Bahumatrik | বহুমাত্রিক

সরকার নিবন্ধিত বিশেষায়িত অনলাইন গণমাধ্যম

চৈত্র ১৩ ১৪৩০, বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪

মেধাবী হাওর কণ্যা তানিয়ার সহকারী জজ হওয়ার গল্প

মোঃ নজরুল ইসলাম, নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রকাশিত: ২৩:৩৫, ২৭ জানুয়ারি ২০২৩

আপডেট: ১৬:৫২, ২ ফেব্রুয়ারি ২০২৩

প্রিন্ট:

মেধাবী হাওর কণ্যা তানিয়ার সহকারী জজ হওয়ার গল্প

প্রবল ইচ্ছাশক্তি আর অধ্যবসায় থাকলে যেকোনো প্রতিবন্ধকতা ডিঙিয়ে লক্ষ্যে পৌঁছানো যায়, তা প্রমাণ করে দেখিয়েছেন হাওরের বুক বেড়ে ওঠা মেধাবী চৌকস অদম্য হাওর কণ্যা তানিয়া। নিজ মেধা ও যোগ্যতায় কৃতিত্বের স্বাক্ষর রেখে আজ সাফল্যের সিঁড়িতে উত্তীর্ণ স্বপ্নবাজ মেয়েটি।

দারিদ্র্যের কষাঘাত ও অভাব-অনটনের সংসারে বেড়ে ওঠা ছোটবেলায় অন্য দশজনের মতো ডাক্তার কিংবা ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার স্বপ্ন দেখার সাহস হয়নি তার। কিন্তু নজরুল বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তার মনে স্বপ্ন দানা বাঁধে। অজপাড়াগাঁয়ে নিম্নবিত্ত পরিবারে জন্ম নেয়া মেয়েটি এর আগে কখনও বড় স্বপ্ন দেখার সাহস পায়নি। পরিবারের আর্থিক অসচ্ছলতা তাকে ভাবাত। কিন্তু কে জানত- স্বপ্নহীন এই মেয়েটির জন্য বিধাতা অনেক বড় পরিকল্পনা করে রেখেছিল। নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়ের আঙিনায় প্রবেশ করে সে বুঝতে পারে মানুষ তার স্বপ্নের চেয়ে বড়। তাই লেখাপড়া করতে হবে এবং স্বপ্ন দেখতে হবে। আসলে গল্পটি তানিয়া আক্তারের। ১৫তম বাংলাদেশ জুডিশিয়াল সার্ভিস পরীক্ষায় সহকারী জজ বা জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে সুপারিশপ্রাপ্ত হয়েছেন তিনি।

সম্প্রতি বাংলাদেশ জুডিশিয়াল সার্ভিস কমিশনের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত সুপারিশপ্রাপ্তদের একটি তালিকা থেকে এ তথ্য জানা যায়।

নেত্রকোনা জেলা সদরের মদনপুর ইউনিয়নের একটি নিম্নবিত্ত পরিবারে জন্ম তানিয়া আক্তারের। কৃষক বাবার মেয়ে হয়ে বড় স্বপ্ন দেখা তার কাছে আকাশ কুসুম মনে হত সেই শৈশবে । ডাক্তার কিংবা ইঞ্জিনিয়ারতো বহু দূরের ভাবনা, যখন সে হাইস্কুলে পড়তেন তখন তার ভাবনা ছিল মাধ্যমিকের পাঠটুকু চুকলেই বুঝি সফলতা। কিন্তু ভালো ফলাফল করতে থাকেন তিনি। ধীরে ধীরে আত্মবিশ্বাস বাড়ে। মদনপুর শাহ সুলতান হাইস্কুল থেকে ২০১২ সালে এসএসসি পাসের পর ভর্তি হয় শাহ সুলতান ডিগ্রি কলেজে।

তানিয়া বলেন, এই সময়টায় আমি ছিলাম পাখির মত উড়ন্ত। জীবনের অর্থ বুঝতে শিখিনি তখনও। কিন্তু এগিয়ে গিয়েছি শুধু। কলেজে উঠে ভেবেছিলাম, ইন্টারমিডিয়েট শেষ হলেই বুঝি বেঁচে যাব। এতেই আমি খুশি।

উচ্চাকাঙ্ক্ষাহীন তানিয়া কখনও ভাবতেও পারেনি সে একদিন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়বে। কিন্তু প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় কৃতিত্বের পরিচয় দিয়ে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন ও বিচার বিভাগে পড়ার সুযোগ পান তিনি। আইন বিভাগের প্রথম ব্যাচের শিক্ষার্থী হিসেবে ২০১৫-১৬ শিক্ষাবর্ষে ভর্তি হন। সেই থেকে তার স্বপ্ন ধীরে ধীরে বড় হতে থাকে। পদে পদে আর্থিক প্রতিবন্ধকতা তাকে দমিয়ে রাখতে পারেনি। ক্লাসের বন্ধু আর বিশ্ববিদ্যালয় পরিমণ্ডলের প্রত্যেকে আত্মীয়ের মত তানিয়ার পাশে ছিল। সে কারণেই বিভাগে তার ফলাফল দিনদিন ভালো থেকে আরো ভালো হতে থাকে। তার আত্মবিশ্বাস ও স্বপ্ন বড় হতে থাকে। সে ভাবতে সাহস পায় যে সেও বিচারক হতে পারে। এভাবেই স্বপ্নের অঙ্কুরোদগম। আজ সেই স্বপ্ন পূরণ হয়েছে। বিচারক হিসেবে সুপারিশপ্রাপ্ত হয়েছে সে।

এই পথচলায় সে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে মহান সৃষ্টিকর্তার প্রতি। আনন্দে অভিভূত তানিয়া বলেন, ‘আমার স্বপ্ন এত আকাশছোঁয়া ছিল না। সৃষ্টিকর্তার কাছে অনেক শুকরিয়া, তিনি আমাকে এই অর্জনের শক্তি ও বিশ্বাস দিয়েছেন। আমার বাবা-মাসহ আত্মীয়-স্বজন যারা আমাকে তিলে তিলে করে মানুষ করেছেন তাদের প্রতি আমার কৃতজ্ঞতার শেষ নেই। পাশাপাশি বিভাগের শ্রদ্ধাভাজন শিক্ষক থেকে শুরু আমার শুভাকাঙ্ক্ষী ও হিতাকাঙ্ক্ষীগণ আমাকে মেন্টাল এবং লজিক্যাল সাপোর্ট দিয়ে সবসময় পাশে ছিলেন তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা।’ সহপাঠীদের ধন্যবাদ দিতেও ভোলেনি সে।

তার এই অর্জনে নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য সহ আইন ও বিচার বিভাগের সবাই অত্যন্ত উচ্ছ্বসিত। এ ব্যাপারে উপাচার্য প্রফেসর ড. সৌমিত্র শেখর বলেন, প্রচন্ড ইচ্ছা শক্তি, সময়ের যথাযথ ব্যবহার, লেখাপড়ায় গভীর মনোযোগ, শিক্ষক ও সহপাঠীদের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজিয়ে রাখা একজন ছাত্র বাছাত্রীকে অনেকদূর নিয়ে যেতে পারে। এতে সে যা অর্জন করে, অর্জিত সেই শক্তি দিয়ে পরের প্রতিবন্ধকতা গুলো অতিক্রম করা তার পক্ষে সহজ হয়। তানিয়া ও তেমনি ধীশক্তি সম্পন্ন লড়াকু এক ছাত্রীর নাম, যে সমস্ত প্রতিকূলতা অতিক্রম করে সবার সামনে আজ দৃষ্টান্ত হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করেছেন। বিভাগের শিক্ষক শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয়ের সবাই আইন ও বিচার বিভাগ তানিয়ার এমন অর্জনে আনন্দিত।

বিভাগের প্রধান মো. আহসান কবির বলেন, ‘এটি আমাদের অনেক বড় একটি প্রাপ্তি। আইন বিভাগের যাত্রা শুরু হয়েছে ২০১৫-১৬ শিক্ষাবর্ষ থেকে। তারা আমাদের প্রথম ব্যাচের শিক্ষার্থী। অনেক কষ্ট পরিশ্রম করে তারা ক্লাস পরীক্ষাগুলো দিয়েছে। শিক্ষক সংকট ছিল, ক্লাসরুম সংকট ছিল, কিন্তু তাদের পরিশ্রমের কারণে তারা এটি অর্জন করতে পেরেছে। এভাবেই আইন বিভাগ এগিয়ে যাক, ভবিষ্যতে এ সংখ্যাটা উত্তরোত্তর বাড়ুক- এটিই প্রত্যাশা। সে উদ্দেশ্যে আমরা আমাদের সর্বোচ্চটুকু দিতে বদ্ধপরিকর।’

বহুমাত্রিক.কম

Walton Refrigerator Freezer
Walton Refrigerator Freezer