Bahumatrik | বহুমাত্রিক

সরকার নিবন্ধিত বিশেষায়িত অনলাইন গণমাধ্যম

বৈশাখ ৯ ১৪৩১, মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪

আগরতলার চিঠি (২য় পর্ব)

মেহেদী কাউসার ফরাজী

প্রকাশিত: ০০:২৭, ১৫ মে ২০২১

আপডেট: ০০:৩১, ১৫ মে ২০২১

প্রিন্ট:

আগরতলার চিঠি (২য় পর্ব)

-ছবিতে আগরতলায় অবস্থিত ত্রিপুরা রাজ্য যাদুঘর (ঊজ্জয়ন্তী প্যালেস) এর সামনে লেখক

(১ম পর্বের পর)

বাংলাদেশ সহকারী হাইকমিশন থেকে পার্থিব জীবনের অন্যতম এক মধুর অনুভূতি নিয়ে হোস্টেলের উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম। দুপুরের আগরতলা শহর দেখছি আর ইতিহাসের বই পড়ে স্বপ্নে আঁকা আগরতলার সঙ্গে মেলানোর চেষ্টা করছি। বলা চলে, আগরতলা শহর স্বপ্নের চেয়েও সুন্দর, কল্পনার চেয়েও হৃদয়গ্রাহী।

শত শত বছর ধরে হাওড়া নদীর বুকের উপর তিলে তিলে গড়ে উঠা এই আগরতলা শহর জীবনযুদ্ধে পরাজিত, রাজ্যতাড়িত ও নিপীড়িত মানুষকে অবিরাম আশ্রয় দিয়ে চলেছে। আগরতলা শহর যেন অপরকে দিয়েই সুখী হতে চায়। উত্তরপূর্ব ভারতীয় এই পাহাড়ি জনপদে নানা জাতি, নানা সংস্কৃতি, নানা ভাষা মিলেমিশে একাকার হয়েছে এই শহরের বুকে। এই শহর সবাইকেই আপন করে নেয়। যিনি যখন আগরতলাকে নিজের ভেবেছেন, আগরতলা তার হয়েছে। এই ভালবাসা নিঃশর্ত। এই আবেগ নির্ভেজাল। এই অনুভূতি নিরঙ্কুশ।

ভারতীয় উপমহাদেশের মানুষের ইতিহাস যেমন সমৃদ্ধ, তেমনই চোখের জলে ভেজা। বিশেষত, ব্রিটিশ বেনিয়াদের সময়ই এই উপমহাদেশের মানুষের দুঃখের দিন দীর্ঘায়িত হয়েছে। একদা সম্প্রীতির মেলবন্ধনে আবদ্ধ ভারতীয় জাতিকে ধর্ম ও রাজনীতির তরবারি দিয়ে ছিন্নভিন্ন করেছে সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশ রাজশক্তি। এতে হয়তো তাদের ক্ষমতা নিরঙ্কুশ হয়েছে, কপাল পুড়েছে ভারতবাসীর। সাতচল্লিশে কাঁটাতারে বিভক্ত হয়ে দেশের ভেতরই দেশের মানুষ প্রবাসী হয়ে পড়ে। ধর্মের আফিমে বুঁদ হয়ে থাকা প্রতিবেশীর হাতে বেঘোরে প্রাণ দিতে হয় ভারতমাতার লক্ষ লক্ষ নিরপরাধ সন্তানকে।

পাকিস্তান এবং ভারত নামক দুটো বিভক্ত দেশে কাঁটাতার টপকে লোকবিনিময় শুরু হয়। ভিটেমাটি ছেড়ে এপারের মুসলিম ওপারে, ওপারের হিন্দু এপারে স্থানান্তরিত হয়। কেউ কেউ মাটি আঁকড়ে পড়ে থাকেন। রেডক্লিফের ছুরির আঘাতে বিভক্ত মানচিত্রের স্বাধীনতা, দেশ, জনসংখ্যা হয়তো অর্জিত হয় -মানুষ আর ভালবাসা চিরবিদায় নেয়!

একথাটি বোধহয় ঠিক বললাম না। রাজনৈতিক সিদ্ধান্তে মানুষ হয়তো নিয়ন্ত্রিত হয়েছে, আবেগ-অনুভূতির চাপা বারুদ আজও তাদের হৃদয়ে পুঞ্জীভূত দেখতে পাই। আমি যখন পশ্চিমবঙ্গে ছিলাম, বেশীরভাগ মানুষ জানাতেন তারা স্থানান্তরিত হয়েছেন নিজেদের পৈত্রিক ভিটা থেকে এবং সেজন্য তাদের হৃদয়ের হাহাকার আমি দেখেছি লজ্জাবনত দৃষ্টিতে! আমি যখন আগরতলায় এলাম, একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হল কেবল। চারদিকে যার সঙ্গেই দেখা হচ্ছে, এক বা দুই প্রজন্ম আগেও তাদের ভিটেমাটি ছিলো আজকের বাংলাদেশ নামক ভূখণ্ডে!

১৯৪৭ সালে ভারতীয় উপমহাদেশ দুই অংশে ভাগ হলেও শত শত বছরের মাণিক্য রাজবংশ কর্তৃক পরিচালিত ত্রিপুরা রাজ্য ভারতীয় ইউনিয়নে যুক্ত হয় কয়েক বছর পর। তবে, তখনই পূর্ববঙ্গ (যেটি তখন পাকিস্তানের অংশ হয়) থেকে হিন্দু ও অমুসলিম জনগোষ্ঠীর একটি বিশাল অংশ ত্রিপুরায় আশ্রয় নেন।

এরপর ১৯৭১ সালে যখন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ চলমান, তখনও এই রাজ্যে পনেরো লক্ষাধিক মানুষ শরণার্থী হিসেবে আশ্রয় নেন, যা ছিলো তখন এই রাজ্যের নিজস্ব জনসংখ্যার চেয়েও অধিক! এই যে লাখ লাখ মানুষ সবকিছু ছেড়ে এখানে চলে এসেছেন, বলতে দ্বিধা নেই, যে তারা স্বেচ্ছায় আসেননি! ধর্মীয় ও রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ কর্তৃক নির্যাতিত হয়েই কিংবা প্রাণ হারানোর ভয়েই তারা চলে আসতে বাধ্য হয়েছিলেন (অল্প কয়েকজন হয়তোবা স্বেচ্ছায় এসেছিলেন?!)।

এতকিছুর পরও যখনই বাংলাদেশের কেউ নিপীড়িত হয়ে এখানে আশ্রয় চেয়েছে কিংবা বাংলাদেশের নাগরিকদের ভাল থাকার জন্য কোন সহযোগিতা প্রয়োজন হয়েছে -এই আগরতলা তথা ত্রিপুরার মানুষ বিনা বাক্য ব্যয়ে সর্বোচ্চ সহযোগিতা করেছেন। এটি আমার নিজের বানানো কথা নয়, এটিই ইতিহাসের নির্মম সত্য।

ফলে, এই অতিথিপরায়ণ ও পরোপকারী মানুষের নগরীতে এসে আমার মনে হয়েছে আমার জীবনের অন্যতম তীর্থক্ষেত্রে এসে উপস্থিত হয়েছি। এখানকার কেউ যখন বলেন, আমার বাড়ি বাংলাদেশে ছিলো কিংবা বাংলাদেশে আমার আত্মীয় আছে- হয়তো তারা কেবলমাত্র ছিলো বলেই ছিলো বলছেন কিংবা আছে বলেই আছে বলছেন, কিন্তু, আমি জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত একটি পরিবারের হৃদয়ের হাহাকার অনুভব করে ভেতরে ভেতরে ভয়ঙ্কর লজ্জাবোধ করি, প্রকাশ্যে ক্ষমা প্রার্থনা করতে পারি না বলেও দুঃখ হয়। পৃথিবীতে সংখ্যাগুরু ও সংখ্যালঘুর এই অসম ও নিষ্ঠুর লড়াই না থাকলেই পৃথিবী সুন্দর হবে বলে বিশ্বাস করি।

যাহোক, অনেক কথার ভিড়ে আসল কথা চাপা পড়ে যায়। আগরতলায় এসেছি পড়াশোনা করতে, তাই করছি। সারাদিন ক্লাস-ল্যাব করে দম ফেলার সময় থাকে না। এর ফাঁকে প্রাত্যহিক জীবনযাপনে নানা অভিজ্ঞতা জমা হয়, সহস্র প্রশ্ন জাগে মনের গহীনে।

হোস্টেলে এসে বহুজাতিক সংস্কৃতির স্পর্শ পাচ্ছি। একই ডাইনিং রুমে এক টেবিলে বাঙালি-অসমিয়া-ত্রিপুরা-কাশ্মীরী-মিজো-নাগাল্যান্ড ও অন্যান্য অবাঙালি ভারতীয় বসে একই খাবার খাচ্ছি। বিভিন্ন ভাষায় পরস্পরের সঙ্গে গল্প করছি। এই অভিজ্ঞতা কেবলমাত্র ভারতবর্ষেই হয়তো সম্ভব! হোস্টেলের বিশেষ মিটিংগুলোতে বহুজাতিক অনুভূতি বিনিময় যেমন অধিক বৈচিত্র্যময়, তেমনই ভারতের বিভিন্ন প্রদেশ থেকে আগত সবাই মিলে দাঁড়িয়ে যখন তাদের জাতীয় সঙ্গীত গায়, আমি তখন গাই একই কবির রচিত "আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালবাসি"।

বৈচিত্র‍্যের মধ্যে এই যে স্বকীয়তা, বহুজাতিক মেলবন্ধনের পরেও এই স্বাধীন অস্তিত্ববোধ এবং ইতিহাসের হাড়গোড় ভেঙ্গে বর্তমানের রক্তমাংসের মানুষ হয়ে উঠার এই লড়াইটাই একবিংশ শতাব্দীর একজন বাঙালি ও বাংলাদেশী তরুণের গর্বের বিষয়। এই গৌরব অর্জিত হবার অর্ধশতক পূর্ণ হচ্ছে এ বছরই। এমন এক সন্ধিক্ষণে আমার মতো কোটি মানুষকে "বাংলাদেশী নাগরিক" হিসেবে পরিচয় প্রাপ্তিতে সহায়ক ঐতিহ্যবাহী আগরতলা শহর এবং এই শহরের নির্ভেজাল মানুষদের জানাই লাল-সবুজের শুভেচ্ছা ও কৃতজ্ঞতা। দুঃসহ অতীত ভুলে রাজনৈতিক কাঁটাতারের বাস্তবতা মেনে নিয়েও সাম্প্রদায়িক সঙ্কীর্ণতার ঊর্ধ্বে উঠে উপমহাদেশের `মানুষ` ঐক্যবদ্ধভাবে সমৃদ্ধ আগামীর দিকে এগিয়ে যাবে, সেই প্রত্যাশা করি। (চলবে...)

লেখক: স্নাতকোত্তর শিক্ষার্থী, ত্রিপুরা বিশ্ববিদ্যালয়। ইমেইল: [email protected]

আগরতলার চিঠি (প্রথম খণ্ড) 

বহুমাত্রিক.কম

Walton Refrigerator Freezer
Walton Refrigerator Freezer