মরণঘাতী করোনাভাইরাস মহামারীতে গোটা বিশ্ব কাঁপছে। উন্নত রাষ্ট্রগুলোতে এই মহামারী যে মহাবিপর্যয় ডেকে এনেছে তার ঢেউ আছড়ে পড়েছে বাংলাদেশেও। ইতিমধ্যে বিশ্বজুড়ে করোনা প্রাণ নিয়েছে ১৪ হাজারেরও বেশি মানুষের। বাংলাদেশে এই সংখ্যা এখ পর্যন্ত চারজন। আক্রান্তের সংখ্যা যে হারে বাড়ছে তাতে উদ্বেগ এতোটাই ঘনীভূত হচ্ছে যে শেষ পর্যন্ত এই সংকট কী আকার ধারণ করবে তা আমাদের চিন্তার বাইরে। অবস্থা যখন এমন গভীর সংকটের দিকে ধাবিত তখন এর বহুমাত্রিক প্রভাব জনজীবনকে পর্যুদস্ত করে তুলছে। সংকট মোকাবেলায় বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার পরামর্শ মেনে কর্তৃপক্ষ আক্রান্ত ব্যক্তি কিংবা অঞ্চলকে বিচ্ছিন্ন করে প্রাদুর্ভাব ঠেকানোর প্রচেষ্টায় রীতিমতো মরিয়া।
আক্রান্ত অপরাপর দেশসমূহের মতোই বাংলাদেশেও আক্রান্তদের চিকিৎসা প্রদানে, রোগ নির্ণয়ে, সংক্রমণ হ্রাসে আক্রান্ত বা সন্দেহভাজনদের বিচ্ছিন্নকরণের মতো অত্যাবকশ্যকীয় বিষয়ে সীমাবদ্ধতা ক্রমেই প্রকট হয়ে উঠছে। চিকিৎসা উপকরণ, চিকিৎসক ও চিকিৎসাকর্মীদের সুরক্ষা উপকরণে সীমাবদ্ধতার সঙ্গে দক্ষ মানবসম্পদের সীমাবদ্ধতা কিংবা অপ্রতুল আইসিইউ সুবিধার বিরাট ঘাটতি ইতিমধ্যেই প্রকাশ্যে এসেছে। কিন্তু এসব ছাপিয়ে নতুন করে যে সংকট সামগ্রিক দৃশ্যপটকে আরও ঘনীভূত করছে তা হচ্ছে করোনা প্রাদুর্ভাব ঠেকাতে বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিচ্ছিন্নকরণ বাব বন্ধ ঘোষণার ফলে আর্থ-সামাজিক ক্ষেত্রে যে সংকট সৃষ্টি হচ্ছে তা আমাদের কোন পথে নিয়ে যাচ্ছে?
কলকাতাভিত্তিক দৈনিক বর্তমান’র সাম্প্রতিক এক সম্পাদকীয়তে করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবকে ‘তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ’র সঙ্গে তুলনা করে সতর্কবাণী উচ্চারণ করেছে। এই সম্পাদকীয় পর্যবেক্ষণ বলছে, করোনা সারা বিশ্বে এক ভয়াবহ আতঙ্ক ছড়িয়েছে। সারা বিশ্ব দীর্ঘদিন এমনভাবে আতঙ্কে কেঁপে ওঠেনি। সেই পরিপ্রেক্ষিতে মনে হচ্ছে, লেগে গেল বুঝি তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ।
পৃথিবীর দ্রুত বদলে যাওয়া উল্লেখ করে এতে বলা হয়, বিশ্বে বদলে গিয়েছে যুদ্ধাস্ত্র এবং যুদ্ধের কৌশলও। এখন সারা বিশ্ব শুধু পরমাণু অস্ত্র এবং ক্ষেপণাস্ত্র দিয়ে লড়াইয়ে মুখোমুখি নামবে না। কেননা আধুনিক অস্ত্রসম্ভার কমবেশি সব দেশেরই আছে। তাই এখন যুদ্ধকৌশল অবশ্যই জৈবাস্ত্রের উপর নির্ভরশীল। স্যার উইলিয়াম স্টুয়ার্ট এই ভবিষ্যত বাণী উচ্চারণ করে বলেছিলেন, প্রথম বিশ্বযুদ্ধ ছিল রাসায়নিক, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ছিল পারমাণবিক এবং তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ হবে জৈবিক।
করোনা মহামারী আমাদের উদ্বেগকে সেইদিকে ধাবিত যেমন করছে তেমনি আর্থিক কাঠামো ভেঙে পড়ার অশনি সংকেতও কড়া নাড়ছে। এর ফলে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবেন নিঃসন্দেহে শ্রমজীবী মানুষেরা। এই ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার চিত্র ইতিমধ্যেই আমাদের চোখে ধরা পড়ছে। আতঙ্কিত মানুষের ঘরমুখো হয়ে পড়া খোদ রাজধানীর সিএনজি অটোরিক্সা চালক, রিক্সা-ভ্যান চালক, হকার কিংবা নিন্ম আয়ের অন্যান্য পেশাজীবীদের জীবন-জীবিকাকে অনিশ্চয়তায় ফেলেছে। তাদের রোজগার নূন্যতম পর্যায়ে চলে এসেছে। অনেকেই দূরগ্রামে পাড়ি জমাচ্ছেন। ‘নুন আনতে পান্তা ফুরায়’ এসব মানুষদের জন্য সরকারিভাবে কোনো সহায়তা এখনো দৃশ্যমান হয়নি। নিত্যপণ্যের বাজার ক্রমেই অস্থির হয়ে উঠছে। বরাবরের মতোই নিয়ন্ত্রণহীন এই বাজার ব্যবস্থা সাধারণ মানুষের নাভিশ্বাসকে তীব্র করে তুলছে।
অবস্থা যখন এমন খারাপের দিকে যাচ্ছে দিনকে দিন; তখন কিছু খবর বড় আশাবাদের জন্ম দিচ্ছে। সংবাদপত্রের খবরে ও সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম ফেসবুকে জানা যাচ্ছে, দুই জন বাড়ি মালিক তাদের ভাড়াটিয়াদে এক মাসের ভাড়া মওকুফ করে দিয়ে অন্যন্য উদারতার নজির গড়েছেন। কিছু ছাত্র সংগঠন, বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগ, গবেষণা প্রতিষ্ঠানসমূহ ও অনেকে ব্যক্তিগতভাবে করোনা ভাইরাসের ছোবল থেকে মানুষকে রক্ষায় সুরক্ষা সামগ্রী তৈরি করে বিতরণ করছেন। এসব প্রয়াস নিঃসন্দেহে আমাদের অনেক আশাবাদী করছে। কিন্তু সংকট যে মাত্রায় ধেয়ে আসছে তাতে যে বিরাট প্রস্তুতির আবশ্যকতা দেখা দিয়েছে তা আমাদের নেই-এটি দ্ব্যর্থহীন ভাবেই বলা যায়।
রোববারই সরকারের পরিকল্পনা মন্ত্রী এম এ মান্নান গণমাধ্যমকে বলছিলেন, পরিস্থিতি মোকাবেলায় সরকার প্রধানের নির্দেশনায় ইতিমধ্যে হাজার কোটি টাকার তহবিল সৃষ্টির পদক্ষেপ সরকার দিয়েছে। প্রয়োজনে তা আরও কয়েকগুণ বৃদ্ধি করা হবে। তবে চীন, ইতালি, স্পেন, যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্রসহ উন্নত রাষ্ট্রগুলোর যেসব পদক্ষেপ এবং সীমাবদ্ধতা দেখতে পাচ্ছি তাতে এটি জোর দিয়েই বলা যায়-বাংলাদেশ এই দুর্যোগ মোকাবেলায় যথেষ্ট প্রস্তুত নয়। বিশেষজ্ঞরা ইতিমধ্যেই যে মাত্রার আর্থিক ও অন্যান্য প্রস্ততির প্রয়োজনীয়তার বার্তা দিচ্ছেন তা সংস্থানে সরকারের একার পক্ষে সামাল দেওয়া দুরূহ ব্যাপার।
গণমাধ্যমের খবরে আমরা জানতে পারছি, বিশ্বের শীর্ষ ধনী আলিবাবার কর্ণধার জ্যাক মা বাংলাদেশসহ করোনা আক্রান্ত বেশ কিছু দেশের জন্য বিরাট অংকের এক অর্থসহায়তা ঘোষণা করেছেন। কিন্তু আমরা সাম্প্রতিক সময়ে বিশ্ব অর্থনীতির যেসব সূচক প্রকাশ হতে দেখেছি তাতে বাংলাদেশের বিপুল সংখ্যক মানুষকে দেখছি যাঁরা বিত্তের দৌঁড়ে বিশ্বের বহু উন্নত দেশের সঙ্গে তাল মেলাচ্ছেন বা ছাপিয়ে যাচ্ছেন। খবরে প্রকাশ, প্রকাশ্যে যা দৃশ্যমান তারচেয়ে বাস্তবচিত্র আরও ভয়াবহ। দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জিত দেশের বিপুল অর্থ বিদেশে পাচার করে ‘সেকেন্ড হোম’ গড়ার দৌঁড়েও আমরা অনেক দেশের চেয়ে এগিয়ে।
গণমাধ্যমে প্রকাশি তথ্য অনুযায়ী, গেল বছরের (২০১৯) ৩১ মার্চ পর্যন্ত দেশে কোটিপতি আমানতকারীর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৭৬ হাজার ২৮৬ জন। দশ বছর আগে অর্থাৎ ২০০৯ সালের মার্চ শেষে ব্যাংক খাতে কোটিপতি আমানতকারী ছিলেন ১৯ হাজার ৬৩৬ জন। এই হিসাবে গত দশ বছরে ৫৬ হাজার ৬৫০ জন ব্যক্তি নতুন করে কোটিপতির তালিকায় নাম লিখিয়েছেন।
দশ বছরে ৫৬ হাজারেরও বেশি মানুষ কোটিপতির তালিকায় নাম লেখানোকে ‘বৈষম্যের উন্নয়ন’ বলে চিহ্নিত করছেন অর্থনীতিবিদরা। করোনাভাইরাস মহামারী আকার নেওয়ার পর উদ্ভূত পরিস্থিতিতে সরকার বা সরকারি দায়িত্বশীল প্রতিষ্ঠানসমূহ এই সংকট মোকাবেলায় যে নাজুক পরিস্থিতির মধ্যে পড়তে যাচ্ছে সেখানে এসব বিত্তবানদের ভূমিকা কী তাই এখন আলোচনার দাবি রাখে।
রাজধানীর যে দু’জন বাড়ি মালিক তাদের বাড়িভাড়া মওকুফ করে উদারতার নজির গড়েছেন, সেক্ষেত্রে এই বিপুল সংখ্যক বিত্তবান শ্রেণীর কী কোনোই সামাজিক দায়বদ্ধতা নেই? করোনার কারণে ইতিমধ্যে জীবন-জীবিকার সংকটে পড়া শ্রমজীবী সাধারণ মানুষেরা যে চ্যালেঞ্জের মুখে দিনআতিপাত করছেন তাদের পাশে কী দাঁড়াবার কোনো দায়িত্ব তাঁরা অনুভব করছেন না আদৌ? শোষণ বঞ্চনাহীন যে রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছিল, স্বাধীনতার ৫০ বছরের প্রাক্কালে আমরা কী সেই চেতনা ও মূল্যবোধের জায়গা পুরোপুরি হারিয়ে ফেলেছি?
আজ পবিত্র শবে মেরাজ পালন করছেন মুসলিম উম্মাহ। পবিত্র মাহে রমজান দুয়ারে কড়া নাড়ছে। এরকম সময়ে দাঁড়িয়ে জাতীয় কবি নজরুলের সেই আহ্বানই বার বার মনে পড়ছিল, ‘দে জাকাত, দে জাকাত, তোরা দে রে জাকাত/তোর দিল্ খুলবে পরে ওরে আগে খুলুক হাত’
বাংলাদেশে অসংখ্য প্রতিষ্ঠান দেশের গণ্ডি পেরিয়ে আন্তর্জাতিক পরিসরে ব্যবসায় সাফল্য অর্জন করেছেন। জাতির এই চরম দূর্যোগে সময় এসেছে আপনাদের পাশে দাঁড়ানোর। দেশের বিত্তবানরা এগিয়ে এলে আর ব্যবস্থাপনা ত্রুটি এবং দুর্নীতিমুক্ত করা গেলে সর্বংসহা এই জাতির পক্ষে করোনা মহামারি মোকাবেলা করা কঠিন কিছু হবে বলে মনে করি না।
লেখক: প্রধান সম্পাদক, বহুমাত্রিক.কম
বহুমাত্রিক.কম