Bahumatrik | বহুমাত্রিক

সরকার নিবন্ধিত বিশেষায়িত অনলাইন গণমাধ্যম

বৈশাখ ১১ ১৪৩১, বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪

জাতীয় মাছ ইলিশের মূল্য ও প্রাচুর্য

ড. মো. হুমায়ুন কবীর

প্রকাশিত: ১৭:৪০, ১৬ অক্টোবর ২০২০

প্রিন্ট:

জাতীয় মাছ ইলিশের মূল্য ও প্রাচুর্য

ইলিশ আমাদের দেশের জাতীয় মাছ। তাছাড়া ইলিশ মাছ এখন জিআই (জিওগ্রাফিক্যালি ইনডেক্স) ধারী পণ্য হিসেবে তালিকাভুক্ত হয়েছে। কারণ মাছে-ভাতে বাঙালি বলতে বাঙালির খাদ্য তালিকার একটি বিরাট অংশ জুড়ে মাছকে বুঝানো হয়েছে। কিন্তু কালের পরিক্রমায় অনেক বিরল প্রজাতির মাছ যখন বিলুপ্তির পথে যাচ্ছিল তখনই শুরু হয় ব্যাপকভাবে মাছ চাষের প্রযুক্তি। আর দেশে প্রাকৃতিক মাছের যেভাবে আকাল, তাতে মাছ চাষ করতে না পারলে এখন হয়তো মাছ থেকে আমরা আর কোন প্রেটিন আহরণের কথা স্বপ্নেও ভাবতে পারতাম কিনা সন্দেহ।

ইলিশ মাছ বাংলাদেশের জাতীয় মাছ হলেও তা পুকুরে চাষ করা যায় না। কিন্তু একসময় সারাদেশে ইলিশ মাছেরই প্রাচুর্য ছিল। আমাদের ছোট বেলাতেও দেখেছি বাজারে গেলে ইলিশের ছড়াছড়ি। একসময় বাজারে ইলিশ ছাড়া অন্য কোন মাছ এত বেশি পরিমাণে পাওয়া দুষ্কর ছিল। কাজেই বাড়িতে তখন ইলিশ মাছ খেতে খেতে অতৃপ্তি ধরে যেত।
তবে তখনকার বিভিন্ন সাইজের ইলিশ মাছের স্বাদ ও গন্ধ এখনো নাকে-মুখে লেগে রয়েছে।

আগেই বলেছি, ইলিশ মাছ পুকুরে চাষযোগ্য নয় একং তা বিশেষ কিছু এলাকা ও মৌসুম ছাড়া সারাবছর পাওয়াও যায়না। নদী থেকে সাগরে পানি নামার পযেন্ট সমূহের সংযোগস্থলে অর্থাৎ নদীর মোহনায় প্রাকৃতিকভাবেই ইলিশ মাছের প্রাচুর্য পাওয়া যায়। সেখান থেকে যতই নদীর ভিতরের দিকে আসা যায় ততই ইলিশের পরিমাণ কমতে থাকে। কাজেই সেরকমভাবে একসময় পদ্মা, মেঘনা, ভৈরব ইত্যাদিসহ আরো উপকূলবর্তী নদীর মোহনার এলাকা হিসেবে কক্সবাজার, চট্টগ্রাম, নোয়াখালী, বরিশাল, পটুয়াখালী, ফরিদপুর, খুলনা ইত্যাদি স্থানে প্রচুর পরিমাণে ইলিশ মাছ ধরা পড়তে দেখা যেত।

সারাবছর না থাকলেও ইলিশ মৌসুমে আবার তা ঝাঁকে ঝাঁকে ধরা পড়ত জেলেদের জালে। কিন্তু আশির দশকের পর থেকে ইলিশের পরিমাণ অস্তে আস্তে কমে যেতে থাকে। আর এ কমে যাওয়ার পিছনে অনেক কারণ রয়েছে। আমরা জানি ইলিশ মাছ মূলত লবণাক্ত পানির মাছ। কিন্তু তার প্রজননসহ অন্যান্য জীবনচক্রের কয়েকটি ধাপ সম্পন্ন করতে স্বাদু বা মিঠা পানির প্রয়োজন পড়ে। কারণ দেখা গেছে, সমুদ্রের লোনাপানিতে বড় হয়ে যখন পেটে ডিম হয় তখন স্বাদু পানিতে ডিম ছাড়ার জন্য চলে আসে। আর নদীর মোহনায় স্রোতের তোড়ে পানি যেখানে ঘোলা হয়ে যায়, সেই স্রোতস্বিণী ঘোলা পানিই মূলত ইলিশ মাছের ডিম ছাড়ার উপযুক্ত স্থান। তখন সেই স্রোতের মধ্যে ডিম ছেড়ে চলে যাওয়ার সময়ই এরা আসলে শিকারীদের জালে ধরা পড়ে।

পরবর্তীতে সেই ডিম ফুটে বাচ্চা হয়ে আস্তে আস্তে বড় হতে থাকে এবং তখন তারা ঝাঁকে ঝাঁকে নদীর মোহনায় ঘোরাফেরা করতে থাকে। মৎসজীবীরা যখন ইলিশ কিংবা অন্য মাছ ধরার জন্য এসব স্থানে জাল ফেলে তখন সেখানে ইলিশের প্রচুর বাচ্চা ধরা পড়ে। ছোট ইলিশের এসব বাচ্চাই ঝাটকা হিসেবে পরিচিত। বছর ঘুরে এসব ঝাটকা ইলিশই অবার মা ইলিশে রূপান্তরিত হয়ে আবারো প্রজননের জন্য ডিম ছাড়ে। কিন্তু আমাদের দেশের সবচেয়ে বড় সমস্যা দেখা দেয় তখনি। আমরা সোনার ডিমপাড়া সেই রাজহাঁসের গল্পটা নিñয়ই জানি। এখানেও তার কোন ব্যতিক্রম হয় না।

জেলেরা তাদের জালে উঠা সকল ধরনের ইলিশ মাছের পোনা, ঝাটকা ইলিশ যা-ই তাদের জালে উঠে তার একটিও ছাড়ে না। ফলে ইলিশের বাচ্চা কিংবা ঝাটকা ইলিশ ধরে ধরে চাপিলা মাছের মতো কেজি দরে বাজারে নির্দয়, নিষ্ঠুর ও নির্মমভাবে বিক্রি করে ফেলে। তাতে একেবারে ইলিশ মাছের বীজসহ শেষ হয়ে যায়।

অথচ বাংলাদেশের এ রূপালি ইলিশের পার্শ্ববর্তী ভারত, মিয়ানমারসহ ইউরোপ ও আমেরিকায় ব্যাপক কদর রয়েছে। যে প্রাপ্তির প্রাচুর্য, স্বাদ ও গন্ধের জন্য ইলিশ আমাদের জাতীয় মাছের গৌরব অর্জন করেছিল, সেটি অনেকাংশেই দীর্ঘদিন যাবৎ ভুলুণ্ঠিত হওয়ার পথে ছিল।

কিন্তু দেখা গেছে বিগত কয়েকবছর আগে আওয়ামীলীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর তারা ভারতসহ কয়েকটি দেশে ইলিশ রপ্তানির উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে রাখে। এ কাজটি করে মাত্র এক বছরের তাও আবার একটি মৌসুমের জন্য। তাতেই সেসময় বাজারে ইলিশের মৌসুমে মাছের প্রাচুর্য লক্ষ্য করা গিয়েছিল। সেই অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে সরকার ইলিশের ঐতিহ্য ফেরানোর জন্য ব্যাপক কর্মসূচী গ্রহণ করে। তারমধ্যে ঝাটকা নিধন বন্ধ করা, প্রজনন মৌসুমে মা ইলিশকে ধরা বন্ধ করা, ইলিশের রফতানি কিছুদিন বন্ধ রাখা, সাগর ও নদীর মোহনায় ইলিশের অভয়রারণ্য নির্ধারণ করা ইত্যাদি। তারই অংশ হিসেবে এবারও ১৪ অক্টোবর থেকে ৪ নভেম্বর পর্যন্ত ২২ দিন ইলিশ ধরা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করা হয়েছে।

সেজন্য দেখা গেছে, এসব কয়েকটি মাছের ইতিবাচক কার্যক্রমের ফলেই ২০১৬ সাল থেকেই সারাদেশে ইলিশের ছড়াছড়ি চলছে। মনে হচ্ছে যেন ইলিশের সেই সুদিন আবার ফিরে এসেছে। আগে কয়েকবছর যে পরিমাণ ও ওজনের একটি ইলিশ মাছের যে দাম ছিল তা এখন কোন কোন ক্ষেত্রে অর্ধেকেরও কমে চলে এসেছে। তাছাড়া দেড়-দুই কেজির ওজনের পর্যন্ত ইলিশও এখন কিনতে পাওয়া যাচ্ছ, আগে যা ছিল স্বপ্নের মতো। সকল শ্রেণি-পেশার মানুষই তাদের স্বাদ, সঙ্গতি ও সাধ্যের মধ্যে একেকটি ইলিশ মাছ কিনে কেতে পারছে। অথচ বিশেষ বিশেষ দিনে বিশেষত পহেলা বৈশাখ, কিংবা অন্য কোন পূজা-পার্বণের সময় নিত্য প্রয়োজনীয় উপকরণ হিসেবে এ ইলিশ মাছ সোনার চেয়ে বেশি দামী হয়ে যেত। পত্রিকান্তরে প্রতিনিয়ত খবরে প্রকাশ পাচ্ছে এখন ইলিশের এলাকা হিসেবে পরিচিত বরিশাল, খুলনা, ফরিদপুর, কক্সবাজার, চট্টগ্রাম, নোয়াখালী ইত্যাদি স্থানে বাড়িতে বাড়িতে ফেরি করে ইলিশ মাছ বিক্রি করছে সরাসরি জেলেরা।

আর কয়েক বছরের মধ্যে এবারে সবচেয়ে বেশি মাছ ধরতে পারায় তাদের মুখেও সারাক্ষণ হাসির ঝিলিক লেগে থাকছে। আমরা জানি মৎস্য বিজ্ঞানীদের মতে, বছরের একটি নির্দিষ্ট সময়ে যদি এসব নিয়ন্ত্রণমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা যায় তবে প্রতিবছরই ইলিশ মাছ এভাবেই সবার জন্য সহজলভ্য হবে। এতে করে বাংলাদেশের জাতীয় মাছ হিসেবে পরিচিত ইলিশের হারানো গৌরব ফিরতে খুব বেশি সময়ের প্রয়োজন হবেনা। মাছে এমনিতেই আমরা বিশ্বের অন্যান্য দেশের তুলনায় অনেক এগিয়ে রয়েছি। সাম্প্রতিক এক পরিসংখ্যানে প্রকাশ, বিশ্বে স্বাদু পানির মৎস্য উৎপাদনে আমরা চতুর্থ স্থান দখল করতে পেরেছি। কিন্তু যেহেতু ইলিশ মাছ নিয়ন্ত্রিত পরিবেশে এখনও আবাদ করা সম্ভব হয়নি। অপরদিকে ইলিশ আমাদের জাতীয় মাছ, সেজন্য একে বাঁচিয়ে রাখতে হলে বর্তমানে প্রচলিত ব্যবস্থার বিকল্প নেই। এবারে দেখে তাই আমরা আশাবাদী না হয়ে পারি না।

লেখক: কৃষিবিদ ও ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়

email: [email protected]

বহুমাত্রিক.কম

Walton Refrigerator Freezer
Walton Refrigerator Freezer