Bahumatrik | বহুমাত্রিক

সরকার নিবন্ধিত বিশেষায়িত অনলাইন গণমাধ্যম

চৈত্র ৪ ১৪৩০, মঙ্গলবার ১৯ মার্চ ২০২৪

চেতনায় জাগরণে মৈরাংয়ের বিজয় আখ্যান

আশরাফুল ইসলাম

প্রকাশিত: ২৩:১১, ১৪ এপ্রিল ২০২০

আপডেট: ০১:২৩, ১৫ এপ্রিল ২০২০

প্রিন্ট:

চেতনায় জাগরণে মৈরাংয়ের বিজয় আখ্যান

ছবি: সংগৃহীত

ঢাকা: করোনা মহামারীতে পর্যুদস্ত বিশ্ব। ভাইরাসঘটিত এই মহামারীর বিস্তার ও ভয়াবহতায় বিশ্ব সভ্যতা এমন ঝাঁকুনি খেয়েছে যে বিশ্লেষক-ঐতিহাসিকরা একে বিশ্বযুদ্ধ পরিস্থিতির সঙ্গে তুলনা করছেন। বাস্তবতা হয়তো এমনি।

উৎসবপ্রিয় বাঙালির সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যে চৈত্র সংক্রান্তি-পহেলা বৈশাখ বহুকালের এক চিরায়ত উৎসব। করোনার করালগ্রাসে চিরায়ত এই উৎসবও চিরচেনা উদযাপনের চিত্র নিয়ে হাজির হয়নি। পথে পথে মেলায় হইহুল্লোড়ে মেতে উঠা এই অঞ্চলের উৎসবপ্রিয় মানুষেরা ঘরবন্দি হয়ে অতীত স্মৃতি রোমমন্থন করছেন। 

করোনা মহামারীর কালে বাংলা নববর্ষের মতো আরও এক গৌরবময় দিন নিরবেই কেটে গেল। এই অঞ্চলের মানুষের সাংস্কৃতিক ইতিহাসের মতোই মুক্তি সংগ্রামের ইতিহাসও গৌরবোজ্জ্বল। স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ে একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধ যেমন চিরন্তন ইতিহাসে ঠাঁই পেয়েছে তেমনি অখণ্ড ভারতবর্ষের ঔপনিবেশিক পরাধীনতার শৃঙ্খল মোচনে আজাদ হিন্দের রক্তক্ষয়ী সংগ্রামও অভিন্ন গৌরবের আরেক উপাখ্যান। 

বাঙালির গৌরব, অখণ্ড ভারতবর্ষের সূর্যসন্তান নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর নেতৃত্বে পরাধীন ভারতের মুক্তির অভিযানে আজাদ হিন্দের ফৌজের বিজয় নিশান উড়েছিল ১৪ এপ্রিল ১৯৪৪-এ। পরাধীন ভারতবর্ষের মণিপুরের মৈরাং-এ নেতাজির আজাদ হিন্দ ফৌজ রাজকীয় ব্রিটিশ সেনাদের এক রক্তক্ষয়ী সমরে পর্যুদস্ত করে ভারতভূমি থেকে হটিয়ে মণিপুর অধিকার করে। আজকের এই দিনে পার্বত্যভূমি মৈরাংয়ে বিজয়ী আজাদি সেনারা নিজ মাতৃভূমিতে উড্ডীন করেন স্বাধীন ভারতের তেরঙ্গা পতাকা। 

মৈরাংয়ের বিজয় আখ্যান ছড়িয়ে পড়ে ভারতের দূর জনপদেও। দুই শতাব্দির পরাধীনতার শৃঙ্খলমোচনে ভারতবাসীর হৃদয়ে নূতন আকাঙ্খার ঢেউ খেলে যায়। মৈরাংয়ে সেদিনের সেনানি ‘সর্দার-ই-জঙ’ কর্ণেল শওকত মালিকের নেতৃত্বে পতাকা উত্তোলনের বিজয়গাঁথা বিভিন্ন রণাঙ্গনে আজাদি সেনাদের মনোবল বহুগুণে বাড়িয়ে দেয়। বীরদর্পে ভারত মায়ের দামাল ছেলেরা বুকের তাজা রক্ত দিয়ে রচনা করেন স্বাধীনতার গৌরবময় ইতিহাস।  এই দিনটিকে অখণ্ড ভারতের প্রকৃত স্বাধীনতা দিবস হিসেবেও উদযাপন করেন অসংখ্য মানুষ।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালের সেই সংগ্রামে ছন্দপতন ঘটে আজাদ হিন্দ ফৌজের মিত্রদের যুদ্ধে পরাজয়ে। কিন্তু ব্রিটিশরা আজাদি সেনাদের বীরত্ব ও দেশপ্রেমের দুর্দমনীয় যে স্বরূপ দেখতে পান তাতে ভীত হয়ে অচিরেই তারা ভারত ছেড়ে পালিয়ে যায় ‘দেশভাগ’র মতো ষড়যন্ত্রের বীজ বপণ করে।

সেই ষড়যন্ত্র গত সাত দশকে ডালপালা মেলে আরও বিকশিত হয়েছে। খণ্ডিত ভারতের সরকারগুলো স্বাধীনতার সেই বীরসন্তানদের আত্মত্যাগের প্রকৃত ইতিহাস রচনায় দ্বিধাবিভক্তি দেখিয়েছে, দেখিয়েছে এক রহস্যজনক নীরবতা। তবে সত্য সন্ধানী দেশপ্রেমিক প্রজন্ম তাদের গৌরবোজ্জ্বল অতীতকে ঠিকই ধারণ করেছেন নিজেদের জীবনে, মননে-আদর্শে। তাইতো সাম্প্রতিক দশক ও বছরগুলোতে আজাদি সেনাদের ভারত অভিযানের ঐতিহাসিক ক্ষণগুলো তারা স্মরণ করে আসছে বর্ণিল আনুষ্ঠানিকতায়। ভারতবর্ষের প্রতিটি প্রান্তে, এমনকি ঐতিহাসিক অখণ্ড ভারতবর্ষের বাংলাদেশেও এই বীরবন্দনা গীত হচ্ছে সগৌরবে। 

প্রজন্মের মাঝে স্বদেশের মুক্তি সংগ্রামের এইসব হৃতগৌরব নূতন প্রেরণা ও জাগরণের মন্ত্র হয়ে তাদের উদ্ভাসিত করছে। তবে এবারের ১৪ এপ্রিল করোনার করালগ্রাসে স্তব্ধ বিশ্ব চরাচরের মতোই এই অঞ্চলেও মৈরাং দিবস নিয়ে ছিল না কোনো আনুষ্ঠানিক আয়োজন। তবে অন্তর্জালের মাধ্যমে বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে উৎকীর্ণ হয়েছে আজাদি সেনাদের স্মরণে নানা বন্দনা। ফেসবুকে, টুইটারে-হোয়াটস অ্যাপে নেতাজির বন্দনায় আপলোড হয়েছে স্মরণালোচনা, কবিতা, আবৃত্তি ও গান। এসব প্রয়াসের মধ্য দিয়ে নেতাজিপ্রেমীরা এই আবেদনেই উচ্চকিত হতে চেয়েছেন-যে রক্তরঞ্জিত অভিযানে স্বাধীন ভারত লাভ হয়েছে, তার প্রজন্ম কখনো সেই বীরদের ভুলবে না। সেইসঙ্গে তাঁরা নিন্দায় ভাসিয়েছেন রাষ্ট্রের কর্তৃপক্ষকে, ফরমায়েশি ইতিহাস রচয়িতাদের; যাঁরা সচেতনভাবে বিদেশিশক্তি আনুকূল্য দেখিয়ে আজও জাতির বীরসন্তানদের প্রকৃত মর্যাদা দিতে কুণ্ঠিত। 

সেই আক্ষেপের কথাই জানিয়েছেন বিশিষ্ট নেতাজি বিশেষজ্ঞ, লেখক ও গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব ডঃ জয়ন্ত চৌধুরী। কলকাতার প্রভাবশালী সাপ্তাহিক আলিপুর বার্তা’র সম্পাদক ডঃ চৌধুরী বহুমাত্রিক.কম-কে বলেন, ‘‘ইতিহাস মুছে যাচ্ছে। আমরা ভুলে যাচ্ছি ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা দিনগুলির কথা। অখণ্ড ভারতের স্বাধীনতার জন্য নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু দক্ষিণ এশিয়ার ভারতীদের কাছে মাতৃভূমির শৃঙ্খল মোচনে ‘করো সব নিছাবর বনোসব ফকির’ অর্থাৎ ‘দেশের জন্য সর্বস্ব ত্যাগ করে ফকির’ হওয়ার আহ্বান জানিয়েছিলেন। নেতাজির ‘দিল্লি চলো’ আবেগের মতোই এই আবেগ স্পর্শ করেছিল প্রবাসী হাজারো ভারতীয়দের।’’

নেতাজি সাধক এই গবেষক গভীর অন্তর বেদনার সঙ্গে জানাচ্ছিলেন, ‘যাঁরা অনেকেই হয়তো তাদের মাতৃভূমিকে সচক্ষে দেখার সুযোগ পাননি। রেঙ্গুনের কোটিপতি ব্যবসায়ীরা স্বদেশের মুক্তির জন্য নেতাজির আহ্বানে রাতারাতি সর্বস্ব দান করে নিঃস্ব ফকির হয়ে গিয়েছিলেন । এমনি কয়েকজন হলেন-হাবিব, করিম, গনি এবং আদমজীরা। অথচ রাষ্ট্রের অভ্যুদয়ের ইতিহাসের তাদের নাম লেখা নেই।’

মৈরাংয়ের বিজয় উপাখ্যানকে কিভাবে উপেক্ষা করা হয়েছে যুগের পর যুগ-সেই গ্লানির কথা বলতে গিয়ে আবেগতাড়িত জয়ন্ত চৌধুরী বলেন, ‘বুকের রক্ত ঢেলে দিয়ে হাজার হাজার তরুণ আজাদি সেনা ইম্ফল-কোহিমার পার্বত্যভূমি ভিজিয়ে দিয়েছেলেন। ইংরেজ বাধ্য হয়েছিল দ্রুত দেশ ভাগ করে ব্রিটিনে পালিয়ে যেতে। ইতিহাস আজও পর্যন্ত তাদের আত্মত্যাগ নিয়ে সঠিক মূল্যায়ন করেনি। রাজনীতি আশ্রয়ী ইতিহাসবিদ গবেষকরা আজও মৌন সেদিনের সেই আজাদ হিন্দের অভিযানকে ভারতীয় উপমহাদেশের ইতাহাস সঠিকভাবে তুলে ধরতে।’’

তবে জয়ন্ত চৌধুরীর মতোই হাজারো নেতাজিপ্রেমী ঐতিহাসিক এই দিনে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তাদের নেতাজি বন্দনা উৎকীর্ণ করে জানান দিচ্ছেন-রক্তে লেখা ইতিহাসের বিস্মৃতি ঘটে না, প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে তা জাগরণের মন্ত্র হয়ে সর্বপ্রকার অন্যায় আর শোষণ-নিষ্পেষণকে রুঁখে দাঁড়ায়। 

ঐতিহাসিক মৈরাং দিবসে আমরা অখণ্ড ভারতের স্বাধীনতার সূর্যসন্তানদের স্মরণ করি বিনম্র শ্রদ্ধায়। আমাদের চেতনায়-মননে তাদের ত্যাগের মহিমা চিরভাস্বর। মানব সভ্যতার অস্তিত্বের মতোই তাদের শৌর্য-বীর্যের আখ্যান টিকে থাকবেই।

লেখক: প্রধান সম্পাদক, বহুমাত্রিক.কম

বহুমাত্রিক.কম

Walton Refrigerator Freezer
Walton Refrigerator Freezer