Bahumatrik | বহুমাত্রিক

সরকার নিবন্ধিত বিশেষায়িত অনলাইন গণমাধ্যম

বৈশাখ ১০ ১৪৩১, বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪

স্বাধীনতা দিবসের আনন্দ

মুহম্মদ জাফর ইকবাল

প্রকাশিত: ০০:৫৫, ২৯ মার্চ ২০১৯

প্রিন্ট:

স্বাধীনতা দিবসের আনন্দ

১.
“সর্ব অঙ্গে ব্যথা” বলে একটা কথা শুনেছিলাম, বিষয়টা কী আমি এই মুহূর্তে সেটি টের পাচ্ছি; কিন্তু মজার কথা হচ্ছে এই বিষয়টি নিয়ে আমি নিজের কাছে কিংবা অন্য কারও কাছেই অভিযোগ করছি না, বরং এই ‘সর্ব অঙ্গে ব্যথা’টি আমি ছেলে মানুষের মতো উপভোগ করছি। আমার মনে হয় বিষয়টা আরেকটু ব্যাখ্যা করা দরকার।
প্রতি বছর স্বাধীনতা দিবসের আগে আগে আমাদের এভারেস্ট বিজয়ী পর্বতারোহী নিশাত মজুমদার আমাকে ফোন করে বলে স্বাধীনতা দিবসের ভোরবেলায় তারা শহীদ মিনার থেকে তাদের অদম্য পদযাত্রা শুরু করবে, যেটা শেষ হবে সাভার স্মৃতিসৌধে। আমি কী তাদের সাথে খানিকটা দূরত্ব হাঁটতে পারবো? প্রতি বছরই আমি আনন্দের সাথে রাজি হই এবং তাদের সাথে ঘণ্টাখানেক হাঁটি। আমি তারপর বিদায় নিয়ে চলে আসি এবং একদল তরুণ-তরুণী-কিশোর-কিশোরী-বালক-বালিকা এমনকি শিশুরা বাংলাদেশের এবং মুক্তিযুদ্ধের বিশাল বিশাল পতাকা ঘাড়ে নিয়ে হেঁটে যেতে থাকে। দেখে আমার খুব ভালো লাগে।

কাজেই এ বছরেও আমি আনন্দের সাথে রাজি হয়েছি। রাতে ঘুমাতে দেরি হয়েছে বলে উঠতে একটু দেরি হয়েছে এবং কোনোভাবে তাড়াহুড়া করে শহীদ মিনারে হাজির হয়েছি। পুরো দলটি ঠিক সেই মুহূর্তে পদযাত্রা শুরু করেছে এবং আমি কোনোভাবে তাদের পিছনে শামিল হয়েছি। (মজার ব্যাপার হচ্ছে পরের দিন খবরের কাগজে সংবাদ ছাপা হয়েছে পদযাত্রার শুরুতে আমি একটা ভাষণ দিয়েছি। ভাষণে আমি কী বলেছি সেটাও বানিয়ে বানিয়ে লেখা হয়েছে। এটি প্রথম নয়, কিছু দিন আগে প্রথম আলো ঠিক এই কাজটি করেছে, আমি যে কথাটি বলিনি তারা আমার মুখ থেকে সেই কথা বলেছি বলে সংবাদ করেছে। আমি প্রতিবাদ করে একটা ইমেইল পাঠিয়েছিলাম, তার কোনও উত্তর আসেনি। আমার ধারণা, সারা পৃথিবীর মাঝে শুধু বাংলাদেশের সংবাদপত্র এবং সাংবাদিকদের এরকম দুঃসাহস আছে, আর কারও নেই। কিছুদিন আগে একজন একুশে পদক পাওয়া অর্থনীতিবিদ বলেছেন, তার লেখা একটা কলামের মাঝখানে সংবাদপত্রটি নিজেদের বক্তব্য ঢুকিয়ে দিয়েছে। সংবাদপত্রের সম্পাদক এবং সাংবাদিকবৃন্দ-আপনারা যদি এই লেখাটি পড়েন তাহলে আমি করজোড়ে আপনাদের কাছে মিনতি করছি, দোহাই লাগে আপনারা যত বড় শক্তিশালী মানুষই হয়ে থাকুন না কেন, এত বড় অন্যায় করার দুঃসাহস দেখাবেন না)।

যাই হোক আমি মোটেও সংবাদপত্রের দুই নম্বরি কাজকর্মের কথা বলার জন্য লিখতে বসিনি, আমি আমার প্রিয় মানুষদের প্রিয় কাজকর্মের কথা লিখতে বসেছি! এই পদযাত্রাটি মূলত তরুণ তরুণীদের, সংগঠনটির নাম অভিযাত্রী, এখন তাদের সাথে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর যুক্ত হয়েছে, পদযাত্রাটি নিবেদিত হয়েছে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের জন্য তহবিল সংগ্রহের উদ্দেশ্যে। কাজেই এই পদযাত্রার শুরুতে সেখানে অনেক মুক্তযোদ্ধা থাকেন, তাদের বয়স হয়েছে, তরুণ তরুণীদের উৎসাহ দেয়ার জন্যে আসেন। তাদের সাথে দেখা হয়, গল্প করতে করতে আমরা খানিক দূর হাঁটি, বড় ভালো লাগে।

ঠিক কতক্ষণ হাঁটবো ঠিক করে আসিনি তাই মনে হলো মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর পর্যন্ত যাওয়া যেতে পারে। সেখানে অনেক ছেলেমেয়ে জড়ো হয়, দেশাত্মবোধক গান গায়, ব্রতচারী নৃত্য হয়। সবচাইতে বড় কথা পদযাত্রায় অংশ নেয়া সবাইকে নাস্তা খাওয়ানো হয়। হাঁটতে হাঁটতে একসময় আমরা মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে পৌঁছালাম, আমার খুবই প্রিয় একটি জায়গা। সারা বাংলাদেশে দেখার মতো যে কয়টি জায়গা আছে এটি তার মাঝে অন্যতম। সেখানে একজন শ্বেতাঙ্গিনী মহিলার সাথে দেখা হলো, জাদুঘরের অন্যতম ট্রাস্টি মফিদুল হক আমার সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়ে বললেন, ইনি বসনিয়ার যুদ্ধাপরাধী রেডোভান কারাভিচের ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর ছিলেন। (যে বিচার কাজ সমাপ্ত হওয়ার পর কারাভিচের চল্লিশ বছর জেল হয়েছে!)। আমি অবাক হয়ে মহিলার দিকে তাকিয়ে রইলাম, বললাম, এরকম একটি ঐতিহাসিক কাজ করেছে যে মানুষটি, ধারণা করেছিলাম সে নিশ্চয়ই আরও অনেক বয়সী হবে। ভদ্রমহিলা হাসলেন, বললেন, “আমাকে যে বয়সী দেখায়, আসল বয়স তার থেকে অনেক বেশি!” বিনয়ের কথা, সব সময়েই দেখেছি পৃথিবীর বড় বড় মানুষেরা বিনয়ী হয়।

যাই হোক মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে খানিকক্ষণ বিশ্রাম করে, নাস্তা করে, গান শুনে, ব্রতচারী নাচ দেখে আমার পদযাত্রা শেষ করে ফিরে আসার কথা। কুমুদিনী থেকে মেয়েরা প্রতিবছরই আসে, কিন্নরকণ্ঠে আমার খুবই প্রিয় “মুক্তির মন্দির সোপান তলে” গানটি গেয়ে শুনিয়েছে। আমি যখন পদযাত্রা শেষ করে বাসায় ফিরে আসার প্রস্তুতি নিচ্ছি তখন হঠাৎ মনে হলো আরও একটু হাঁটলে কেমন হয়?

তাই আবার পদযাত্রীদের সাথে নেমে গেলাম! আমি তখন তাদের মতোই টকটকে লাল টি শার্ট পরেছি, সেখানে লেখা “শোক থেকে শক্তি, অদম্য পদযাত্রা” এবং “৫২ থেকে ৭১ স্বাধীনতার পদরেখায় পদযাত্রা”। আমাকে দেখে শুনে রাখার জন্যে আমার পাশে পাশে সারাক্ষণ একজন আছে। রাস্তায় চৈত্র মাসের কটকটে রোদ, মনে হয় সারা শরীর ঝলসে দিচ্ছে। ভাগ্যিস মাথার চুল পেকে সাদা হয়ে গেছে, তাই সূর্যের আলো শোষিত না হয়ে প্রতিফলিত হয়ে যাচ্ছে, তা না হলে অবস্থা আরও খারাপ হতো। যারা নিয়মিত হাঁটাহাঁটি করে তারা অনেকেই মাথায় গামছা জড়িয়ে নিয়েছে। আমাদের একেবারেই গ্রামীণ বিষয় হচ্ছে গামছা, একজন চাষি শ্রমিক না হয় মুক্তিযোদ্ধার কথা চিন্তা করলেই চোখের সামনে ভেসে উঠে মাথায় গামছা বাঁধা। আমার পরিচিত অনেকেই আছে যারা আমেরিকা যাওয়ার সময় গামছা নিয়ে গিয়েছে, নাম দিয়েছে ফিনফিনে পাতলা তোয়ালে!

আমার সাথে যারা হাঁটছে তাদের বললাম, “পরেরবার একটা গামছা নিয়ে আসতে হবে।” মুখ থেকে কথাটি বের হওয়ার আগেই একজন তার ব্যাকপেক থেকে লাল টকটকে একটা গামছা বের করে আমার গলায় ঝুলিয়ে দিলো। আরেকজন রোদ থেকে বাঁচার জন্যে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের একটা বেসবল ক্যাপ আমার মাথায় পরিয়ে দিলো! একটা ছোট শিশুকে যেভাবে সবাই দেখে শুনে রাখে আমার অবস্থাটা অনেকটা সেরকম। সবাই আমাকে দেখে শুনে রাখছে, যেন আমার কোনও কষ্ট না হয়। চৈত্র মাসের বিখ্যাত কটকটে রোদে হেঁটে হেঁটে আমরা মিরপুরের জল্লাদখানা বধ্যভূমিতে পৌঁছেছি। দেখবো দেখবো করেও ঢাকাতে থেকেও এই বধ্যভূমিটি আগে দেখা হয় নি। সবার সাথে হেঁটে হেঁটে জল্লাদখানা বধ্যভূমিটি দেখলাম। মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের তত্ত্বাবধানে এটাকে তৈরি করা হয়েছে, উপস্থাপনাটি সব মিলিয়ে অসাধারণ। ৭১ সালে এটা মূল জনবসতি থেকে একটুখানি দূরে ছিল বলে সাধারণ মানুষদের ধরে এনে জবাই করে এখানে ফেলে দেয়া হতো। ৭১ সালে আমাদের দেশে যে ভয়াবহ গণহত্যা হয়েছে, বাংলাদেশ এখন তার একটা আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পাওয়ার চেষ্টা করছে। আমার ধারণা, জল্লাদখানার মতো দুই একটি বধ্যভূমি দেখলেই এই দেশে সংঘটিত পৃথিবীর নিষ্ঠুরতম জেনোসাইড নিয়ে কারও কোনও সন্দেহ থাকবে না।

জল্লাদখানা থেকে সবাই বোটানিক্যাল গার্ডেনের ভেতর দিয়ে চটবাড়ি ঘাট পর্যন্ত যাবে। সেখান থেকে ঘণ্টাখানেক পথ নৌকায়। বোটানিক্যাল গার্ডেনে কখনও যাইনি, সবাই আমাকে বললো এর ভেতরের পথটুকু খুবই সুন্দর। বসন্তে গাছে গাছে নতুন পাতা, পুরো এলাকা ফুলে ফুলে ঢাকা। দেখার লোভ হলো,কিন্তু আমার অনভ্যস্ত শরীর ততক্ষণে বিদ্রোহ ঘোষণা করতে শুরু করেছে, বিশেষ করে চৈত্র মাসের গনগনে রোদ মনে হচ্ছে সবকিছু ঝলসে দেবে। একজন বুদ্ধি দিলো শহরের খানিকটা পথ আমরা গাড়ি দিয়ে পাড়ি দিতে পারি।

শেষ পর্যন্ত তাই করলাম,তরুণ তরুণী কিশোর কিশোরীরা যখন বাংলাদেশ এবং মুক্তিযুদ্ধের পতাকা নিয়ে রাজপথ প্রকম্পিত করে হেঁটে হেঁটে যাচ্ছে আমি তখন খানিকটা পথ গাড়ি করে চলে এসেছি। বোটানিক্যাল গার্ডেনের গাছগাছালির ছায়ায় অপেক্ষা করতে লাগলাম এবং কিছুক্ষণের মাঝেই পুরো দলটি চলে এলো। আমি আবার তাদের সাথে হাঁটতে শুরু করেছি। বোটানিক্যাল গার্ডেনের ছায়াঢাকা পথ দিয়ে হেঁটে হেঁটে একসময় চটবাড়ি ঘাট নামে নৌকা ঘাটে পৌঁছেছি। সেখানে আমাদের নেওয়ার জন্যে তিনটি বড় বড় ট্রলার অপেক্ষা করছে। নদীর কালো বিষাক্ত দুর্গন্ধময় পানির ভেতর দিয়ে ট্রলারগুলো যেতে থাকে এবং আমি নিজের ভেতর এক ধরনের বেদনা অনুভব করি। বাংলাদেশের নদীর মতো এতো সুন্দর নদী পৃথিবীর কোথাও নেই; অথচ এই নদীগুলোর এখন কী ভয়াবহ করুণ অবস্থা! দেশের উন্নয়নের জন্য এখানে কলকারখানা দরকার, সেই কলকারখানা তার বর্জ্য ফেলার জন্যে নদীগুলোকে ব্যবহার করেছে। একসময় আমরা দরিদ্র ছিলাম,আমাদের কিছু করার ছিল না,আমরা সহ্য করেছি। কিন্তু এখন তো দেশ দরিদ্র নয়, এখন কেন আমরা পরিবেশের দিকে নজর দিই না? কলকারখানার মালিকদের কেন বোঝাই না তারা একটুখানি কম মুনাফা করে কেন পরিবেশটুকু রক্ষা করে না? তারা কী অনুমান করতে পারে যে তার কোনও একজন আপনজন যখন ক্যান্সারে মারা যায় তার জন্যে সে নিজেই হয়তো দায়ী? তার কারখানার বর্জ্য নদীর পানি থেকে ঘুরেফিরে তার আপনজনের দেহে এই ভয়াবহ রোগের বীজ বপন করেছে?

আমাদের নদীগুলোকে রক্ষা করার জন্য তাদেরকে প্রায় মানুষের সম্মান দিয়ে আইন পাস হয়েছে। নদীগুলো যেহেতু নিজেরা কথা বলতে পারে না,তাদের বাঁচিয়ে রাখার জন্যে কাতরকণ্ঠে আর্তনাদ করতে পারে না, তাই মানুষেরা এখন তাদের পক্ষে আইনি সহায়তা চাইতে পারবে। আমাদের বিচার বিভাগের কী অসাধারণ একটি অবদান। কবে আমরা তার সুফল পাইতে শুরু করবো?

যাই হোক,তিনটি নৌকা পাশাপাশি যেতে থাকে। যারা গান গাইতে পারে প্রত্যেকটি নৌকা তাদের নিয়ে টানাটানি করেছে,সৌভাগ্যক্রমে তারা আমাদের নৌকায় জায়গা পেয়েছে। কাজেই পুরো পথটুকু তারা গান গাইতে গাইতে এসেছে। পতাকাগুলো নৌকাগুলোতে উঁচু করে ধরে রেখেছে, অনেকদূর থেকে দেখা যায় সেগুলো উড়ছে। দূরে একটা নৌকায় মুক্তিযুদ্ধের পতাকা, একাত্তরের মুক্তিযোদ্ধারা তো এভাবেই নৌকা করে যুদ্ধ করতে যেতো। যদি এসব তরুণ তরুণীর একাত্তরে জন্ম হতো তারা নিশ্চয়ই সবাই মুক্তিযুদ্ধ করতে যেতো,এখন আর সেই সুযোগ নেই কিন্তু দেশের জন্যে ভালোবাসা প্রকাশ করার যে সুযোগটা পেয়েছে সেটা দিয়েই প্রকাশ করছে।

একসময় নৌকা ঘাটে থেমেছে। আমরা সবাই নৌকা থেকে নেমে আবার হাঁটতে শুরু করেছি। অবাক হয়ে লক্ষ করলাম পথের দুই পাশে বিস্তৃত গোলাপ বাগান। নেদারল্যান্ডসে টিউলিপ বাগানের ছবি দেখে মুগ্ধ হয়েছি কিন্তু আমাদের নিজের দেশেই যে এরকম বিশাল গোলাপ বাগান আছে কে জানতো?

হেঁটে হেঁটে দুটি স্কুল পার হয়েছি। একটি স্কুলের বাচ্চা ছেলেরা নাড়ু মুড়কি আর সরবত তৈরি করে অপেক্ষা করছে। দ্বিতীয় স্কুলটিতে দুপুরের খাবারের আয়োজন। এর মাঝে কতো কিলোমিটার হাঁটা হয়েছে কে জানে,কিন্তু অনেকেই ক্লান্ত হতে শুরু করেছে। সুযোগ পেলেই ঘাসের ওপর লম্বা হয়ে শুয়ে পড়ছে।

দুপুরের খাবারের পর আবার হাঁটা শুরু হলো। এবারে গন্তব্য জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়। সেখানকার লোকপ্রশাসন বিভাগের কম বয়সী বিভাগীয় প্রধানও আমাদের সাথে আছে। তার উদ্যোগে বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক ছেলেমেয়ে এই অভিযাত্রী দলটিকে অভ্যর্থনা করার জন্য অপেক্ষা করছে।

কাঠফাটা রোদটিকে দেখে আমি হেঁটে যাওয়ার সাহস পেলাম না। গাড়িতে করে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে অন্য সবার জন্যে অপেক্ষা করতে থাকি। এই বিশ্ববিদ্যালয়টি অনেক খোলামেলা,বড় বড় গাছ,বড় বড় দিঘি দিয়ে ঢাকা। আমি যতবার এসেছি ততবার মুগ্ধ হয়েছি।

বসে বসে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছেলেমেয়েদের সাথে কথা বলে সময় কাটাচ্ছি। বাচ্চাকাচ্চাদের জন্যে লেখালেখি করেছি বলে এই প্রজন্মের অনেকেই আমার লেখা কিছু একটা পড়ে বড় হয়েছে,সে জন্যে আমার জন্যে তাদের এক ধরনের মমতা আছে,কথা বলার সময় সেটা টের পাই।

ততক্ষণে সূর্য ঢলে পড়তে শুরু করছে। রোদের তীব্রতা নেই। বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ মিনারে অপেক্ষা করতে করতে একসময় বিশাল পতাকা হাতে অভিযাত্রী বাহিনীটিকে দেখতে পেলাম। তারা পতাকা উড়িয়ে উড়িয়ে আসছে। শহীদ মিনারে খানিকক্ষণ সময় কাটিয়ে সবাই স্মৃতিসৌধের দিকে রওনা দিলো।

সারাদিন এই তরুণ তরুণীর সাথে কাটিয়ে তাদের সম্পর্কে অনেক কিছু জেনেছি। গত ছয় বছর থেকে তারা এই অদম্য পদযাত্রা করে যাচ্ছে। এই বছর শুধু ঢাকায় নয়, জামালপুরের অভিযাত্রীরা পিটিআই বধ্যভূমি থেকে শুরু করে প্রায় একুশ কিলোমিটার দীর্ঘ পদযাত্রা করে মুক্তি সংগ্রাম জাদুঘরে যাচ্ছে। এই অভিযাত্রী দলের পদযাত্রায় স্বাভাবিকভাবে নানা ধরনের খরচ থাকে, কিন্তু তারা কখনোই কর্পোরেট স্পন্সরদের মুখাপেক্ষী হয়নি এবং হবেও না! তারা নিজেরা সবাই মিলে এই খরচটি বহন করে। তাদের এই পদযাত্রায় যোগ দেওয়ার জন্যে সারাদেশ থেকে ছেলেমেয়েরা আসে। গত বছর পাঁচ ছয় বছরের একটি শিশু পুরো পথটি হেঁটে হেঁটে অতিক্রম করেছে।

যাই হোক,রোদ কমেছে বলে আমার সাহস বেড়েছে। আমি এবারে হেঁটে হেঁটে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত আছি। পথটুকু আর কতো কিলোমিটার জিজ্ঞেস করে লাভ নেই। কারণ, এতক্ষণে আমি আবিষ্কার করেছি এই অভিযাত্রী দলের সদস্যদের কাছে দূরত্বের কোনও অনুভূতি নেই,তারা যে কোনও দূরত্ব হেসেখেলে পার হয়ে যায়। অন্ধকার হওয়ার পর যখন স্মৃতিসৌধে কেউ থাকে না তখন তারা নিরিবিলি সেখানে পৌঁছে। এই স্মৃতিসৌধটি তাদের জন্যে একটি আবেগের জায়গা, সেখানে পৌঁছে তারা হই-হুল্লোড় করে না,চুপচাপ অন্ধকারে বসে থাকে!

কাজেই আবার হাঁটছি। হাঁটছি এবং হাঁটছি। কনা নামের যে মেয়েটি সারাক্ষণ আমাকে একটা শিশুর মতো দেখে রাখছে সে একমুহূর্তের জন্যেও আমাকে চোখের আড়াল করেনি। এভারেস্ট বিজয়ী নিশাত মাঝে মাঝেই আমার খবর নিচ্ছে। একবার আমাকে জিজ্ঞেস করল,আমার কী অবস্থা। আমি বললাম,“আমি ভালোই আছি। শুধু হাঁটু দুটো আমার কথা শুনতে চাইছে না। বিদ্রোহ করতে চাইছে।”সে বলল আমি চাইলে আমাকে মোটরবাইকের পিছনে বসিয়ে নিয়ে যেতে পারে। আমি বললাম,মনে হয় তার প্রয়োজন হবে না।

একসময় আমরা স্মৃতিসৌধে পৌঁছে গেছি,তখন সন্ধ্যা সাড়ে সাতটার মতো বাজে। বাইরে অনেক মানুষের ভিড়,ভেতরে অন্ধকার,নিরিবিলি এবং ফাঁকা। শুধু একপাশে দূরে গানবাজনা হচ্ছে,না হলেই ভালো হতো। স্মৃতিসৌধের ভাবগাম্ভীর্যের সাথে এই চটুল গানবাজনা মানায় না। হেঁটে হেঁটে স্মৃতিসৌধের কাছাকাছি এসে সবাই চুপচাপ বসে পড়ে। ঘুঁটঘুঁটে অন্ধকার, ইলেকট্রিসিটি নিয়ে হয়তো একটু সমস্যা রয়েছে। স্মৃতিসৌধটিও অন্ধকারে আবছা আবছা দেখা যাচ্ছে। হঠাৎ করে স্মৃতিসৌধের আলো জ্বলে উঠল,বিশাল স্মৃতিসৌধটি তার পুরো ভাবগাম্ভীর্য নিয়ে উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। যতবার আমি স্মৃতিসৌধটি দেখি ততবার মনে হয় এই বিশাল স্মৃতিসৌধের একটুখানি আমার,মুক্তিযুদ্ধে আমার যে আপনজন,আমার যে বন্ধুরা শহীদ হয়েছেন তাদের অধিকারে স্মৃতিসৌধের একটুখানিও আমার নিজস্ব হয়ে গেছে। একান্তভাবেই আমার।

অভিযাত্রী দল এখানে এসে একটা শপথ নেয়,শপথ নেওয়ার আগে তারা আমাকে কিছু বলতে বললো। আমি কী বলবো? যেটা অনুভব করি সেটাই বললাম। আমি বললাম,তোমরা কেউ নিজের চোখে মুক্তিযুদ্ধ দেখনি। সেই কবে মুক্তিযুদ্ধ হয়ে গেছে, এতদিন পরে তোমরা যদি মুক্তিযুদ্ধের কথা ভুলে যেতে আমাদের কিছু বলার ছিল না। কিন্তু কী আশ্চর্য! মুক্তিযুদ্ধের জন্যে আমাদের ভেতর যে আবেগ,তোমাদের ভেতরেও সেই আবেগ। সেই ভালোবাসা!

তারপর তারা শপথ পাঠ করলো। এই শপথবাক্যগুলো এতো সুন্দর যে সেগুলো লেখার জন্যই আমি আগের পুরো লেখাটুকু ভূমিকা হিসেবে লিখেছি! তাদের কথা শুনে মনে হলো স্মৃতিসৌধটি বুঝি পাথর এবং কংক্রিটের একটি বস্তু নয়। এই সৌধটির ছদ্মবেশে লক্ষ লক্ষ শহীদ,লক্ষ লক্ষ মুক্তিযোদ্ধা সামনে নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে আছে,আর এই তরুণ-তরুণী কিশোর-কিশোরীরা তাদের কাছে শপথ করছে। তারা বললো :

“হে আমার মহান অগ্রজেরা, তোমাদের উপর অর্পিত কর্তব্য তোমরা পালন করেছো অসীম সাহসিকতায়,বিরল ভালোবাসায় আর নিপুণ নিষ্ঠায়। কর্তব্যের সময় এবার আমাদের।

জীবন উৎসর্গকারী হে শ্রেষ্ঠ সন্তানেরা,তোমাদের সাহস,ভালোবাসা ও নিষ্ঠা সঞ্চারিত হোক আমাদের হৃদয়ে,মস্তিষ্কে, শহীদের রক্তের মতো উজ্জ্বল হয়ে জ্বলে উঠুক আমাদের মেধা মনন, শিল্পবোধ ও রুচি। অসাম্প্রদায়িক মানবিকতা, জ্ঞান-দক্ষতা ও সাধনা শক্তিতে সমাজ হয়ে উঠুক বলীয়ান।

যে মহান আত্মত্যাগে আমরা আজ উচ্চশির স্বাধীন, সেই ত্যাগ স্মরণ করে শপথ নিই, তোমাদের আত্মত্যাগ বৃথা যেতে দেবো না। যে শক্ত ভিত্তির পত্তন তোমরা করেছো, তারই উপর নির্মাণ করবো সৌধের পর সৌধ। সমৃদ্ধ সাংস্কৃতিক সৌধ, অর্থনৈতিক উন্নয়নের সৌধ, সম্প্রীতির সৌধ আর জাতির নবজাগরণের সৌধ।”

শপথ শেষ করে সবাই নিঃশব্দে বসে রইলো অনেকক্ষণ।

২.

আমি যখন চলে আসছি তখন আট নয় বছরের ছোট একটি মেয়ে আমার কাছে ছুটে এসে বললো, “স্যার, আজকে আমি পুরো পথটি নিজে নিজে হেঁটে এসেছি।”

আমি শিশুটির দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলাম। তারপর তাঁকে বুকে জড়িয়ে ধরলাম। যে দেশে এরকম শিশু জন্মায় সেই দেশ নিয়ে আমাদের ভয় কী?

হ্যাঁ, এই মুহূর্তে আমার সর্ব অঙ্গে ব্যথা। বসলে দাঁড়াতে পারি না, দাঁড়ালে বসতে পারি না। কিন্তু আমার মুখে এগাল ওগাল জোড়া হাসি। হঠাৎ করে এরকম অসাধারণভাবে স্বাধীনতা দিবস পালন করতে পারলে কার না আনন্দ হবে?

 

বহুমাত্রিক.কম

Walton Refrigerator Freezer
Walton Refrigerator Freezer