ছবি : বহুমাত্রিক.কম
মৌলভীবাজার: বৃহস্পতিবার বিশ্ব বন দিবস। তবে ভালো নেই মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জ উপজেলার লাউয়াছড়া বন। বিশ্বের বিলুপ্তপ্রায় উল্লুকসহ বিরল প্রজাতির বন্যপ্রাণি, উদ্ভিদ ও বৃক্ষরাজি সমৃদ্ধ লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানে গত দুই যুগে বনের গভীরতা অনেক হ্রাস পেয়েছে। জাতীয় এই উদ্যানটিতে পুরনো প্রাকৃতিক গাছগুলো ক্রমাম্বয়ে বিলীন হয়ে যাচ্ছে। কাঠচোর চক্রের দৌরাত্ম্যসহ বিভিন্ন অপতৎপরতায় এই বনের সংকটাপন্ন অবস্থা দেখা দিয়েছে। বন ফাঁকা হওয়ায় হুমকির মুখে পড়ছে জাতীয় উদ্যানের বন্যপ্রাণি ও জীববৈচিত্র্য।
লাউয়াছড়া বন্যপ্রাণি বিভাগ সূত্রে জানা যায়, ১৯১৭ সালে আসাম সরকার পশ্চিম ভানুগাছের ১২৫০ হেক্টর এলাকাকে সংরক্ষিত বন হিসেবে ঘোষণা করে। পরবর্তী সময়ে ১৯২৩ ও ১৯২৫ খ্রি: পর্যায়ক্রমে কালাছড়া ও চাউতলী এলাকাকে সংরক্ষিত বন ঘোষণা করে। তদান্তিন বিট্রিশ সরকারের বনায়ন থেকে আজকের এই বনায়ন। বনের চারপাশ ঘিরে চা বাগান, হাওর, সংরক্ষিত বন ও গ্রামগঞ্জ রয়েছে।
অনুসন্ধানে জানা যায়, সুদীর্ঘকাল থেকে বিশ্ব বন দিবস পালিত হলেও কমলগঞ্জে লাউয়াছড়া উদ্যানটি বিরল প্রজাতির প্রাণির সংমিশ্রণে জাতীয় পর্যায়ে গুরুত্ব বহন করলেও এ বনের গাছ উজাড়, মাগুরছড়া গ্যাস কূপ খনন, বিভিন্ন স্থাপনা, পর্যটন কেন্দ্র, অত্যধিক দর্শনার্থীর বিচরন, পার্শ্ববর্তী টিলাভূমিতে হোটেল, কটেজ ও বাণিজ্যিক কার্যক্রম সব মিলিয়ে অস্থিত্ব সংকটে পড়েছে বন। চিরসবুজ এই বনকে ঘিরে নানা কার্যক্রমে বনের অবক্ষয়, খাবার ও বাসস্থান সংকটে অতিষ্ঠ প্রাণিকূল। ঘন সবুজ বনে পুরনো গাছ গাছালি দিয়ে লাফালাফি করে এদিক-ওদিক ঘুরে আর খাবার সংগ্রহে বেড়ায় এসব নানা প্রাণি।
তবে দীর্ঘ সময় ধরে বনের মূল্যবান গাছ গাছালি পাচার হয়ে যাওয়ায় এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগে উপড়ে পড়ায় ক্রমাম্বয়ে ফাঁকা হয়ে পড়ছে বন। পূর্বের মতো দিনের বেলা এখন আর বনে অন্ধকার দেখা যায় না। ফলে একদিকে প্রাণির আবাসস্থল বিলুপ্ত হচ্ছে অন্যদিকে খাবার সংকটে পড়ছে বন্যপ্রাণি। লাউয়াছড়ায় ৪৬০ প্রজাতির দুর্লভ উদ্ভিদ ও প্রাণীর মধ্যে ১৬৭ প্রজাতির উদ্ভিদ, ৪ প্রজাতির উভচর, ৬ প্রজাতির সরীসৃপ, ২৪৬ প্রজাতির পাখি এবং ২০ প্রজাতির স্তন্যপায়ী প্রাণী রয়েছে। এদের মধ্যে উল্লুক, হনুমান, ছোট লেজি বানর, লজ্জাবতি বানর, সজারু সহ বিরল প্রজাতির প্রাণি।
বন্যপ্রাণি ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগের লাউয়াছড়া রেঞ্জের প্রাক্তন কর্মকর্তা সাহাব আলী বলেন, ৩৫ বছর পূর্বের লাউয়াছড়ায় যে বন ছিল সেটি এখন আর নেই। উদ্যানে ক্লোরোফর্ম গাছটিও নেই। যে সময়ে চন্দন, ক্লোরোফর্ম, আগর, সেগুন, চাপালিশ প্রজাতির বৃহদাকার গাছ ছিল সেগুলো এখন আর নেই। গাছ-বাঁশ চুরি হয়ে বন ফাঁকা হয়ে যাচ্ছে। তিনি আরও বলেন, বনের ভেতর দিয়ে রেল ও সড়কপথ থাকায় ট্রেনের ধাক্কায় কিংবা সড়কপথে সাপ, শূকর, শিয়াল হরদম মারা যাচ্ছে।
লাউয়াছড়া উদ্যানের পার্শ্ববর্তী গ্রামের বাসিন্দা আসিদ আলী বলেন, বনে খাবার সংকটে রাতে শোকর, বানরসহ বিভিন্ন প্রাণি গ্রামগঞ্জে ঝাপিয়ে পড়ে। ক্ষেতের ধান ও সবজি বিনষ্ট হচ্ছে। এছাড়াও ৯৭ সালে মাগুরছড়া গ্যাসকূপ বিস্ফোরনে গাছগাছালি মারা যাওয়ায় প্রকৃতির মারাত্মক ক্ষতির শিকার হয়েছে। কমলগঞ্জ পৌরসভার মেয়র জুয়েল আহমদ বলেন, গাছ শেষ হওয়ার সাথে সাথে প্রকৃতিও শেষ হয়ে লাউয়াছড়া তার যৌবন হারিয়ে ফেলছে। রেল ও সড়কপথে প্রতিনিয়ত প্রাণি মারা যাওয়ার খবর বেরুচ্ছে। সিলেট বন বিভাগের সহকারী বন কর্মকর্তা মো. আবু বক্কর বলেন, বনের গভীরতা ফিরিয়ে আনতে বিভিন্ন স্থানে সামাজিক বনায়ন তৈরি করা হচ্ছে। তাছাড়া এখন আর গাছ চুরির ঘটনা ঘটছে না।
উল্লেখ্য, ১৯৯৬ সালে ১২৫০ হেক্টর জায়গা নিয়ে লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান ঘোষণা করা হয়। বিশ্বের বিলুপ্ত প্রায় জীববৈচিত্র্যময় বন গবেষণা কেন্দ্রসহ এই উদ্যানে রয়েছে বিলুপ্তপ্রায় বন্যপ্রাণির বিচরন। লাউয়াছড়ায় ৪৬০ প্রজাতির প্রাণ বৈচিত্র্যের ভেতর ১৬৭ প্রজাতির উদ্ভিদ, ৪ প্রজাতির উভয়চর প্রাণী, ৬ প্রজাতির সরিসৃপ, ২৪৬ প্রজাতির পাখি, ২০ প্রজাতির স্তন্যপ্রায়ী প্রাণী এবং ১৭ প্রজাতির পোকামাকড় রয়েছে।
বহুমাত্রিক.কম