Bahumatrik | বহুমাত্রিক

সরকার নিবন্ধিত বিশেষায়িত অনলাইন গণমাধ্যম

বৈশাখ ১১ ১৪৩১, শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪

ভালোবাসা নাকি অভ্যাস

এ কে এম গোলাম কাওসার

প্রকাশিত: ১১:৪৬, ৩১ মে ২০২২

প্রিন্ট:

ভালোবাসা নাকি অভ্যাস

আজ সাদিয়ার মন ভালো নাই। সকাল থেকে রাজীব ভাইয়া একবারও ফোন করে নাই, কোন মেসেজও দেয় নাই। সকাল থেকে সাদিয়া যে কতবার মোবাইল দেখেছে তার হিসাব নাই, এই বুঝি রাজীব ভাইয়ার মিসড কল আসলো, মেসেজ আসলো, কিন্তু না, কল কিংবা মেসেজ কোনটাই আসে নাই। কেমন যেন অস্থির লাগছে সাদিয়ার। সাদিয়ার তো এমন অস্থির লাগার কথা ছিল না। সে তো রাজীবের কল আর মেসেজের যন্ত্রনায় বিরক্ত ছিল। সকালে অফিস যাওয়ার আগে উনার কল, অফিসে কাজের ফাকে কল, অফিস থেকে বাসায় আসার পর কল, সন্ধায় কল, রাতে ঘুমানোর আগে কল।

সাদিয়া কোন সময় রিসিভ করতো, কোন সময় করতো না। সাদিয়ার রাজীবের কল কিংবা মেসেজে খুব বেশী আগ্রহ ছিল না। বেশীর ভাগ সময়ই মেসেজ দেখতো না, সে জানে হয় মোবাইল অপারেটর কো¤পানী কিংবা রাজীব ভাইয়ার মেসেজ। অনেকক্ষন পর যখন মোবাইল দেখতো, মেসেজ দিয়ে মোবাইল ভরে গেছে। দু একটা বাদে প্রায় সবগুলাই রাজীব ভাইয়ার। সাদিয়ার মন চাইলে উত্তর দিত না চাইলে দিত না। রাজীব একটা উত্তর পেলেই দ্বিগুন আগ্রহ নিয়ে আবার মেসেজ দেয়া শুরু করতো।

সাদিয়া খুব বিরক্ত হতো, এই লোকের কি কোন কাজ নাই, সারাদিন ফোন আর মেসেজ দেয়। চাকুরী করে এতো সময় পায় কই? কোন ব্যক্তিত্ব নাই? এতো সিনিয়র একজন লোক! ফোন রিসিভ করছে না দেখেও একটা মেয়েকে বার বার ফোন করে। মেসেজের উত্তর না পেয়েও মেসেজ দেয়। কতবার যে কড়া কড়া কথা বলেছে সাদিয়া তার ইয়ত্তা নাই, কতো অপমানজনক কথা বলেছে তার হদিস নাই, তারপরও ফোন মেসেজ দিয়েই যায়। প্রেমে পড়লে কি মানুষ মাথাশুন্য হয়ে যায়?

অপমানবোধ থাকে না? সাদিয়ার এসব ভালো লাগে না। উনাকে তো বহু আগেই সাদিয়া পরিস্কার বলে দিয়েছে, উনার সাথে সাদিয়ার বিয়ে সম্ভব না। ওর পরিবার দিবে না। প্রথম কারন, রাজীবের বাড়ি দূরে, নারায়নগঞ্জ। ওর পরিবার চায় না, একমাত্র মেয়ে বিয়ে হয়ে এতো দূরে থাকুক। সাদিয়া প্রথমবার কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছিল, দ্বিতীয়বার আবার ভর্তি পরীক্ষা দিয়ে হাজী দানেশ বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছে শুধুমাত্র বাড়ির কাছে থাকার জন্য। দ্বিতীয় কারন উনি একটা বেসরকারী চাকুরী করে। বেসরকারী চাকুরীর নিশ্চয়তা কি? যখন তখন চলে যায়। হুট করে চাকুরীটা চলে গেলে খাওয়াবে কি? সব জানার পরও উনি ফোন আর মেসেজ দিয়েই যায়।

রাজীব ভাইয়ার এই মেসেজের যন্ত্রণা শুরু হয়েছিল জসিম ভাইয়া আর সোহেলী আপুর বিয়ের দিন থেকে। সোহেলী সাদিয়ার ডিপার্টেমেন্টের সিনিয়র এবং রুমমেট। আর জসিম রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করে মোবাইল অপারেটর কোম্পাানি তে ভালো বেতনে চাকুরী করে। সোহেলীর বাড়ি কুমিল্লা আর জসিমের বাড়ী নারায়নগঞ্জ। চার বছরের প্রেমের পরিণতি। বিয়েতে সাদিয়ারা তিনরুমমেটই গিয়েছিল। সোহেলী আপু খুব জোড়াজুড়ি করেছিল তাই যাওয়া, না হলে এতো দূর! কে যায়? সাদিয়ারা তিন রুমমেট ঘিয়ে রঙয়ের শাড়ী আর ম্যাচিং করা ব্লাউজ পড়েছিল। জসিম ভাইয়ার সাথে ওনার কয়েকজন বন্ধু এসেছিল। ওরাও মোটামুটি ম্যাচিং করে হলুদ পাঞ্জাবী আর সাদা পায়জামা পড়েছিল, সাথে পাঞ্জাবীর উপরে ছিল মেরুন রঙয়ের কটি। বন্ধুদের মধ্যে রাজীব ভাইয়াও ছিল। রাজীব আর জসিম একই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশুনা করেছে। একই ডিপার্টমেন্টের না হলে একই এলাকার হওয়ায় ওরা খুব ভালো বন্ধু।

জসিম ভাইয়ার বন্ধুরা বেশ মজা করতেছিল, নিজেদের মধ্যে কানাগুষা করছিল আর হাসছিল। মাঝে মধ্যে সাদিয়াদের দিকে তাকাচ্ছিল, কে যে কার দিকে তাকিয়ে হাসছে বোঝা যাচ্ছিল না। অনুষ্টানগুলাতে এরকম একটু আধটু হয়েই থাকে। বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা শেষ করে সবাই যখন খেতে বসল, জসিম ভাইয়ার দুই বন্ধু রাজীব আর সুমন সাদিয়াদের টেবিলে বসেছিল। সাদিয়ারা তো অবাক! ওনাদের তো ভালোই সাহস। চোখাচুখিতে আর হয় নাই, সরাসরি টেবিলে চলে এসেছে। বন্ধুর বিয়েতে এসেছে, বন্ধু আর বন্ধুর বঊয়ের কোন খোজ নাই, খেতে বসেছে। খেতে বসে সুমনই প্রথম কথা শুরু করেছিল-আপনারা তো অনেক সেলফি তুললেন দেখলাম। আপনাদের ক্যামেরার সেলফি মুডটা মনে হয় বেশ ভালো, তাই না?

সাদিয়ার রুমমেট কান্তা উত্তর দিল-কেন? আপনাদের টাতে মনে হয় সেলফি হয় না, তাই না? রাজীব উত্তর দেয়- না সেরকম না। ভাবছিলাম আপনাদের ভালো ক্যামেরায় একটা সেলফি তুলব। সাদিয়া একটু রেগে গিয়ে রাজীবের দিকে চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে বলেছিল- কেন, আপনাদের না ডিএসএলআর আছে, সেইটা দিয়ে হয় না? চলেন এক্সচেঞ্জ করি, আমাদের ডিএসএলআর আর আপনাদের সেলফি। এরকম কিছু কথায় কথায় খাওয়া শেষ হয়েছিল। এসবের মধ্যেই কিছু সেলফি আর ডিএসএলআর কিছু ক্লিক পড়েছিল। শেষে ফেসবুকে ছবি পোষ্ট করা আর ট্যাগ দেয়ার সুত্র ধরে রাজীব আর সাদিয়ার মধ্যে ফেসবুক আইডির আদান-প্রদান হয়েছিল। সাদিয়ার ফেসবুক আইডি শুকতারা আর রাজীবের টা ছিল বেষ্ট বয় রাজীব।

বিয়ে শেষ করে ওইদিন বিকেলেই সাদিয়ারা ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা করেছিল। রাতে ঢাকায় খালার বাসায় থেকে পরদিন সকাল সাতটায় দিনাজপুরের দিকে যাত্রা শুরু করেছিল। বিয়েতে অনেক ছবি তোলায় মোবাইলের চার্জ অনেক কমে গিয়েছিল সাদিয়ার। তাই ফেসবুক কিংবা মেসেঞ্জারে ঢোকা হয় নাই। সন্ধ্যা হলে ফিরে মোবাইলে চার্জার ঢুকিয়ে মেসেঞ্জার অন করতেই বেষ্ট বয় রাজীবের প্রথম মেসেজ-ঠিকমতো পৌছেছেন? সাদিয়ার উত্তর ছিল- হুম।

সেই হুম থেকে আজ পর্যন্ত হুমই চলছে। খুব বেশী পরিবর্তন হয় নাই। প্রথমের দিকে রাজীব কোন প্রশ্ন করলে একদিন পর সাদিয়ার উত্তর আসতো, আর এখন দিনে দিনেই উত্তর পাওয়া যায়। এতোটুকুই প্রাপ্তি রাজীবের। এভাবইে চলতেছিল সেই তিন বছর যাবৎ।

কিন্তু কয়েকদিন যাবৎ রাজীব মেসেজ কম দিচ্ছে আর সাদিয়া তো কখনোই আগে মেসেজ দেয় নাই। মেসেজ পেলে উত্তর দিয়েছে। আর মেসেজ দেয়ার প্রয়োজনবোধ কখনো হয় নাই। রাজীবের মেসেজ দেয়ার হার খুব বেশী ছিল সবসময়ই, সাদিয়ার উত্তর দেয়ার হার কমই ছিল। উত্তর না পেয়েও রাজীব একতরফা মেসেজ দিয়েই গেছে। সাদিয়া বিরক্ত হয়েছে, ভালোও লেগেছে মাঝেমধ্যে। একটা ছেলে তার জন্য পাগল, ভাবতে কার না ভালো লাগে। আজ যখন সাদিয়া তার অপরাগতা বুঝিয়ে দিয়েছে তখন রাজীবের সক্রিয়তা কমে গেছে। এখন আর আগের মতো প্রতিবেলায় বিরক্ত করে না। নিজেকে হয়তো মানিয়ে নেয়ার চেষ্টা করছে। মাঝে মধ্যে সাদিয়াকে পাবার আশায় নতুন করে শুরু করার চেষ্টা করছে। কিন্তু সময় বেশী নাই। হবে কি সরকারি চাকুরী পাওয়া?

রাজীব তো বর্তমান টাতেই সন্তুষ্ট ছিল। আবার মাঝে মাঝে উৎসাহ হারিয়ে ফেলে রাজীব, তাহলে কি ক্যারিয়ারটাই ভালোবাসার পথে বাঁধা হয়ে দাড়াল? ভালোবাসা যদি এই সামান্য বাঁধাকে অতিক্রম করতে না পারে, সেটা কি ভালোবাসা নাকি ক্যারিয়ারকে কেন্দ্র করে বিয়ের আয়োজন? ওইদিকে সাদিয়াও পরিবারকে কষ্ট দিতে পারবে না। এতোটা সাহস ওর নেই। বস্তুতঃ ভালোবাসার জোরটাই বুঝি কম। কম হওয়াটাই স্বাভাবিক। কতদিনেরই বা বোঝাপড়া। তিন বছরে কতটুকুই বা দুজন দুজনাকে চিনেছে? দুজন দুজনার জন্য কতটুকুই বা উৎসর্গ করেছে? এতো কিছুর পরও যে ব্যাপারটা তৈরি হয়েছে সেটা হল সাদিয়া রাজীবের মেসেজ খুব মিস করছে। এই মিস করাটা কি রাজীবের জন্য সাদিয়ার ভালোবাসা নাকি একটা অভ্যাসের অনাকাক্ষিত পরিণতি?

বার্লিন, জার্মানি

বহুমাত্রিক.কম

Walton Refrigerator Freezer
Walton Refrigerator Freezer