Bahumatrik | বহুমাত্রিক

সরকার নিবন্ধিত বিশেষায়িত অনলাইন গণমাধ্যম

বৈশাখ ২ ১৪৩১, বুধবার ১৭ এপ্রিল ২০২৪

হতভাগ্য নবাবের শহরে

আশরাফুল ইসলাম

প্রকাশিত: ০১:৫১, ১ ডিসেম্বর ২০১৯

আপডেট: ০১:২৭, ২৪ জুন ২০২১

প্রিন্ট:

হতভাগ্য নবাবের শহরে

ছবি: প্রতিবেদক

শ্রাবণের ভরা বর্ষা। ভাগীরথীর থই থই ঘোলা জলে ইঞ্জিন চালিত নৌকায় চেপে বসেছি। ছোটখাটো ফেরি বললেও বোধহয় ভুল হয় না নৌযানটিকে! স্কুল-কলেজ পড়ুয়া ছেলে-মেয়ে, নানা পেশাজীবির সঙ্গে মোটরসাইকেল নিয়ে অনেক আরোহীও রয়েছেন এতে। মিনিট দুই-তিনে ফুরাবে এই নৌযাত্রা। মুর্শিদাবাদের লালবাগ ফেরিঘাটের এপাড় থেকে ওপাড়।

ঐতিহাসিক এই জনপদের প্রতি কদমে জড়িয়ে ইতিহাসে কত না আখ্যান! কল্পনায় বিস্ফারিত চোখে সেই স্মৃতি অনুভবে স্পর্শ করার ক্ষীণ চেষ্টা। ভাগীরথীর বুকে দাঁড়িয়ে দু’পাড়ের শ্যামল জনপদের প্রতি কী যেন অসীম মায়া। পুঁথির আসরে, দাদী-নানীর গল্পে আশৈশব দুর্নিবার আকর্ষণে টেনেছে যে জনপদ, বাস্তবে তার স্পর্শ সীমাহীন এক উচ্ছ্বাসে ভরে দিয়েছে মনপ্রাণ। কল্পনায় ভেসে উঠছে, ভাগীরথীর স্রোতে দোল খেয়ে ক্রমশ: এগিয়ে আসছে কোনো রাজকীয় নৌবহর। নদীতীরে রব উঠছে সেই রাজাধিরাজের জয়োধ্বনি। কল্পনায় ক্ষণিকের এমন আবেশ কাটিয়ে পা রেখেছি ভাগীরথীর পশ্চিম পাড়ে। ধীর পদক্ষেপে দৃষ্টি মেলে এগিয়ে চলা। গন্তব্য ইতিহাসের বেদানসিক্ত খোশবাগ। যেখানে সমাহিত বাংলা-বিহার-ঊড়িষ্যার হতভাগ্য শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজ-উদ-দৌলা, তাঁর প্রিয়তমা বেগম লুৎফ-উন-নিসা, মাতামহ নবাব আলিবর্দি খাঁসহ নিকট স্বজনরা।

পিচ ঢালাই পথ ধরে অটোরিক্সায় ৫-৭ মিনিট লাগে খোশবাগের সেই সমাধিসৌধের ফটকে পৌছাতে। প্রহরীবিহীন ফটকের কাছেই শোভা পাচ্ছে ভারতের প্রত্নতত্ত্ব দপ্তরের বাংলা ও ইংরেজিতে দু’খানি বিজ্ঞপ্তি। কয়েক শতাব্দি প্রাচীন এই সমাধিক্ষেত্রের চারপাশের সেই সময়কার উঁচু প্রাচীরের অনেক অংশ ধ্বসে পড়ছে। স্বদেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষায় তরুণ নবাব সিরাজের মরণপণ সংগ্রামের আদর্শকে ধারণ করে তাঁর সমাধিতে শ্রদ্ধা জানিয়ে এখানে বহু স্বাধীনতা সংগ্রামীই রক্তশপথ নিয়েছেন। সেইসব বিপ্লবীর পূণ্য পদস্পর্শে ধন্য এই সমাধি চত্বরে বহু ইতিহাসের এক জীবন্ত স্মারক। মির্জা জাফরদের বিশ্বাসঘাতকতায় বাংলার স্বাধীনতার যে সূর্য অস্তমিত হয়, তাতে সুদীর্ঘ পরাধীনতার শৃঙ্খলে পিষ্ট গোটা ভারতবর্ষই টের পায় হাড়ে হাড়ে। ইতিহাসের সেই মর্মান্তিক ট্রাজেডির সূচনা নবাব সিরাজের বর্বর হত্যাযজ্ঞের মধ্য দিয়ে।

সমাধিসৌধের প্রধান ফটক পেরিয়ে মনোমুগ্ধকর স্নিগ্ধ এক পরিবেশ। ওয়াকওয়ের দু’পাশে সবুজঘাসের চত্বর। সীমনাপ্রাচীর ঘিরে উঁচু ঘাসের সারি নয়নাভিরাম এক দৃশ্যের অবতারণা করছে। সবুজের এই সমুদ্রেই সেই সমাধি তীর্থ। আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অব ইন্ডিয়ার রক্ষণাবেক্ষণে প্রত্নতাত্ত্বিক এই নিদর্শন দেখতে ভারতবর্ষের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আজও বহু দর্শনার্থীর আগমন ঘটে এখানে। তবে এই অঞ্চলের কয়েক শতাব্দির ইতিহাসের সঙ্গে যাঁদের নিবিড় পরিচয় নেই তারা কেবল চুন-সুরকির কিছু স্থাপনা আর সবুজ চত্বর দেখেইে ফিরে যাবেন। এখানে সমাধিস্থদের সঙ্গে ভারতবর্ষের রক্তস্নাত ইতিহাসের বাকবদলের যে সুগভীর সম্পর্ক তা হয়ত অজানাই থেকে যাবে।

সমাধিসৌধের প্রবেশদ্বারে আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অব ইন্ডিয়া’র দু’খানি পরিচিতিমূলক বিজ্ঞপ্তি ও বাইরে সচিত্র বিবরণ ব্যতিত ঐতিহাসিক গুরুত্বপূর্ণ এই স্থাপনাকে দর্শনার্থীদের মাঝে তুলে ধরার উল্লেখযোগ্য কোনো প্রচেষ্টা চোখে পড়লো না। সচিত্র বিবরণ সম্বলিত ছোট ব্যানারে উৎকীর্ণ ঐতিহাসিক খোশবাগ বা ‘আনন্দ উদ্যান’র সংক্ষিপ্ত পরিচিতি।

তাতে লেখা আছে, ‘‘নবাব আলিবর্দি খাঁ দিল্লির জামা মসজিদের অনুকরণে ৭.৬৫ এক জমির উপরে ‘খোশবাগ’ বা ‘গার্ডেন অব হ্যাপিনেস’ তৈরি করেন। এটি চারদিকে ২, ৪৭১ ফুট দেয়াল দিয়ে ঘেরা। এখানকার সাজানো সুন্দর বাগানের মাঝে নবাব আলিবর্দি খাঁ, আলিবর্দি খাঁ’র মা, সিরাজ-উদ-দৌলার বেগম লুৎফউন্নিসা এবং নবাব পরিবারের অন্য সদস্যদের সমাধি সমাহিত রয়েছে।’’

‘তাছাড়াও এখানে চারদিকে কারুকার্যখচিত বারান্দা দিয়ে ঘেরা চৌকাকৃতির সমতল ছাদবিশিষ্ট ঘরের মধ্যে বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজ-উদ-দৌলার সমাধি রয়েছে। এখানে চারদিকে দেয়ালবেষ্টিত চত্বরের মধ্যে ব্রিটিশদের গুলিতে নিহত দানিশ ফকিরের সমাধিও রয়েছে-যিনি নবাবের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করে সিরাজ-উদ-দৌলার গুপ্ত স্থান দেখিয়ে দিয়ে সিরাজকে হত্যায় সাহায্য করেছিলেন।’
খোশবাগের বর্ণনায় আরও উল্লেখ রয়েছে, ‘খোশবাগের গোলাপ বাগানে ১০৮ রকমের গোলাপ পাওয়া যায়। ১৭৮৬ খ্রীষ্টাব্দে লুৎফউন্নিসার মৃত্যুর পর তাকে সিরাজের পাশেই সমাধিস্থ করা হয়। বাগানের একেবারে দূরবর্তী প্রান্তে রয়েছে খোশবাগ মসজিদ। ১৭৪০ খ্রীষ্টাব্দে এই মসজিদ নির্মিত হয়।’

এই সবুজ সমাধিচত্বরে অগ্রসর হতে গিয়ে মনে পড়ছিল ইতিহাসের সুদীর্ঘ আখ্যান। সেসবের কিঞ্চিত তুলে ধরার প্রয়াসও যদি নিতো ভারতীয় প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ তবে দর্শনার্থী, তথা প্রজন্ম জানতে পারতো তাদের শৌর্য-বীর্যের ইতিহাস। বাঙালি জাতি ও ভারতবর্ষের গৌরবদীপ্ত ইতিহাস যে এই নবাব পরিবারকে ব্যতিরেকে অসম্পূর্ণ তা বলার অপেক্ষা রাখে না। ‘নিরাভরণ-নিরাবরণ’ এই সমাধিসৌধও দুর্ভাগ্যের অমোঘ পরিণতিই বরণ করেছে।

শ্রাবণের মধ্য দুপুর, খরতাপ অবিরাম ঘাম ঝরিয়ে যাচ্ছে। বিশাল সমাধি চত্বরে কোনো জনমানবের দেখা নেই। নিস্তব্ধ এক চরাচর। সীমানাপ্রাচীর ঘেঁষে সুউচ্চ গাছে ঠাঁই নেয়া পাখিরা থেমে থেমে রব তুলছে। বাতাসের প্রবাহ নেই, সব যেন থমকে আছে। কয়েক শতাব্দি ধরে ইট-সুরকিতে চাপা সমাধিতে যে বেদনার দীর্ঘশ্বাস, স্তব্ধ এই দুপুরে তা যেন আরও প্রকট হয়ে উঠলো।

বহুভাষাবিদ-ঐতিহাসিক ও অনুবাদক আবুল কালাম মোহাম্মদ যাকারিয়ার ‘নবাব সিরাজ-উদ-দৌলা’ শীর্ষক নাতিদীর্ঘ গ্রন্থটি বাংলার শেষ স্বাধীন নবাবের বিষয়ে আমার বহু জিজ্ঞাসারই মীমাংসা করেছে। নবাবের সমাধিসৌধে এসে অনুপুঙ্খ সেই বিবরণের সঙ্গে মেলাবার চেষ্টা। নিস্তব্ধ সেই অঙ্গনের ভেতরে হঠাৎ দেখা মিললো স্থানীয় দুই কিশোরের। তারা কেবল হতভাগ্য নবাবের সমাধিটি দেখিয়ে দিয়েই লাপাত্তা। তাদের কাছে এই অঙ্গন নিছকই ‘চোর-পুলিশ’ খেলার এক জায়গা। পরম শ্রদ্ধেয় মাতামহ নবাব আলিবর্দি খাঁ ও প্রিয়তমা বেগম লুৎফ-উন-নিসার মাঝে শায়িত নবাব সিরাজ-উদ-দৌলা। কয়েক শতাব্দি পেরিয়ে বিবর্ণ সমাধিসৌধের ভবনটি। অদূরেই খোশবাগ মসজিদ। এই মসজিদে পাঁচ ওয়াক্তে ধ্বনিত হয় না আযানের মধুর ধ্বনি। হয় না নামাজ আদায় কিংবা পরম করুণাময়ের কাছে প্রার্থনা।

আত্মত্যাগ আর বীরত্বকেই মানুষ মনে রাখে, কাপুরুষতাকে ভুলে যায়। বাংলা তথা ভারতবর্ষের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব রক্ষায় তরুণ নবাব সিরাজের যে সংগ্রাম আজকে কিংবদন্তি ছড়িয়েছে-তার পেছনেও রয়েছে অনেক গৌরবগাঁথা। কিন্তু বহুকাল এই নবাবকেই কালিমালিপ্ত করার প্রচেষ্টাও হয়েছে তাঁর স্বদেশে। তাঁর চরিত্র হননের অংশ হিসেবে ফরমায়েশি ইতিহাসবেত্তাদের আবির্ভাব ঘটেছে। শত শত পৃষ্ঠা ভরে তোলা হয়েছে নবাবের ‘কুকীর্তির আখ্যানে’। তদুপরি সেই হীনপ্রচেষ্টা সফল হয়নি। বহু বাঙালি আজও অবনত হয় নবাবের সমাধিপার্শ্বে। সেই তরুণ বীর হয়ত তখন সবার অলক্ষ্যেই হেসে উঠেন।

নবাব সিরাজের সেই স্মৃতিধন্য জনপদে তাঁর স্মৃতির সুরক্ষায় যে বিশেষ পদক্ষেপ থাকার কথা বাস্তবে তা দৃশ্যমান হলো না। বাংলার প্রত্যন্ত জনপদে বহু জমিদারবাড়ি আজও সগৌরবে মাথা তুলে ঐতিহ্যের পতাকা উড্ডীন রেখেছে। কিন্তু বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজের স্মৃতি মুছে ফেলতে তৎপরতা চলেছে কয়েক শতাব্দি ধরেই। নাট্যমঞ্চে আর লোকজ পুঁথির আসরে সিরাজের যে আখ্যান লোকমুখে ফিরেছে বাস্তবে তার অস্তিত্ব নেই।

খোঁশবাগের সমাধিসৌধ থেকে বেদনার দীর্ঘশ্বাস নিয়ে ফিরে আসার পথে স্থানীয়দের খোঁজ করি নবাব সিরাজ-উদ-দৌলার স্বপ্নের হীরাঝিল প্রসাদের কথা। ইতিহাস বিধৃত, এই হীরাঝিল প্রাসাদ থেকেই নবাব সিরাজ-উদ-দৌলা পলাশীর প্রান্তরে যাত্রা করেছিলেন। মীর জাফরদের বিশ্বাসঘাতকতায় যুদ্ধে পরাজয়ের পর স্ত্রী লুৎফ-উন-নিসা ও একমাত্র শিশু কন্যা উম্মে জোহরাকে নিয়ে শেষবারের মতো হীরাঝিল প্রাসাদ ছেড়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু নবাবের স্মৃতিধন্য সেই জনপদের মানুষেরা আজ ভুলে গেছেন তাদের হতভাগ্য নবাবকে। হিরাঝিল প্রাসাদের খোঁজ স্থানীয় অধিবাসীরা দিতে পারলেন না।

ঐতিহাসিক আবুল কালাম মোহাম্মদ যাকারিয়া গ্রন্থ নবাব সিরাজ-উদ-দৌলা পাঠে জানতে পারছি, নবাব হীরাঝিল প্রাসাদ ছেড়ে গেলে বিশ্বাসঘাতক সেনাপতি মির জাফর প্রাসাদ দখল করেন। ১৭৫৭ সালের ২৯ জুন লর্ড ক্লাইভ হীরাঝিল দরবার কক্ষে মসনদে মীরজাফরকে নবাব হিসেবে হাত ধরে বসিয়ে দেন। হীরাঝিল প্রাসাদের কোষাগার থেকে ওই সময় বিপুল পরিমাণ সোনা, রূপা, সোনার টাকা, হীরা, জহরত, চুনি, পান্না ইংরেজরাসহ নবাবে সাথে বিশ্বাসঘাতরা ভাগ বাটোয়ারা করে নেন।

পুতুল নাবাব মির জাফরের সময় থেকেই হীরাঝিলের পতন শুরু হয়। বর্তমানে নবাব সিরাজের প্রিয় হীরাঝিল দুই-একটি চত্বরের ভিত্তিভূমি গভীর জঙ্গলে আচ্ছন্ন। প্রাসাদের অস্তিত্ব না থাকলেও ভিত্তিভূমিটুকু বেদনার স্বাক্ষী টিকে আছে। মুর্শিদাবাদের অদূরে জাফরাগঞ্জের বিপরীতে ভাগীরথীর পশ্চিমতীরে অবস্থিত হীরাঝিল নবাব সিরাজের হত্যার পর সর্বস্ব লুটপাটের পাশাপাশি একপর্যায়ে প্রাসাদটি ইংরেজরা ধ্বংস করে দেয়। বাকিটুকু স্রোতধারা ভাগীরথীর গর্ভে বিলীন। নানা আলীবর্দী খাঁর থেকে অর্থ নিয়ে ১৭৪৬ সালে তরুণ ভাবী নবাব সিরাজ গড়ে তুলেন মনোরম প্রাসাদ হীরাঝিল।

হীরাঝিলের এই পরিণতি হলেও ইংরেজদের আধিপত্যের যুগে গড়ে উঠা হাজারদুয়ারি প্রাসাদ আজও টিকে আছে পর্যটক মনোরঞ্জনে। প্রাসাদে প্রদর্শিত সামগ্রী ও স্মৃতিস্মারকের ভিড়ে নবাব সিরাজের অস্তিত্ব সামান্যই। লোকমুখে শোনা গেল নবাব সিরাজের বংশধরেরা অস্তিত্বহীন হলেও মির জাফরের বংশধরো আজও সেই জনপদে আধিপত্য ধরে রেখেছে। স্বদেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষায় রক্ত দিয়ে যে ইতিহাস লিখে গেছেন নবাব সিরাজ-মুক্ত স্বদেশে তাঁর এই উপেক্ষা বিশ্বাসঘাতকতার ইতিহাসকেই দীর্ঘায়িত করে।

লেখক: সাংবাদিক ও গবেষক।

বহুমাত্রিক.কম

Walton Refrigerator Freezer
Walton Refrigerator Freezer