Bahumatrik | বহুমাত্রিক

সরকার নিবন্ধিত বিশেষায়িত অনলাইন গণমাধ্যম

বৈশাখ ৫ ১৪৩১, শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪

জনস্বাস্থ্যের জন্য নগর পরিকল্পনা

ফাহিম আহম্মেদ মন্ডল

প্রকাশিত: ২৩:৩৩, ১০ ডিসেম্বর ২০২০

প্রিন্ট:

জনস্বাস্থ্যের জন্য নগর পরিকল্পনা

-লেখক

অতি সম্প্রতি বিশ্বে মহামারী আকারে ছড়িয়ে পড়া করোনা ভাইরাসের প্রকোপ আমাদেরকে চোখে আঙুল তুলে দেখিয়েছে, নগর পরিকল্পনায় মানব স্বাস্থ্য সুরক্ষার বিষয়টি নিশ্চিত করা কতোটা গুরুত্বপূর্ণ। মানব সভ্যতার আধুনিক প্রযুক্তির সকল জ্ঞান এবং যুক্তি গুলোকে কাজে লাগিয়েও কোভিড-১৯ মহামারীর হাত থেকে মুক্তি লাভ করা সম্ভব হচ্ছে না।

অথচ আমরা যদি পূর্ব থেকেই আমাদের নগর গুলোকে মানব স্বাস্থ্য সুরক্ষার আঙ্গিকে সাজানোর চেষ্টা করতাম, তাহলে এই মহামারীকে প্রাথমিক পর্যায়েই রুখে দেয়া সম্ভব হতো, যেমনটি করে দেখাতে পেরেছে, হংকং কিংবা সুইজারল্যাণ্ড। তাই এখন আমাদের উচিত, ইতোমধ্যে ঘটে যাওয়া, ভয়ংকর সব অভিজ্ঞতাকে ভয় না পেয়ে, ভবিষ্যতের সকল বাঁধা-বিপত্তিগুলোকে যেনো সহজে অতিক্রম করা যায়, তার উপায় বের করতে হবে। এখনই সময়, আমাদের নগর গুলোকে এমনভাবে ঢেলে সাজানোর, যেনো প্রকৃতি সৃষ্ট মহামারীই হোক, কিংবা মনুষ্য সৃষ্ট ভয়াবহ দূর্যোগ, মানব জীবন হুমকির মুখে না পড়ে।

সৃষ্টির আদিকাল থেকেই মানুষ তাঁর চারপাশের পরিবেশকে সহজাত মেধা দ্বারা বশ করে এসেছে। মানব সভ্যতার ইতিহাসে অসংখ্য ভয়ঙ্কর সব মহামারী দেখা গিয়েছে। প্রকৃতির বিরুদ্ধে এই লড়াইয়ে ধরাশায়ী হয়েছে লাখো-কোটি প্রাণ। কিন্তু তবুও মানুষ কোনোদিন হার মানেনি। নিত্য নতুন উপায়ে মানুষ প্রকৃতির উপর তাঁর রাজত্ব কায়েম করেছে।

ইতিহাস ঘাটলে আমরা দেখতে পাই, ৫৪১-৫৪২ খৃষ্টাব্দে ‘প্লেগ অব জাস্টিনিয়ান’ এর প্রভাবে ইউরোপে প্রায় ২৫ মিলিয়ন প্রাণহানী ঘটে; ১৩৪৬-১৩৫৩ খৃষ্টাব্দে মহামারী ‘দ্যা ব্ল্যাক ডেথ’ এর প্রভাবে ইউরোপ, এশিয়া ও আফ্রিকার প্রায় ৭৫-২০০ মিলিয়ন মানুষের মৃত্যু ঘটে; ১৮৫২-৬০ অবধি সময়কালে কলেরার প্রাদুর্ভাবে প্রায় ১ মিলিয়ন মানুষের মৃত্যু ঘটে। এছাড়া পরবর্তী সময়ে ‘স্প্যানিশ ফ্লু’, ‘এশিয়ান ফ্লু’ এবং হালের ‘ইবোলা ভাইরাস’ এর কারণেও অসংখ্য মানুষের প্রাণহানী ঘটে।

প্রাকৃতিক দূর্যোগের বাইরে মানুষ তাঁর নিজ সৃষ্ট বিপদেও বারবার বিপর্যস্ত হয়েছে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে মানুষ নিজ সৃষ্ট ভয়াবহ দূর্যোগের সবচেয়ে বড় দামামা দেখেছে। প্রাণ গিয়েছে লাখো-কোটি মানুষের। কিন্তু এতসবের পরও মানুষ এসব দূর্যোগ মোকাবেলা করেই টিকে রয়েছে। প্রতিবারই মানুষ এসব বিপর্যয় মোকাবেলায় নিয়ে এসেছে নতুন কোনো উদ্ভাবনী পদক্ষেপ, যাতে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছে গোটা বিশ্ব। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, মহামারী দূরীকরণে টিকা আবিস্কার, নদী ভাঙনের হাত থেকে শহর রক্ষায় বাঁধ নির্মাণ কিংবা বিশ্বযুদ্ধ শেষে শান্তির আহ্বান জানিয়ে জাতিসংঘের প্রতিষ্ঠা।

বর্তমান বিশ্বেও আমরা ‘কোভিড-১৯’ কিংবা করোনা ভাইরাসের প্রকোপে চরম শঙ্কায় জীবন কাটাচ্ছি। এর থেকে পরিত্রাণের জন্য, রাশিয়া, চীন এমনকি আমাদের বাংলাদেশের একটি কোম্পানী কর্তৃক ভ্যাকসিন আবিস্কারের কিছু দাবিও আমরা দেখেছি।

কিন্তু এই মহামারীটি আমাদেরকে বুঝিয়ে দিয়েছে, নগর পরিকল্পনায় বাড়ন্ত শিল্প কারখানা, যান্ত্রিক প্রযুক্তি এবং অর্থনৈতিক মুক্তিকে প্রাধান্য দিতে গিয়ে আমরা আমাদের জনস্বাস্থ্য নিরাপত্তাকে কতোটা হুমকির মুখে ফেলে দিয়েছি। পাশাপাশি ডেঙ্গু সমস্যা এবং বর্জ্য ব্যবস্থাপনার অনিয়ম এবং নকল স্বাস্থ্য উপকরণের সরবরাহ আমাদের স্বাস্থ্য নিরাপত্তাকে ভয়াবহ হুমকির সামনে এনে দাঁড় করিয়েছে। তাই এখনই সাবধান ও সচেতন না হলে ভবিষ্যতে করোনা মহামারীর মতো আরও অনেক ভয়াবহ বিপর্যয় আমাদের জন্য অপেক্ষা করে রয়েছে।

 নগর পরিকল্পনায় জনস্বাস্থ্য নিরাপত্তায় করনীয়: নতুন শহর তৈরীর ক্ষেত্রে নতুন প্রযুক্তি এবং জ্ঞানের সঙ্গে পরিকল্পনা করে শহর গুলোকে সাজানো সম্ভব। কিন্তু আমাদের দেশে বড় বড় শহর এবং নগর গুলোতে ইতোমধ্যে লক্ষ লক্ষ মানুষ স্থায়ী কিংবা অস্থায়ীভাবে বসবাস করছেন। শুধু মাত্র আমাদের ঢাকা শহরেই প্রায় দুই কোটির উপর মানুষের বসবাস এবং বসবাসের স্থান হিসেবে ঢাকা পৃথিবীর সবচেয়ে অনুপযোগী শহরের শীর্ষে। তাই বুঝাই যাচ্ছে যে, আমাদের নগর গুলোকে একবারে ঢেলে সাজানো সম্ভব নয়। আমাদের শহর গুলোকে জনস্বাস্থ্যের জন্য নিরাপদ এবং বসবাসের জন্য উপযোগী করতে হলে আমাদেরকে কিছু দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে, যা বাস্তবায়ন হবে পর্যায়ক্রমে ধাপে ধাপে। আর এসবের জন্য প্রয়োজন প্রশাসনের পাশাপাশি ব্যক্তি ও বেসরকারি উদ্যোগ এবং বাস্তবায়ন।

নগর পরিকল্পনার ক্ষেত্রে জনস্বাস্থ্যকে গুরুত্ব দিতে হলে শুরুতেই আমাদেরকে কিছু মৌলিক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের সমন্বয়ের দিকে নজর দিতে হবে। যেমন: শহরকে পরিবেশ দূষণ মুক্ত করতে হবে, পর্যাপ্ত চিকিৎসালয় এবং চিকিৎসক থাকতে হবে, খেলাধুলা এবং শরীর চর্চার পর্যাপ্ত সুযোগ সুবিধা থাকতে হবে, খাদ্যসামগ্রীকে হতে হবে ভেজাল বিহীন সহ ইত্যাদি ইত্যাদি। নিচে এমনই কিছু সুনির্দিষ্ট বিষয়ের দিকে আলোকপাত করা হলো:

১। কার্বন নিঃসরণ: কার্বন এর মাত্রাধিক্যতা, বিশাল নির্গমন আমাদের শহরগুলোকে অনেক বেশি অনিরাপদ এবং জনস্বাস্থ্যের জন্য হুমকি হিসেবে গড়ে তুলেছে। শুধুমাত্র চীন এবং আমেরিকা মিলেই প্রায় ৫০% এর কাছাকাছি কার্বন নির্গমন করছে। পরিবেশের এই মারাত্মক দূষণের ফলে প্রতি বছর মারা যাচ্ছে লাখো মানুষ। নিধন হচ্ছে সবুজ বৃক্ষ। জাতিসংঘের তথ্যমতে, শুধুমাত্র অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে বসবাসের জন্য ২০১২ সালে বিশ্বে ১২.৬ মিলিয়ন মানুষ মারা গিয়েছিলো। জাতিসংঘের অন্য আরেকটি প্রতিবেদনের তথ্য মতে, বিশ্বে প্রতি ১০ টি শহরের মাঝে ১ টিরও কম শহর স্বাস্থ্যকর জলবায়ু নিশ্চায়নে কাজ করে!

২০১৫ সালে প্যারিসে অনুষ্ঠিত জলবায়ু সম্মেলনের আগে বিভিন্ন দেশকে স্বপ্রণোদিত হয়ে কার্বন নিঃসরণ কমানোর লক্ষ্য নির্ধারণ করতে অনুরোধ করে জাতিসংঘ৷ ২০৩০ সালের পূর্বেই প্রত্যেক দেশ অন্তত ৫ শতাংশ হারে কার্বন নিঃসরন করতে উদ্যোগী হয়েছে। বাংলাদেশও ইতোমধ্যে এ লক্ষ্যে কার্যক্রম শুরু করেছে। এ লক্ষ্য পূরণে প্রথমেই তিনটি বিষয়ে মনযোগ দিতে হবে। তা হচ্ছে, জ্বালানি, শিল্পখাত ও পরিবহণ খাতের কার্বন নিঃসরন ঘটানো৷ তবেই কমে আসবে বায়ুতে কার্বনের পরিমাণ।

জ্বালানি খাত: নবায়নযোগ্য জ্বালানীর প্রসার ঘটানোর মাধ্যমে কার্বন নিঃসরণ করতে হবে। উদাহরণ স্বরূপ, সোলার হোম সিস্টেমের কথা বলা যায়। সোলার হোম সিস্টেম ছাড়াও সৌরশক্তি ব্যবহার করে সেচের পাম্প চালানো, প্রত্যন্ত অঞ্চলে রাস্তায় সৌরশক্তি চালিত লাইটের ব্যবস্থা করা, পিকো সোলার সিস্টেম, গ্রিড টাই সোলার ইত্যাদির মাধ্যমে নবায়নযোগ্য জ্বালানির উৎস তৈরি করতে হবে৷ এতে করে আমাদের বনভূমির পরিমাণও বৃদ্ধি পাবে।

শিল্প খাত: শিল্পখাতে আমাদেরকে প্রথমে নজর দিতে হবে শিল্প কারখানা গুলোর অবস্থানের দিকে। কারখানা গুলোকে শহরের প্রধানতম সড়ক এবং বসতির বাইরে নিয়ে যেতে হবে এবং কারখানার জন্যেও আলাদা সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে। পাশাপাশি তাঁদের উপর কার্বন নিঃসরনের জন্য চাপ প্রয়োগ করতে হবে। প্রয়োজনে, তাদের উপর ট্যাক্সের পরিমাণ বাড়িয়ে দিতে হবে।

পরিবহন খাত: পাবলিক ট্রান্সপোর্টের সংখ্যা বৃদ্ধি করে ব্যাক্তিগত গাড়ির পরিমাণ কমাতে হবে। এক্ষেত্রে, মেট্রোরেল, পাতাল রেল, ট্রাম ইত্যাদি প্রযুক্তির সঙ্গে আমাদের শহর এবং শহরবাসীকে পরিচয় করাতে হবে। পাশাপাশি নৌ পথে যাতায়ত সহজ এবং নিরাপদ করার দিকে মনযোগ দিতে হবে। কার্বন নিঃসরন অনেকাংশে কমে যাবে। তাই আমাদের নগর গুলোকে জনস্বাস্থ্য নিরাপত্তার স্বার্থে ঢেলে সাজানোর প্রক্রিয়া হিসেবে আমাদেরকে অবশ্যই উপরোক্ত খাতগুলোতে কার্বন নিঃসরণের পরিমাণ বাড়াতে হবে এবং পরিবেশের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে হবে।

২। প্রয়োজনীয় বনভূমি স্থাপন: একটি শহরের মোট আয়তনের অন্ততপক্ষে এক-চতুর্থাংশ, অর্থাৎ পচিশ শতাংশ এলাকা জুড়ে বনভূমি থাকতে হবে। কিন্তু সরকারী হিসেব মতে, আমাদের শহরগুলোতে বনভূমির পরিমাণ গড়ে দশ শতাংশের কিছু বেশি মাত্র। তাই পরিবেশ রক্ষায় এবং স্বাস্থ্য সুরক্ষায় আমাদের নগর গুলোকে সাজানোর ক্ষেত্রে অবশ্যই প্রয়োজনীয় বনভূমির জায়গা করে নিতে হবে। এজন্য প্রয়োজন, অবৈধ দখলদারিত্বের উচ্ছেদ এবং সরকারী কঠোর নির্দেশনা, দ্রুত পদক্ষেপ গ্রহণ ও বাস্তবায়ন এবং পতিত জায়গা গুলোর পূর্ণ ব্যবহার।

যান্ত্রিক জীবনে সবুজ প্রকৃতির স্পর্শ আনতে পারলেই এ লক্ষ্যে অনেকখানি এগিয়ে যাওয়া সম্ভব হবে। এক্ষেত্রে প্রশাসনের প্রধান দায়িত্ব বেসামরিক মানুষজনকে সার্বিকভাবে বনায়নে উৎসাহিত করা। এক্ষেত্রে ছাদকৃষি একটি উত্তম এবং উজ্জদ্বল দৃষ্টান্ত রাখতে পারে। এ ধরণের বনায়ন আমাদেরকে একদিকে যেমন শহরের বনভূমি বৃদ্ধিতে, সর্বোপরি প্রাকৃতিক ভারসাম্য তৈরীতে সাহায্য করবে, অন্যদিকে অর্থনৈতিক মুনাফাও দান করবে। প্রশাসন চাইলেই এ ধরণের উদ্যোগকে জনপ্রিয় করতে পারে। যেমন,

· “যেসব বাড়িতে ন্যূনতম ৫ টি গাছ থাকবে, তাঁদের ২০% আয়কর মওকুফ করা হবে।” -এমন একটি ঘোষণার মাধ্যমে খুব সহজেই নগর কৃষিকে জনপ্রিয় করা সম্ভব। এক্ষেত্রে পৌরসভা এবং সিটি কর্পোরেশন কর্তৃপক্ষ ভেবে দেখতে পারেন।

“নগরের বাড়ি গুলোর মাঝে, অন্তত পাশাপাশি অবস্থান করা প্রতি দুটো বাড়ির বাসিন্দাগণ তাঁদের মাঝে যে বাউন্ডারী সীমাটি ব্যবহার করেন, সেই বাউন্ডারিটি ইট-পাথরের না হয়ে, গড়ে তোলা হোক বড় বড় পাঁচ-ছয়টি গাছের মাধ্যমে। অর্থাৎ সাধারনভাবে আপনার বাড়ী এবং আমার বাড়ির মাঝে যে বাউন্ডারীর দেয়ালটি তুলে দিয়ে সীমানা চিহ্নিত করি আমরা, সেই সীমানাটিকে আমরা চাইলেই ইট-পাথরের বদলে গাছের মাধ্যমে নির্ধারণ করতে পারি। এতে করে পরিবেশে বৃক্ষরোপণ যেমন বাড়বে, একই সঙ্গে বৃদ্ধি পাবে আমাদের আন্তঃ সামাজিক যোগাযোগ। বৃদ্ধি পাবে আমাদের পারস্পরিক মেলামেশা। বাচ্চাদের জন্য বাড়বে খেলাধুলার জায়গা। সর্বোপরি বাড়বে আবহমান কাল থেকে চলে আসা আমাদের সামাজিক ভার্তৃত্বের অটুট বন্ধন।” – আপাতদৃষ্টে প্রস্তাবটি বাস্তবতা বিমুখী মনে হলেও, সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধি এবং যথাযথ কর্তৃপক্ষের সদিচ্ছা থাকলে এটি বাস্তবায়ন সময়ের ব্যাপার মাত্র।

৩। সুষ্ঠু বর্জ্য ব্যবস্থাপনা: বর্তমান বিশ্বের প্রায় অর্ধেক জনগোষ্ঠীই শহরে বসবাস করেন। খোদ জাতিসংঘের ভাষ্য মতে, ২০৩০ সালের মধ্যে বিশ্বের মোট জনসংখ্যার প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ শহরে বাস করবে এবং উন্নয়নশীল দেশগুলির শহুরে জনসংখ্যা বর্তমানের চেয়ে দ্বিগুণ হবে। নগরায়নের এই আধিক্যের ভীড়ে আমরা হারাচ্ছি আমাদের সুষ্ঠু সমাজ ব্যবস্থাপনা। আমাদের দেশেই আমরা বর্জ্য ব্যবস্থাপনার চরম অবহেলা এবং বিশৃঙ্খলা দেখতে পারি। ফলস্বরূপ পরিবেশে দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে দূষণ। নিত্য নতুন সব রোগ জীবাণু এবং সমস্যার উদ্ভব হচ্ছে এসব আবর্জনা থেকে।

আমাদের দেশে সাধারণভাবে শহর গুলোর সব বর্জ্য নদীতে নিয়ে ফেলা হয়। ফলস্বরূপ দূষিত হচ্ছে আমাদের নদীগুলো, যা সর্বোপরি প্রভাব ফেলছে আমাদের মানসিক স্বাস্থ্যের উপর। আবার যত্রতত্রই আমরা দেখতে পাই খোলা ডাস্টবিন, যা থেকে প্রতিনিয়ত ছড়ায় দূর্গন্ধ। তাই পরিবেশ এবং পরিবেশের উপাদনগুলোকে এভাবে কৃত্রিম সমাধান যোগ্য কারণে যেনো নষ্ট না হতে হয় এবং তা যেনো আমাদের মানসিক এবং শারীরিক স্বাস্থ্যের প্রতি হুমকি স্বরূপ না হয়, এজন্য নগর পরিকল্পনার ক্ষেত্রে প্রয়োজন সুষ্ঠু বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কিংবা প্রোপার ড্রেনেজ ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম।

৪। পর্যাপ্ত হাসপাতাল স্থাপন: আমাদের দেশের হাসপাতাল গুলোর অবস্থা ভীষণ নাজুক এবং রোগীর তুলনায় চিকিতসকের সংখ্যা একদমই অপ্রতুল। একটি গবেষণায় দেখা গিয়েছে, বাংলাদেশে প্রতি দশ হাজার মানুষের জন্য গড়ে একজন করে ডাক্তার এবং তিনজন নার্স রয়েছেন, যা রীতিমতো ভীতি জাগানিয়া একটি তথ্য। তাই আমাদের নগর গুলো পরিকল্পনার সময়ই এমন ভাবে সাজাতে হবে যেনো, একটি নির্দিষ্ট সংখ্যক জনগোষ্ঠীর বসবাসরত পরিধির জন্য একটি করে হাসপাতালের ব্যবস্থা করা হয় এবং প্রয়োজনীয় চিকিৎসা উপকরণ সেখানে বিদ্যমান থাকে। এক্ষেত্রে পরিকল্পনার প্রস্তাবনাতেই হাসপাতালে কর্মীর সংখ্যা এবং এলাকায় বসবাসরত লোকের সংখ্যার অনুপাতে উল্লেখ করে দেয়া যেতে পারে।

৫। প্রাকৃতিক বিনোদনের ব্যবস্থা: আমাদের দেশের অসংখ্য নদী-নালা, খাল-বিল ভরাট করে জবরদখল করে রাখা হয়েছে। সেখানে প্রকৃতিকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে ইচ্ছেমতো গড়ে তোলা হচ্ছে ইমারত, দালান-কোঠা। নদীমাতৃক বাংলাদেশে আজ আমরা একে একে আমাদের সবগুলো নদী হারাতে বসেছি। তাই, যথাযথ পরিকল্পনা প্রণয়নের মাধ্যমে এসব প্রাকৃতিক সম্পদকে পুনরুদ্ধারের ব্যবস্থা করতে হবে। এতে করে প্রতিটি শহরের নদী বা পানির আধার যখন স্বরূপে ফিরবে, তখন নদীর ধারের বায়ু শহরের জন্য আশীর্বাদ হিসেবে বিবেচিত হবে।

শহরের মাঝে প্রতি তিন-পাঁচ কিলোমিটার দূরত্বে একটি করে ছোট কিংবা মাঝারী আয়তনের পার্ক এবং প্রতি দশ কিলোমিটার অন্তর অন্তর একটি বড় পার্ক স্থাপনের মাধ্যমে স্থানীয় জনগণকে বিশুদ্ধ বায়ুতে শ্বাস নেয়ার সুযোগ করে দিতে হবে। পাশাপাশি এতে করে, এলাকার ছোট ছোট বাচ্চারা খোলা জায়গাতে খেলাধুলা করে মানসিক এবং শারীরিক বিকাশ ঘটাতে সক্ষম হবে। সর্বোপরি সবার জন্য একটা বিনোদন ব্যবস্থা গড়ে উঠবে। এসবের পাশাপাশি কৃত্রিম উপায়ে কোনো এলাকা বা অঞ্চলকে সাজানোর মাধ্যমে সেটিকে জনস্বাস্থ্যের জন্য উপকারী করে তোলা সম্ভব। যেমন-হাতিরঝিল প্রকল্প, ঢাকা।

৬। পরিকল্পনাবিদগণের হাতে পর্যাপ্ত ক্ষমতা প্রদান: নগর পরিকল্পনাবিদগণ আমাদের দেশে অনেকাংশেই কাজে বাঁধার সম্মুখীন হয়ে থাকেন। রাজনৈতিক ভাবে কিংবা প্রশাসনিকভাবে নানা রকমের বাহ্যিক চাপের মুখ পরিকল্পনাবিদগণ প্রায়শই অসহায় হয়ে পড়েন এবং নিজেদের সঠিক পরিকল্পনা বাস্তবায়ন ঘটাতে পারেন না। তাই জনস্বাস্থ্যের বিষয়টি নগর পরিকল্পনাতে গুরুত্বের সঙ্গে অন্তর্ভূক্তিকরণ এবং সুষ্ঠু বাস্তবায়ন দেখতে চাইলে পরিকল্পনাবিদগণের হাতে অবশ্যই পর্যাপ্ত ক্ষমতা প্রদান করতে হবে এবং একই সঙ্গে কাজের তদারকি করার সুযোগ দিতে হবে। এতে পরিকল্পনাবিদগণ শহরের বৈশিষ্ট্যের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে নিজদের মতো করে পরিকল্পনা করার সুযোগ পাবেন এবং সকল দিকে সমান গুরুত্ব দিতে পারবেন। তবেই কেবল শতভাগ নিশ্চয়তার সঙ্গে জনস্বাস্থ্য রক্ষার বিষয়টি পরিকল্পনায় বাস্তবায়ন করা সম্ভব। 

এসডিজি ও নগর পরিকল্পনায় জনস্বাস্থ্য: এসডিজি বা টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য প্রণীত হয়েছিলো সারা বিশ্বের মানুষের সার্বিক মৌলিক অধিকার সংরক্ষণ এবং নিশ্চিতকল্পে। ২০১৬ সালে যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে বিভিন্ন দেশের সরকার প্রধানদের আলোচনার মধ্যমে এ লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিলো। এর মেয়াদ ২০১৬ থেকে ২০৩০ সাল অবধি। এই পনেরো বছরে জাতিসংঘের আওতাভূক্ত রাষ্ট্রগুলোকে ১৭ টি লক্ষ্যমাত্রা এবং এর আওতাধীন ১৬৯ টি লক্ষ্য অবশ্যই পূরণ করতে বলা হয়েছে। এই লক্ষ্যমাত্রা গুলোতেও জনস্বাস্থ্য এবং টেকসই নগর পরিকল্পনার উপর জোর দেয়া হয়েছে। এসডিজির ৩ নং লক্ষ্যমাত্রায় বলা হয়েছে, “সকল বয়সী মানুষের জন্য সুস্বাস্থ্য এবং কল্যাণ নিশ্চিত করতে হবে” এবং ১১ নং লক্ষ্যমাত্রায় বলা হয়েছে, “অন্তর্ভূক্তিমূলক, নিরাপদ, অভিঘাত সহনশীল এবং টেকসই নগর ও জনবসতি গড়ে তুলতে হবে।”

অর্থাৎ, এসডিজির ৩ এবং ১১ নং লক্ষ্যমাত্রার দিকে তাকালেও আমরা বুঝতে পারি টেকসই পৃথিবীর জন্য নগর পরিকল্পনার পাশাপাশি জনস্বাস্থ্যের সুরক্ষাও জরুরি। তাই নগর পরিকল্পনায় জনস্বাস্থ্যের নিরাপত্তার বিষয়টি অন্তর্ভূক্ত করে পরিকল্পনা সাজালে সর্বোপরি, শত শত প্রাণ রক্ষা পাবে এবং সমাজও অদৃষ্ট শত্রুর হাত থেকে রক্ষা পাবে।

পরিশেষে এটুকুই বলবো, বাংলাদেশ তৃতীয় বিশ্বের উন্নয়নশীল একটি রাষ্ট্র এবং আমরা এর নাগরিক। জিডিপির উত্তরোত্তর বৃদ্ধির পাশাপাশি আমাদের দেশের জনসংখ্যাও ক্রমাগত বেড়ে চলেছে। আমাদের দেশের বর্তমান ক্ষমতাসীন সরকার তাঁদের নির্বাচনী ইশতেহারেই বলেছে, “গ্রাম হবে শহর”। অর্থাৎ, নাগরিক সুবিধাদি শহর থেকে এখন গ্রামেও সম্প্রসারণ করা হবে এবং শহরগুলোকেও যুগোপযোগী করে তোলা হবে। এমতাবস্থায় আমাদের গ্রাম এবং শহরগুলোকে সাজানোর ক্ষেত্রে যদি আমরা জনস্বাস্থ্যকে সমান গুরুত্ব না দিই এবং এটির নিরাপত্তায় যথাযথ পদক্ষেপ না গ্রহণ করি, তবে ভবিষ্যতে দেশের প্রতিটি শহরই হবে ঢাকার মতো বসবাস অযোগ্য নগরী এবং মানব মন ও শরীরের স্বাস্থ্য হবে চরম হুমকির দ্বারপ্রান্তে। আর যদি আমরা জনস্বাস্থ্যের বিষয়টিকে অগ্রভাগে রেখে অর্থনৈতিক উন্নয়নে মনযোগী হই, তাহলে আমাদের অতিরিক্ত জনসংখ্যা অভিশাপ না হয়ে আমাদের জন্য আশীর্বাদ হিসেবে পরিগণিত হবে। তাই নগর পরিকল্পনায় জনস্বাস্থ্যের সুরক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা পরিকল্পনাবিদ এবং প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব।

 লেখক: শিক্ষার্থী, নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, সাভার-ঢাকা।

ইমেইল: [email protected] 

বহুমাত্রিক.কম

Walton Refrigerator Freezer
Walton Refrigerator Freezer