ছবি: সংগৃহীত
গ্রামের নাম জঙ্গলবাড়ী। এক সময়ের মধুপুর বনাঞ্চলের ঘন অরণ্যবেষ্টিত এই গ্রামে এখন তেমন জঙ্গল নেই। উত্তর পাশ দিয়ে বয়ে চলেছে এক সময়ের খরস্রোতা ক্ষীরু নদী। সবুজের বুক চিরে সোজা রাস্তা চলে গেছে হাটের দিকে। মেঠোপথের দু`পাশে গাছের সারি। বাতাসে ছড়িয়ে পড়ছে বাসন্তী ফুলের ঘ্রাণ।
শুধু ফুল নয়, ছড়িয়েছে শিক্ষা ও শান্তির সুবাতাস -তৈরি হয়েছে প্রগতির মসৃণ পথ। আর সেই পথটি তৈরী করেছে জ্ঞানভিত্তিক সমাজ বিনির্মাণের অঙ্গীকার নিয়ে বছর চারেক আগে প্রতিষ্ঠিত গ্রাম পাঠাগার জঙ্গলবাড়ী বাতিঘর। গ্রামের মানুষ ভালবেসে যার নাম দিয়েছে "প্রজন্মের জঙ্গলবাড়ী বাতিঘর"। ময়মনসিংহের ফুলবাড়ীয়া উপজেলার আছিম ইউনিয়নের জঙ্গলবাড়ী গ্রামে শিখরী ফাউন্ডেশনের সভাপতি মেহেদী কাউসার ফরাজীর ঐকান্তিক উদ্যোগ ও জঙ্গলবাড়ী গ্রামের তরুণসমাজের প্রচেষ্টায় গড়ে ওঠা প্রতিষ্ঠানটি এখন আলো ছড়াচ্ছে পুরো এলাকায়।
মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিকের গণ্ডি পার না হতেই জঙ্গলবাড়ীর মেয়েদের বিয়ে হয়ে যায়, ছেলেরা ছোটে শহরের দিকে কাজের খোঁজে। বছরের পর বছর এভাবেই চলছিল। এ গ্রামের ছেলে মেহেদী কাউসার ফরাজী ছোটকাল থেকেই ভাবতেন গ্রাম নিয়ে। সেই ভাবনা পরিকল্পিত রূপ পায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার পর। গত চার বছর ধরে অন্ধকারে আলোর মশাল জ্বালানোর চেষ্টা করে চলেছেন কাউসার। শত বাধাবিপত্তি মোকাবিলা করে স্থানীয় তরুণদের সংগঠিত করেছেন, গড়ে তুলেছেন গ্রামীণ জনপদে পিছিয়ে থাকা সুবিধাবঞ্চিত মানুষের জন্য বিনামূল্যের এই পাঠাগার। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাড়িতে এলেই কাউসার ছুটে যান বাতিঘর ও মানুষের বাড়িতে বাড়িতে, মাঝে উচ্চশিক্ষার জন্য ভারতে চলে গেলেও তার এই অভ্যাস কমেনি। এলাকায় এসেই শিক্ষার্থীদের উৎসাহ দেন।
বাতিঘরের বিভিন্ন উদ্যোগ এরই মধ্যে গ্রামবাসীর প্রশংসা কুড়িয়েছে। জঙ্গলবাড়ী বাতিঘরের ধারাবাহিক আন্দোলনের ফলে গ্রামে প্রথমবারের মতো স্থায়ী শহীদ মিনার নির্মিত হয়েছে। গ্রামের সামগ্রিক উন্নয়নে শিক্ষিত সমাজ, যুবসমাজ ও সুশীল সমাজের সাথে ধারাবাহিক ব্যতিক্রমী সংলাপ আয়োজন বোদ্ধামহলে ব্যপক প্রশংসিত হয়েছে। ২১ ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসে শিশুদের নিয়ে এই পাঠাগারের প্রভাতফেরির দৃশ্য দেশে-বিদেশে প্রশংসা কুড়িয়েছে। এছাড়াও গ্রামের শতাধিক শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতার আয়োজন গ্রামবাসীদের প্রশংসা পেয়েছে।
জঙ্গলবাড়ী বাতিঘরের প্রতিষ্ঠাতা মেহেদী কাউসার ফরাজী ২০১০ সালে ময়মনসিংহ জিলা স্কুলে পড়াকালীন নিজের গ্রামে পাঠাগার স্থাপনের পরিকল্পনা করেন। ময়মনসিংহের শহীদ সৈয়দ নজরুল ইসলাম কলেজে উচ্চমাধ্যমিক পড়াকালীন পাঠাগার স্থাপনের জন্য ঘনিষ্ঠদের সঙ্গে আলোচনা করেন। এরপর ২০১৫ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে তিনি গ্রামে গ্রামে পাঠাগার স্থাপনের জন্য নিজের প্রতিষ্ঠিত শিখরী ফাউন্ডেশনের উদ্যোগে ঢাকার শাহবাগে অবস্থিত গণগ্রন্থাগারের ভিআইপি সেমিনার হলে আন্তর্জাতিক সাক্ষরতা দিবসে সেমিনার আয়োজন করেন এবং নিরক্ষরতা দূরীকরণের জন্য ছয়দফা কর্মসূচি সম্বলিত "শিখরী মডেল" ঘোষণা করেন। সেই মডেলের আলোকে শিখরী ফাউন্ডেশন "একটি গ্রাম, একটি পাঠাগার" প্রকল্প গ্রহণ করে।
গ্রামীণ শিক্ষার্থীদের বইপড়ার প্রতি আগ্রহী করে তুলতে ২০১৬ সালের ২২ মে মেহেদী কাউসার ফরাজী তার সহপাঠী-বন্ধু আবু সাঈদ ফকির, নাজমুল হুদা, বেলায়েত হোসেন বাবু, আবু রায়হান ফরাজী, ছোটভাই মাসুদ রানা ফরাজী, মাহমুদুল হোসাইন ফিরদাউস, ইকরামুল হাসিব ইকরা, মাহমুদুল হাসান হৃদয় প্রমুখকে নিয়ে গড়ে তোলেন জঙ্গলবাড়ী বাতিঘর। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার খরচ থেকে টাকা জমিয়ে ও সহযোদ্ধাদের অক্লান্ত পরিশ্রমে এটি গড়ে তোলেন তিনি।
এই পাঠাগার প্রতিষ্ঠার শুরুতে তিনি গ্রামের বিত্তবানদের তেমন সহযোগিতা না পেলেও মনোবল হারাননি। বরং পাঠাগার প্রতিষ্ঠার পর আসে নানা বিপত্তি। পাঠাগারে মলমূত্র ছোঁড়া ও বিভিন্ন হুমকি প্রদানের মতো ঘটনাও ঘটে! প্রাথমিকভাবে ব্যবহৃত ভাড়াটে ঘর নিয়ে নানামুখী সঙ্কট তৈরী হলে অবশেষে পিতা আবু সাঈদ ফরাজীর ব্যবসায়িক উদ্দেশ্যে লীজ নেয়া ঘরেই শুরু করেন পাঠাগারের কার্যক্রম।
শত বাধা ঠেলে এখন তার পাঠাগারের সুফল পাচ্ছে জঙ্গলবাড়ী গ্রামের সর্বস্তরের মানুষ। বিজ্ঞান, সাহিত্য, ইতিহাস, ধর্মীয় ও শিশুতোষ বইয়ের সমাহার থেকে যে কেউ বিনামূল্যে সদস্য হয়ে বই পড়তে পারেন। জ্ঞানার্জনে এখন পাঠাগারপ্রিয় হয়ে উঠছে জঙ্গলবাড়ী গ্রামের শিক্ষিত তরুণরা। `বই পড়ি, সমাজ গড়ি` -এ স্লোগানে এ পাঠাগারকে ঘিরে বই পড়ার আনন্দে মেতেছে পিয়াস, আব্দুল্লাহ, মিঠু, নাঈম, রাজীব, ইমরান, মামুন, সানি ও নোমানের মতো টগবগে তরুণরা।
কথা হয় জঙ্গলবাড়ী বাতিঘরে নিয়মিত বই পড়তে আসা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র ফিরদাউসের সঙ্গে। তিনি বলেন, `এখন অবসর সময়টুকু পাঠাগারে বিভিন্ন বই পড়ে কাটাই। কোনো কোনো বই বাড়িতেও নিয়ে যাই।`
জঙ্গলবাড়ী বাতিঘরের সহ-প্রতিষ্ঠাতা ও বর্তমান সাধারণ সম্পাদক আবু সাঈদ ফকির বলেন, "দীর্ঘ চার বছরের নানা চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে গ্রামের মানুষের অকুণ্ঠ ভালবাসা ও তরুণদের সক্রিয় অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে পারাটাই আমাদের সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি। জঙ্গলবাড়ী গ্রামের আপামর জনতার পাঠাভ্যাস বৃদ্ধি পাচ্ছে বাতিঘরের মাধ্যমে"।
জঙ্গলবাড়ী বাতিঘরের প্রতিষ্ঠাতা ও বর্তমান সভাপতি মেহেদী কাউসার ফরাজী বলেন, "ছোটবেলা থেকেই গ্রামের প্রজন্মের বিনষ্ট হওয়া আমাকে ব্যথিত করতো। তখন থেকেই চিন্তা করতাম জ্ঞানভিত্তিক গ্রাম নির্মাণে কিছু একটা করার। গত চার বছরে খানিকটা হলেও সফল হয়েছি। তবে এ ধরনের প্রতিষ্ঠান টিকিয়ে রাখতে ও বিকশিত করতে সবার অহিংস-অকুণ্ঠ সমর্থন দরকার"।
জঙ্গলবাড়ী বাতিঘরের কার্যক্রম নিয়ে দেশ-বিদেশের তরুণ, শিক্ষক, সাহিত্যিক ও ছাত্রনেতাদের ইতিবাচক মনোভাব পরিলক্ষিত হয়। পারফেক্ট মডেল স্কুলের প্রধান শিক্ষক সাইফুল আলম তুহিন বলেন, "জঙ্গলবাড়ী বাতিঘর তরুণদের মাঝে বই পড়ার আগ্রহ তৈরী করতে ব্যপক ভূমিকা রেখে চলেছে"।ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী তরুণ কবি মাসুম পারভেজ সানি জানান, "জঙ্গলবাড়ী বাতিঘর এমন এক অনন্য সৃষ্টি যে প্রতিষ্ঠানটি জঙ্গলবাড়ির সকল অচলায়তন ভেঙ্গে যুগ যুগ ধরে মানুষকে আলোকিত করে যাবে"।
জঙ্গলবাড়ী বাতিঘর নিয়ে তরুণ ব্যারিস্টার কামরুল হক রুবেল বলেন "শিক্ষাই উন্নয়নের মূল ভিত্তি। প্রধানমন্ত্রী কর্তৃক ঘোষিত গ্রাম থেকে উন্নয়নের আলোকবর্তিকা হচ্ছে আজকের এই বাতিঘর"।ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সলিমুল্লাহ মুসলিম হল ছাত্র সংসদের নির্বাচিত জিএস জুলিয়াস সিজার তালুকদার জানান, "নিরক্ষরতার অন্ধকার দূর করে আলো ছড়াচ্ছে দুর্গম এলাকায় তরুণদের উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত জঙ্গলবাড়ী বাতিঘর। বাতিঘরের সৃষ্টিশীল ও বুদ্ধিবৃত্তিক কার্যক্রম আমাকে মুগ্ধ করেছে"।ভারতের বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয় ইন্টারন্যাশনাল স্টুডেন্টস এসোসিয়েশনের সভাপতি জাহাঙ্গীর আলম জানান, "গ্রামীণ জনপদে জ্ঞানচর্চার জন্য জঙ্গলবাড়ী বাতিঘরের একনিষ্ঠ প্রয়াস প্রশংসার দাবিদার। আমি জঙ্গলবাড়ী বাতিঘরের কার্যক্রমে আনন্দিত"।