Bahumatrik | বহুমাত্রিক

সরকার নিবন্ধিত বিশেষায়িত অনলাইন গণমাধ্যম

চৈত্র ১৪ ১৪৩০, শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪

ঈদোত্তর বন্যা পুনর্বাসনে যা করণীয়

ড. মো. হুমায়ুন কবীর

প্রকাশিত: ২২:২৪, ১৪ আগস্ট ২০১৯

প্রিন্ট:

ঈদোত্তর বন্যা পুনর্বাসনে যা করণীয়

দেশে প্রতিবছরই ছোট-বড় একাধিক বন্যা হতে দেখা যায়। সেই বন্যার স্থায়ীত্বের উপর ভিত্তি করে আবার এর ক্ষয়ক্ষতির মাত্রা নির্ভর করে থাকে। প্রতি ১০ বছর পরপর বাংলাদেশের ইতিহাসে একেকটি বড় আকারের বন্যা আঘাত হানতে দেখা যায়। যাই হোক না কেন যেকোন ধরনের বন্যাতেই কিছু না কিছু ক্ষয়ক্ষতি হয়েই থাকে। এইতো এবছরই (২০১৯) জুলাই-আগস্ট মাসে বাংলাদেশের বেশ কয়েকটি জেলায় মধ্যবর্তী বন্যায় ফসলের ব্যাপক ক্ষতি করেছে। বন্যায় সেসব উপদ্রুত এলাকার আমন ধান, ধানের চারা, শাক-সবজি ও অন্যান্য ফসলসহ মাছের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে।

এবারের এ বন্যাটি সম্পর্কে বিগত আরো মাস দুয়েক আগে থেকেই একটি পূর্বভাস পাওয়া যাচ্ছিল। সে পূর্বাভাস ও সতর্কতা অনুযায়ী দেশের সরকার এবং সংশ্লিষ্ট এলাকাসমূহ কিছুটা হলেও পূর্ব প্রস্তুতি নেওয়ার সুযোগ পেয়েছিল। তার জন্যই অন্য অনেক সময়ের তুলনায় এবারে বন্যায় সার্বিক ক্ষয়ক্ষতি কম হয়েছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। যদিও বাংলাদেশের উজান হিসেবে চীন, নেপাল, ভারত এমনকি মায়ানমারেও বন্যা হয়েছে এবং সেখানে বন্যার কারণে কিছু প্রাণহানিরও খবর পাওয়া গেছে।

এবারের বন্যায় প্রথমে দেশের পূর্বাঞ্চল এবং পরে উত্তরাঞ্চলকে উপদ্রুত করেছে। সাধারণত বন্যার পানি নি¤œাঞ্চল থেকে উপরের দিকে উঠতে দেখা যায়। সেখানে দেশের সবচেয়ে নি¤œাঞ্চলগুলো আগে বন্যা কবলিত হয়। পক্ষান্তরে অপেক্ষাকৃত উঁচু স্থানসমূহ ধীরে ধীরে পরে বন্যায় আক্রান্ত হয়। কিন্তু এবারের এ বন্যার কারণ অনুসন্ধ্যান করলে দেখা যাবে ভারত, চীন, নেপাল, ভুটান ইত্যাদি আমাদের প্রতিবেশী দেশে ভয়াবহ বন্যা দেখা দিয়েছে। সেখানকার নদ-নদীর পানি ফুলে-ফেঁপে উঠেছে। যে কারণে তারা তাদের অতিরিক্তি পানি ছেড়ে দিয়েছে। আর এ পানির প্রবাহ এসে পড়েছে বাংলাদেশের পূর্বাঞ্চল ও উত্তরাঞ্চলের অধিকতর উঁচু এলাকায়। তাতে স্বাভাবিকভাবে প্রতিবছর যেসব নি¤œাঞ্চল ও হাওরাঞ্চল অর্থাৎ বৃহত্তর সিলেট, নেত্রকোণা এবং নীলফামারী, কুড়িগ্রাম, গাইবান্ধা, সিরাজগঞ্জ ইত্যাদি স্থান। তবে এবারের বন্যায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয় জামালপুর জেলার নদী তীরবর্তী স্থানসমূহ।

যদিও এখন বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে, কিন্তু বন্যার প্রকোপে তাদের যে পরিমাণ ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে তা দীর্ঘস্থায়ী হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। কারণ সেসব এলাকায় কৃষি ফসলের মধ্যে আমন ধান প্রধান। তারপর মাছ, রয়েছে শাকসবজিসহ অন্যান্য ফসল। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে গবাদিপশুও। এসব নিত্যপণ্য পানিতে তলিয়ে যাওয়ার কারণে সেসব এলাকার কৃষককুল এখন নিঃস্ব হয়ে পড়েছে। তাদের চাল-চুলো কিছুই আর অবশিষ্ট নেই। বন্যার পানি চলে গেলেও তাদের পরবর্তী রবি ফসল আবাদ করার জন্য কোন অর্থই তাদের কাছে নেই। উপরন্তু তারা এখন তাদের স্বভাবিক জীবন যাপন করার মতো কোন অর্থের সংস্থান নেই। তারা এখন চরম মানবিক বিপর্যয়কর পরিস্থিতির মধ্যে পড়েছেন।

এখন কৃষি ফসলের মধ্যে রয়েছে দেশের একমাত্র সহজে এবং কমখরচে আবাদযোগ্য আমন ধান। সেই আমন ধান আবাদেও জন্য সদ্য রোপনকৃত ধানের ক্ষেত ক্ষতিগ্রস্থ করেছে এ বন্যা। অপরদিকে যে জমিতে রোপন করতে পারেনি সেখানকার ধানের বীজতলা ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। আরো ক্ষতিগ্রস্ত করেছে শাকসবজি। তবে বন্যার পানিতে পাট ভেজানোর ব্যবস্থাকরণ সহজতর হবে। বন্যায় পরিবহন ব্যবস্থা, কাঁচা-পাকা রাস্তাঘাট, বেড়িবাঁধ, বিভিন্ন গ্রামীণ অবকাঠামোর যে স্থায়ী ক্ষতি করে থাকে তা সহজে পূরণযোগ্য হয়না, কিংবা হলেও তা সময় ও ব্যয়সাধ্য হয়ে থাকে। এতে একদিকে যাতায়াত ব্যবস্থার অসুবিধার কারণে সরবরাহ কম থাকার জন্য শাকসবজিসহ অন্যান্য নিত্যপণ্যের মূল্য বৃদ্ধি পেতে থাকে।

বন্যায় জানমালের ক্ষয়ক্ষতির পাশাপাশি কৃষি ফসল হানি, মাছ ভেসে যাওয়া, স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসাসহ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ হওয়া, রাস্তাঘাট ভেঙ্গে গিয়ে যোগাযোগ ব্যবস্থার ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি তো রয়েছেই। সেইসাথে বড় ধরনের ক্ষয়ক্ষতি হয় গবাদি পশুর। জানা গেছে এবারের বন্যায় বন্যাদুর্গত এলাকায় খাবার ও আশ্রয়ের অভাবে গরু, ছাগল, ভেড়া, মহিষ ইত্যাদি মৃত্যুবরণ করেছে। বন্যার ধকল কাটতে না কাটতেই চলে এলো আমাদের অন্যতম বড়ঈদ বলে খ্যাত কোরবানির ঈদ। সেখানে প্রতিবছর লক্ষকোটি পশু কোরবানি করতে হয়। কিন্তু বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকের ঘওে ঘওে এখন হাহাকার। কারণ তারা কোরবানি ঈদেও জন্য মোটাতাজা করা গরুটিই হয়তো আর নেই। তাছাড়া অন্য যেসকল গরু বা ছাগল ছিল সেগুলোও খাবারের অভাবে জীর্ণ-শীর্ণ হয়ে মরার উপক্রম। বাকীগুলো কমদামে বিক্রি করতে হয়েছে। তাতে তাদেও পারিবারিক চাহিদা মেটেনি।

যেকোন একটি প্রাকৃতিক দুর্যোগের পর সেটা কাটিয়ে উঠার জন্য প্রয়োজন হয় সঠিকভাবে পুনর্বাসন কার্যক্রম গ্রহণ করার। সেখানে সেক্টর অনুযায়ী প্রয়োজন হয় আলাদা আলাদা ব্যবস্থা গ্রহণ। যেমন- যদি কৃষি পুনর্বাসনের কথা ধরা হয়, তবে সেখানে নিতে হবে কৃষি সহায়ক পুনর্বাসন কর্মসূচি। সেখানে যদি এখনি যেসব এলাকা থেকে বন্যার পানি নেমে গেছে সেসব এলাকার জন্য পূর্বেই উঁচু জায়গায় নাবী জাতের তৈরী করা বীজতলা হতে চারা সংগ্রহ করে তাড়াতাড়ি জমিতে রোপন করে দিতে হবে। নিচু এলাকার জন্য জলি আমন ধানের বীজ বিশেষ পদ্ধতিতে পুতে দিতে হবে। তারপর বন্যার পানি নেমে যাওয়ার সাথে সাথে সেই জমিতে বিনা চাষে গম, ভূট্টা, ডাল, সরিষা ইত্যাদি বুনে দিতে হবে।

রবি শাকসবজি হিসেবে আলু, পিঁয়াজ, রসুন, ফুলকপি, বাধাকপি, মূলা ইত্যাদি আবাদ করতে হলে বড় অংকের বিনিয়োগের প্রয়োজন হয়। সে খরচ সেসব এলাকার ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকেরা মেটাতে পারবেনা বিধায় সরকারের ব্যবস্থাপনায় সহজ শর্তে তাদেরকে কৃষিঋণের ব্যবস্থা করে দিতে হবে যা ইতোমধ্যে দেওয়ার জন্য সরকারের তরফ থেকে ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। মাছ চাষ, পোল্ট্রি শিল্প, গবাদি পশু ইত্যাদির জন্য একই রকম ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।

বন্যা চলাকালীন সময়ে এক ধরনের সমস্যা থাকে এবং বন্যার পানি নেমে যাওয়ার পর শুরু হয় অন্য ধরনের সমস্যা। সবগুলো সম্পর্কেই সকলকে সজাগ দৃষ্টি রাখতে হয়। তা না হলে জানমালের ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ আরো বেড়ে যায়। বন্যা চলাকালীন সময়ে খাদ্য সংকট, বিশুদ্ধ খাবার পানির সংকট, মানুষের খাদ্যের পাশাপাশি পশুখাদ্যের সংকট ইত্যাদি নিত্য নৈমিত্তিক বিষয়। আর সেসব কারণে মানুষের নানা ধরনের পেটের পীড়াজনিত রোগ দেখা দেয়। সেজন্য সরকারি- বেসরকারি ত্রাণ কার্যক্রম হিসেবে এসব নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিস পত্রাদি সরবরাহের উপর জোর দেওয়া হয়ে থাকে।

কাজেই বন্য চলে যাওয়ার পর কৃষি পুনর্বাসন, ভেঙ্গে যাওয়া বাঁধ ও রাস্তাঘাট পুনসংস্কার করা, জরুরি ঔষধ সরবরাহ ইত্যাদি তাৎক্ষণিক প্রয়োজন হয়ে পড়ে। আমরা যে কোন প্রাকৃতিক কিংবা দৈব-দুর্বিপাক মোকাবেলার ক্ষেত্রে শুধু সরকারের উপর দায় চাপিয়ে বসে থাকি। মৌলিক অধিকারের প্রশ্নে সরকারের অবশ্যই দায় রয়েছে। কিন্তু এসব বিষয়ে শুধু সরকারকে এককভাবে দায়ী না করে সবাইকেই সাধ্যমত সম্মিলিতভাবে এগিয়ে আসতে হবে। আর সেজন্যই এসব সমস্যা মোকাবেলায় সকলকে এগিয়ে আসতে হবে। এগিয়ে আসতে হবে বেসরকারি পর্যায়ের স্বেচ্ছাসেবী বিভিন্ন সংগঠনকেও। তাহলে সম্মিলিতভাতে এ দুর্যোগ মোকাবেলা করে আগামীর পথচলা মসৃণ করা সম্ভব।

লেখক: কৃষিবিদ ও ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়

Email: [email protected] 

বহুমাত্রিক.কম

Walton Refrigerator Freezer
Walton Refrigerator Freezer