Bahumatrik | বহুমাত্রিক

সরকার নিবন্ধিত বিশেষায়িত অনলাইন গণমাধ্যম

চৈত্র ৪ ১৪৩০, মঙ্গলবার ১৯ মার্চ ২০২৪

করোনার ক্ষতি পোষাতে ধানের মুড়ি ফসল

ড. মো. হুমায়ুন কবীর

প্রকাশিত: ২৩:৪৮, ১২ মে ২০২০

প্রিন্ট:

করোনার ক্ষতি পোষাতে ধানের মুড়ি ফসল

চলছে করোনাকাল। বিশ্বজুড়ে সকল কিছু তছনছ করে দিয়েছে এ মারণব্যাধি করোনা। ইতোমধ্যে জাতিসংঘ ও বিশ্ব খাদ্য সংস্থাসহ আরো অনেক প্রতিষ্ঠান ভবিষ্যদ্বাণী করেছে একটি সমূহ দুর্ভিক্ষের। করোনার জন্য বিশ্বের বিভিন্ন দেশে কাংখিত খাদ্য উৎপাদন বন্ধ থাকার কারণে অনেক দেশ তাদের খাদ্য রপ্তানি বন্ধ করে দিয়েছে। প্রধান খাদ্য হিসেবে চাল, গম ও ভূট্টা উৎপাদনে সবচেয়ে বেশি সমস্যা দেখা দেওয়ায়- এ ফসলগুলোই খাদ্য নিরাপত্তায় প্রভাব ফেলবে বেশি। এসব বিষয়ে অধিকতর খাদ্য নিরাপত্তার স্বার্থে যেকোনভাবেই হোক খাদ্য উৎপাদনের জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছে গোটা বিশ্ব।

বাংলাদেশ এক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা নিতে পারে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশের প্রতিটি কৃষি পরিবারে যাতে এক ইঞ্চি জমিও অনাবাদি না রাখার এবং যে যেখানে পারে সেখানেই শাক সবজিসহ অন্যান্য সকল প্রয়োজনীয় ফসল আবাদ করার পরামর্শ প্রদান করেছেন। কারণ তিনি বলেছেন যে আমাদের দেশের মাটির গুণাগুণ ও আবহাওয়া কৃষিফসল উৎপাদনের জন্য খুবই উপযোগি। যেখানেই বীজ পুতে রাখা হয় সেখানেই গাছ গজিয়ে কোন না কোন ফসল ফলে যায়। পৃথিবীর অনেক দেশেই সেটি সম্ভব নয়।

তারমধ্যে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ ছিল এবারে (২০২০) হাওরের বোরোধান মাড়াই। আল্লাহর অশেষ রহমতে সরকারি বিভিন্ন সফল ও সময়োপযোগি উদ্যোগে সেটি ভালোভাবে শতভাগ মাড়াই করা সম্ভব হয়েছে। এখন চ্যালেঞ্জ চলছে সারাদেশের বোরোধান সংগ্রহের। করোনার এ প্রাদুর্ভাবের সময় এমনিতেই কৃষি শ্রমিকের সমস্যা এবং পাশাপাশি উৎপাদিত পণ্যের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত না হওয়ায় কৃষকের কাছে কোন নগদ অর্থ নেই। তবে আশার কথা দেশের ধান ফসলের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বোরো মৌসুমে বাম্পার ফলন হয়েছে এবং হাওরের মতো যদি সারাদেশের ধানগুলো সময়মতো কোন প্রাকৃতিক দুর্যোগ ছাড়াই মাড়াই করা যায় তবে আগামী ছয় থেকে আট মাসের খাবারের কোন সমস্যা নেই।

তাহলে বাকী থাকে বছরের অন্য ফসলগুলো সঠিকভাবে আবাদ করা এবং সময়মতো ঘরে তোলা। সেইসাথে ধান, গম, ভূট্টা ব্যতিত অন্যান্য ফসলগুলি বিপণন করে কৃষক যাতে সঠিক মূল্য পেতে পারে সেদিকে খেয়াল রাখার প্রয়োজন। কৃষিঋণসহ সেচ, সার, বীজ, মাড়াই যন্ত্র, সরাসরি কৃষকের নিকট থেকে সরকারি ক্রয় ইত্যাদি ক্ষেত্রে প্রণোদনা প্রদানের বিষয়টি এক্ষেত্রে বেশ কাজে আসবে। বোরোর পরে অন্য ফসল বলতে মূলত আউস ধানের আবাদকে বোঝায়। আমরা জানি বাংলাদেশে বোরো ধানের আবাদ বৃদ্ধি পাওয়ার সাথে সাথে আউসের আবাদ কমে গিয়েছে। এখন কৃষকদেরকে প্রণোদনা দিয়ে আউস আবাদ করানো হয়ে থাকে। সরকারের তরফ থেকে এবছর (২০২০) আউসের জন্য প্রণোদনা আরো বাড়িয়ে দিয়ে বেশি লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে।

স্বল্প সময়ে স্বল্প খরচে কিছু ধান উৎপাদনের জন্য ধানের মুড়ি ফসলের চাষ একসময় বাংলাদেশেও বেশ জনপ্রিয় ছিল। তখন অবশ্য বাণিজ্যিক কিংবা বৈজ্ঞানিকভাবে তা আবাদ করা হতো না। মৌসুমের মূল ধান ফসল কেটে নেওয়ার পর যে নাড়ার মুথা থেকে যেতো সেখান থেকে আবা চারা গজিয়ে স্বল্প সময়ে কিছু ধান উৎপাদিত হতো। অনেক সময় গরু,ছাগল, মহিষের খাবারের জন্যও এভাবে মুড়ি ধান বৃদ্ধি করা হয়ে থাকে। আসলে মুড়ি ফসলের কথা উঠলেই মনে হয় এটা আবার কি! কিন্তু এটা নতুন কোন পদ্ধতি বা প্রযুক্তি নয়। ছোটবেলা থেকেই গ্রামীণ ট্র্যাডিশন হিসেবে ধানের মুড়ি ফসলের আবাদ হয়ে আসছে। অর্থাৎ মূল ধান ফসল কেটে নেওয়ার পর সেটিকে নষ্ট না করে একটু যতেœর আওতায় নিয়ে আসলেই হয়ে গেল মুড়ি ধান আবাদ। এটিকে ইংরেজিতে Ratoon cultivation বলা হয়ে থাকে। আখসহ আরো কিছু বহু বর্ষজীবি ফসল এমনভাবে আবাদ করা হয়ে থাকে।

বিশ্বের বিভিন্ন ধান উৎপাদনকারী দেশ যেমন চীন, ভারত, ফিলিপাইন, ভিয়েতনাম, জাপান, থাইল্যান্ড ইত্যাদি দেশ সময় ও খরচ বাঁচাতে প্রায়শই মুড়ি ধানের আবাদ করে থাকে। আমরা এ করোনা সময়ে যেসব জমিতে আউস আবাদ করবো তো করবোই সেখানে কোন কথা নেই। কিন্তু যেসব জমির বোরোধান কেটে নেওয়ার পর আর আউস আবাদ করবো না সেখানে পরবর্তীতে আমন আবাদ করার জন্য জমি রেখে দেবো। সেখানে মুড়ি আউস ধানের আবাদ অতি সহজেই করতে পারি। ধরা যাক যদি ১৫ মে তারিখে কোন জমির বোরোধান কাটা শেষ হলো এবং সেই জমিতে পরের আমন ছাড়া আর আউস আবাদ হচ্ছেনা। এমন জমিকে সহজেই আমরা আউসের মুড়িধান আবাদের জন্য নির্বাচন করে রেখে দিতে পারি।

বোরধান কাটার পর সেখানে কোন গরু-ছাগল যাতে জমিতে না ঢুকে সেব্যবস্থা নিতে হবে। কারণ ধরেই নেওয়া হয়, যে জমির বোরো ধান কেটে নেওয়া হয়েছে এবং আমন ছাড়া আর কোন ফসল এতে আবাদ করা হবেনা অর্থাৎ পতিত থাকবে। সেখানে মানুষ গোচারণ ভূমি বানিয়ে ফেলে। সেজন্য লাল নিশান, বাঁশের কঞ্চিসহ আগা অথবা যেকোন ধরনের চিহ্ন দিয়ে বুঝানো- এ জমিটি মুড়ি হিসেবে সংরক্ষণ করা হয়েছে। তখন আর কেউই সেটা নষ্ট করবেনা। যদি সেই জমিতে ১৫ জুলাই তারিখ বা তারপর আমন ধান রোপন করা হয় তবে ১৫ মে থেকে ১৫ জুলাই পর্যন্ত দুমাস সময় পাওয়া যাবে। এ দুমাস সময় বোরো ধানের রেখে দেওয়া মুথা থেকে মুড়ি আউস উৎপাদন খুব সহজেই সম্ভব।

প্রথমে এক থেকে দুসপ্তাহের মধ্যেই সেই জমিতে বোরোধানের রেখে দেওয়া নাড়ার গোঁড়া থেকে চারা গজিয়ে বড় হতে থাকবে। অতঃপর ভালভাবে চারাগুলো গজিয়ে শেষ হলে প্রয়োজনে একটু পানি রাখতে হবে। পানি না থাকলে একটু সেচ দেওয়া যেতে পারে। সেই দুই সপ্তাহের চারাধানের উপর প্রতি একরে ২৫-৩০ কেজি হারে শুধু ইউরিয়া সার প্রয়োগ করা যেতে পারে। আরো দুই সপ্তাহ পর থেকে শীষ বের হবে যা আরো দুই-তিন সপ্তাহে পরিপক্ক হবে। অর্থাৎ শুরু থেকে পুরো প্রক্রিয়াটি সম্পন্ন করতে মোট সময় লাগবে সর্বোচ্চ দুইমাস। এতে একরে ২০ থেকে ২৫ মণ পর্যন্ত ধান উৎপাদনের সম্ভাবনা রয়েছে। কাজেই স্বল্প সময়ে স্বল্প খরচে পতিত জমিতে এ ধান উৎপাদন আমাদের জাতীয় উৎপাদনকে আরো বাড়িয়ে দিতে পারে।

এ পদ্ধতি যে শুধু বোরো মৌসুমেই সম্ভব তা নয়। একই পদ্ধতি অনুসরণ করে আমন ধান কাটার পরেও পুনরায় বোরো আবাদ শুরু করার পূর্ব পর্যন্ত মুড়ি কিংবা রিলে বা সাথি ফসল আবাদ করে মোট উৎপাদন বৃদ্ধি করা যেতে পারে। এভাবেই বিভিন্ন প্রযুক্তি ও পদ্ধতি ব্যবহার করে আমাদেও উৎপাদন যত বাড়ানো যাবে ততই আমরা নিজেদেও খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করে বাড়তি অংশ বিদেশে রপ্তানি করা যাবে। আর এটি যে শুধু বাণিজ্যিক চিন্তাভাবনা তা নয়। এটা হতে পারে মানবিকও। কারণ টাকা থাকলেই খাদ্য না থাকলে কেউ খাবার কিনতে পারবেনা। কাজেই এ কাজে আমাদের যা সুযোগ আছে তার সবটুকুই ব্যবহার এখন সময়ের দাবি।

লেখক: কৃষিবিদ ও ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়
email: [email protected] 

বহুমাত্রিক.কম

Walton Refrigerator Freezer
Walton Refrigerator Freezer