-ফারদিন ফেরদৌস। ছবি: সংগৃহীত
করোনা ভাইরাসে সারাবিশ্ব ধুঁকছে। বিশ্বজুড়ে মানবিক সংকট ঘনীভূত হচ্ছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর পৃথিবী এমন ভয়াবহ সংকটে আর পড়ে নাই-এমনসব খবর আমাদের ‘দেশি বিবিসি, সিএনএন বা আল জাজিরা’সহ যেসব টিভি চ্যানেল দিচ্ছে তারাই আবার ভাইরাসটারে শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে যাচ্ছে
ধরেন ২০ মিনিটের সংবাদে ৫টা করোনার নিউজ চালানো হবে, সেখানে ৫ কালারের ৫ ধরণের করোনাভাইরাস দেখানো হবে, বের হয়ে থাকবে বিচিত্র গজদন্ত নখর, দেখলেই মনে হবে অমিত সুন্দর অথচ ভয়ঙ্কর-বীভৎস শ্বাপদ এই বুঝি খুবলে খেতে আসছে। ভেতরে থাকবে আরও ১০ কালারের ক্ষুদে করোনা, যতক্ষণ প্রেজেন্টার নিজের পার্টটুকু পড়বেন, ঠিক ততোক্ষণ করোনার রঙেঢঙের গ্রাফিক্সটা প্রেজেন্টারের পেছনে পুরো পর্দাজুড়ে হেলতে দুলতে থাকবে, যেন করোনার রাজ্যে প্রেজেন্টার ছন্দময় করোনা এমনিতেই নাচুনি বুড়ি। তারওপর টিভিওয়ালাদের ঢোলের বাড়ি, ঝলকানিতে টিভিপর্দায় চোখ রাখা দায়!
করোনা কি আসলেই এত সুন্দর? যমদূত কি দেখতে এমন বিউটিফুল! আজরাইল আলাইহিসসালাম এমন মনোমুগ্ধকর! তা যদি না হয়, করোনাকালে টিভি চ্যানেলগুলার তো একদম শোকবিহ্বলতা নাই, তারা করোনাকে অহেতুক শিল্পচর্চার জায়গায় নিয়ে যাচ্ছে!
বলছি না টিভিওয়ালারা সবাই গলাগলি ধরে বিলাপ করবে, কিন্তু কোভিড ভাইরাস নিয়া এমন কারিকুরিরও তো কিছু নাই, মানবিক ট্রাজেডির চেয়ে করোনার রূপদর্শন বড় হয় কী করে? ভাইরাস অসুন্দর, কুৎসিত, কলঙ্কময় বা আরও নেতিবাচক কিছু হোক কিন্তু ভাইরাস যে মানুষ চেনাচ্ছে তা অস্বীকার করবার উপায় নাই; কোভিড যে সকল মনোযোগ তার দিকে কেড়ে নিচ্ছে এটাই বাস্তবতা।
সর্বোপরি করোনা হয়ত জানান দিয়ে যাচ্ছে, দু`দিনের পৃথিবীতে কেউ কারো না; জন্মের এই ক্ষণকালটা সার্থক করতে হলে, কারো মনে আঘাত দিও না। জীবনদেবতার যত সদিচ্ছা সবটাই তোমাতে পূর্ণ করো হে অবুঝ মনুষ্যপ্রাণ! এহেন সুপারস্টারের বন্দনা করাই তাই হয়ত ‘বোকাবাক্স’গুলোর ভালো মানায়। শতবর্ষেও এত সুন্দর ঢাকা দেখা যায়নি, যেমনটা জানালা দিয়ে মানুষ এখন দেখছে।
এতটা আরামে ঢাকাবাসী নিঃশ্বাস নিতে পারে নাই, পাখির ডাক শোনে নাই, ধুলির দূষণহীন নগরে দৃষ্টি মেলতে পারে নাই, যা এখন নগরবাসীর কপালে জুটছে। যানবাহন, কলকারখানা, এসি, ফ্রিজে টনের টন কার্বন উৎপন্ন করে বায়ুমণ্ডলের ওজোন স্তর ফুটো করে ফেলেছিল। যেখান দিয়ে ক্ষতিকর অতিবেগুনি রশ্মি পৃথিবীতে ঢুকে পড়ছে, সেই ভাঙা ওজোন স্তর এখন প্রায় জোড়া লাগার পথে।
মানুষের রোদপোহানোর অত্যাচারে সমুদ্র সৈকতের কাছ থেকে ডলফিন, কাঁকড়া বা কচ্ছপরা মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিল, তারা এখন তাদের পৃথিবী আগের মতো ফিরে পাচ্ছে, উপভোগ করছে, মানুষের উগ্রতা বা উত্তেজনার চেয়ে প্রাণ-প্রকৃতির স্বচ্ছন্দ উপভোগ্যতা আগে জরুরি।
মানুষের অত্যাচারে বনের পাখি আর প্রাণীরা গান ভুলে গিয়েছিল, তারা এখন সকাল-সন্ধ্যা গলা সাধছে।মানুষে মানুষে নীতিবিবর্জিত মাখামাখি বেশি বেড়ে গিয়েছিল, সম্রাট বা পাপিয়াদের বর্বর সাম্রাজ্যবাদ মাত্রা ছাড়িয়ে গিয়েছিল, সেসব এখন থমকে গেছে।
বাংলাদেশে খুন নাই, ধর্ষণ নাই, মাদ্রাসায় শিশু বলাৎকার নাই, অযাচার, অনাচার সব এখন ভাটির গাঙ্গে নাও ভিড়ায়ে আছে। পৃথিবীতে বিবদমান যুদ্ধবাজরা সব ছেড়ে ছুড়ে রণেভঙ্গ দিয়েছে, এমনকি আমাগো দেশের বাবাসম্রাট বদিদেরও এখন একটাই জল্পনা, ‘চল যাই যুদ্ধে-কোভিডের বিরুদ্ধে’।
যুদ্ধটা দ্বিপাক্ষিক, এখনো যতটা না মানুষ মারা পড়ছে তারচে’ কয়েকগুণ বেশি পুরনো অস্ত্রে কোভিই ড্যারাই তাদের দাদা দাদি ছানা পোনা নাতি নাতনি নিয়ে মারা পড়ছে, সমস্যা একটাই যুদ্ধে ওরা হাল ছাড়ছে না, মানুষও নতুন মারণাস্ত্রের হদিস করে ওঠতে পারছে না।
মানুষের মতোই কোভিডের নিজস্ব ধর্ম আছে, মানুষ তুই সাবান দিয়ে হাত ধুবি, খাচার পাখিদের মতো ঘরে আটকে থাকবি, সাগরেদদের কাছ থেকে তিন ফুট দূরত্ব বজায় রাখবি, কম খাবি, বাজারঘাট করবি না, কৃচ্ছতা সাধন করবি, উপাসনালয় সব বন্ধ রাখবি, ধর্মকে পণ্য বানিয়ে ব্যবসাবাণিজ্য টোটাল স্টপ, তীর্থযাত্রা হবে না, হজ্ব বন্ধ, ভ্যাটিকানের ভেল্কিবাজি এখন নয়; ধর্মসভা, জমায়েত, তাবলিগ, চিল্লা এইসময় চলবে না। এরোপ্লেন, ট্রেন, লঞ্চ, গাড়ি, প্রমোদতরী সব ক্লোজ পানশালা, পার্ক, বড়ানো, হোটেল, রেস্টুরেন্ট চলবে না।
প্রকৃতি চলবে প্রকৃতির আপন নিয়মে, সূর্য ওঠবে এবং অস্তাচলে যাবে রোজকার মতো, রাতের নিস্তব্ধতায় চাঁদের কোমল আলোর সৌরভ ছড়াতে বাঁধা নাই। শুধু মানুষ নামের স্বঘোষিত চতুরক পৃথিবীতে তোর হস্তক্ষেপ চলবে না আর, তুই আটকে থাকবি চারদেয়ালের লকডাউন, কোয়ারেন্টিন আর আইসোলেশনে।
বৈশ্বিক রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজনীতি ও ধর্মাচার নিয়ন্ত্রিত হবে ওই এক করোনাদর্শনে; দুনিয়াটা সূক্ষ্ম এক অনুপ্রাণ কোভিডের বশ, দজ্জাল মানুষের আর নয়। এরমধ্যেই কোভিড বেটা বাঙালির স্বরূপ নতুন করে উন্মোচিত করছে, এখানে তার সবে জন্মকাল, ভালোভাবে ছানাপোনাও বিস্তার করতে পারে নাই।
এইটুকুতেই বাঙালি পেরেশানে হযবরল। চোখের সামনে ইতালি, স্পেন, আমেরিকা হাজির হলে এদের কি জানি কী অ বস্থা হয়। সর্দি কাশি হলেও এখন আমাদের আর রক্ষা নাই। কেউ জানলে খবর আছে, বাড়িতে হামলা করবে, বউ স্বামীকে চিনবে না, পুত্র বাপকে অস্বীকার করবে, মরলে রক্ষা নাই, জানাজা পড়ানোর মৌলভী-মুসুল্লি কেউ নাই, পুলিশ ছাড়া দাফনেরও মানুষ নাই।
সিঙ্গাপুরের মতো সৌন্দর্য বা কানাডার মতো অর্থনীতি নিয়েও বাংলাদেশে যে এত গরীবের বসবাস তা কে জানত, হাজারে-বিজারে খাদ্য সাহায্য নিয়া চারপাশে মানুষ ঝাপায়ে পড়ছে, দেনেওয়ালা ক্যামেরার দিকে তাকিয়ে গর্বের হাসি দিচ্ছে আর নেনেওয়ালা সঙ্কোচের বিহ্বলতায় মাথা নিচু করে রাখছে।
ঢাল তলোয়ার ছাড়া ডাক্তাররা নিজেদের সংক্রমণই সামাল দিতে পারছেন না, রোগী দেখার টাইম কোথায় তাদের; উপায়ন্তর না পেয়ে কোভিড রোগিরা দেশজুড়ে এখন পলান্তিক খেলতেছে। অতঃপর কোভিডে মরণ লেখা নাই, সর্দি রোগে আমাদের মরণ শিরোধার্য হয়ে যাচ্ছে, দেখার কেউ নাই
এমনতর ‘হাইড এন্ড সিক’ চলছে ওপর থেকে নিচে।
এমন পৃথিবী অথবা এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি, গানটির সার্থকতা করোনা না আসলে কি আমরা টের পেতাম? মোটকথা হলো, টিভিগিরি যারা করেন তারা কিন্তু অযথা ওই কোভিডবন্দনা না করে পরিবর্তিত পৃথিবীতে বাংলা অথবা বাঙালির স্বরূপ কী সেসবও সবিস্তারে দেখাতে পারেন, পর্দায় দোদুল্যমান গ্রাফিক্সসহ।
লেখক: সাংবাদিক
ইমেইল: [email protected], [email protected]
বহুমাত্রিক.কম