Bahumatrik | বহুমাত্রিক

সরকার নিবন্ধিত বিশেষায়িত অনলাইন গণমাধ্যম

বৈশাখ ৯ ১৪৩১, মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪

করোনাকালে কৃষিকে বাঁচাতে বন্যাত্তোর পুনর্বাসন

ড. মো. হুমায়ুন কবীর

প্রকাশিত: ১৯:২৯, ১০ আগস্ট ২০২০

আপডেট: ২১:৩৫, ১০ আগস্ট ২০২০

প্রিন্ট:

করোনাকালে কৃষিকে বাঁচাতে বন্যাত্তোর পুনর্বাসন

ছবি- সংগৃহীত

এবারের করোনাকালের বন্যা যতটা তীব্রতা ও স্থায়িত্ব নিয়ে অবস্থান করার আশঙ্কা করা হয়েছিল তার ব্যতিক্রম হয়েছে বলে মহান সৃষ্টিকর্তার নিকট কোটিকোটি শুকরিয়া। এবারে মূলত দেশের উত্তররাঞ্চল, উত্তর-পশ্চিমাঞ্চল ও মধ্যাঞ্চলে বেশি আঘাত হেনেছে প্রলয়ঙ্করী বন্যা। ক্ষতিগ্রস্ত করেছে সেসব এলাকার বাড়িঘর, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, কাঁচাপাকা রাস্তাঘাট, বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ, হাটবাজার, কৃষি ফসল, মাছ, গবাদিপশু, হাঁসমুরগি, সর্বোপরি সার্বিক জনজীবনের। একেতো করোনাকাল, তারউপর হয়ে গেল ভয়াবহ আরেক প্রাকৃতিক বিপর্যয় ঘুর্ণিঝড় আম্ফান, এরপর এ বন্যা- এগুলো মানুষের উপর চরম দুর্ভোগ সৃষ্টি করেছে যা বর্ণনাতীত। এখন আস্তে আস্তে বন্যার পানি নেমে যাচ্ছে এবং প্রতিনিয়তই দেশের সার্বিক বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি পরিলক্ষিত হচ্ছে যা জনমনে আশার সঞ্চার করছে।

বন্যার পানি নেমে যাওয়ার সাথে আমাদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দেখা দেবে পূণর্বাসন কার্যক্রম। সেখানে বহুমুখী ও বিভিন্ন মেয়াদি পরিকল্পনা অনুযায়ী পূণর্বাসন কার্যক্রম গ্রহণ করতে হয়। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, রাস্তাঘাট, বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ, হাটবাজার ইত্যাদি অবকাঠামোগত স্থাপনা পূণর্বাসনের জন্য সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের তাৎক্ষণিক, সাময়িক, স্বল্প মেয়াদি, মধ্যমেয়াদি ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার অধীনে বাস্তবায়ন করতে হবে। তবে তাৎক্ষণিক করণীয় হলো কৃষি পূণর্বাসন কার্যক্রম। ক্ষতির তালিকায় থাকা মূল কৃষির সাথে অন্যতম কৃষির উপখাত হিসেবে মাছ, গবাদিপশু ও হাঁসমুরগি ইত্যাদির জন্যও বিভিন্ন মেয়াদি পরিকল্পনামাফিক প্রকল্প আকারে বাস্তবায়ন করতে হবে।

কৃষির সাথে সংশ্লিষ্ট প্রকল্পগুলো বাস্তবায়নের জন্যও স্ব-স্ব মন্ত্রণালয় হিসেবে কৃষি, খাদ্য, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ, বন, পরিবেশ ও জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক মন্ত্রণালয় ও তাদেও অধিনস্থ বিভাগসমূহকে একযোগের সম্মিলিতভাবে সমন্বয়ের মাধ্যমে কাজ করতে হবে। কৃষি মন্ত্রণালয়ের অধীনে রয়েছে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর (ডিএই), বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশন (বিএডিসি), বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিল (বিএআরসি), বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইন্সটিটিউট (বারি), বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইন্সটিটিউট (ব্রি), বাংলাদেশ পরমাণু গবেষণা ইনসটিটিউট (বিনা), বাংলাদেশ প্রাণিসম্পদ গবেষণা ইন্সটিটিউট (বিএলআরআই), বাংলাদেশ মাৎস্য গবেষণা ইন্সটিটিউট (বিএফআরআই) ইত্যাদি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান যারা সরাসরি স্বল্প, মধ্যম ও দীর্ঘমেয়াদি বিভিন্ন পরিকরকল্পনা ও প্রকল্প গ্রহণ করে কৃষির বিভিন্ন সেক্টরে গবেষণার মাধ্যমে কৃষি পুনর্বাসন প্যাকেজ তৈরি করে থাকে।

ব্রি, বারি, বিনা ইত্যাদি গবেষণা প্রতিষ্ঠান গবেষণা করে বন্যা পূণর্বাসন উপযোগী বিভিন্ন ফসলের জাত ও বিভিন্ন উৎপাদন প্রযুক্তি উদ্ভাবন করে। সেগুলোর মধ্যে বীজ উৎপাদন করে বিএডিসি এবং মাঠ পর্যায়ে বিস্তার ঘটায় ডিএই, আবার বিএলআরআই গবেষণা করে গবাদিপশু ও হাঁসমুরগি নিয়ে পূণর্বাসন উপযোগী বিভিন্ন উন্নত জাত ও প্রযুক্তি উদ্ভাবন করে যা প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর মাঠ পর্যায়ে বিস্তার ঘটায়। তেমনিভাবে বিএফআরআই মাছের বিভিন্ন জাত ও উৎপাদন প্রযুক্তি উদ্ভাবন করে যা মৎস্য অধিদপ্তর তা মাঠ পর্যায়ে বাস্তবায়ন করে থাকে। সরকারের কৃষি সেক্টরের এসব সুশৃঙ্খল বিভাগ ও প্রতিষ্ঠান প্রতিবছরই বন্যা হলে কীভাবে সেগুলো মোকাবেলা করা যায় তার প্রস্তুতি নিয়ে রাখে। এবারো তার ব্যতিক্রম হয়নি। সেজন্য দেখা গেছে বন্যা চলাকালীন সময়ে তারা গণমাধ্যমে ক্ষয়ক্ষতি থেকে পরিত্রাণ পাওয়া, বন্যা পরবর্তী পুনর্বাসন কর্মসূচি ইত্যাদি সম্পর্কে ব্যাপক প্রচারের ব্যবস্থা করেছে।

এবারের বন্যার ব্যাপ্তি মূলত শুরু হয়েছে মধ্য জুলাই থেকে আগস্টের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত। এসময়ে কৃষি ফসলের মধ্যে বোরোধান আগেই তোলা শেষ হয়ে গিয়েছিল। শুধু আউস ধান, আমন বীজতলা, শাকসবজি, মাছের ঘের, গবাদিপশুর আবাসস্থল, খামার ও তাদের খাদ্য, হাঁসমুরগির আবাসস্থল, খামার ও তাদের খাদ্য ইত্যাদি বন্যা উপদ্রুত এলাকায় ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির মধ্যে পড়েছে। আমরা জানি করোনাকালে খাদ্য নিরাপত্তার জন্য কৃষিই মহামারির ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়ার অন্যতম অবলম্বন। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এসময়ে কৃষির উপর সর্বাধিক গুরুত্ব আরোপ করেছেন। তিনি দেশের কোথাও এক ইঞ্চি জমি ফাঁকা না রাখার কথা বারবার বলে চলেছেন। তারই সূত্র ধরে বোরোধানের বাম্পার ফলনের পর আউস ও পরবর্তী আমনের উপর ব্যাপক জোড় দেওয়ার কথা বলা হয়েছিল। সেভাবেই এগোচ্ছিল। কিন্তু বাধ সাথে বন্যা।

ইতোমধ্যে ব্রি ও বিনা হতে কিছু স্বল্পদিনে উৎপাদনক্ষম ধানের জাত আমনে রোপনের কথা বলা হয়েছে। বিনাধান-৭, বিনাধান-৯, বিনাশাইলসহ আরো কিছু আমন মৌসুমে চাষযোগ্য উন্নত জাত রয়েছে। বিআর-২২, বিআর-২৩, ব্রিধান৩৪, ব্রিধান৪৬, ব্রিধান৫৪, নাইজারশাইল ইত্যাদি উচ্চফলনশীল ও স্থানীয় জাতসমূহ বন্যাত্তোর পূণর্বাসনে আবাদ করা যেতে পারে। সাধারণত ৩০-৪৫ দিনের ধানের চারা নাবী জাত হলে আগস্টের মাঝামাঝি পর্যন্ত আমন রোপন করা যায়। কিন্তু বন্যা পরবর্তীতে তা একটু বেশি বয়সের অর্থাৎ ৬০ দিন বয়সের পর্যন্ত ধানের চারা আগস্টের শেষাবধি রোপন করা যেতে পারে। তাতেও যদি বন্যার পানি না নেমে জমি জো অবস্থায় না আসে তবে সেখানে দাপগ পদ্ধতিতে (ভাসমান) সবজির আবাদ করা যেতে পারে।

আর বন্যা শুরু হওয়ার সাথে সাথে উঁচু জায়গায় ধানের চারা তৈরির ব্যবস্থা নিতে হয়। সেভাবে যেসকল জমিতে তারপরও ধান আবাদ করা যাবে না কিংবা সবজি আবাদের সময় চলে যাবে সেগুলোর জন্য আগেই বন্যার পানি নেমে যাওয়ার সাথে সাথেই বীজ/চারা লাগিয়ে দিতে হবে। সীম, শীত লাউসহ মাচাতে হয় এমন সবজির জন্য মূল জমি প্রস্তুতের পূর্বেই উঁচু বা ভাসমান কোন স্থানে চারা উৎপাদন করে রাখতে হবে। যাতে ক্ষেতের পানি নেমে যাওয়া পরপরই সেখানে তা লাগিয়ে দেওয়া যায়। বন্যার কারণে যেসকল জমিতে ধান চাষ করা সম্ভব হলোনা সেগুলোতে আগাম শীতকালীন শাকসবজি চাষ করে অধিক লাভবান হওয়ার সুযোগ রয়েছে। টমেটো, বাধাকপি, ফুলকপি, লেটুসপাতা, শালগম, গাজর, মূলা, লালশাক, ডাটা ইত্যাদি শীতকালীন সবজি যাতে মৌসুমের শুরুতে সবার আগে বাজারে তোলা যায় সেদিকে নজর দিয়ে পরিকল্পনামাফিক কাজ করতে হবে।

এসব ক্ষেত্রে সরকার কমিউনিটি ভিত্তিতে বীজতলা তৈরি করে রিলিফ হিসেবে চারা বিতরণ করতে পারে। তাছাড়া সরাসরি আর্থিক প্রণোদনাও দেওয়া যেতে পারে। এমনিতেই সার, বীজ, পরিবহনসহ অনেকক্ষেত্রে সরকারি সাবসিডি দিয়ে চলেছে এবং তা অব্যাহত রাখতে হবে। এভাবে সরকারি তরফ থেকে সহযোগিতা অব্যাহত রাখলে বাঙালি কৃষক ঘুরে দাঁড়ানোর মতো বহু উদাহরণ অতীতে আমরা দেখেছি। কারণ বাংলাদেশের কৃষককুল সবসময় বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলা করে উঠে দাঁড়াতে সিদ্ধহস্ত। তবে এবারের করোনাকালের এ বন্যা পরবর্তী পুনর্বাসন কার্যক্রম জোরদার করে সত্যিই কৃষিকে এগিয়ে দিতে পারলে আমাদের খাদ্য নিরাপত্তা আরো কমপক্ষে ছয়মাসের জন্য নিশ্চিত করা যাবে। কাজেই সকলকে সম্মিলিতভাবে কৃষিকে এগিয়ে নিতে তৎপর হতে হবে।

লেখক: কৃষিবিদ ও ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়

email: [email protected] 

বহুমাত্রিক.কম

Walton Refrigerator Freezer
Walton Refrigerator Freezer