Bahumatrik | বহুমাত্রিক

সরকার নিবন্ধিত বিশেষায়িত অনলাইন গণমাধ্যম

বৈশাখ ১১ ১৪৩১, বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪

চা শ্রমিক হত্যার শতবর্ষ: এখনও দৈনিক মজুরি ১২০ টাকা!

নূরুল মোহাইমীন মিল্টন, নিজস্ব প্রকিবেদক

প্রকাশিত: ১৭:০১, ২০ মে ২০২১

প্রিন্ট:

চা শ্রমিক হত্যার শতবর্ষ: এখনও দৈনিক মজুরি ১২০ টাকা!

ছবি- বহুমাত্রিক.কম

আজ ২০ মে চা শ্রমিকদের ইতিহাসে রক্তাক্ত সংগ্রামের শতবর্ষে পা রাখলো। শত বছর পেরিয়ে এখনও চা শ্রমিকরা দৈনিক সর্বোচ্ছ ১২০ টাকা মজুরি নিয়ে দিনযাপন করছেন। ফলে পাঁচ, সাত শ্রমিক সদস্যের পরিবার চালাতে অভাব অনটনে দিন কাটাচ্ছেন বলে শ্রমিকরা অভিযোগ তুলেছেন। ঐতিহাসিক মুল্লুক চলো ও চা শ্রমিক দিবস হিসাবে আজ দেশের বিভিন্ন চা বাগানে দিবসটি পালিত হচ্ছে। ১৯২১ সালের ২০ মে ঘটে যাওয়া সেই রক্তাক্ত ঘটনা স্মরণ করেই চা-শ্রমিকরা দিবসটি পালন করে থাকেন। এবছর দিবসটির শতবর্ষ পালিত হলেও চা শ্রমিকদের জীবনের কোন পরিবর্তন ঘটেনি।

অনুসন্ধানে জানা যায়, ১৯২১ সালে থেকে ২০২১ সাল। ঐতিহাসিক মুল্লুক চলো আন্দোলনের শতবর্ষে পদার্পন করলেও চা শ্রমিকদের তরুন প্রজন্মের অনেকেই এই দিবস সম্পর্কে জানেন না। শোষণ মুক্তির সংগ্রামের ইতিহাসে ত্যাগের গৌরবোজ্জ্বল এই দিনে যে মুক্তির জন্য শ্রমিকরা শত বছর আগে প্রতিবাদী হয়েছিল তার সমাধান আজও হয়নি। ফলে চা-শ্রমিকদের কাছে ২০ মে একটি স্বরণীয় দিন। সস্তায় শ্রম কিনে অধিক মুনাফা লাভে ব্রিটিশরা ভারতের বিহার, উড়িষ্যা, মাদ্রাজ, উত্তর প্রদেশ প্রভৃতি বিভিন্ন প্রদেশ থেকে ১৮৩৪-১৮৩৫ সালে চা শ্রমিকদের এদেশে নিয়ে আসে। সে সময় তাদের ‘গাছ হিলায়ে গা তো পাইসা মিলেগাÑগাছ নাড়লে টাকা মিলবে’ এইসব মিথ্যে প্রলোভন দেখিয়ে চা শ্রমিকদের সংগ্রহ করে দেশে নিয়ে আসে।

এক পরিসংখ্যান মতে, চা চাষের জন্য ১৮৬৩-১৮৬৬ সালে এ অঞ্চলে ৮৪,৯১৫ জন শ্রমিক আনা হয়। যার মধ্যে অনাহারে-অর্ধাহারে, অসুখে-বিসুখে হাজার হাজার শ্রমিক মারা যান। তাদের মধ্যে ক্ষুধা, রুগ-ভোগ, মৃত্যু, নিজ আপনজন থেকে দূরে থাকা এমনকি ফিরে যাবার অনিশ্চয়তা দেখা দেয়। এখানে আসার পর পাহাড়ি জঙ্গল পরিস্কার করা, রাস্তাঘাট-গৃহ নির্মাণ, দ্রুত বর্ধনশীল আগাছা নিয়মিত পরিস্কার করতে দরকার হয় অনেক শ্রমিক। ফলে লোক সংগ্রহের জন্য শুরু হয় এই অনৈতিক কর্মকান্ড।

চা শ্রমিক সংঘের নেতা রাজদেও কৈরী ও শমশেরনগর ইউপি সদস্য সীতারাম বীনসহ কয়েকজন প্রবীন শ্রমিক জানান, নিরীহ, সহজ-সরল চা শ্রমিকরা গাছ নাড়লে টাকা পাওয়া তো দূরের কথা; হিং¯্র জন্তু জানোয়ারের সাথে লড়াই করে বেঁচে থাকতে হয়। পাহাড়, জঙ্গলময় পরিবেশে নিজেদের জীবন বাঁচানোই দু:সাধ্য হয়ে উঠে। অনাহার-অর্ধাহার, ডায়রিয়া-কলেরাসহ অসুখ-বিসুখে এক বীভৎস জীবনের সম্মুখীন হন। বাগান থেকে পালিয়ে গেলে তাদের ধরে আনা হতো। দেয়া হতো অমানবিক শাস্তি। চাবুক আর বুটের লাথির আঘাত সহ্য করতে হতো। এভাবে চা শ্রমিকদের জীবনে নেমে আসে ঘোর অন্ধকার।

১৯২০ সালে শ্রমিক আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে বাগান থেকে বাগানে। বিট্রিশদের শোষণ, নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে চা শ্রমিকরা ১৯২১ সালের ২০ মে নিজ মাতৃভূমিতে ফিরে যেতে উদ্যত হন। চা শ্রমিকরাও বাগান থেকে বের হয়ে আসে। স্ত্রী-পুত্র, পরিজন নিয়ে রেলপথ ধরে হাঁটতে থাকে। ক্লান্ত, ক্ষুধার্ত প্রায় ৩০ হাজার শ্রমিক সিলেট থেকে পায়ে হেঁটে চাঁদপুরে জাহাজ ঘাটে এসে জড়ো হয়।

চাঁদপুর ঘাটে যখন স্টিমার এসে ভিড়ে তখন টিকেট নিয়ে জাহাজ কর্মীদের সাথে ধাক্কাধাক্কি ও বাকবিতন্ডার সৃষ্টি হয়। পূর্ব থেকেই সেখানে প্রস্তুত ব্রিটিশ পুলিশ ও বাগান মালিকদের স্বার্থ রক্ষাকারী গুর্খা বাহিনী বিদ্রোহ দমনের পরিকল্পনা করে। শ্রমিকরা যখন জোর করে জাহাজে উঠতে চাইলো, তখন গুর্খা সৈনিকরা নির্বিচারে শ্রমিক ও তাদের পরিবার পরিজনদের উপর গুলিবর্ষণ ও নির্যাতন শুরু করে। এসময়ে শত শত শ্রমিক গুলিব্ধি হয়ে মারা যান। আহত হন আরও প্রায় হাজারো শ্রমিক। রক্তে লাল হয় চাঁদপুর ঘাটের মেঘনা নদীর পানি। এই সময়ে কতজন শ্রমিক নিহত হয়েছিল আর কতজন আহত হয়েছিল তার পুরোপুরি কোন হিসেব পাওয়া যায়নি। লোকজন নদীতে শুধু লাশের সারি ভাসতে দেখে।

শুধু জাহাজ ঘাটেই নয়; চাঁদপুর রেলষ্টেশনে অপেক্ষমান হাজার হাজার ক্লান্ত শ্রমিকদের উপর গভীর রাতে ঘুমন্ত অবস্থায় গুর্খা সৈন্যরা ঝাপিয়ে পড়ে। রাতের অন্ধকারে অনেক লাশ গুম করে ফেলা হয়। শ্রমিক ও তাদের পরিবার সদস্যদের হত্যা করে। এসময় জাহাজ ঘাট ও রেলস্টেশনে এক বিভীষিকাময় পরিবেশের সৃষ্টি হয়। আন্দোলনে নেতৃত্বদানকারী বেশকিছু নেতৃস্থানীয়দের গ্রেপ্তার করে নিয়ে যায় পুলিশ।

এরপর থেকে চা শ্রমিকদের মুল্লুক চলো যাত্রায় হতাহতের ঘটনায় প্রতি বছর ২০ মে শ্রমিক হত্যা দিবস পালন করা হয়। এবছর বেদনাবহুল ‘মুল্লুক চলো’ দিবসটির শতবর্ষ পালিত হলেও এটি এখনও স্বীকৃতি পায়নি। দিবসটিকে স্বীকৃতি প্রদান ও বর্তমান বাজার দরের সাথে সঙ্গতি রেখে বাঁচার মতো মজুরি প্রদানের দাবি চা শ্রমিকদের।

বহুমাত্রিক.কম

Walton Refrigerator Freezer
Walton Refrigerator Freezer