Bahumatrik | বহুমাত্রিক

সরকার নিবন্ধিত বিশেষায়িত অনলাইন গণমাধ্যম

চৈত্র ১৪ ১৪৩০, শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪

বিদায় হে জাতির বাতিঘর

এম এইচ মোবারক

প্রকাশিত: ১৯:৩১, ১৫ মে ২০২০

প্রিন্ট:

বিদায় হে জাতির বাতিঘর

করোনার দহন দিনে জাতির প্রগতি-মননের বাতিঘর জাতীয় অধ্যাপক আনিসুজ্জামান আমাদের ছেড়ে অনন্তলোকে যাত্রা করেছেন। স্যারের চিরপ্রস্থানে গোটা জাতি শোকাতুর। সকলের মতো উত্তরা বিশ্ববিদ্যালয় পরিবারও স্যারের মহাপ্রয়াণে শোকস্তব্ধ৷ তাঁর মৃত্যুতে গোটা প্রগতিশীল সমাজ আজ অভিভাবকহীন।
 
বৃহস্পতিবার বিকেল ৪টা ৫৫ মিনিটে ঢাকার সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় চিরতরে আন্ধকার হয়ে যায় বাঙালীর প্রগতি-মননের এই বাতিঘর৷ আনিসুজ্জামান জন্মেছিলেন ১৯৩৭ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি পশ্চিমবঙ্গের চব্বিশ পরগনা জেলার বসিরহাটে। তার বাবা এটিএম মোয়াজ্জেম ও মা সৈয়দা খাতুন। বাবা ছিলেন বিখ্যাত হোমিও চিকিৎসক আর মা গৃহিণী হলেও লেখালেখির প্রতি ছিল তার আন্তরিক ভালোবাসা। স্যার এর পিতামহ শেখ আবদুর রহিম ছিলেন তার সময়ের একজন বরেণ্য লেখক ও সাংবাদিক আনিসুজ্জামান স্যারের শিক্ষাজীবন শুরু হয় কলকাতার পার্ক সার্কাস হাই স্কুলে।
 
পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশে চলে আসার পর খুলনা জিলা স্কুলে অষ্টম শ্রেণিতে ভর্তি হন। ১৯৫১ সালে ঢাকার প্রিয়নাথ হাই স্কুল থেকে মাধ্যমিক ও ১৯৫৩ সালে জগন্নাথ কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক শেষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগে ভর্তি হন।
 
১৯৫৬ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক ও ১৯৫৭ সালে একই বিষয়ে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম স্থান অধিকার করে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন। ১৯৫৯ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন। ১৯৬৫ সালে শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডক্টরেট ডিগ্রি অর্জন করেন। ১৯৬৯ সালের জুনে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগের রিডার হিসেবে কাজ শুরু করেন।
 
অধ্যাপক আনিসুজ্জামান স্যার ভাষা আন্দোলন, রবীন্দ্র উচ্ছেদবিরোধী আন্দোলন, রবীন্দ্র জন্মশতবার্ষিকী আন্দোলন এবং মহান স্বাধীনতাযুদ্ধ শুরু হলে তিনি ১৯৭১ সালের ৩১ মার্চ পর্যন্ত চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে অবস্থান করেন এবং পরে ভারত গমন করে শরণার্থী শিক্ষকদের সংগঠন `বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতি`র সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। যুদ্ধকালীন গঠিত অস্থায়ী বাংলাদেশ সরকারের পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য হিসেবে যোগ দেন। মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ী স্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধান ইংরেজিতে প্রণয়নের পর তার দ্রুতগতির বাংলা রূপান্তরের কাজ শেষ করেন এই মনস্বী পণ্ডিত ব্যক্তিত্ব।
 
১৯৭২ সালে ড. কুদরাত-এ-খুদাকে প্রধান করে গঠিত জাতীয় শিক্ষা কমিশনের সদস্য ছিলেন তিনি। অধ্যাপক আনিসুজ্জামান স্যার শহীদ জননী জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে গঠিত গণআদালতে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন। আশির দশকে স্বৈরাচার এরশাদবিরোধী আন্দোলনে নাগরিক সমাজের নেতৃত্ব দেন তিনি। ১৯৮৫ সালে তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আবারও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দেন।
 
বাংলা একাডেমির সভাপতির দায়িত্বে ছিলেন বরেণ্য এই ব্যক্তিত্ব আনিসুজ্জামান স্যারের উল্লেখযোগ্য রচনাবলির মধ্যে রয়েছে- মুসলিম মানস ও বাংলা সাহিত্য, মুসলিম বাংলার সাময়িকপত্র, স্বরূপের সন্ধানে, আঠারো শতকের বাংলা চিঠি, পুরোনো বাংলা গদ্য, আমার একাত্তর, মুক্তিযুদ্ধ এবং তারপর, কাল নিরবধি, বাংলা-ফারসি শব্দসংগ্রহ ও আইন-শব্দকোষ অন্যতম ইত্যাদিসহ প্রায় পঞ্চাশটি গ্রন্থ। স্বাধীন বাংলাদেশে মুক্তবুদ্ধি ও সকল গণতান্ত্রিক-মানবাধিকার প্রশ্নে রুচিশীল আনিসুজ্জামান স্যার ছিলেন সুদৃঢ় প্রগতিবাদী ও ন্যায়ের প্রতি অকুণ্ঠ। মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তবুদ্ধি ও অসাম্প্রদায়িকতার প্রশ্নে অবিচল ড.আনিসুজ্জামান স্যার জাতির বিবেক হিসেবে বহুবার আবির্ভূত হয়েছেন। যে কোনো সরকারের আমলে ঋজু ও অমল কণ্ঠে তিনি মানুষের বাক ও চিন্তার স্বাধীনতার পক্ষে অনড় অবস্থান গ্রহণ করেছেন।
 
বাংলাদেশের অজস্র মানুষের সরাসরি শিক্ষক তিনি; তারপরও তার সরাসরি ছাত্র না হলেও বয়স নির্বিশেষে কয়েক প্রজন্মের কাছে তিনি শ্রদ্ধেয় শিক্ষকই ছিলেন। ভালোবাসা আর শ্রদ্ধায় তাকে সবাই `স্যার` বলে সম্বোধন করেছেন। বহু বিচিত্র শ্রেণি-পেশার মানুষ তার কাছে বরাবর পেয়েছেন সুস্মিত প্রশ্রয়, উদার অভিভাবকত্ব। বাংলাদেশে লেখক, সংস্কৃতিকর্মী, রাজনৈতিক কর্মীর আস্থা ও ভরসাস্থল ছিলেন আনিসুজ্জামান স্যার। সবার মতামত শোনার মতো বিবেচনা ও প্রজ্ঞা তার ছিল।
 
অসামান্য অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ তিনি ১৯৭০ সালে বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার ও ১৯৮৫ সালে একুশে পদক লাভকরেন৷ আরও পেয়েছেন অলক্ত পুরস্কার, আলাওল সাহিত্য পুরস্কার, ব্র্যাক ব্যাংক-সমকাল সাহিত্য পুরস্কারসহ নানা পুরস্কার। এ ছাড়া রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্মানসূচক ডি-লিট ডিগ্রিতে ভূষিত হয়েছেন। স্যার ভারতের রাষ্ট্রীয় সম্মাননা `পদ্মভূষণ` অর্জন করেন। এ ছাড়া তিনি ১৯৯৩ ও ২০১৭ সালে দু`বার আনন্দবাজার পত্রিকা কর্তৃক প্রদত্ত আনন্দ পুরস্কার লাভ করেন। ২০১৮ সালের ১৯ জুন বাংলাদেশ সরকার তাকে জাতীয় অধ্যাপক পদে নিয়োগ দেয়।
 
দীর্ঘ ছয় দশক ধরে পথ দেখিয়েছেন অধ্যাপক ড. আনিসুজ্জামান স্যার। অন্ধকার সরিয়ে আলোর পথে ধাবিত হতে নির্দেশনা দিয়েছেন। আজ বাতিঘর অন্ধকার কারণ স্যার আর নেই স্যার আর ফিরে আসবেন না৷ তবে হ্যা আমার এটুকুই বিশ্বাস বাংলাদেশ তথা গোটা বাঙালীর হৃদয়ে স্যার আপনি চির অমর৷ 
 
লেখক:জনসংযোগ কর্মকর্তা,উত্তরা বিশ্ববিদ্যালয়৷

বহুমাত্রিক.কম

Walton Refrigerator Freezer
Walton Refrigerator Freezer