Bahumatrik | বহুমাত্রিক

সরকার নিবন্ধিত বিশেষায়িত অনলাইন গণমাধ্যম

চৈত্র ৪ ১৪৩০, মঙ্গলবার ১৯ মার্চ ২০২৪

‘ইটা কি পরছিস? তুই একটা দেশের প্রধানমন্ত্রীর ছেলে…’

রুহেল আহমেদ বাবু

প্রকাশিত: ১১:৪১, ১৯ আগস্ট ২০১৭

আপডেট: ০৯:৫৪, ২০ আগস্ট ২০১৭

প্রিন্ট:

‘ইটা কি পরছিস? তুই একটা দেশের প্রধানমন্ত্রীর ছেলে…’

ছবি: লেখক

ঢাকা : মিউনিখ অলিম্পিকে শেখ কামালের সাথে আমার কথোপকথনের একটা অংশ অনেকের কাছেই ভুলভাবে উপস্থাপিত হচ্ছে। অনেকেই প্রশ্ন তুলেছেন, ১৫০০ টাকার পোশাক সস্তা হয় কিভাবে? আবার ‘৭২ রে বঙ্গবন্ধুর ইউরোপযাত্রা নিয়েও অনেকেই তীব্র আপত্তি তুলেছেন। তাদের প্রশ্ন হলো গরীব দেশের রাজকোষের উপর চাপ ফেলে কোন যুক্তিতে এই বিলাসী সফরে গেলেন প্রধানমন্ত্রী? ব্যাপারটা পরিস্কার করা প্রয়োজন।

শেখ কামালের সাথে আমার পরিচয় সেই স্কুল জীবন থেকে। যদিও দুই স্কুলে পড়তাম কিন্তু থাকতাম একই পাড়ায় (ধানমণ্ডি)। ‘৫৪ সালের নির্বাচনে যুক্তফ্রন্ট জয়ী হবার পর বঙ্গবন্ধু তৎকালীন পুর্ব পাকিস্তানের কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি মিনিস্টার হলেন, আর আব্বা হলেন পাকিস্তানের সেন্ট্রাল কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি মিনিস্টার। সিলেট অঞ্চলে আওয়ামীলীগের জন্ম আমার আব্বার হাত ধরেই।

ষাটের দশক থেকে শুরু করে সত্তরের দশকের পুরোটা সময় জুড়ে বঙ্গবন্ধু যখন ধীরে ধীরে বাংলাদেশের প্রতিশব্দ হয়ে উঠছেন, তখন থেকেই আব্বা মনে প্রানে বিশ্বাস করতেন, “মুজিব” একদিন অনেক বড় হবে। বঙ্গবন্ধুও ভরসা করতেন আব্বার উপর, সিলেট এলে আমাদের বাড়িতেই মিটিং করতেন। বৃহত্তর সিলেট অঞ্চলে দলের যেকোন প্রয়োজনে যেকোন সমস্যায় যেকোন দরকারে তার আস্থার জায়গা ছিল তার প্রিয় “নুরু ভাই”।

তারপর আমরা ঢাকায় মুভ করলাম, স্কুলে ভর্তি হয়ে নতুন করে পড়ালেখা শুরু করলাম, আস্তে আস্তে কামালকে চিনতে লাগলাম তখন। পোশাক-আশাক, চলনে-বলনে একবারে সাধাসিধে সরল একটা ছেলে, সারাক্ষনই কিছু না কিছু একটা করছে। ক্রিকেটে দুর্দান্ত পেসার, বাস্কেটবল টিমের ক্যাপ্টেন,ছায়ানটের সেতারবাদক, নাট্যাঙ্গনের পরিচিত মুখ কামালকে সবসময় পাওয়া যেত যেকোন মিছিলের সামনের সারিতে। 

‘৭০ দশকের সেই মিছিলে মিছিলে অগ্নিগর্ভ উত্তাল দিন গুলোয় কামাল ছিল রাজপথের পরিচিত মুখ। একুশে ফেব্রুয়ারিতে এবং পহেলা বৈশাখে তখন পাকিস্তানী সামরিক সরকার রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে মিছিল আর সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হত।কামাল স্কুলে স্কুলে ঘুরতো, সবাইকে মিছিল নিয়ে বেরোতে বলতো।

আমরা তার অনুপ্রেরণায় স্কুলে অঘোষিত হরতাল লাগিয়ে দিতাম, কোন স্টুডেন্ট ক্লাসে থাকতে পারবে না, সবাইকে মিছিলে যেতে হবে। তার পরিবারের বাকি মানুষগুলোর মত সেও ছিল খুব সাধারন। দিলখোলা, হাসিখুশি ছেলেটা ছিল বন্ধু অন্তপ্রান। অসম্ভব সরল আর লাজুক ছিল ও, সুলতানাকে ভালোবাসতো প্রচন্ড, কিন্তু মুখ ফুটে বলার সাহস ছিল না। শেষমেষ অবশ্য বলতে পেরেছিল, তাও সে বহুদিনের সাধনায়। সেই কামালকে আজো গাড়িতে মেয়ে তুলে নিয়ে যাওয়া লম্পট হিসেবে পরিচয় করিয়ে দিতে চায় কিছু মানুষ!

মিউনিখ অলিম্পিকে শেখ কামালের সঙ্গে লেখক

মিউনিখ অলিম্পিকে কামালের সাথে দেখা হয়ে যাবে সেটা ভাবতেও পারিনি। কারন সে ছিল বঙ্গবন্ধুর সাথে লন্ডনে। দেশ স্বাধীন হবার পর বঙ্গবন্ধু দেশে ফিরলেন, নয় মাসের এই দীর্ঘ সময় মানুষটাকে রাখা হয়েছিল তার জন্য খোঁড়া কবরের পাশে। জীবনের ১৭টা বছর জেলের ভেতর কাটানো মানুষটা দেশে ফেরার পরে অসুস্থ হয়ে পড়লেন, হঠাৎ হঠাৎ বুকে ব্যাথা হয়। 

চিকিৎসার জন্য লন্ডনে নেওয়া হলো তাকে, পরিবারের কেউ তাকে একলা ছাড়তে চাইলেন না। লন্ডনে ডাক্তার শুকনো মুখে জানালেন, বঙ্গবন্ধুর শাররীক প্রবলেম হয়েছে, স্ট্রেসফ্রি কোথাও বেশ কয়েকদিন বিশ্রাম নিতে হবে, কোন কাজ-কর্মের ঝামেলায় যাওয়া চলবে না। একেবারে কড়া অর্ডার!

বঙ্গবন্ধু আর কি করেন! বাধ্য হয়ে ডাক্তারের প্রেসক্রিপশন মেনে তাকে যেতে হলো সুইজারল্যান্ড। ডাকলেন ইউরোপের সব রাষ্ট্রদূতদের। নিঃসঙ্গতা কাটানোর চেয়েও সবাইকে ডাকার পেছনে জরুরি কারণ ছিল সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের পৃথিবীব্যাপী স্বীকৃতি আদায় এবং পুনর্গঠনের জন্য তহবিল তৈরি বিষয়ে পরামর্শ করতে।

 

তো প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে ওয়েস্ট জার্মানির রাষ্ট্রদূত হুমায়ূন রশীদ চৌধুরী এলেন জেনেভায়, মিউনিখ অলিম্পিক ফেলে আসতে হয়েছে দেখে কিছুটা বিমর্ষ। কথায় কথায় কামালকে বললেন, তার অলিম্পিক দেখার ভিআইপি টিকেটগুলা জার্মান দূতাবাসের অ্যাসিস্ট্যান্ট টু দ্যা অ্যাম্বাস্যাডরের (উনার ম্যান ফ্রাইডে আরকি) কাছে আছে। এই কর্মকর্তা একজন যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা (আমি) কামাল চাইলে তার সাথে অলিম্পিক দেখতে যেতে পারে। শুনে কামাল উল্লসিত হয়ে উঠলো। কারন তার অলিম্পিক দেখার ইচ্ছে ছিল বহুদিনের।

কামাল সে রাতেই চলে এল ওয়েস্ট জার্মানি ছোটভাই জামালকে সাথে নিয়ে। ওর পোশাক দেখে একটু অবাক হলাম। কামাল স্যুট পড়েছে! ঠাট্টার ছলে জিজ্ঞেস করলাম, কি রে, এইটা কি পরছিস? ফকিরা ফকিরা লাগতেছে। তুই একটা দেশের প্রধানমন্ত্রীর ছেলে…

কামাল প্রথমে ক্ষেপে গেল, তারপর রসিকতাটা বুঝে হাসতে হাসতে বললো, “কি কস ব্যাটা! নরমাল স্যুটের দাম জানস? এইটা ১৫০০ টাকা দিয়ে বানাইছি, ১৫০০! মাস্টার টেইলার্স থেকে বানানো, আর কত দামী পোশাক পড়তে বলস আমারে?”

যে কামালকে কোনদিন কি পড়েছে না পড়েছে, এসব নিয়ে মাথা ঘামাতে দেখিনি, সেই কামালের প্রতিক্রিয়াটা এমনই হবার কথা ছিল। জীবনে একবারই স্যুট বানিয়েছিল কামাল,(খুব সম্ভবত) সেটাও বিদেশযাত্রা সামনে রেখে জরুরি দরকারে। অর্থাৎ বঙ্গবন্ধু অসুস্থ না হলে কামালের লন্ডনে যেতে হত না, আর লন্ডনে যেতে না হলে তার স্যুটটা বানাবারও প্রয়োজন পড়তো না। স্যুটটা ছিল একটা অপ্রত্যাশিত প্রাপ্তি, নিপাট সাধাসিধে জীবনযাপন করে যাওয়া ছেলেটার জীবনে দামী এই স্যুটটা এসেছিল একটা স্মরনীয় ঘটনা হয়ে, তার স্টাইলিশ ফ্রেন্ডসার্কেলে গর্বভরে বলার মত এক উপলক্ষ্য হয়ে, বন্ধুদের বিস্ময়ের মুহুর্ত হয়ে!

মিউনিখ অলিম্পিকে শেখ জামালের সঙ্গে লেখক

আজকে কামালের ১৫০০ টাকার স্যুটপিসকে শার্ট হিসেবে চালিয়ে দিয়ে কিছু মানুষকে বলতে শুনি, এগুলো নাকি শেখ কামালকে নিয়ে চাটুকারিতা। অথচ এরাই শেখ কামালের বিরুদ্ধে করা প্রোপ্যাগান্ডার জবাব দিলে নাখোশ হয়, সত্যটা তুলে আনতে চাইলে দলীয় ভক্তিতে অন্ধ হয়ে যাওয়া আওয়ামীলীগের দালাল বানিয়ে দেয়। এরা কামালের স্যুটপিসের দামটা শুনেই দালাল আর চাটুকার বলে সিদ্ধান্ত দিয়ে দেয়, অথচ বাবার অসুস্থতার সূত্রে হঠাৎ বিদেশযাত্রার প্রয়োজনে বানানো সেই স্যুটটার পেছনে একটা সাধাসিধে ছেলের চাপা গর্ব আর অসম্ভব আনন্দটুকু এরা জানতে চায় না। কি দরকার!

উল্টো যে দেশে একজন শেখ কামালকে ব্যাংক ডাকাত আর লম্পট হিসেবে চেনে বেশিরভাগ মানুষ, সেখানে এসব প্রোপ্যাগান্ডার জবাব না দিয়ে এরা দুপাশ ব্যালেন্স করে কামালকে স্বাধীনভাবে সমালোচনার সুযোগ চায়। অর্ধ শতাব্দী ধরে ব্যাংক ডাকাতি আর ডালিমের বউ তুলে নিয়ে যাওয়ার নির্লজ্জ মিথ্যে সমালোচনা এদের কাছে যথেষ্ট হয়নি, মৃত কামালকে সমালোচনার ব্যবচ্ছেদে ছিন্নভিন্ন করতে এদের আরো সময় চাই!

সরি রে দোস্ত, বড় ভুল এক জমিনে জন্মাইছিলি, বুঝছস! যে প্রজন্মরে একটা স্বাধীন পরিচয় দিতে যুদ্ধে গেছিলাম আমরা, সেই প্রজন্ম আজ চোখ বুজে আমাদের ব্যাংক ডাকাত ভাবে, মেয়ে তুলে নিয়ে যাওয়া লম্পট ভাবে, আমাদের এসব কুকীর্তি স্বাধীনভাবে প্রচারের সুযোগ চায়, সমালোচনার সুযোগ চায়। নির্লজ্জ মিথ্যাচার আর প্রোপ্যাগান্ডা স্টাব্লিশ করার জন্য ৪৫ বছর বোধহয় একেবারেই কম সময়!

ধন্যবাদ হে নতুন প্রজন্মের যোদ্ধারা! আমার প্রিয় সন্তানেরা!

ফুটনোট : আমার প্রোফাইলে আমার আর কামালের মিউনিখের ছবি আর নীচে জামালের সাথে পেছনে মিউনিখ অলিম্পিক মাঠের ব্যাক ড্রপ…

লেখক: যুদ্ধাহত বীর মুক্তিযোদ্ধা, সাব সেক্টর কমান্ডার, সেক্টর-৪, সাব সেক্টর -৪

বহুমাত্রিক.কম

Walton Refrigerator Freezer
Walton Refrigerator Freezer