Bahumatrik | বহুমাত্রিক

সরকার নিবন্ধিত বিশেষায়িত অনলাইন গণমাধ্যম

বৈশাখ ৬ ১৪৩১, শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪

বদলে যাওয়া এক দ্বীপ মহেশখালী

বহুমাত্রিক ডেস্ক

প্রকাশিত: ১১:১৭, ১০ ফেব্রুয়ারি ২০২০

প্রিন্ট:

বদলে যাওয়া এক দ্বীপ মহেশখালী

ঢাকা : কক্সবাজার জেলার দ্বীপ উপজেলা মহেশখালী। উপজেলা সদরের দুই কিলোমিটার উত্তরে আদিনাথ সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়। বৃহস্পতিবার সকালে বিদ্যালয়ে গিয়ে দেখা যায় অন্যরকম এক দৃশ্য। তৃতীয় শ্রেণীতে শিক্ষার্থীরা নিবিষ্ট মনে তাকিয়ে রয়েছে ডিজিটাল পর্দার দিকে। শিক্ষক ফারিহা আহমদ ঢাকায় বসেই সরাসরি এ শিশু শিক্ষার্থীদের ইংরেজী পড়াচ্ছেন। ইন্টারনেট সুবিধা নিয়ে প্রত্যন্ত এ দ্বীপের শিক্ষার্থীরা দূর শিক্ষণে পাঠ গ্রহণ করছে।

শিক্ষার্থী তাসনিয়া জানালেন প্রায় প্রতিদিনই দূর শিক্ষণের মাধ্যমে ঢাকার অভিজ্ঞ শিক্ষকের কাছ থেকে পাঠ নেয় তারা। নিজ বিদ্যালয়ে বসেই ইংরেজী, অংক, বাংলা বিষয়ে পাঠ নিচ্ছে। তাসনিয়ার মতো ফারিহা ইসলাম, বুলবুল আহমদসহ বিদ্যালয়টির অন্যান্য শিক্ষার্থীরাও খুশী দূর-শিক্ষণের মাধ্যমে ইংরেজী শিখতে পেরে।

মূল ভুখন্ড থেকে বিচ্ছিন্ন এ দ্বীপে শুধু পড়ালেখায় পরিবর্তন এসেছে তা নয়। তরুণ-তরুণীদের জীবন জীবিকায়ও এসেছে আমূল পরিবর্তন। ডিজিটাল মাধ্যমের সুবিধা নিয়ে যুক্ত হয়েছেন অনলাইন ব্যবসায়। দ্বীপের বাসিন্দা দিদারুল ইসলাম, মারুফা নাসরিন লোপা এবং রোমেনা আকতার। এ তরুণরা এখন ‘উদ্যোক্তা’। গড়ে তুলেছেন অনলাইনে শুটকি ক্রয় বিক্রয়ের ব্যবসা প্রতিষ্টান ‘ই-বিজনেস সেন্টার’।

এ তরুণ-তরুণীরা মহেশখালীর শুটকি পৌঁছে দিচ্ছেন দেশের নানাপ্রান্তে গ্রাহকদের কাছে। তাদের উৎপাদিত পণ্য বিক্রি করে দেশের অন্যতম অনলাইন প্রতিষ্টান ‘দারাজ’। মহেশখালীতে বেড়াতে আসা পর্যটকেরাও তাদের কাছ থেকে শুটকি কিনে নিয়ে যাচ্ছে।

দ্বীপের গোরকঘাটা এলাকার গৃহবধূ আনোয়ারা বেগম তাঁর ছয় বছরের মেয়ে শেফুকে নিয়ে এসেছেন উপজেলা হাসপাতালে। শিশুটি চর্ম রোগে ভুগছেন। হাসপাতালে এ বিষয়ে কোন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক না থাকলেও মেডিকেল অফিসার শিব শেখর ভট্টাচার্য ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে ঢাকায় বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের শরণাপন্ন হলেন। আনোয়ারা বেগম তাঁর মেয়ের জন্য ব্যবস্থাপত্র নিলেন। আনোয়ারা বেগম এর মতো আরো অনেকে এ সুবিধা নিচ্ছেন। তাদেরকে এখন আর দূরে যেতে হচ্ছে না। দ্বীপে বসেই ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে বিশেষজ্ঞ ডাক্তার দেখাতে পারছে।

২০১৭ সালের ২৭ এপ্রিল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মহেশখালীকে ‘ডিজিটাল আইল্যান্ড’ ঘোষণা করেছেন। দ্বীপে ইতোমধ্যে দেওয়া হয়েছে গিগা মাইক্রোওয়েভ সংযোগ। ফলে ১০০ এমবিপিএসেরও বেশি গতিসম্পন্ন ইন্টারনেট সুবিধা নিয়ে দ্রুত বদলে যাচ্ছে মহেশখালী। দেশের অন্য কোন প্রত্যন্ত এলাকায় বর্তমানে এমন দ্রুতগতির ইন্টারনেট সুবিধা নেই। আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থা (আইওএম) ডিজিটাল আইল্যান্ড প্রকল্পটি বাস্তবায়নে আর্থিক সহায়তা দিয়েছে। বাংলাদেশ সরকারের তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগ, বাংলাদেশ কম্পিউটার কাউন্সিল এবং কোরিয়া টেলিকম যৌথভাবে এ প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করেছে।

মহেশখালীর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো জামিরুল ইসলাম বলেন- ডিজিটাল আইল্যান্ড একটি বহুমুখী প্রকল্প। দেশের বিচ্ছিন্ন একটি এলাকার পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীকে দ্রুততম গতির ইন্টারনেট মাধ্যমে বিশ্বের সাথে যুক্ত করেছে এ প্রকল্প।

তিনি বলেন- ‘ডিজিটাল আইল্যান্ড প্রকল্পটির মাধ্যমে দ্বীপে আমূল পরিবর্তন এসেছে। টেলিমেডিসিন, দূর-শিক্ষণে শিক্ষা, তথ্যপ্রযুক্তি ও কমিউনিটি ক্লাবের মাধ্যমে দ্রুত সেবা পাচ্ছেন জনগণ। দ্রুতগতির ইন্টারনেটের মাধ্যমে উপজেলা প্রশাসন ই-ফাইলিংয়ের মাধ্যমে ৮০ শতাংশ দাপ্তরিক কাজ সম্পন্ন করছে।’

মহেশখালী দ্বীপ সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, দ্রুতগতির ইন্টারনেট সুবিধা স্থানীয় জনগোষ্ঠীকে উন্নত স্বাস্থ্য সেবা, শিক্ষা এবং কর্মসংস্থানের পরিষেবাগুলো পেতে ভূমিকা রাখছে। ই-কমার্সের মাধ্যমে কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে।

মহেশখালী উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষক আমিনুল হক জানালেন- ই-লার্নিংয়ের মাধ্যমে স্থানীয় শিক্ষকদের সক্ষমতা উন্নত হয়েছে। এ প্রকল্পের মাধ্যমে অনেক শিক্ষা উপাদান দেয়া হয়েছে। তার সুফল পাচ্ছে শিক্ষার্থী ও শিক্ষকরা। দ্বীপে উৎপাদিত নানান পণ্য ই-কমার্সের মাধ্যমে সারা দেশে বিক্রি করার সুবিধা পাওয়া যাচ্ছে। এতে মধ্যস্বত্তভোগীদের দৌরাত্ম্য দূর হয়েছে।

চারটি কমিউনিটি স্বাস্থ্য ক্লিনিক এবং একটি উপজেলা হাসপাতালের মাধ্যমে মোবাইল স্বাস্থ্য পরিষেবা পাওয়া যাচ্ছে। এসব পরিষেবাগুলোর মধ্যে রয়েছে স্বয়ংক্রিয় স্বাস্থ্যগত রেকর্ড সিস্টেম, টেলিমেডিসিন পরামর্শ, মোবাইল স্বাস্থ্যসেবা ডিভাইসগুলোর মাধ্যমে রোগ নির্ণয় ইত্যাদি।

আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থা আইওএম-এর ট্রানজিশন এন্ড রিকভারি ডিভিশনের প্রধান প্যাট্রিক শেরিগনন বলেন- মহেশখালী দ্বীপটিকে ‘ডিজিটাল আইল্যান্ড’ প্রকল্পের জন্য নির্বাচন করা হয়েছে, কারণ এটি বাংলাদেশের স্বল্প-উন্নত একটি এলাকা। এখানে নিরক্ষরতার হার বেশি। মাটির লবণাক্ততা কৃষি ফলনকে বাধাগ্রস্থ করে। স্থানীয় যুবসমাজ দ্বীপ থেকে স্থানান্তরিত হচ্ছে জীবিকার সন্ধানে।

তিনি বলেন- ডিজিটাল দ্বীপ প্রকল্পের লক্ষ্য হল সরকারের তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগের বিদ্যমান জনসুবিধাদির আরো প্রসার ঘটিয়ে মহেশখালীর বাসিন্দাদের জন্য সুযোগ তৈরি করা। এ প্রকল্পের কারণে দ্বীপের তরুণরা এখন ব্যাবসা করার সুবিধা পাচ্ছে। স্থানীয় এবং সরকারী কর্মকর্তাদের কম্পিউটার দক্ষতা বিষয়ক প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে আইওএমের ডিজিটাল সেন্টারে। সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সাথে সমন্বয় করে একটি কমিউনিটি ক্লাব এবং কম্পিউটার প্রশিক্ষণ কেন্দ্র করা হয়েছে। এখান থেকেও জনগণ দ্রুতগতির ইন্টারনেট সুবিধা পাচ্ছে।

মহেশখালী পৌরসভার মেয়র মকছুদ মিয়া বলেন- এ প্রকল্পের মাধ্যমে মহেশখালীর মানুষ অনেক সুফল পাচ্ছেন। শিক্ষার্থীরা ইন্টারনেটের মাধ্যমে ঢাকার অভিজ্ঞ শিক্ষকের কাছ থেকে শিক্ষা পাচ্ছে। কৃষকরাও সুফল পাচ্ছেন।

তিনি বলেন- বর্তমানে একটি পৌরসভা ও ৩ ইউনিয়ন ‘ডিজিটাল আইল্যান্ড’ প্রকল্পের আওতায় এসেছে। পরে অন্য ৭টি ইউনিয়নকে এ প্রকল্পের অন্তর্ভূক্ত করা হবে।

Walton Refrigerator Freezer
Walton Refrigerator Freezer