Bahumatrik | বহুমাত্রিক

সরকার নিবন্ধিত বিশেষায়িত অনলাইন গণমাধ্যম

বৈশাখ ১১ ১৪৩১, শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪

করোনাকালের লেখাপড়া ও শিক্ষার্থীদের মানসিক অবস্থা

ড. মো. হুমায়ুন কবীর

প্রকাশিত: ২১:৪৫, ২৯ অক্টোবর ২০২০

আপডেট: ০০:৩৪, ৩০ অক্টোবর ২০২০

প্রিন্ট:

করোনাকালের লেখাপড়া ও শিক্ষার্থীদের মানসিক অবস্থা

ছবি- সংগৃহীত

চলছে করোনাকাল। করোনা ভাইরাল ডিজিজ যা ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে প্রথমে চীনে সনাক্ত হওয়ার কারণে এটি কোভিড-১৯ হিসেবে সারাবিশ্বে পরিচিতি লাভ করেছে। শুধু কী পরিচিতি লাভ করেছে! এটি এখন সারাবিশ্বের একটি আতঙ্ক হিসেবে মানবজাতিকে পঙ্গু করে দিয়েছে।

এ পর্যন্ত সারাবিশ্বে করোনায় সনাক্তের সংখ্যা প্রায় চার কোটি পঁচিশ লাখের অধিক লোক যার মধ্যে মৃত্যুবরণ করেছে প্রায় সাড়ে এগারো লক্ষের অধিক মানুষ। বাংলাদেশে এ পর্যন্ত সনাক্ত প্রায় চার লাখ ছাড়িয়েছে এবং মৃতের সংখ্যা প্রায় ছয় হাজার। আর দিনদিন তা বেড়েই চলেছে।

চীনে প্রথমে সনাক্ত হওয়ার পর থেকে দেশে দেশে বিভিন্ন বয়সের নারী পুরুষ আক্রান্ত হচ্ছে। কিন্তু প্রত্যেকটি দেশেই কোভিড-১৯ এর রোগীর সংখ্যা বাড়ার উপর ভিত্তি করে সেসব দেশের অফিস, আদালত, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে কখনো আংশিক আবার কখনো পুরো লকডাউনের আওতায় নিয়ে যাওয়া হয়।

বাংলাদেশে প্রথম ৮ মার্চ তিনজন করোনা রোগী সনাক্ত হয়। বাংলাদেশে ১৮ মার্চ থেকে লকডাউনের মাধ্যমে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসহ সকল কিছু বন্ধ করে দেয়া হয়েছিল। তারই ধারাবাহিকতায় আমাদের নিকট চলতি ১৪ নভেম্বর ২০২০ তারিখ পর্যন্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ছুটির নোটিশ রয়েছে।

এখানে করোনাকাল শুরুর দিককার কিছু বিষয় তুলে ধরতে চাই। আমরা জানি বাংলাদেশে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ে পহেলা জানুয়ারি থেকে শিক্ষাবর্ষ শুরু হয়ে থাকে। বর্তমান সরকার বছরের প্রথমদিন শিক্ষার্থীদের হাতে নতুন পাঠ্যবই তুলে দিয়ে শিক্ষাবর্ষের শুভসূচনা করে থাকে। উচ্চ মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহেও (বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে) জানুয়ারি থেকে সর্বোচ্চ মার্চ, এপ্রিল, মে মাসের দিকে সেসন শুরু হয়ে যায়। আবার এ সরকারের আমলে শিক্ষাকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে সেসন জট কমানোর অংশ হিসেবে পিইসি, জেএসসি, মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক এবং তাদের সমমান পাবলিক পরীক্ষা সমূহের তারিখসহ রুটিন আগেই নির্ধারিত থাকতো।

তাই বরাবরের মতো এ বছরের (২০১৯) শেষদিকে নভেম্বর, ডিসেম্বর, ফেব্রয়ারি মাসে যথাক্রমে পিইসি, জেএসসি, মাধ্যমিক এবং তাদের সমমান পরীক্ষাসমূহ নির্ধারিত সময়ে অনষ্ঠিত হতে পারলেও উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা সংঘটিত হতে পারেনি।

উচ্চশিক্ষার জন্য মেডিক্যাল কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয সমূহের ভর্তি পরীক্ষাগুলো হতে পারলেও এবং তারপর ক্লাস শুরু করতে পারলেও নির্ধারিত সময়ে সেমিস্টার মধ্যবর্তী ও ফাইনাল পরীক্ষাগুলো হতে পারেনি। এতেকরে সকল পর্যায়ের শিক্ষার্থীরাই অনেক মানসিক চাপের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে।

স্কুল কলেজ এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা সাধারণত কখনোই বাসায় বসে থাকেনা। তাদের চঞ্চল মন। সারাক্ষণ এদিক-ওদিক ছুটা-ছুটি করে বেড়ানোই তাদের স্বভাব। সারাক্ষণই নিয়মিত প্রাতিষ্ঠানিক ক্লাস, পরীক্ষা, কোচিং, মডেল টেস্ট, ভর্তি পরীক্ষা, প্রাইভেট পড়া, পড়ানো, প্রাইভেট টিউশন করা, করানো- ইত্যাদি কার্যক্রমে সর্বদাই শিক্ষার্থীরা ব্যস্ত থাকতো। কিন্তু এখন এর সবই বন্ধ রয়েছে। সেজন্য শিক্ষার্থীরা হতভম্ব ও কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়েছে। দিশেহারা হয়ে পড়েছে তাদের ভবিষ্যৎ ভাবনায়।

শুরুর দিকে করোনার আতঙ্কের মধ্যেও শিক্ষার্থীদের মধ্যে লেখাপড়ার বাইরে থাকতে পেরে অনেক খুশি হয়েছিল তারা। কিন্তু দিন বাড়ার সাথে সাথে এখন তাদের আর ভাল লাগছেনা। তারা না পারছে কোথাও বেড়াতে যেতে, না পারছে বন্ধু-বান্ধব ও সহপাঠীদের সাথে মিশে সময় কাটাতে। সেজন্য তারা একঘুয়ে ও বোরিং হয়ে পড়ছে।

তবে সরকারি নির্দেশে সব না হলেও কোন কোন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান অনলাইন ভিত্তিক ক্লাস নেওয়া শুরু করেছে। তবে এর সুবিধার চেয়ে অসুবিধাই বেশি পরিলক্ষিত হচ্ছে। এখন অবশ্য অনলাইন ক্লাসের বাইরে আর কোন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নেই। ডিজিটাল প্রযুক্তির কল্যাণে গ্রামীণ পর্যায়ের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানও এখন অনলাইন ক্লাসের আওতায় চলে এসেছে।

স্বাস্থ্যবিধি মেনে জুম অ্যাপ, গুগল মিট, বিডিরেনসহ আরো অনেক অ্যাপের মাধ্যমে এসব অনলাইন কার্যক্রম পরিচালিত হয়ে আসছে। কোন কোন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এখন অনলাইন ক্লাসের পাশাপাশি সীমিত আকারে কুইজভিত্তিক মূল্যায়ন হিসেবে পরীক্ষাও শুরু করেছে। আমরা দেখতে পাচ্ছি ইতোমধ্যে সরকার এইচএসসি পরীক্ষার বিশেষ পদ্ধতিতে ফলাফল প্রকাশের পাশাপাশি মাধ্যমিক পর্যায়ে বিশেষভাবে মূল্যায়নের ভিত্তিতে অটো প্রমোশন দেওয়ার নির্দেশনা জারি করেছে।

অনলাইন ক্লাস একদিকে যেমন স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদেরকে আধুনিক ডিজিটাল ডিভাইস হিসেবে স্মার্টফোন, ল্যাপটপ, ডেস্কটপ কম্পিউটার ব্যবহারে অভ্যস্ত হচ্ছে, অপরদিকে তারা এসব ডিজিটাল ডিভাইসে আসক্ত হয়ে পড়ছে। এটি একদিকে সুবিধা এবং অপরদিকে অসুবিধা। সুবিধা হলো- সবাই এসব ডিজিটাল ডিভাইসে অভ্যস্ত হলে ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার উদ্যোগ আরো একধাপ এগিয়ে যাবে।

অপরদিকে শিক্ষার্থীরা তাদের প্রত্যেকের নিজ নিজ নামে ইমেইল আইডি, ফেসবুক আইডি খুলে চ্যাটিংয়ে নেশাগ্রস্থ হয়ে পড়ছে। অবসরের বেশিরভাগ সময় তারা এসব ডিভাইসে আটকে থাকছে। আর সকল অভিভাবকের সঙ্গতি একরকম নয়। সবার একটি স্মার্টফোন কিংবা ল্যাপটপ, ডেস্কটপ ক্রয়ের জন্য সঙ্গতি বা স্বচ্ছলত নেই। আবার এগুলো ক্রয়ের ব্যবস্থা করতে পারলেও নিরবিচ্ছিন্ন ইন্টারনেট ব্যবস্থা রাখা সম্ভব হচ্ছে না। এতে যাদের সঙ্গতি নেই তারা এসব সুযোগ সুবিধা হতে বঞ্চিত হচ্ছে। অর্থাৎ সকলের সমান অধিকারের বিষয়টি নিশ্চিত করা যাচ্ছে না। তাতে শিক্ষার্থীদের মধ্যে অনেকে মানসিকভাবে হতাশ হয়ে পড়ছে। সঙ্গতিহীনরা নিজেদেরকে ছোট ও বঞ্চিত মনে করে হীনমন্যতায় মানসিকভাবে কষ্ট পাচ্ছে।

তবে এটিও ঠিক, করোনার টীকা আবিষ্কার না হওয়া পর্যন্ত হয়তো আমাদেও করোনাকে নিয়েই বাঁচার চেষ্টা করতে হবে। আমাদের এখন এ পর্যায়ে এসে মনে হচ্ছে অন্য সবার মতো শিক্ষার্থীদেরকেও মানসিকভাবে করোনার ভিতর দিয়েই এভাবে চলার অভ্যাস গড়ে তোলার পরামর্শ দিতে হবে।

আমরা দেখতে পাচ্ছি আমাদের দেশের তুলনায় শীতের দেশগুলোতে করোনা মহামারির অবস্থা অনেক বেশি ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। আমাদের দেশেও সমানে শীতকাল আসছে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে প্রথমবার করোনার আক্রমণ সর্বোচ্চ সীমায় পৌঁছানোর পর দ্বিতীয় ঢেউ আসছে। সেই চিন্তাভাবনা থেকেই সামনে হয়তো কমপক্ষে এবছরের (২০২০) ডিসেম্বরের মধ্যে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলা নাও হতে পারে। কারণ সাধারণ মানুষের চলাফেরা আর শিক্ষার্থীদের চলাফেরা একরকম নয়। অপরদিকে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে করোনা কমে যাওয়ার পর শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়ার পর আবারো সনাক্তের হার বেড়ে যাওয়ায় তা আবারো বন্ধ করে দিতে বাধ্য হয়েছে। আর সেজন্যই হয়তো আমাদের দেশে এখনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলার সিদ্ধান্ত নিচ্ছে না।

এ করোনাকালে আমার নিজের বাসায় সবধরনের অভিজ্ঞতাই লক্ষ্য করছি। আমি উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান হিসেবে একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে কাজ করি। আমার স্ত্রী কাজ করেন একটি উচ্চ মাধ্যমিক ও ডিগ্রি পর্যায়ের কলেজে। আমার বড় ছেলে ক্যাডেট কলেজের মাধ্যমিক শাখার শিক্ষার্থী এবং ছোট ছেলে প্রাথমিক স্কুলের একজন শিক্ষার্থী।

আমার স্ত্রী কলেজ শিক্ষার্থীদের জন্য অতি যত্নসহকারে অনলাইন ক্লাস নিলেও শিক্ষার্থীরা কতটুকু উপকৃত হচ্ছে তা বুঝা কঠিন। কারণ আমিতো আমার নিজের দু সন্তানের অনলাইনে ক্লাস করার অভিজ্ঞতায় সমৃদ্ধ হচ্ছি। অপরদিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক জায়গা থেকে এ করোনাকালে শিক্ষার্থীদের মন-মানসিকতার আকুতি কিছুটা হলেও বুঝতে পারি।

তবে মন্দের ভালো যে শিক্ষার্থীদের অলস সময় কিছুটা হলেও কাজে লাগছে। তার উপর বিষয়টি শুধু যেহেতু আমাদের দেশের একার নয়। আর এমন পরিস্থিতি মোকাবেলার অভিজ্ঞাও আমাদের কারোর নেই। সেজন্য বিজ্ঞানী থর্ন ডাইকের প্রচেষ্টা ও ভ্রম সংশোধন (Trial and error) নীতির মাধ্যমেই এগুনো ছাড়া গত্যন্তর নেই।

তবে প্রত্যাশা করি যেন এমন পরিস্থিতি আর প্রলম্বিত না হয়। আর হলেও যেন তা আমরা কার্যকরভাবে মোকাবেলা করতে সে বিষয়েও গবেষণা পরিচালনা করা প্রয়োজন। এমনিভাবেই হয়তো আমরা অন্য মহামারির মতো করোনাকেও জয় করবো ইনশাল্লাহ। এমন প্রত্যাশার মাধ্যমেই আমাদের কোমলমতি শিক্ষার্থীদের মানসিক শক্তি ফিরে আসবে।

লেখক: ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়
email: [email protected]

বহুমাত্রিক.কম

Walton Refrigerator Freezer
Walton Refrigerator Freezer