Bahumatrik | বহুমাত্রিক

সরকার নিবন্ধিত বিশেষায়িত অনলাইন গণমাধ্যম

চৈত্র ১৩ ১৪৩০, শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪

করোনাযুদ্ধে কৃষি কর্মীরাও সম্মুখযোদ্ধা

ড. মো. হুমায়ুন কবীর

প্রকাশিত: ১৫:৪৯, ২৯ আগস্ট ২০২০

আপডেট: ১৫:৫০, ২৯ আগস্ট ২০২০

প্রিন্ট:

করোনাযুদ্ধে কৃষি কর্মীরাও সম্মুখযোদ্ধা

ফাইল ছবি

করোনাকালে করোনা মহামারিকে প্রতিরোধ, দমন, নিরাময়, সচেতনতা সৃষ্টি, চিকিৎসা সেবা প্রদান, সচেতনতা সৃষ্টির জন্য আইন প্রয়োগ, সরবরাহ চেইন নিশ্চিত রাখা, খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, উৎপাদন সমুন্নত রাখা ইত্যাদি কাজের জন্য সম্মুখ পানে থেকে যারা যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছেন তাদের সবাইকেই সম্মুখ সারির করোনাযোদ্ধা বলা হচ্ছে।

এখানে সবচেয়ে প্রথম সারির যোদ্ধা হলেন চিকিৎসক, নার্স, স্বাস্থ্যকর্মী, মেডিক্যাল টেকনোলজিস্টসহ স্বাস্থ্যখাতের সকল কর্মীবৃন্দ- তাতে কোন সন্দেহ নেই। কারণ তারা সরাসরি ছোঁয়াচে এ কোভিড-১৯ মহামারি রোগের নিরন্তর চিকিৎসা দিয়ে যাচ্ছেন।

আমরা গণমাধ্যমের কল্যাণে যেখানে দেখতে পাচ্ছি বাবা ছেলেকে, ছেলে বাবা-মাকে, এবং নিকট আত্মীয়রা তাদের কোভিড-১৯ আক্রান্ত রোগীদের রাস্তায় ফেলে চলে যাচ্ছে। আবার কোভিড আক্রান্ত হয়ে মারা যাওয়ার পর শেষকৃত্য বা সৎকার কিংবা সমাহিত করতে আসছে না কেউ। উপরন্তু লাশের ওয়ারিশ পর্যন্ত স্বীকার করছে না। সেখানে স্বাস্থ্যকর্মীগণসহ সরকারি প্রশাসন ও নিরাপত্তা কাজে নিয়োজিত ব্যক্তিবর্গ নিজ দায়িত্বে সেসব মৃতদেহের সৎকার করছেন। আমরা দেখতে পাচ্ছি এ কাজে এগিয়ে আসছে স্বেচ্ছাসেবী কিছু সংগঠনও।

তারপরে যারা সম্মুখযোদ্ধা হিসেবে কাজ করছেন তারা হলেন দেশের আইনশৃঙ্খলা/শান্তিশৃঙ্খলা বাহিনীর গর্বিত সদস্যবৃন্দ। সশস্ত্র বাহিনী, পুলিশ, র‌্যাব, বিজিবি, আনসার- প্রত্যেকে তাদের নিজ নিজ জায়গায় থেকে সর্বোচ্চ সহযোগিতার হাত সম্প্রসারিত করে চলেছেন। রয়েছে গণমাধ্যম কমীবৃন্দও। কারণ তারা সবচেয়ে কঠোর লক ডাউনের ভিতর দিয়েও সংবাদ সংগ্রহ করেছে। দীর্ঘ সময় ধরে থাকা করোনাযুদ্ধে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ঘরবন্দী মানুষকে সর্বশেষ খবরটি এনে দিয়েছেন। ঘরে থাকার জন্য বিনোদনেরও ব্যবস্থা করে চলেছেন তারা। এতে করে সেসব স্বাস্থ্যকর্মী, আইনশৃঙ্খলা/শান্তিশৃঙ্খলা বাহিনী এবং গণমাধ্যমকর্মীসহ সম্মুখযোদ্ধা বীর সদস্যদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন। অনেকে মৃত্যুবরণ করেছেন, অনেকে মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ছেন, অনেকে চিকিৎসাধীন রয়েছেন। স্যালুট সকল সম্মুখযোদ্ধাদের।

এটিকে যেহেতু একটি যুদ্ধের সাথে তুলনা করা হচ্ছে, সেখানে মৃতদেরকে শহীদী মর্যাদা এবং বেঁচে যাওয়াদের করোনাযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া প্রয়োজন।

এ করোনাযুদ্ধে কৃষিকর্মীদের অবদান কোন অংশে কম নয়। কৃষিকর্মী বলতে এখানে আমি কৃষিবিদ (কৃষি, মৎস্য, প্রাণিসম্পদসহ সরকারি ও বেসরকারি সংস্থায় মাঠে ও গবেষণায় কর্মরত সকল পর্যায়ের কৃষিবিদদেরকে বোঝানো হয়েছে), ডিপ্লোমা কৃষিবিদ (কৃষি, মৎস্য, প্রাণিসম্পদসহ সরকারি ও বেসরকারি সংস্থায় মাঠে ও গবেষণায় কর্মরত সকল পর্যায়ের ডিপ্লোমা কৃষিবিদদেরকে বোঝানো হয়েছে), কৃষির সাথে সংশ্লিষ্ট সকল কর্মীবৃন্দ, বাংলার আপামর সাধারণ কৃষককুল খাদ্য নিরাপত্তায় সম্মুখ সারির করোনাযোদ্ধা।

কারণ ৮ মার্চ বাংলাদেশে প্রথম করোনা রোগী শনাক্ত হওয়ার পর থেকে এখন পর্যন্ত প্রায় ছয়মাসে করোনা পরিস্থিতি ভালোর দিকে যায়নি। সারাবিশ্বের কোন কোন দেশে একবার ভালো পরিস্থিতির পরে আবারও দ্বিতীয় দফা আক্রমণ দেখা দিচ্ছে। ইতোমধ্যে বিশ্বে প্রায় আড়াই কোটি মানুষ করোনায় আক্রান্ত হয়েছে। মৃত্যুবরণ করেছে প্রায় সাড়ে আট লাখ মানুষ। তারই ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশে এখন মোট আক্রান্ত তিন লাখ ছাড়িয়েছে এবং মৃত্যুর সংখ্যাও এখন চার হাজার ছাড়িয়েছে। আর মৃত্যুর হারও এখন বেড়ে চলেছে।

আমরা দেখেছি করোনাকালের এ ছয়টি মাস দেশে কোন খাদ্য নিরাপত্তাজনিত সমস্যা সৃষ্টি হয়নি। এরমধ্যে দুটি ঈদ গিয়েছে। আম্ফান নামের একটি ভয়াবহ ঘুর্ণিঝড়, একটি বড় ধরনের বন্যা সামাল দিতে হয়েছে এ দেশের মানুষকে, সরকারকে। এরপরও কিন্তু খাদ্য সরবরাহ ও মূল্য স্বাভাবিক ছিল। সেইসাথে কোভিড রোগ না হওয়ার জন্য শরীরে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা সৃষ্টির যেসকল খাদ্য অর্থাৎ বেশি পরিমাণে পুষ্টিকর খাবার যথা- মাছ, মাংস, ডিম, দুধ, ফল-মূল, শাক-সবজি, লেবুজাতীয় ভিটামিন-সি ইত্যাদির উৎপাদন ও সরবরাহ সম্পূর্ণ স্বাভাবিক থেকেছে। এর পিছনে কারা রয়েছে তা আমাদের আর নতুন করে মনে করিয়ে দেওয়ার প্রয়োজন নেই। নিসেন্দেহে তারা হলেন কৃষিকর্মীগণ।

আমরা জানি বাংলাদেশ একটি কৃষিপ্রধান দেশ। এদেশে বর্তমানে সরাসরি কৃষিকাজের সাথে জড়িত এমন লোকের সংখ্যা মোট জনসংখ্যার প্রায় ৪৩ শতাংশ। খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও) সহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশ ধারণা করছে বিশ্বজুড়ে করোনার কারণে যে সঙ্কট সৃষ্টি হবে তার প্রাথমিক ধাক্কাটা আসবে খাদ্য নিরাপত্তার উপর। আর সেটির কারণে বিশ্বে বিরাট খাদ্য ঘাটতিই শুধু নয়, দেখা দিতে পারে ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ।

বিশ্ব ইতিহাস পর্যালোচনা করলে এমন দুর্যোগের পরে খাদ্যাভাব ও দুর্ভিক্ষ নিত্য নৈমিত্তিক হিসেবে দেখা দেয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে দুর্ভিক্ষ সংঘটিত হয়েছিল যা আমরা সবাই জানি। বস্তুত এ করোনার প্রাদুর্ভাবকে একটি যুদ্ধ হিসেবে বিবেচনা করে এটিতে তৃতীয় বিশ^যুদ্ধ বলে মনে করছেন অনেকে। আর এ যুদ্ধের ফলে খাদ্য সঙ্কট সৃষ্টি এবং দুর্ভিক্ষ মোকাবিলায় কৃষিই একমাত্র ভরসা। বাংলাদেশে বর্তমানে কৃষির যে অবস্থা সেটিকে সঠিকভাবে এগিয়ে নিতে পারলে তা দিয়ে আমাদের দেশের দুর্ভিক্ষ তো বটেই, উপরন্তু আরো পাশর্^বর্তী অনেক দেশকে সহযোগিতা করা যাবে। আর এ কাজটি অত্যন্ত সুচারুরূপে করে চলেছেন আমাদের কৃষিকর্মীবৃন্দ।

আমাদের দেশটি সুজলা সুফলা শস্য শ্যামলা। কৃষির জন্য এর মাটি, জল, আবহাওয়া খুবই উপযোগি। সেজন্য দেশের স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু মনে করতেন এবং এখন তাঁরই কন্যা কৃষকরতœ শেখ হাসিনাও তাই মনে করেন। তিনি তাঁর বিভিন্ন বক্তব্যে বলেছেন সে কথা। বাংলাদেশের এমন উর্বর মাটিই হতে পারে এসময়ে আমাদের জন্য আশীর্বাদ। এটি উপলব্ধি করেই মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আমাদের দেশের চলমান বর্তমান কৃষি উৎপাদন অব্যাহত রাখতে তাদের কথা মাথায় রেখে বিভিন্ন কৃষিবান্ধব কর্মসূচি গ্রহণ করেছেন। কোন কৃষিজমি পতিত না রাখার পরামর্শ দিয়েছেন তিনি। আর সেটি বাস্তবায়ন করে চলেছেন আমাদের কৃষিকর্মীবৃন্দ। কারণ করোনাকালের প্রথম দিকে হাওরসহ সারাদেশের বোরো ধান মাড়াই করে ঘরে তোলা ছিল একটি বড় চ্যালেঞ্জ। সরকারি সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে অন্যান্যদের মতো কৃষি কর্মীরাও ঝাঁপিয়ে পড়ে সেসব কাজে। এরপর আউস ধান তোলা এবং রোপা আমন রোপন করাসহ সারাবছর শাকসবজি উৎপাদন তো রয়েছেই।

যদিও মৃত্যুর হারের দিক থেকে অন্যান্য দেশের তুলনায় আমাদের দেশে তা খুবই কম। কিন্তু কৃষি কমিউিনিটিতে সেই হার অনেক বেশি। একটি পরিসংখ্যান দিলেই তা একটু পরিষ্কার হবে। কৃষিবিদগণের মধ্যে আক্রান্ত, চিকিৎসাধীন, সুস্থ ও মৃত্যু সংক্রান্ত একটি প্রতিবেদন কৃষিবিদদের প্রাণের পেশাজীবী সংগঠন ‘কৃষিবিদ ইনস্টিটিউশন বাংলাদেশ (কেআইবি)’ থেকে প্রতিদিন প্রকাশ করা হয়ে থাকে। সেখানে ২৭ আগস্ট ২০২০ পর্যন্ত প্রাপ্ত তথ্যে দেখা যায়- মোট আক্রান্ত কৃষিবিদ-২৯০ জন, আরোগ্য লাভ-২২৮ জন, মৃত্যু-২৪ জন এবং চিকিৎসাধীন-৩৮ জন। এখানে দেখা যায়, আক্রান্ত বিবেচনায় মৃত্যুর হার প্রায় ৮.২৮%। অন্যান্য পেশাজীবীদের পরিসংখ্যান আমার কাছে না থাকায় তুলনা করতে না পারলেও দেশের সাধারণ মৃত্যুহারের (১.৩৬%, ২৮/০৮/২০২০) তুলনায় তা অনেক বেশি। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক, বিএডিসির চেয়ারম্যানসহ প্রশাসন, ব্যাংক-বীমার অনেক উর্ধ্বতন ব্যক্তিবর্গ করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন এবং তারমধ্যে অনেকে মৃত্যুবরণও করেছেন। প্রণতি জানাই তাঁদের প্রতি।

করোনার ভয়াল থাবা থেকে সহজেই দেশ এবং দেশের অর্থনীতি নিস্কৃতি পাবে এমনটি আশা করা কঠিন। সাধারণ একটি বন্যা হলেও সেটিকে পুনর্বাসন করতে অনেকবছর সময় লেগে যায়। সেকাজ করতে কৃষিকর্মীদের গলদঘর্ম হয়ে যেতে হয়। কাজেই করোনাকালে সাধিত কৃষি অর্থনৈতিক ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়ার জন্য অনেক দীর্ঘ সময় পাড়ি দিতে হবে।

যেহেতু বাংলাদেশের অর্থনীতি কৃষিপ্রধান, সেজন্য এ খাতকেই আগামীতে শক্তিশালী করতে হবে। সেটি করতে গেলে কৃষি কর্মীদেরকে ব্যাপকভাবে কাজে লাগাতে হবে। সবক্ষেত্রেই জনবল সংকট রয়েছে। কৃষির ক্ষেত্রগুলোও এর বাইরে নয়। আমরা দেখেছি স্বাস্থ্য বিভাগের কর্মী সংকট কিছুটা হলেও লাগব করার জন্য করোনাকালে তাৎক্ষণিক অনেক ডাক্তার, নার্স, মেডিক্যাল টেকনোলজিস্টসহ অনেক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। অধিক স্বাস্থ্যঝুঁকি থাকায় তাদের জন্য আলাদাভাবে ঘোষণা করা হয়েছে প্রণোদনা প্যাকেজ।

কৃষিকে সামনে দাঁড় করাতে হলে এ খাতের জনবল সঙ্কট নিরসন করতে হবে। সেজন্য এ খাতে অনেক বেকার রয়েছে। তাদেরকেও করোনা মোকাবেলায় বিশেষভাবে কাজে লাগানোর জন্য বেকার কৃষিকর্মীদেরকে তাৎক্ষণিক ও জরুরিভিত্তিতে চাকুরি দিয়ে মাঠে নামানো দরকার। পাশাপাশি সম্মুখযোদ্ধা হিসেবে অন্যান্যদের ন্যায় কৃষিকর্মীদের জন্যও বিশেষ প্রণোদনার ব্যবস্থা নিতে হবে। তাহলে একদিকে যেমন বেকার সমস্যার সমাধান হবে। অন্যদিকে প্রণোদনা পেলে পারিবারিক নিরাপত্তা নিশ্চিত হবে বিধায় তারা করোনাকালে ক্ষতি হয়ে যাওয়া কৃষিকে পুণরুদ্ধারে ঝাঁপিয়ে পড়বে।

বর্তমানে কৃষিবান্ধব গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের কৃষি মন্ত্রণালয়ে মন্ত্রীর দায়িত্বে রয়েছেন একজন প্রথিতযথা কৃষিবিজ্ঞানী ও কৃষিবিদ ড. মো. আব্দুর রাজ্জাক এমপি এবং সরকার দলীয় বাংলাদেশ আওয়ামীলীগে গুরুত্বপূর্ণ যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্বে রয়েছেন কৃষিবিদ আফম বাহাউদ্দিন নাছিম। রয়েছেন কৃষকলীগের সভাপতি কৃষিবিদ সমীর চন্দসহ আরো অনেকে। তারা হয়তো নিশ্চয়ই এমন করেই ভাবছেন যা আগামীতে বাস্তবে দেখতে পাবো বলে আশা রাখি।

লেখক: কৃষিবিদ ও ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়
email: [email protected]

বহুমাত্রিক.কম

Walton Refrigerator Freezer
Walton Refrigerator Freezer