আমরা সকলেই জানি গতবছরের শেষদিকে অর্থাৎ ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে প্রথমে চীনে করোনা ভাইরাস শনাক্ত হওয়ার কারণে তা কোভিড-১৯ নামে সারাবিশ্বে পরিচিত। সে ধাক্কায় দেশে দেশে করোনা বাড়তে বাড়তে এমন চূড়ায় পৌঁছেছে যা মহামারি কিংবা অতিমারি যে ভাষাতেই ব্যাখ্যা করি না কেন কোন কিছুতেই তার ভয়াবহতা বোঝানো যায় না।
বিশ্ব ইতিহাসে মানুষের মধ্যে ছোঁয়াচে রোগের কারণে অতিমারির মৃত্যুর ঘটনা এবারই নতুন নয়। কিন্তু ইতিহাস থেকে জানা যায় সেগুলোর কোনটাই এত ভয়াবহ রূপ লাভ করেনি।
তাছাড়া জ্ঞান-বিজ্ঞান ও চিকিৎসা বিজ্ঞান এখন এমন আধুনিকতা পেয়েছে যা ইতিপূর্বে সংঘটিত অতিমারির সময়ে কল্পনাই করা যেতো না। কলেরা, টাইফয়েড, গুটিবসন্ত, প্লেগ, যক্ষা, হাম, ধনুষ্টঙ্কার, জলাতঙ্ক এমনকি এইডস রোগও এখন মানুষের নিয়ন্ত্রণে। ক্যানসার রোগটির কোন প্রতিষেধক বা নিরাময় না থাকলেও প্রাথমিক পর্যায়ে তা নির্ণীত হলে ভালো চিকিৎসায় শতভাগ নিরাময়যোগ্য।
কিন্তু একবিংশ শতাব্দীর এ আধুনিক ডিজিটাল ও বিজ্ঞানের যুগে এসে কোভিড-১৯ নামক এ রোগটি এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি করবে তা কেউ কোনদিন ভাবেনি। তবে এটি ঠিক যে এখানেই বিধাতার শক্তি। তিনি যে তাঁর সর্বোৎকৃষ্ট সৃষ্টি মানুষের সকলকিছুর উর্ধ্বে তা স্মরণ করার সময় এসেছে।
যা হোক গতবছরের (২০১৯) ডিসেম্বর থেকে এবছরের (২০২০) নভেম্বর মাসের শেষদিকে এসে দেখা যাচ্ছে সকল পরিকল্পনা ও ধারণা সকল কিছু পাল্টে দিয়ে আবারো বেড়ে চলেছে করোনা আক্রান্তের সংখ্যা ও মৃত্যুর সংখ্যা। এটিকেই সেকেন্ড ওয়েব বা দ্বিতীয় ঢেউ বলে বেশ আগে থেকেই আশঙ্কা করা হচ্ছিল। প্রথম ধাক্কায় সারাবিশ্বে আক্রান্ত ও মৃত্যুর রেকর্ডের ছড়াছড়ি। বর্তমানে সারাবিশ্বে আক্রান্ত প্রায় সাড়েপাঁচ কোটি এবং মৃত্যুর মিছিলে যুক্ত হয়েছে প্রায় সাড়ে তেরো লক্ষ মানুষ। বাংলাদেশও এর বাইরে নয়।
ভাইরাসটি নতুন হওয়ার কারণে যদিওবা এটি সম্পর্কে তেমন কোন গবেষণা তথ্য নেই তারপরও সাধারণভাবে বলা যায় শীতকালে এবং শীতপ্রধান দেশে এ ভাইরাসের আক্রমণের ভয়াবহতা সবচেয়ে বেশি। তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ হলো যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যসহ ইউরোপ- আমেরিকার দেশসমূহ।
পরিসংখ্যান দেখলেই তা সহজেই যেকারো কাছেই পরিস্কার হয়ে যায়। সর্বোচ্চ আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যায় সবচেয়ে বেশি এগিয়ে যুক্তরাষ্ট্র। তবে আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ হিসেবে ভারতও পিছিয়ে নেই। আক্রান্ত ও মৃত্যুর তালিকায় প্রথম দিকেই স্থান করে নিয়েছে দেশটি। সকল দেশেই এখন প্রথম পর্যায়ের করোনা আক্রমণ শেষ করে দ্বিতীয় ঢেউ শুরু হয়েছে। বাংলাদেশেও তা বাড়ছে আবারো। কারণ দেখা গেছে প্রথম ঢেউয়ের সময় আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা বাড়তে বাড়তে সর্বোচ্চ চূড়ায় পৌঁছার পর তা আস্তে আস্তে কমে এসেছিল। কিন্তু তাপমাত্রা কমে শীতের তীব্রতা বাড়ার সাথে সাথে করোনা আক্রান্তের ও মৃতের সংখ্যাও আস্তে আস্তে বেড়ে চলেছে।
এই যে দ্বিতীয় ঢেউ শুরু হলো তাকে প্রতিরোধ আমাদের অনেক কিছুই করণীয় রয়েছে। কারণ প্রথম শুরু হওয়ার সময় এটি নতুন ছিল বলে মোকাবেলার কৌশল কারোরই জানা ছিলনা। কিন্তু এখন ইতিমধ্যেই আমরা প্রায় করোনাকে নিয়েই প্রায় একবছর পার করে দিচ্ছি। এখন আমরা অনেক কিছুই শিখে গিয়েছি। আমাদের অভ্যাসের মধ্যে অনেক কিছু রপ্ত হয়ে গিয়েছে। করোনা থেকে স্বাভাবিক জীবন পেতে হলে আমাদের হয়তো আরো অনেকদিন অপেক্ষা করতে হবে।
কারণ টীকা কিংবা চিকিৎসা পদ্ধতি আবিষ্কার না হওয়া পর্যন্ত সকলকে করোনা ভাইরাস নিয়ে সতর্কভাবেই চলতে হবে বলে বিশষজ্ঞগণের আশঙ্কা। আমরা জানি ‘প্রিভেনশন ইজ বেটার দেন কিউর’। এজন্যই হয় করোনার টীকা নতুবা চিকিৎসা আবিষ্কার না হওয়া পর্যন্ত আমরা মোটেও নিরাপদ নই।
ইতোমধ্যে আমরা দেখতে পাচ্ছি করোনার টীকা আবিষ্কারের তোড়জোড় শুরু হয়েছে। প্রথম সারির উন্নত দেশগুলোতে সেগুলো ট্রায়ালের পর্যায় থেকে ৯০-৯৫% কার্যকর হিসেবে ঘোষণা দিয়ে মানুষকে আশ্বস্ত করতে দেখা যাচ্ছে। সেগুলোও বিশ্বে প্রায় সাতশ কোটি মানুষের কাছে পৌঁছাতে কতদিন লাগবে তা সময়েই বলে দেবে।
তবে আশায় বুক বেধেইতো মানুষ বেঁচে থাকে। আমাদেরও সেভাবেই অপেক্ষা করা ছাড়া গত্যান্তর নেই। তবে করোনা ভাইরাস থেকে রক্ষা পেতে হলে আমাদের নিয়মতান্ত্রিক সতর্কতার বিকল্প নেই। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অনেক কিছুই শিক্ষণীয় থাকে। সম্প্রতি করোনা সতর্কতায় অন্যতম রক্ষাকবচ হিসেবে মাস্ক পরা নিয়ে একটি পোস্ট ভাইরাল হয়েছে। সেখানে তিনটি অসাবধানতার কথা উল্লেখ করে সে বিষয়ে সতর্ক হওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।
ধারাবাহিক কয়েকটি ছবি দিয়ে সেখানে লেখা রয়েছে, ‘যে প্রচলিত ভুলে করোনা দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে আমাদের মাঝে সেই প্রচলিত তিনটি ভুল হলো- ১) এরা আমার সহকর্মী আমি তাদের সাথে মাস্ক ছাড়াই কথা বলতে পারি, ২) এরা আমার ঘনিষ্ট বন্ধু তাদের সাথে মাস্ক ব্যবহার ও শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখার প্রয়োজন নেই এবং ৩) উনারা আমার আত্মীয়, তাদের সাথে মাস্ক ছাড়াই মেলামেশা করা যায়। আরো বলা হয়েছে, উপরের তিনটি ভুল করা থেকে বিরত থাকুন, সঠিকভাবে মাস্ক পরুন, নিজে বাঁচুন এবং সমাজকে রক্ষা করুন। কাজেই আমরা দেখেছি একসময় মসজিদসহ ধর্মীয় উপাসনালয়গুলোতেও সীমিত পরিসরে প্রার্থনা করা হয়েছে। কিন্তু পরবর্তীতে মাস্ককে বাধ্যতামূলক করে সেসব স্থানে পুনরায় স্বাভাবিকতার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।
আমরা ষ্পষ্টতই দেখতে পাচ্ছি বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মতো আমাদের বাংলাদেশেও দি¦তীয় ঢেউয়ের তরঙ্গ প্রতীয়মান হচ্ছে। বিগত একবছরের অভিজ্ঞতা দিয়ে এখন আগামীদিনে দ্বিতীয়, তৃতীয় ইত্যাদি যত ঢেউই আসুক না কেন তা সচেতনতার সাথে মোকাবেলা করতে হবে। এটি তো পরিষ্কার যে বিশ্বের অন্য যেকোন দেশের তুলনায় আমাদের বাংলাদেশে আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা কম। সেটি আমাদের জন্য স্বস্তি বয়ে আনলেও তার অত্মতুষ্টি নিয়ে আমাদের অসতর্কভাবে বসে থাকার সুযোগ নেই। কাজেই মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দেওয়া স্লোগান- ‘নো মাস্ক নো সার্ভিস’ মেনে নিয়ে সকল মহলে তা প্রতিপালন করে নিজেও সুরক্ষিত থাকি, পরিবার-পরিজন, পাড়া-প্রতিবেশি, আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব সকলকেই সুরক্ষিত রেখে গোটা দেশকে সুরক্ষিত করি। কারণ অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে হলে এর বিকল্প নেই।
লেখক: ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়
email: [email protected]
বহুমাত্রিক.কম