-রশীদ ভূঁইয়া
রশীদ ভূঁইয়া, অনন্য সাধারণ এক দেশপ্রেমিক। ২০১৩ সালের এইদিনে (৮ নভেম্বর) দুরারোগ্য ক্যান্সার আক্রান্ত রশীদ ভূঁইয়া ৬৭ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন। দুঃসাহসী রশীদ ভূঁইয়া মহান মুক্তি সংগ্রামে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে সন্মুখ যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন।
১৯৭১ সালের ৫ মার্চ টঙ্গীর শ্রমিক জনতাকে সংগঠিত করে সর্বপ্রথম টেলিফোন এক্সচেঞ্জ ঘেরাও করেন। এসময় পুলিশ ও ইপিআর সদস্যরা গুলি চালালে ৫ শ্রমিক শহীদ হন। ১৯ মার্চ জয়দেবপুরে প্রথম সশস্ত্র প্রতিরোধ যুদ্ধ সংগঠিত হওয়ার সময় টঙ্গী ও গাছা এলাকা থেকে হাজার হাজার শ্রমিক জনতাকে নিয়ে জয়দেবপুরে ঘটনাস্থলের দিকে অগ্রসর হন।
২৫ মার্চ গণহত্যা শুরুর প্রেক্ষাপটে মুক্তিযুদ্ধের গেরিলা বাহিনীর অগ্রনী বিশেষ টিম ক্রেক প্লাটুনের সদস্য হিসেবে তিনি মেজর হায়দারের তত্ত্বাবধানে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। এপ্রিলে ঢাকায় ফিরে এসে সিদ্ধিরগঞ্জ পাওয়ার স্টেশন ধ্বংস করার অপারেশন সফলভাবে পরিচালনা করেন। পরে নির্দেশনা মোতাবেক মে মাসে আগরতলায় চলে যান।
আগরতলা থেকে ন্যাপ-কমিউনিস্ট পার্টি-ছাত্র ইউনিয়নের যৌথ উদ্যোগে সংগঠিত প্রায় ১০ হাজার সদস্যের এক বিশাল গেরিলা বাহিনী গঠনে নেতৃত্ব দেন। ওই বাহিনীর প্রশিক্ষণ শেষে তিনি ডাঃ এস খলিল উল্যাহ ও ডাকসুর তৎকালিন জিএস কমরেড মোর্শেদ আলীর নেতৃত্বে রণাঙ্গণে ফিরেন এবং পূবাইল, গাছা অঞ্চলে ক্যাম্প স্থাপন করে বিভিন্ন অপারেশনে অংশ নেন।
স্বাধীনতা উত্তোরকালে তিনি দেশের ক্ষতিগ্রস্ত অর্থনীতি পুর্নগঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। টঙ্গী শিল্পাঞ্চলে ব্যাপক লুটতরাজ ঠেকাতে এবং যুদ্ধবিধ্বস্ত মিলকারখানা চালু করার বিষয়ে সাহসী পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। নয় মাস মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে মেঘনা টেক্সটাইল মিলে ১০ হাজার বেল কাপড় উৎপাদিত হয়।
মিয়া সিরাজুল হকের নেতৃত্বে প্রতিনিধি দলসহ বঙ্গবন্ধু ও তৎকালিন প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের সাথে কথা বলে তিনি উৎপাদিত ওই ১০ হাজার বেল কাপড় লুটপাটের হাত থেকে রক্ষা করেন। এছাড়াও টঙ্গীর বিভিন্ন মিল-কারখানায় কর্মরত তিন শতাধিক অবাঙালি যুদ্ধবন্দি-পরিবারের নারী-শিশু ও বৃদ্ধদের জেনেভা ক্যাম্পে পাঠনোর ব্যবস্থা করেন।
যুদ্ধ পরবর্তী বিধবস্ত দেশ পুর্নগঠনে কমিউনিস্ট পার্টি ও ন্যাপের যৌথ উদ্যোগে ত্রি-ইউনিয়ন সেচ প্রকল্প প্রণয়ন করে রাশিয়ার অনুদান প্রাপ্ত সেচযন্ত্রের মাধ্যমে পনি সরবরাহ করে টঙ্গী, গাছা ও পূবাইল এলাকায় কৃষি বিপ্লবের সুচনা করেন। ওই প্রকল্পের অধীনে বিএডিসি থেকে প্রাপ্ত বৃহৎ মরিশান মেশিনের মাধ্যমে তুরাগ নদী থেকে পানি এনে টঙ্গীর পাগার এলাকায় খালের মুখে বাঁধ দিয়ে সেখানে ফেলা হতো।
ওই খাল থেকে ৩১টি ছোট মেশিনের মাধ্যমে পাগার, দত্তপাড়া, বনমালা, গাজীপুরা, খাইলকৈর, ঝাজর, মৈরান, দাক্ষিনখান, হায়দরাবাদ, শুকুন্দি ও মাঝুখানের বিস্তীর্ণ কৃষি জমিতে সেচ দিয়ে বোরো ধানের ব্যাপক উৎপাদন বাড়াতে সক্ষম হন। এইসব কাজে রশীদ ভূঁইয়া টঙ্গীর শ্রমিক ও স্বচ্ছল ব্যক্তিদের নিকট থেকে চাঁদা সংগ্রহ করে প্রকল্প ব্যয় নির্বাহ করতেন।
সমাজসেবক হিসেবেও অনুকরণীয়
নিজ বেতনের অংশ এবং স্বচ্ছলদের নিকট থেকে চাঁদা তুলে তহবিল গঠন করে দুঃস্থ্য নারী-পুরুষের মাঝে বিতরণ করতেন রশীদ ভূঁইয়া। বহু মানুষের চাকুরির ব্যবস্থা করেন। কম বা বিনা খরচে চিকিৎসার জন্য পার্টির সমর্থক ডাক্তারদের নিকট সুপারিশসহ রোগী পাঠাতেন। দেশের শিক্ষা ও স্বাস্থ্যখাত উন্নয়নে ব্যপক অবদান রাখা বেসরকারী সংস্থা পিএসটিসি’র কার্যক্রমে নির্বাহী বোর্ডের সদস্য হিসেবে এবং সহসভাপতির দায়িত্বে থাকাকালে ব্যপক ভূমিকা রাখেন।
শ্রমিক আন্দোলনে নেতৃত্ব দানের অভিজ্ঞতা অর্জন করায় তিনি রাশিয়া ও চেকোশ্লোভাকিয়ায় দীর্ঘ মেয়াদি প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। এছাড়াও রাজনৈতিক কর্মকান্ড পরিচালনার জন্য আমন্ত্রণ পেয়ে তিনি সোভিয়েত রাশিয়া, চেকোশ্লোভাকিয়া, হাঙ্গেরী, বুলগেরিয়া, যুগোশ্লোভাকিয়া, নেপাল, ভারত, থাইল্যান্ড এবং সিঙ্গাপুরে শুভেচ্ছা সফরের পাশাপাশি আইএলও’র আমন্ত্রণেও বহু সেমিনার ও সম্মেলনে যোগ দেন।
১৯৪৭ সালের পহেলা জানুয়ারি রশিদ ভূঁইয়া টঙ্গীর নোয়াগাঁও এলাকায় জন্মগ্রহণ করেন। নোয়াগাঁও সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রাথমিক শিক্ষা শেষ করে ১৯৬৩ সালে টঙ্গী হাইস্কুল থেকে ম্যাট্রিকুলেশন করেন। ১৯৬৫ সালে ঢাকার কায়েদে আজম (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী) কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট পাশ করেন। ছাত্র জীবন থেকেই মেধাবী ছাত্র হিসেবে পরিচিতি লাভের পাশাপাশি রাজনীতিতেও ছিলেন সক্রিয়।
বি.এ পড়া অবস্থায় ১৯৬৬ সালে রশীদ ভূঁইয়ার পিতা জাহেদ আলী মারা গেলে তাঁর শিক্ষা জীবনে ছেদ পড়ে। তখন রাজনৈতিক কর্মকান্ড পরিচালনার পাশাপাশি বাধ্য হয়ে তাঁকে কর্মজীবনে প্রবেশ করতে হয়। এরপর তিনি মূল ধারার বামপন্থী রাজনীতিতে জড়ান এবং কমিউনিস্ট পার্টির সদস্যপদ লাভ করেন।
বামপন্থী রাজনীতির সাথে যুক্ত থেকে টঙ্গীর মেঘনা টেক্সটাইল মিলের শ্রমিক কর্মচারিদের নেতৃত্ব দিয়েছেন দীর্ঘ সময়। ১৯৭৫ সালে সপরিবারে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার পর অন্যান্য প্রতিবাদী নেতাদের মতো রশীদ ভূঁইয়াকেও কারাবরণ করতে হয়েছিল। এ ঘটনায় তিনি বিনা বিচারে নয় মাস জেল খাটেন।
বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুর রশিদ ভূঁইয়া আদর্শিক ও নিষ্ঠাবান শ্রমিক নেতা হিসেবে ছিলেন সর্বমহলে সুপরিচিত। তিনি ছিলেন মুক্তিযুদ্ধে অন্যতম সাহসী মুক্তিযোদ্ধা, আদর্শবান রাজনীতিক ও শ্রমিক সংগঠক। আমৃত্যু তিনি একজন নি:স্বার্থ সমাজসেবী হিসেব জনগণের কাছাকাছি থেকে কীর্তিমান মহান ব্যক্তিত্ব হিসেবে শ্রমজীবী মানুষের মনে জায়গা করে নিয়েছিলেন। বর্তমান বাংলাদেশে এমন ব্যক্তিত্বশীল নেতার বড়ই অভাব। স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে তার পরিচিতি ছিল এক আপোষহীন যোদ্ধা হিসেবে।
অসহায় ও গরিব মানুষের সন্তানদের লেখাপড়া ও স্বাস্থ্য সেবায় তিনি ছিলেন নিবেদিত প্রাণ। প্রগতিশীল এই নেতা বাংলাদেশ কমিউনিস্ট পার্টির একনিষ্ঠ কর্মী হিসেবে কৃষক সমিতি, ক্ষেতমজুর সমিতির সংগঠকের পাশাপাশি অসাধারণ গুণাবলী ও মানব প্রেমের দৃষ্টান্ত অনুসরণ করে শেষ বয়সে গরীব-দু:খী-মেহনতি মানুষের কল্যাণে কাজ করে গেছেন।
শ্রমজীবি মানুষের বন্ধু হয়ে প্রগতিশীল শ্রমিক রাজনীতির সুতিকাগার টঙ্গী অঞ্চলে তিনি বহু ঐতিহাসিক ঘটনার সাথে যুক্ত ছিলেন। গণমানুষের কাজে নানা ঘাত প্রতিঘাত পাড়ি দিয়ে জীবন কাটিয়েছেন। তিনি একাধারে মানুষের রাজনৈতিক অধিকার প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি সমাজ উন্নয়নের জন্য কাজ করেছেন।
রশীদ ভূঁইয়া তাঁর ব্যক্তিত্ব, স্বকীয়তা ও কর্মে নিজেকে টঙ্গী-গাজীপুরের গন্ডি ছাড়িয়ে দেশের বৃহত্তর রাজনৈতিক অঙ্গনে সৎ, নিষ্ঠাবান রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হয়েছিলেন। আদর্শের প্রতি অবিচল আস্থা রেখে দেশ ও জাতির কল্যাণে শোষণ ও বৈষম্যহীন সমাজ গড়তে আমৃত্যু সংগ্রাম করেছেন। রশীদ ভূঁইয়া তাই নিজ কর্মগুণে দেশের প্রতিটি শ্রমজীবী মানুষের অন্তরে অনন্তকাল বেঁচে থাকবেন।
প্রয়াত এই নেতা মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় যেমন বার বার সন্মুখ যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছেন, তেমনি ভাবে ১৯৭৫ পরবর্তী সময়ে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখলকারী জিয়াউর রহমানের অবৈধ কার্যক্রমের বিরুদ্ধেও রুখে দাঁড়িয়েছিলেন। কৃষক ও শ্রমিকদের সংগঠিত করে দূর্বার আন্দোলন গড়ে তুলার কারণে এই নেতা জিয়াউর রহমানের রোষানলে পড়েন। কোন প্রকার আপোষ না করার কারণে তাকে কারাবরণসহ চাকুরীচ্যুত হতে হয়। একইভাবে স্বৈরাচার এরশাদের বিরুদ্ধেও তিনি দূর্বার আন্দেলন গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছেন। রাজনৈতিক ময়দানে তিনি অকুতোভয় সৈনিকের মতই আমৃত্যু লড়াই সংগ্রাম করেছেন।
একজন শ্রমিক হিসেবে তিনি ছিলেন অত্যন্ত পরিশ্রমী ও নেতা হিসেবে শ্রমিকবান্ধব। শ্রমিকদের স্বার্থ রক্ষায় তিনি সব সময় ছিলেন সোচ্চার। সবকটি শ্রমিক আন্দোলন ও দাবি আদায়ে থাকতেন লড়াকু এক আপোষহীন নেতার ভূমিকায়। জিয়াউর রহমান ও স্বৈরাচার এরশাদের বিরুদ্ধে গড়ে তোলা আন্দোলনের সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছেন। দিকনির্দেশনা দিয়ে তিনি আন্দোলনে শ্রমিকদের সংগঠিত রাখতেন। এসব আন্দোলনে তিনি টঙ্গী, পল্টন ময়দানসহ রাজপথ রাখতেন উত্তপ্ত। ‘৭৫ পরবর্তী মৌলবাদি গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে প্রতিটি কর্মসূচিতে সক্রিয় ছিলেন। ঘাতক দালাল নির্মুল কমিটির টঙ্গী শাখার আহ্বায়ক হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন।
(তথ্যসূত্র: রশীদ ভূঁইয়া সম্পর্কে প্রকাশিত বিভিন্ন সংবাদ ও স্মারক প্রকাশনা ‘নিঃশঙ্ক সারথি’।)
বহুমাত্রিক.কম