Bahumatrik | বহুমাত্রিক

সরকার নিবন্ধিত বিশেষায়িত অনলাইন গণমাধ্যম

বৈশাখ ১১ ১৪৩১, বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪

স্মরণঃ জননেতা মফিজ আলী

অনন্য আদিত্য

প্রকাশিত: ১৩:২৭, ৮ অক্টোবর ২০২০

প্রিন্ট:

স্মরণঃ জননেতা মফিজ আলী

 

“বিপ্লবের জন্য যাদের প্রাণের টান আছে এবং মনের বল আছে
ইতিহাস কৃষক-শ্রমিকের এই সংগ্রামে তাদের টেনে আনবেই।”-মফিজ আলী

শ্রমিক-কৃষকের সংগ্রামের প্রতি এমন যার আস্থা তিনি এতদ্বাঞ্চল তথা বৃহত্তর সিলেটের প্রগতিশীল রাজনীতির পুরোধা ব্যক্তিত্ব মফিজ আলী। তিনি ১৯২৭ সালের ১০ ডিসেম্বর মৌলভীবাজার জেলার কমলগঞ্জ উপজেলার শ্রীসূর্য ধোপাটিলা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন।

সামন্ত ভূ-স্বামী পিতা আজফর আলী ও মাতা নূরজাহান বিবির বড় ছেলে মফিজ আলী জন্মেই প্রত্যক্ষ করেন ’৩০ এর দশকের মহামন্দা, যার পরিণতি ছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। আর আগামী ১০ অক্টোবর ২০২০ যখন জননেতা মফিজ আলীর মৃত্যুর ১২ বছর পূর্ণ হচ্ছে তখন সমগ্র পুঁজিবাদী-সাম্রাজ্যবাদী বিশ্বব্যবস্থায় ২০০৮ সালে সূচিত বৈশ্বিক মন্দাও আঁকাবাকা গতি পথে ১২ বছর অতিক্রম করেছে। বিশ্ব অর্থনীতি মহামন্দার দিকে ধাবিত হওয়ার এ সময়ে করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব সেই সংকট ও অচলাবস্থাকে আরও ত্বরান্বিত করছে।

২০১৯ সালের ডিসেম্বর চীনের হুবেই প্রদেশের রাজধানী উহানে দেখা দেওয়া নভেল করোনা ভাইরাস বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়ে বৈশ্বিক মহামারিতে(চবহফবসরপ) রূপলাভ করে বিশ্বব্যাপী ৩ কোটি ৬০ লাখের বেশি মানুষ আক্রান্ত এবং ১০ লাখ ৫৫ হাজারের বেশি মানুষের মৃত্যুর মধ্য দিয়ে প্রচলিত স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা ব্যবস্থার বিপর্যয় ঘটিয়ে লকডাউন তথা অর্থনৈতিক জীবনসহ সামগ্রিক সামাজিক কর্মকান্ডকে স্থবির করে দেয়। আমাদের দেশও এর থেকে বাইরে নয়। করোনা ভাইরাসজনিত মহামারি বৈশ্বিক, সঙ্গত কারণেই তা মোকাবেলায় প্রয়োজন ছিল বৈশ্বিক সমন্বিত উদ্যোগ।

কিন্তু সাম্রাজ্যবাদ ও তার বিশ্বসংস্থা এবং দেশে দেশে দালাল সরকারগুলো তা না করে সংকটের প্রকৃত সত্যকে সামনে না এনে নানা রূপের ষড়যন্ত্র-চক্রান্ত ও বিভ্রান্তি ছড়িয়ে সংকটের বোঝা বিশ্ব শ্রমিক শ্রেণি, নিপীড়িত জাতি ও জনগণের উপর চাপিয়ে পার পাওয়ার চেষ্ঠা করছে। প্রথম দিকে বাংলাদেশে করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব ছিল না। বিদেশ থেকে আগত প্রবাসীদের দেশে ফিরে আসার মধ্যদিয়ে দেশে করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ ও বিস্তার ঘটে। বিমানবন্দরে পরীক্ষা নিরীক্ষার ক্ষেত্রে কড়াকড়ি তো দুরের কথা, কার্যকরী ব্যবস্থাই ছিল না। অথচ ফিরে আসা প্রবাসীদের যথাযথ পরীক্ষা নিরীক্ষা ও কোয়ারান্টাইনের ব্যবস্থা নিশ্চিত করা গেলে করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ ও বিস্তার রোধ করা সম্ভব ছিল। শুরু থেকেই আমাদের সরকার করোনা মোকাবেলায় পর্যাপ্ত প্রস্তুতির কথা জানালে বাস্তবে তার প্রতিফলন ছিল না।

করোনা ভাইরাস পরীক্ষার পর্যাপ্ত ব্যবস্থা তো দুরের কথা, সরকার একটি মাত্র পিসিআর মেশিন দিয়ে দায়সারা গোছের কাজ শুরু করে। ডাক্তার, নার্স, চিকিৎসাকর্মী, পরিচ্ছন্নতা কর্মীদের জন্য পিপিই, মাস্কসহ প্রয়োজনীয় সুরক্ষা সামগ্রী ছিল না, ছিল না টেস্টকিটও। ফলে করোনা ভাইরাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধে ডাক্তার, নার্স ও স্বাস্থ্য কর্মীদের অপ্রয়োজনীয় মৃত্যু ও অসুস্থ্যতার মুখে পড়তে হয়। চিকিৎসা ক্ষেত্রে চরম অব্যবস্থাপনা বিরাজ করতে থাকে। বহু মানুষ হাসপাতাল থেকে হাসপাতাল ঘুরেও ভর্তি হতে না পেরে মৃত্যূমুখে পতিত হন। হাসপাতালগুলোতে, এমনকি রাজধানী ঢাকাতে, বন্দরনগরী চট্টগ্রামে, বিভাগীয় শহরগুলোতে, সরকারি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালগুলোতে অক্সিজেনের চরম সংকট এবং প্রয়োজনীয় আইসিইউ না থাকার বিষয়টি উন্মোচিত হয়ে সরকারের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার দেঊলিয়াত্ব নগ্নভাবে জনসাধারণের সামনে আসে।

করোনা মোকাবেলায় সরকার ঘোষিত ৭২,৫০০ কোটি টাকার প্রণোদণা প্যাকেজ, যা পরবর্তীতে ১,১৬০ কোটি ডলার(প্রায় ১ লক্ষ কোটি টাকা) বৃদ্ধি করা হয়; তা মূলত শাসক শোষক, মালিকগোষ্ঠি ও ব্যবসায়ীদের স্বার্থে প্রদান করা হয়। গার্মেন্টস শ্রমিকদের বেতনের জন্য ৫,০০০ কোটি টাকা মালিকদের বরাদ্দ দেওয়া হলেও তা মালিকরা ঠিকমত, সময়মত ও পূর্ণাঙ্গভাবে প্রদান না করায় শ্রমিকরা সীমাহীন দুঃখ-দুর্দশার মধ্যে পতিত হয়। ব্যাপক শ্রমিক ছাঁটাই, শ্রমিকদের মজুরি কর্তন করে ৬৫% করা ইত্যাদি শ্রমিকদের আরও দুর্দশায় ফেলে। এমন কি করোনার জন্য প্রদত্ত সরকারি প্রণোদনা নগদ ২,৫০০ টাকা করে জনপ্রতি বরাদ্দও সরকারি দলের নেতা ও জনপ্রতিনিধিরাই মূলত লুটপাট করে নেয়। আইএলওর তথ্য অনুযায়ী মহামারিতে বিশ্বব্যাপী অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের ২০০ কোটি শ্রমিকের মধ্যে ১৬০ কোটি শ্রমিক জীবিকা হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে গেছেন এবং বিশ্বের শ্রমিকরা মজুরি হারিয়েছেন ৩.৫ ট্রিলিয়ন ডলার।

পৃথিবীব্যাপী অনাহারক্লিষ্ট ও ক্ষুধার্ত মানুষের সংখ্যা ব্যাপক বৃদ্ধি পাচ্ছে। ২০২০ সালে অনাহারে দিন কাটবে বিশ্বের ২৭ কোটি মানুষ, যা ২০১৮ সালে ছিল ১৫ কোটি। ২০১৮ সালে অনাহারে প্রতিদিন যে ২৫ হাজার মানুষের মৃত্যু বরণ করেছে এ বছর তা আরো পঞ্চাশ শতাংশ বৃদ্ধি পাবে বলে তথ্য প্রকাশিত হয়। এর বিপরীতে করোনা অতি মহামারীর দিনে আরো ধনী হয়েছে দুনিয়ার অতি ধনীরা। গত মার্চ থেকে তিন মাসে আমেরিকার বিলিয়নিয়ারদের ঝুলিতে জমা পড়েছে ৫৬৫ বিলিয়ন ডলার। এর মধ্যে জানুয়ারি থেকে আমাজনের মালিক জেফ বেজোসের লাভ হয়েছে ২৫ মিলিয়ন ডলার। কারণ অনলাইনে কেনাকাটা ব্যাপক বেড়েছে। জুলাইয়ের ১০ তারিখে একদিনে বেজোস এর ১৩ বিলিয়ন ডলার লাভ হয়েছে।

২০২০ সালে তার সম্পত্তির পরিমাণ ৭৪ বিলিয়ন ডলার বেড়ে হয়েছে ১৮৯ বিলিয়ন ডলার। অন্যান্য যারা মার্কিন বিলিওয়েনার বিপুল লাভ করেছে তার মধ্যে জুমের সিইও এরিক ইউয়ান এবং মাইক্রোসফটের প্রাক্তন সিইও স্টিভ বালমের অন্যতম । বালমের স্কাইপির মালিক। দুজনেই ভিডিও কনফারেন্স থেকে লাভ করেছে। ফেসবুকের মার্ক জুকারবার্গ এবছর ৯.১ বিলিয়ন ডলার লাভ করেছে। ১০ আগস্ট চতুর্থ বৃহত্তম ধনী ব্যক্তি মুকেশ আম্বানির সম্পত্তি বেড়ে হয়েছে ৭৯ দশমিক ৩ বিলিয়ন ডলার। এ বছর তার সম্পত্তি বেড়েছে ২২ বিলিয়ন ডলার। ভারতে গত ছয় মাসে নতুন ১৫ জন বিলিয়নিয়ারদের সৃষ্টি হয়েছে।

ভারতে মোট বিলিয়নিয়ার সংখ্যা মোট ১৩৭ জন, তাদের মোট সম্পত্তির পরিমান ৩০ হাজার কোটি ডলার। দুনিয়া জুড়ে ধনী গরিবের ব্যবধান বাড়ছে, বাড়ছে জনগণের ক্ষোভ বিক্ষোভ আন্দোলন সংগ্রাম। এসময়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপসহ বিভিন্ন দেশে করোনা যুদ্ধের সন্মুখ সারিরর যোদ্ধা ডাক্তার, নার্সসহ স্বাস্থ্যকর্মীরা স্বাস্থ্য ব্যবস্থার অব্যবস্থাপনা, সরকারের দুর্নীতি ও প্রতারণার বিরুদ্ধে বিভিন্ন রূপে প্রতিবাদ বিক্ষোভে সোচ্চার হয়, আন্দোলন সংগ্রাম করে। আবার শ্রমিক শ্রেণি বেকারত্বের বিরুদ্ধে বিভিন্ন দাবিতে; লকডাউনের সময়ে প্রয়োজনীয় সকল সহযোগিতা পাওয়া, স্বাস্থ্যবিধি মেনে কাজের সুষ্ঠু পরিবেশের দাবি; মজুরি কমানো; কাজের সময় বাড়ানো, শ্রমিক আন্দোলন ও গণআন্দোলন দমনে পুলিশী আক্রমণের বিরোধিতাসহ বিভিন্ন দাবিতে আন্দোলন সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছে।

এ সময়ে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ও তাৎপর্যপূর্ণ আন্দোলণ হচ্ছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে পুলিশী হেফাজতে কৃষ্ণাঙ্গ যুবক জর্জ ফ্লয়েডকে হত্যার বিরুদ্ধে ফেটে পড়া গণআন্দোলন। ব্ল্যাক লাইফ ম্যাটার নামে এই আন্দোলনে সামিল হয় সাদাকালো নির্বিশেষে লক্ষ লক্ষ বিক্ষুব্ধ শ্রমিক-জনতা। এটা বিচ্ছিন্ন কোন বিষয় নয়, এটা হচ্ছে শ্রমিক শ্রেণি ও জনগণের উপর নির্মম শোষণ-লুন্ঠন এবং তাদের স্বার্থরক্ষাকারী রাষ্ট্র ও সরকারের নির্মম দমন-পীড়নের বিরুদ্ধে জনগণের পুঞ্জিভূত ক্ষোভ বিক্ষোভের প্রবল বিস্ফোরণ।

এই আন্দোলনের দাবানল শুধু যুক্তরাষ্ট্রের সকল অঙ্গরাজ্যের শহরগুলোতেই ছড়িয়ে পড়ে না বরং তা ছড়িয়ে পড়ে আমেরিকা ইউরোপসহ বিশ্বের দেশে দেশে। বৈশ্বিক মহামারি করোনার লকডাউনের মধ্যেও শ্রমিক শ্রেণি ও জনগণ যে আন্দোলন-সংগ্রামে ফেটে পড়তে পারে এ আন্দোলন তার একটি উজ্জ্বল সাহসী দৃষ্ঠান্ত। এ রকম একটি বিশ্ব পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে নয়া উপনিবেশিক আধা সামন্তবাদী বাংলাদেশে সাম্রাজ্যবাদ, সামন্তবাদ বিরোধী আন্দোলনে দ্রোহী মফিজ আলীর মত নেতৃত্বের আজ খুবই প্রয়োজন।

প্রখ্যাত এই বামপন্থী নেতা ২০০৮ সালের ১০ অক্টোবর ভোররাতে মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণে চিকিৎসারত অবস্থায় ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুর প্রায় মাসাধিক কাল আগে ৩০ আগস্ট কুলাউড়ায় একটি কৃষক সভা শেষ করে ফেরার পথে সন্ধ্যাবেলায় নিজবাড়ির সামনের মাঠ সংলগ্ন রাস্তার পাশে মফিজ আলীকে পড়ে থাকতে দেখে জনৈক পথচারী ডাকাডাকি করে লোকজন জড়ো করে তাঁকে উদ্ধার করেন। কিন্ত একটি নয়াউপনিবেশিক আধাসামন্তবাদী দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থা, হাসপাতাল এবং চিকিৎসকদের দূরাবস্থা, অব্যবস্থা সর্বোপরি গতানুগতিক ও অনান্তরিক চিকিৎসায় এদেশের অন্যতম প্রবীণ বামপন্থী নেতা মফিজ আলীকে বাঁচানো যায়নি।

চিকিৎসকরা তার মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণের কারণ সুনির্দিষ্ট করে প্রয়োজনীয় ভূমিকা নেননি। তাঁর মৃত্যু কি রক্তচাপজনিত ষ্ট্রোকে না কি দূর্ঘটনায় তাও নির্ধারিত হয়নি। দায়িত্বরত চিকিৎসকদের অনান্তরিকতা ও অবহেলা না হলে একটা প্রবোধ হয়তো দেওয়া যেতো। তবে এটা ঠিক যে, তিনি এভাবে আকস্মিক অসুস্থ না হলে আরো বেশ কিছুদিন বেঁচে থাকতে পারতেন। তাতে উপকৃত হতো বাংলাদেশের চা শ্রমিকসহ শ্রমিক শ্রেণী তথা জনগণ এবং প্রগতিশীল আন্দোলন। জননেতা মফিজ আলীর মৃত্যুর পর দেখতে দেখতে ১২ বছর হয়ে গেল। ১০ অক্টোবর’২০ তাঁর ১২-তম মৃত্যুবার্ষিকী।

চা বাগান অধ্যুষিত শমসেরনগর এলাকায় বেড়ে উঠা মফিজ আলী শৈশবকাল থেকে খুব ঘনিষ্ঠভাবে চা শ্রমিকের দুঃখ কষ্ট, নির্যাতন নিপীড়ন প্রত্যক্ষ করেন। তাই যখন তিনি চা শ্রমিকদের মধ্যে কাজ শুরু করেন, তখন ভিন্ন ভাষাভাষী, ভিন্ন জাতপাত; সর্বোপরি ভিন্ন সংস্কৃতির চা শ্রমিকদের নিকট মফিজ আলী খুব সহজেই তাদের একজন হয়ে উঠতে পারেন। ১৯৬৪ সালের ৫ এপ্রিল শমসেরনগরে খেদন ঠাকুরের দালানে বিপুল সংখ্যক চা শ্রমিক প্রতিনিধির উপস্থিতিতে মফিজ আলীর নেতৃত্বে চা শ্রমিকদের সংগ্রামী সংগঠন “পূর্ব-পাকিস্তান চা শ্রমিক সংঘ” গঠিত হয়; যা মফিজ আলীর রাজনৈতিক জীবনে যুক্ত করে নতুন মাত্রা।

ইউনিয়ন গঠনের পর প্রথম সর্বাত্মকভাবে ১৯৬৪ সালে চা শ্রমিকরা মে দিবস পালন করে। সে সময় চা শ্রমিকদের মে দিবসের ছুটি ছিল না। ৩রা মে ১৯৬৪ চা শ্রমিকরা মহান মে দিবস উপলক্ষে শমসেরনগরে এক বিশাল সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। সেই সমাবেশে এডভোকেট মনির উদ্দিন আহমদ, আসদ্দর আলী, রাজা সাহেব প্রমুখ নেতৃবর্গ উপস্থিত ছিলেন। মে দিবসের লাল পতাকাকে উর্ধ্বে তুলে ধরে শুরু হয় ইউনিয়নের কার্যক্রম। তার পর থেকে প্রতি সপ্তাহে এডভোকেট মনির উদ্দিন আহমদ সিলেট থেকে শমসেরনগর গিয়ে মফিজ আলীর সাথে চা শ্রমিকদের সংগঠিত করতে বাগানে বাগানে ঘুরেছেন। সেই সময় মাইলের পর মাইল পায়ে হেটেই চা বাগানে তাঁদের কাজ করতে হতো।

আপোষহীন নেতৃত্বে পরিচালিত আন্দোলন সংগ্রামের মাধ্যমে চা শ্রমিক সংঘ শ্রমিকদের নিকট ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করে, দলে দলে শ্রমিকরা মালিক পক্ষের স্বার্থরক্ষাকারী সোলেমানের নেতৃত্বে আপোষকামী দালাল ইউনিয়ন ত্যাগ করে চা শ্রমিক সংঘের পতাকাতলে সমবেত হতে থাকে। মফিজ আলীর নেতৃত্বে চা শ্রমিক সংঘের দুর্বার অগ্রযাত্রা মালিক পক্ষ ও দালাল ইউনিয়নের ভিত কাঁপিয়ে তোলে। আবারও শুরু হয় মালিক পক্ষ ও দালাল গোষ্ঠীর সমন্বিত ষড়যন্ত্র চক্রান্ত এবং আক্রমণ। সিরাজনগর চা বাগানে মফিজ আলীকে আক্রমণ করার জন্য ভাড়া করা হয় সন্ত্রাসী দই আলী ও তুষান গ্যাংদের আর শমসেরনগর চা বাগানে ইংরেজ ম্যানেজার মফিজ আলীর নামে মিথ্যা মামলা দায়ের করেন। ঐ মামলার হাজিরার দিন বিভিন্ন বাগানের প্রায় ১০ হাজার চা শ্রমিক শমসেরনগরে সমবেত হয়ে পায়ে হেঁটে মিছিল করে মৌলভীবাজার যাত্রা করে এবং কোর্ট প্রাঙ্গণে শিশু পার্কে এক বিক্ষোভ সমাবেশ করে।

মিছিলের সংবাদ পেয়ে আদালত অগ্রীম মফিজ আলীর জামিন দেন। মফিজ আলীর মতো নেতৃত্বের শুন্যস্থান সহজে পুরণ হবার নয়। চা-শ্রমিকরা আজ দালাল চা-শ্রমিক ইউনিয়নের কাছে জিম্মি, আর চা-শ্রমিক ইউনিয়নের নেতারা মালিকদের কাছে দাসখত দিয়ে নিজেদের আখের গোঁছাতে ব্যস্ত। যার কারণে ইউনিয়ননের নেতাদের বাড়ি-গাড়ি, অর্থ-বিত্ত বাড়লেও শ্রমিকদের মজুরি বাড়ে না। এমন কি ২০১৮ সালেই দৈনিক ১০২ টাকা মজুরির মেয়াদ শেষ হয়ে গেলেও তারা মজুরি বৃদ্ধি জন্য পদক্ষেপ না নিয়ে মালিকদের কাছে অনুনয় বিনয় করতে থাকে। এই করোনা কালে যখন সারাদেশের শিল্পাঞ্চল বন্ধ ঘোষণা করা হয় তখনও চা-শ্রমিকরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে উৎপাদনে সক্রিয় ছিলেন। অথচ চা-শ্রমিকদের মজুরি বৃদ্ধি বেলা মালিকরা করোনাকে অজুহাত হিসেবে দাঁড় করাতে পিছ পা হচ্ছে না। দালাল নেতারা ৩০০ টাকা মজুরি করার কথা শ্রমিকদের মধ্যে প্রচার করলেও এখন মালিকদের সাথে আলোচনায় দৈনিক ১১৮ টাকা মজুরি করতে পারাকেও তারা সাফাল্য হিসেবে বিবেচনা করছে বলে শ্রমিকদের সাথে কথা বলে জানা যাচ্ছে। যতদুর জানা যায় মালিক পক্ষ এখন দৈনিক ১১০ টাকা মজুরি বৃদ্ধিতে সম্মত হলেও তারা শেষ পর্যন্ত ১১৫ টাকায় উঠতে পারে আর ইউনিয়নের নেতারা ১১৮ টাকা মজুরির জন্য মালিকদের দয়াদাক্ষিণ্য প্রত্যাশা করছে। অথচ দ্রব্যমূল্যের লাগামহীন ঊর্দ্ধগতির এই সময়ে শ্রমিকরা আশা করছিল দেরিতে হলেও দুর্গা পূজার আগে মজুরি বাড়বে, বোনাস এবং এরিয়ার টাকা এক সাথে পেয়ে কোন রকমে দুর্গা পূজার উৎসব করতে পারবে। কিন্তু মজুরি বাড়লেও এবার মালিকরা এরিয়ার টাকা(অক্টোবর পর্যন্ত ২০ মাস) না দেওয়ার পাঁয়তারা চালাচ্ছে।

বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক জীবনের অধিকারী এই জননেতা জীবনে ৭ বার জেল খাটেন। তার মধ্যে ১৯৬৫ সালে ডিসেন্ট রোলস অব পাকিস্তান আইনে তাঁকে গ্রেফতার করে কুমিল্লা পাকিস্তান কারাগারে এক বছর আটকে রাখা হয়। সেসময় প্রখ্যাত কমিউনিস্ট নেতা, নানকার আন্দোলনের নেতা কমরেড অজয় ভট্টাচার্যের সাথে তাঁর ঘনিষ্ট সম্পর্ক গড়ে উঠে। কমরেড অজয় ভট্টাচার্যের নিকট হতে তিনি মার্কসবাদ সম্পর্কে আরও গভীর জ্ঞান লাভ করেন এবং ক্রুশ্চেভ সংশোধনবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে উদ্বুদ্ধ হন। যার কারণে মফিজ আলী কমরেড অজয় ভট্টাচার্যকে তাঁর রাজনৈতিক শিক্ষাগুরু বলে স্বীকার করতেন। কমরেড অজয় ভট্টাচার্য তাঁর “কুলিমেম” উপন্যাস মফিজ আলীর নামে উৎসর্গ করেন।

বৃটিশ আমল, পাকিস্তান আমল এবং বাংলাদেশ আমলে সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী গণতান্ত্রিক আন্দোলন সংগ্রামের ধারাতে ১৯৮৮ সালে জাতীয় গণতান্ত্রিক ফ্রন্ট (এনডিএফ) গঠিত হয়। সে সময় জাতীয় গণতান্ত্রিক ফ্রন্ট সিলেট জেলা শাখার যুগ্ম-আহবায়ক এডভোকেট ই ইউ শহিদুল ইসলাম মফিজ আলীকে গণতন্ত্রের নির্ভীক মুখপত্র সাপ্তাহিক সেবা পত্রিকা পাঠাতেন। সময়ের সাথে সাথে সেই সম্পর্ক গভীর হয়ে রাজনৈতিক-সাংগঠনিক সম্পর্কের ধারাতে মফিজ আলী ১৯৭১ সালের যুদ্ধ, সাম্যবাদী দলের সংশোধনবাদী লাইন এবং সাম্রাজ্যবাদের দালাল রাজনৈতিক দল ও সরকারের প্রতিক্রিয়াশীল চরিত্র সম্পর্কে বাস্তব অভিজ্ঞতা সারসংকলন ও পূণমূল্যায়ণের মাধ্যমে আত্মসমালোচনা ও আত্মশুদ্ধি করে রাজনৈতিক জীবনকে পুনরুদ্ধার এবং আমৃত্যু শ্রমিক কৃষক মেহনতি জনগণের পক্ষে আত্মনিবেদন করার প্রত্যয়ে ১৯৯৩ সালে সাম্রাজ্যবাদ সামন্তবাদ বিরোধী গণতান্ত্রিক বিপ্লবকে অগ্রসর করার লক্ষ্যে জাতীয় গণতান্ত্রিক ফ্রন্ট-এ যোগদান করেন।

জাতীয় গণতান্ত্রিক ফ্রন্টের মৌলভীবাজার জেলা শাখার সংগঠক এবং কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য হিসেবে আমৃত্যু তিনি সংগঠন সংগ্রাম বিকাশের ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখেন। একই সাথে তিনি ফ্রন্টের শরিক সংগঠন বাংলাদেশ ট্রেড ইউনিয়ন সংঘের কেন্দ্রীয় সহসভাপতি ও মৌলভীবাজার জেলা শাখার সভাপতি হিসাবে চা রাবার, হোটেল, রিক্সা, দর্জি শ্রমিকদের সংগঠিত করতে ভূমিকা রাখেন। এ প্রক্রিয়ায় তিনি চা শ্রমিকদেরকে পুনরায় বিপ্লবী ধারায় সংগঠিত করার জন্য চা শ্রমিক সংঘ গড়ে তোলাসহ চা ও রাবার শ্রমিকদের আন্দোলন সংগ্রাম পুনর্গঠিত করায় আত্মনিয়োগ করেন। বৃদ্ধ বয়সে তাঁর এই নব উদ্যোগ চা শিল্পে আপোষহীন সংগঠন সংগ্রামের নতুন যাত্রা শুরু হয়।

এ প্রেক্ষিতে ২০০৮ সালের জুলাই মাসে জরুরি অবস্থায় চা শ্রমিকদের স্বতস্ফুর্ত আন্দোলনে তিনি আশান্বিত হয়েছিলেন। তাঁর আশা-আকাক্সক্ষা এবং অসমাপ্ত কাজ প্রগতিশীল শ্রমিক সংগঠন, চা শ্রমিক, শ্রমিক শ্রেণীকে অগ্রসর করে সফল করার মহান দায়িত্ব পালন করতে হবে। তাঁর এই দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনের পরিক্রমায় ঘাত-প্রতিঘাত, চড়াই-উৎরাই, উত্থান-পতন থাকলেও শেষ পর্যন্ত তিনি এদেশের শ্রমিক কৃষক মেহনতি জনগণের একজন অকৃত্রিম বন্ধু হিসাবে বিপ্লবী বিকাশ ধারাতে সম্পৃক্ত হয়ে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। যখন তাঁর আত্মউপলব্ধি হয়েছে তখন তিনি তাঁর সংশোধনবাদী ও প্রতিক্রিয়াশীল অবস্থান ত্যাগ করেছেন। এক্ষেত্রে তাঁর মধ্যে দ্বিধাদ্বন্দ্ব ছিল না। এদেশের জনগণের মূল শত্রু হচ্ছে সাম্রাজ্যবাদ, সামন্তবাদ ও আমলা মুৎসুদ্দি পুঁজি। তিনি বিশ্বাস করতেন শ্রমিকশ্রেণীর নেতৃত্বে শ্রমিক-কৃষকের মৈত্রীর ভিত্তিতে বল প্রয়োগের মাধ্যমে এদেশ থেকে সাম্রাজ্যবাদ, সামন্তবাদ, আমলা মুৎসুদ্দি পুঁজিবাদকে উচ্ছেদ করে জাতীয় গণতান্ত্রিক বিপ্লব সম্পন্ন করতে হবে। সে লক্ষ্যে তিনি মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত শ্রমিক কৃষককে সংগঠিত করতে আত্মনিয়োগ করেন।

মফিজ আলীর জীবনের আরও একটি উল্লেখযোগ্য দিক হচ্ছে, তিনি রাজনৈতিক কর্মকান্ডের পাশাপাশি শ্রমিক কৃষকের বিভিন্ন সমস্যা ও দাবি দাওয়া নিয়ে বিশ্লেষণধর্মী লেখনীর মাধ্যমে জনগণকে সচেতন করার চেষ্টা চালান। তিনি ইংরেজি ডন, বহুল প্রচারিত সংবাদ, ইত্তেফাক, সাপ্তাহিক জনতা, লালবার্তা প্রভৃতি পত্রিকায় লেখালেখি করতেন। তিনি গণতন্ত্রের নির্ভীক মুখপত্র সাপ্তাহিক সেবার একজন নিয়মিত লেখক ছিলেন। এছাড়াও তাঁর প্রবন্ধ, লেখা বিভিন্ন সময় বিভিন্ন ম্যাগাজিন, স্মারকগ্রন্থ ইত্যাদিতে প্রকাশিত হয়েছে। এখানো তাঁর অনেক লেখা অপ্রকাশিত আছে।

মফিজ আলী আজ আমাদের মাঝে নেই। কিন্তু তাঁর মতাদর্শ, রাজনীতি, সংগঠন সংগ্রাম আমাদের পাথেয়। সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী গণতান্ত্রিক বিপ্লবী বিকল্প ধারার সংগঠন ও তার নেতাকর্মী এবং জনগণকে এই মহান নেতার অসমাপ্ত দায়িত্ব পালনের শপথ নিয়ে অকুতোভয়ে অগ্রসর হতে হবে। জাতীয় ও জনজীবনের বর্তমান সংকটময় পরিস্থিতিতে মফিজ আলীর জীবন থেকে শিক্ষা নিয়ে সাম্রাজ্যবাদ ও তার দালাল শাসক শোষক শ্রেণীর বিরুদ্ধে শ্রমিক শ্রেণির নেতৃত্বে আন্দোলন সংগ্রাম গড়ে তুলে মফিজ আলীর অসমাপ্ত কাজ অর্থাৎ জাতীয় গণতান্ত্রিক সমাজ প্রতিষ্ঠার সংগ্রামকে বেগবান করার মাধ্যমেই তাঁর প্রতি প্রকৃত শ্রদ্ধা নিবেদন সম্ভব। মৃত্যুঞ্জয়ী সংগ্রামী এই জননেতা ২০০৮ সালের ১০ অক্টোবর ৮১ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন।

লেখক: রাজনৈতিক কর্মী, মৌলভীবাজার।

ইমেইল: [email protected] 

বহুমাত্রিক.কম

Walton Refrigerator Freezer
Walton Refrigerator Freezer