার মধ্যে নিয়ে আসি নিজেদের স্বার্থেই। যেমন জাপানের রাষ্ট্রদূত যে কথাটা বলেছেন, তা তিনি একটা প্রশ্নের উত্তরে বলেছেন। তাকে এই ধরনের আয়োজনে নিয়ে এসে প্রশ্ন করার প্রবণতা আমাদের মধ্যে রয়েছে।’

যে-ই বা যারা প্রশ্ন করেছেন, তাদের উদ্দেশ্য খুঁজে বের করা দরকার বলে মনে করেন তিনি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি আরও বলেন, ভারতে রাষ্ট্রদূতরা যখন রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে দেখা করেন, তখন তা সংবাদই হয় না।

বিভিন্ন অনুষ্ঠানে কূটনীতিকদের অংশগ্রহণ সম্পর্কে তিনি বলেন, তারা আসতে পারেন। তবে তাতে দু’দেশের সম্পর্ক নিয়ে কথা বলবেন। কিন্তু দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয় নিয়ে প্রশ্ন এলে তারা তা নিয়ে কথা বলা থেকে বিরত থাকবেন; এমনটাই হওয়া উচিত।

Walton Refrigerator Freezer
Walton Refrigerator Freezer