Bahumatrik | বহুমাত্রিক

সরকার নিবন্ধিত বিশেষায়িত অনলাইন গণমাধ্যম

বৈশাখ ১০ ১৪৩১, বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪

জিন থেরাপি: চিকিৎসা বিজ্ঞানের শেষ নির্ভরতা

ড. এম. মঞ্জুরুল করিম

প্রকাশিত: ১১:১০, ১১ মে ২০১৪

আপডেট: ১৬:৪৫, ২৫ এপ্রিল ২০১৭

প্রিন্ট:

জিন থেরাপি: চিকিৎসা বিজ্ঞানের শেষ নির্ভরতা

ঢাকা: মানব সভ্যতার ইতিহাসে চিকিৎসা বিজ্ঞানের ইতিবৃত্ত সুপ্রাচীন। প্রাচীন সব বিকশিত সভ্যতাতেই চিকিৎসা বিজ্ঞানের খোঁজ পাওয়া যায়। ভারতের আয়ুর্বেদ এখনও পৃথিবীব্যাপী সমাদৃত। খ্রীস্টপূর্ব যুগে সম্রাট অশোকের সময়ে এমন কি পশু হাসপাতালের ব্যবস্থাও ভারতবর্ষে ছিল।
 
চিকিৎসা শাস্ত্রের ইতিহাস এত সুপ্রাচীন হলেও আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানের যাত্রা মাত্র সেদিনের। ঊনিশ শতকের গোঁড়ার দিকে মানুষ সর্ব প্রথম রোগের কারণ হিসেবে জীবানুর ভূমিকা আবিষ্কার করে। এরপর শুধুই বিপ্লব।
 
গত দু’শো বছরে চিকিৎসা শাস্ত্রে বিপুল উন্নয়ন সাধিত হয়েছে। এই পরিক্রমায় সর্বশেষ সংযোজন জিন থেরাপি। জিনথেরাপি হল রোগের চিকিৎসায় রিকম্বিনেন্ট ডিএনএ (Recombinant DNA) প্রযুক্তির ব্যবহার। এই প্রক্রিয়ায় ত্রুটিপূর্ণ কোন জিনকে গোবেষণাগারে প্রস্তুত সবল জিনের দ্বারা প্রতিস্থাপন করা হয়। এখন পর্যন্ত আমরা চার হাজারেরও বেশি রোগের কারন জানি যেখানে ত্রুটিপূর্ণ জিনের কারনে শরীরের অভ্যন্তরীণ নিঃসরণ ও বিপাক প্রক্রিয়ায় ব্যাঘাত ঘটে।
 
জিন থেরাপির মাধ্যমে এই ত্রুটিপূর্ণ জিন গুলিকে প্রতিস্থাপন করা হয়। এতে শরীর সঠিক এনজাইম বা প্রোটিন উৎপাদনে সক্ষম হয়। প্রচলিত চিকিৎসা পদ্ধতির সাথে এই চিকিৎসা পদ্ধতির পার্থক্য হোল জিন থেরাপির মাধ্যমে শুধু রোগের উপশমই করা হয় না জিনের বৈশিষ্টগত ত্রুটি দূর করে একে সমূলে নিবারণ করা হয়।

আমেরিকায় পরিচালিত এক জরিপে দেখা যায় প্রতি একশ’ নবজাতকে অন্তত একজন মানব শরীরে প্রাপ্ত একত্রিশ হাজার জিনের মধ্যে এক বা একাধিক জিনে মারাত্মক ত্রুটি নিয়ে জন্মায়। প্রতি বছর প্রায় সহস্রাধিক অপ্রাপ্তবয়ষ্ক শিশু এসব রোগে মারা যায়। এছাড়াও প্রায় দশ হাজারেরও বেশি শিশু জীবণ ভর শারিরীক অসামর্থতা নিয়ে বেঁচে থাকে।

যদিও জিন থেরাপি এখনও চিকিৎসা প্রদানের ক্ষেত্রে অনুমোদিত নয়, তবুও বিজ্ঞানিরা আশা করছেন বিপুল পরিমাণ রোগের চিকিৎসায় এবং রোগের বিলুপ্তিতে জিন থেরাপির সুবৃহৎ অবদান থাকবে। জিন থেরাপি হৃদরোগ, ডায়াবেটিস, আরথ্রাইটিস, আলঝাইমার ইত্যাদি রোগের চিকিৎসাতেও গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে শুরু করেছে। বর্তমানে জিন থেরাপি সম্পর্কিত গবেষণার প্রায় ৭৫ ভাগই ক্যান্সার ও এইডস এর চিকিৎসার উন্নতিকল্পে সংঘটিত হচ্ছে।

জিন থেরাপির প্রকারভেদ

বর্তমানে দুই ধরনের জিন থেরাপি প্রচলিত আছে- জার্ম-লাইন থেরাপি (Germ-line Therapy) সোমাটিক-সেল থেরাপি(Somatic-cell Therapy)। জার্ম-লাইন থেরাপিতে জনন কোষে পরিবর্তন আনা হয়। একটি নিষিক্ত ডিম্বানুতে প্রয়োজনীয় পরিবর্তন এনে তাকে আবার মাতৃগর্ভে প্রতিস্থাপন করা হয়। সম্পূর্ণ প্রক্রিয়াটি সফল হলে নবজাতকের সমস্ত কোষে পরিবর্তিত জিনটি উপস্থিত থাকে এবং প্রয়োজনীয় কার্য সম্পাদনে সক্ষম হয়।

ধারণা করা হয় জার্ম-লাইন থেরাপির মাধ্যমে বংশগতির ধারায় প্রাপ্ত সকল রোগের মূলোৎপাটন করা সম্ভব। জিন থেরাপির এই পদ্ধতিটি বিতর্কিতও বটে। এই প্রক্রিয়ায় করা পরিবর্তন গুলি পরবর্তি বংশধরে স্থানান্তরিত হয়। তাই এই ধরনের পরিবর্তন চিরস্থায়ী এবং বংশগতির ধারাকে সরাসরি প্রভাবিত ও পরিবর্তন করে।

সোমাটিক-সেল থেরাপিতে রক্ত কোষ বা ত্বকের কোষ জাতীয় শরীরের কোষে পরিবর্তন আনা হয়। এই পদ্ধতিতে শরীর থেকে কোষ সংগ্রহ করে তাতে প্রয়োজনীয় পরিবর্তন এনে তাকে আবার শরীরে প্রতিস্থাপন করা হয় অথবা শরীরে অবস্থিত কোষেই সরাসরি পরিবর্তন আনা হয়। হ্যামোফিলিয়া বা থ্যালাসেমিয়া রোগের চিকিৎসায় এই পদ্ধতি বেশ কার্যকর।

এই পদ্ধতিতে কয়েক বিলিয়ন সংখ্যক হাড়ের কোষ সংগ্রহ করা হয়। তারপর তাতে প্রয়োজনীয় পরিবর্তন এনে তাকে আবার শরীরে প্রতিস্থাপন করা হয়। এতে নতুন করে যেসব রক্ত কোষ তৈরি হয় তাতে পরিবর্তিত জিনের বৈশিষ্ট্য গুলো প্রকাশ পায়। সোমাটিক-সেল থেরাপির মাধ্যমে কৃত পরিবর্তন গুলো শুধুমাত্র রোগীর মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে, বংশগতির ধারাকে প্রভাবিত করে না।

মৌলিক প্রক্রিয়া

জিন থেরাপিতে মূলত একটি শুদ্ধ জিনকে রোগের জন্য দায়ী জিনের স্থলে স্থাপন করা হয়। দায়ী জিনকে অপসারন করা হয় না। তবে ডমিনেন্ট জেনেটিক রোগের (Dominant genetic diseases) ক্ষেত্রে শুধুমাত্র শুদ্ধ জিনের প্রতিস্থাপন শেষ নয়, দায়ী জিনের সম্পূর্ণ অপসারনও প্রয়োজন হয়।

এক্ষেত্রে এমন একটি জিন ডেলিভারি ব্যবস্থা দরকার হয় যাতে দেহ কোষের ক্রোমসমে অবস্থিত জিন এবং বাহকের মাধ্যমে প্রদানকৃত (Vector-borne) জিনের মধ্যে এমন ভাবে মিশ্রণ বা Recombination ঘটে যেন বাহকের মাধ্যমে প্রদানকৃত জিনটি ক্রোমসমে অবস্থিত জিনকে প্রতিস্থাপনের মাধ্যমে অপসারণ করতে পারে। এজন্য এমন প্রযুক্তির প্রয়োজন হয় যা একসাথে বিভিন্ন ধরনের কোষ, টিস্যু এবং অঙ্গে জিন প্রতিস্থাপন করতে পারে। এ ধরনের জিন থেরাপির ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় বাঁধা হোল নিরাপদ ও কার্যকর বাহকের উৎপাদন।

বাহক

এই বাঁধা অতিক্রমের স্বার্থে যে সব বাহকের উন্নয়ন করা হয়েছে সেগুলোকে মূলত দুই ভাগে গাগ করা যায়ঃ ভাইরাল (Viral) এবং ননভাইরাল (Nonviral)। বর্তমানে বহুল ব্যবহৃত বাহকটি হোল একটি জেনেটিক্যালি অলটার্ড ভাইরাস যা মানুষের শুদ্ধ জিন পরিবহনে সক্ষম। ভাইরাসরা প্রাকৃতিক ভাবেই তাদের জিন মানব কোষে ছড়াতে সক্ষম। বিজ্ঞানিরা তাদের এই সক্ষমতার সুযোগ নিয়ে তাদের রোগ ছড়ানো জিন গুলোর পরিবর্তে রোগবিনাশী জিন গুলো প্রতিস্থাপন করে।

তারপর এই বাহক ভাইরাস গুলোকে রোগ আক্রান্ত কোষ, যেমন যকৃত বা ফুসফুসের কোষে প্রতিস্থাপন করা হয়। বাহক ভাইরাস গুলো এরপর রোগবিনাশী জিন গুলোকে রোগাক্রান্ত কোষ গুলোতে ছড়িয়ে দেয়। এভাবে রোগাক্রান্ত কোষ গুলোতে শুদ্ধ জিন প্রতিস্থাপন করে প্রয়োজনীয় প্রোটিন উৎপাদন করা হয় যেন রোগাক্রান্ত কোষ গুলো পুনরায় সুস্থ স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসে।

বাহক হিসেবে ভাইরাস

বিজ্ঞানীরা সাধারণত তিন ধরনের ভাইরাসকে বাহক হিসেবে ব্যবহার করে থাকে। এগুলো হচ্ছে রেট্রোভাইরাস (Retrovirus), এডিনোভাইরাস (Adenovirus), এডিনো-এসোসিয়েটেড ভাইরাস (Adeno-associated virus)।

রেট্রোভাইরাস

জিন থেরাপি পরীক্ষার ক্ষেত্রে সর্বপ্রথম এই ভাইরাস ব্যবহৃত হয়। এই ভাইরাসের অনন্য বৈশিষ্ট্য হোল তারা তাদের বংশগতির তথ্য পরিবহনের জন্য আরএনএ ব্যবহার করে। কোন কোষকে আক্রান্ত করার পরে তারা রিভার্স ট্রান্সক্রিপ্টেস (Reverse transcriptase) নামে এক ধরনের এনজাইম নিঃসরণ করে তাদের জিন সমূহের অনুরূপ একটি ডিএনএ তৈরি করে। পরবর্তিতে একটি ভাইরাল এনজাইম ইন্টিগ্রিজ (Integrase) অনুরূপ ডিএনএকে আক্রান্ত কোষের ডিএনএর সাথে সম্মিলিত করে।

বিজ্ঞানীরা বাহক হিসেবে এমন একটি রেট্রোভাইরাস ব্যবহার করেন যা ইঁদুরের মধ্যে লিউকেমিয়া ছড়ালেও মানুষে কোন প্রকার রোগ ছড়ায় বলে জানা যায়না। বিজ্ঞানীরা এই রেট্রোভাইরাসে রোগবিনাশী শুদ্ধ জিনের আরএনএ কপির পাশাপাশি প্রমোটার নামে আরেকটি জেনেটিক তথ্য সংযোজন করেন। অতঃপর মানবদেহে ত্রুটিযুক্ত জিনের স্থলে রোগবিনাশী শুদ্ধ জিনের Recombination বা প্রতিস্থাপন ঘটান হয়। প্রমোটার গুলো সাধারণত যে কোন জিনের জন্য সুইচ মত এর কাজ করে। কিছু নির্দিষ্ট ড্রাগের মাধ্যমে এই সুইচকে চালু করা হয়। চালু করার পর এটি রাইবোসমগুলোকে রোগবিনাশী শুদ্ধ জিনের প্রকাশ ঘটাতে বার্তা পৌঁছায়।

যদিও বাহক হিসেবে রেট্রোভাইরাস বহুলাংশে ব্যবহৃত হয় কিন্তু এর কিছু সীমাবদ্ধতাও রয়েছে। এই ভাইরাস শুধুমাত্র কোষ বিভাজন চলছে এমন কোষের উপরেই কাজ করতে পারে। তাই রক্তকোষ, ত্বককোষ বা অন্যান্য দ্রুত বিভাজমান কোষ ছাড়া অন্য কোথাও এই ভাইরাস কাজ করে না। এছাড়া এই ভাইরাস সুনির্দিষ্ট ভাবে আক্রান্ত কোষের ক্রোমসোমের উপরে কাজ করতে পারে না।

তাই বহনকৃত শুদ্ধ জিন বিচ্ছিন্ন ভাবে ছড়ায়। তাছাড়া প্রমোটার থাকা সত্ত্বেও শুদ্ধ জিন গুলো রোগ প্রতিকারের জন্য যথেষ্ট পরিমান প্রোটিন উৎপাদন করতে পারে না। উপরন্তু রোগীর শরীর সাধারনত এই ভাইরাস গুলোকে অচেনা আক্রমনকারী হিসেবে সনাক্ত করে এবং প্রতিরক্ষামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করে।

যেহেতু রেট্রোভাইরাস সুস্থ কোষকেও আক্রমন করার সম্ভাবনা রাখে তাই বিজ্ঞানিরা এক্স ভিভো (ex vivo) ব্যবস্থার মাধ্যমে প্রথমে আক্রান্ত কোষ গুলোকে দেহের বাইরে নিয়ে আসে। তারপর এই থেরাপির যথার্থতা যাচাই করার পরে কোষ গুলোকে দেহের মধ্যে ফিরিয়ে দেয়া হয়।


চিত্র : এক্স ভিভো ব্যবস্থার মাধ্যমে জিন থেরাপি। একটি নতুন শুদ্ধ জিন রেট্রোভাইরাস এর জিনোমে অন্তর্ভুক্ত করানো হয় (১)। অতঃপর রোগীর দেহ থেকে কোষ সংগ্রহের পর গবেষণাগারে তার সঙ্গে রূপান্তরিত রেট্রোভাইরাল জিনোমের সম্মিলনের পর (২) ভাইরাল জিনটি পোষক দেহের নিউক্লিয়াসে অবস্থিত ত্রুটিযুক্ত জিনকে প্রতিস্থাপন করে (৩)। অবশেষে জিনগতভাবে রূপান্তরিত এই দেহকোষকে ইনজেকশনের মাধ্যমে রোগীর দেহে প্রতিস্থাপন করা হয় (৪)।

এডিনোভাইরাস

কোষের সঠিক স্থানে জিন প্রতিস্থাপিত না হলে যে সমস্যা তৈরি হয়, তা থেকে বাঁচতে বিজ্ঞানীরা এডিনোভাইরাস ব্যবহার করে থাকেন। এই ভাইরাসের মাধ্যমে পরিবাহিত জিন পোষক কোষে সম্মিলিত না হয়ে এর নিউক্লিয়াসে অবস্থান করে। এতে শুদ্ধ জিনের অনুলিপি তৈরি না হলেও অন্যান্য জিনের মতই এর প্রকাশ ঘটতে থাকে। এই প্রক্রিয়ায় যেহেতু জিনটির সংখ্যাবৃদ্ধি ঘটে না, সেহেতু প্রতিটি নতুন জন্মানো কোষে বাহকের মাধ্যমে শুদ্ধ জিন পুনঃ পুনঃ প্রতিস্থাপন করতে হয়।

এডিনোভাইরাস এর কার্যকারিতা রেট্রোভাইরাসের থেকে বেশি যেহেতু এটি ধীরে বিভাজমান কোষেও সমান ভাবে কাজ করতে পারে, যেমন- যকৃত কোষ। এডিনোভাইরাসকেও শরীরের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা সহজেই চিহ্নিত করে আক্রমন করতে পারে, তা সত্ত্বেও যকৃত ও ওভারির ক্যান্সার চিকিৎসায় এডিনোভাইরাস বাহক হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে।

এডিনো-এসোসিয়েটেড ভাইরাস

এই ভাইরাস বাহক হিসেবে সবচেয়ে কার্যকর যেহেতু এটি বিভাজনরত ও অবিভাজনরত সব কোষকেই আক্রান্ত করতে পারে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হল এটি ক্রোমসোম ১৯ নামের একটি নির্দিষ্ট জায়গায় শুদ্ধ জিনকে প্রতিস্থাপন করতে পারে। নির্দোষ এই ভাইরাসটি বেশিরভাগ মানুষের দেহেই পাওয়া যায়, তাই এটি শরীরের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থায় কোন প্রভাব ফেলেনা।

বিজ্ঞানীরা এই ভাইরাসকে সফলভাবে প্রাণীদেহে বাহকের কাজে ব্যবহার করেছেন। মানব শরীরে হেমোফিলিয়া রোগ প্রতিরোধে প্রাথমিক ভাবে এই ভাইরাসকে ব্যবহার করার চেষ্টা চলছে। তবে এই ভাইরাসকে বাহক হিসেবে ব্যবহারের সমস্যা হল এটি অত্যন্ত ছোট। প্রাকৃতিকভাবে এরা শুধুমাত্র দুটো জিন বহন করে থাকে। তাছাড়া বাণিজ্যিকভাবে এই ভাইরাসটি উৎপাদনের ক্ষেত্রেও যথেষ্ট সীমাবদ্ধতা রয়েছে।

কাইমেরাপ্লাস্টি (Chimeraplasty)

কাইমেরাপ্লাস্টি হোল জিন থেরাপির নন-ভাইরাল উপায়। এই উপায়ে একটি অকার্যকর জিনকে কোষের মধ্যে রেখেই সরাসরি সংশোধন করা হয়। বিজ্ঞনীরা কাইমেরাপ্লাস্ট নামে ডিএনএ’র ছোট ছোট অংশ তৈরি করে যেগুলো জিনের অকার্যকর অংশের শুদ্ধ রূপ। এই কাইমেরাপ্লাস্টগুলোকে আক্রান্ত কোষের নিউক্লিয়াসে প্রতিস্থাপিত করা হয়।

এতে কোষে অবস্থিত ডিএনএ এবং কাইমেরাপ্লাস্ট এর ডিএনএ’র বেসগুলোর মধ্যে যেগুলো পরিপূরক, তাদের মধ্যে বন্ধন ঘটে, অথচ সিকোয়েন্সের অন্তর্গত পরিপূরকহীন বেসগুলোর মধ্যে বন্ধন না হওয়ায় যে বৈসাদৃশ্য সৃষ্টি হয়, ডিএনএ সংস্কারের কাজে ব্যবহৃত এনজাইমগুলো সেগুলো লক্ষ করে এবং শুদ্ধ ডিএনএ দ্বারা আক্রান্ত ডিএনএকে প্রতিস্থাপন করে। সম্প্রতি কিছু ঈস্ট সেলে এই পদ্ধতির ফলাফল ০.০০০২% পাওয়ার পর এর কার্যকারিতা প্রশ্নের সম্মুখিন হয়েছে।

জিন থেরাপি নিয়ে বিতর্ক

জিন থেরাপির সমালোচক ও সমর্থক উভয়েই এই বিষয়ে একমত যে এর সম্ভাব্য ঝুঁকির পাল্লা কখনোই এর সম্ভাবনার থেকে বেশি নয়, এজন্য বেশির ভাগ জিন থেরাপির প্রয়োগ বিরল রোগের ক্ষেত্রেরি করা হয় যখন প্রচলিত চিকিৎসা পদ্ধতিতে আর কিছু করার থাকে না। এইডস ও ক্যান্সার চিকিৎসায়ও রোগীর শেষ মুহুর্তে জিন থেরাপি দেয়া হয় যখন আর কোন কিছু করার থাকে না এবং মৃত্যু নিকটবর্তি। যদিও নতুন কোন ওষুধ এরকম পর্যায়েই পরীক্ষা করে দেখা হয় তারপরও অনেকে মনে করেন যে জিন থেরাপির ক্ষেত্রে আরও সাবধানি হওয়া উচিৎ কারন এতে বিপদজনক ভাইরাস ব্যবহৃত হয়।

জার্ম-লাইন থেরাপির ক্ষেত্রে এই বিতর্ক আরও গভীর যেহেতু এতে সম্ভাব্য ঝুঁকির মাত্রা অনেক বেশি। একদিকে যেমন রয়েছে আজীবন জিন বাহিত রোগ থেকে মুক্তির সম্ভাবনা তেমনি অপর দিকে রয়েছে সমূহ বিপদের ঝুঁকি। যেমন- আংশিক সফল জিন থেরাপির ফলে বিকৃত মানব শিশুর জন্ম হতেপারে অন্যথায় যা অকাল গর্ভপাতে রূপ নিত। এর ফলে মায়েরও বিভিন্ন রকমের বিপদ হতে পারে তা বাহক ভাইরাসের সংক্রমন থেকেই হোক অথবা এই পদ্ধতির কোন সীমাবদ্ধতা থেকেই হোক।

বৈজ্ঞানিক এবং চিকিৎসা সংক্রান্ত বিতর্ক ছাড়াও জার্ম-লাইন থেরাপি নৈতিক বিতর্কেরও জন্ম দিয়েছে। অনেকেই মনে করেন জিনের তথ্য পরিবর্তনের অধিকার আমাদের নেই কেননা এতে সেই শিশুটির কোন হাত নেই। আবার অনেকেই একে ‘ডিজাইনার বেবী’র প্রথম ধাপ হিসেবে চিহ্নিত করেন।

জিন থেরাপির জটিলতা সমূহ

চিকিৎসা ক্ষেত্রে সরাসরি ভূমিকা রাখতে হলে জিন থেরাপিকে কিছু জটিলতা দূর করতে হবে। বিজ্ঞানিদের আরও কার্যকর বাহক খুঁজে বের করতে হবে যা আরও বেশি সংখ্যক কোষের উপরে কাজ করতে পারে, নতুন পন্থা উদ্ভাবন করতে হবে যেন আরও বেশি সংখ্যক বাহক উৎপাদন করা যায় এবং আরও কার্যকর প্রমোটার খুঁজে বের করতে হবে যেন যথেষ্ট পরিমানে প্রোটিন উৎপাদিত হয়।

পর্যবেক্ষকরা মনে করেন শাস্ত্র হিসেবে জিন থেরাপি এখনও নতুন। কিছু সীমাবদ্ধতা থাকলেও চিকিৎসা ক্ষেত্রে এর ব্যবহার অবশ্যম্ভাবী। তারা মনে করেন জিনবাহিত রোগ নির্মূলে ও জিনের সাধারণ ত্রুটি দূরীকরনে জিন থেরাপিই হবে চিকিৎসা বিজ্ঞানের শেষ দূর্গ।

এম. মঞ্জুরুল করিম সম্পর্কে

ড. এম মঞ্জুরুল করিম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মাইক্রোবায়োলজি বিভাগে অধ্যাপক । শিক্ষা জীবনের প্রতিটি ধাপে তিনি প্রতিভার স্বাক্ষর রেখেছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মাইক্রোবায়োলজি বিভাগ থেকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করে উচ্চতর শিক্ষা গ্রহণ করেছেন যুক্তরাজ্যে ইউনিভার্সিটি অফ ম্যাঞ্চেস্টার ইনস্টিটিউট অফ সাইন্স এন্ড টেকনোলজি থেকে।

এই প্রতিষ্ঠান থেকে পিএইচডি সম্পন্ন করে পোস্টডক্টরাল সম্পন্ন করেন কানাডার ম্যাকগিল ইউনিভার্সিটি থেকে । জাতীয় ও আন্তর্জাতিক অসংখ্য বিজ্ঞান সম্মিলনীতে অংশ নিয়েছেন ড. করিম, উপস্থান করেছেন উল্লেখযোগ্য সংখ্যক গবেষণা নিবন্ধ।

আন্তর্জাতিক বিজ্ঞান সাময়িকীগুলোতে প্রায় অর্ধশত উচ্চ মানদণ্ডের গবেষণা নিবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে। এম. মঞ্জুরুল করিম গবেষণা, পাঠদান ছাড়াও জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বিজ্ঞান সংগঠনের গুরুত্বপূর্ণ নেতৃত্ব প্রদান করে আসছেন। বিশ্বের প্রতিভাবান তরুণ বিজ্ঞান গবেষকদের শীর্ষ স্থানীয় সংগঠন গ্লোবাল ইয়াং একাডেমীর সদস্য তিনি।

এম. মঞ্জুরুল করিম উন্নয়ন-গবেষণা নির্ভর মূলধারা সংবাদপত্র বহুমাত্রিক.কম-এর  উপদেষ্টা সম্পাদক (বিজ্ঞান) এর দায়িত্ব পালন করছেন।

বহুমাত্রিক.কম

Walton Refrigerator Freezer
Walton Refrigerator Freezer